গণপিটুনি থেকে বাঁচতে ৯৯৯-এ চোরের কল

আগের সংবাদ

পরিবারের আড়ালে তৎপর দল > খালেদার বিদেশযাত্রা : আলোচনায় জার্মানি > আশাবাদী দল ও পরিবার > অল্প সময়ে সিদ্ধান্ত

পরের সংবাদ

ইতিহাসের পুনরুদ্ধার ও শেখ হাসিনার সংগ্রাম

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ২৮, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: সেপ্টেম্বর ২৯, ২০২৩ , ১১:০০ পূর্বাহ্ণ

এই লেখাটি কোনো একাডেমিক বা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পণ্ডিতি মানদণ্ডে লেখা রচনা নয়, মুক্তিযুদ্ধের মাঠ থেকে শুরু করে চোখে দেখা অর্ধ শতকের অজস্র ঘটনাবলির আলোকে একটি ব্যক্তিগত উপলব্ধি মাত্র। এতে যৎসামান্য ব্যক্তিগত প্রসঙ্গ উঠে এলেও আত্ম উপলব্ধির বয়ানে সৎ থাকার চেষ্টা করেছি। আমি জানি আমার এই ব্যক্তিক উপলব্ধি হয়তো সবার কাছে সমান গ্রহণযোগ্য হবে না। যদি হয় আনন্দিত হব।
এই রচনার বিষয়বস্তু বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্থপতি ও জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা শেখ হাসিনার সংগ্রাম- বিদেশের মাটিতে প্রায় ছয় বছর নির্বাসন শেষে যিনি স্বদেশের মাটিতে প্রত্যাবর্তন করেন ১৯৮১ সালের ১৭ মে এবং সেদিন থেকেই জড়িয়ে পড়েন রাজনীতির অন্তহীন সংগ্রামে। জাতীয় স্বাধীনতার রণাঙ্গনে যুদ্ধাস্ত্রের সঙ্গে কলম ও ক্যামেরা আমার সঙ্গী হয়েছিল। হয়তোবা সে কারণেই দেশ স্বাধীনের পরক্ষণে পেশাদারি সাংবাদিকতায় প্রবেশ করি। সেই সুবাদে সুযোগ ঘটে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি তেজগাঁও বিমানবন্দরে উপস্থিত থেকে সে দিনের নবীন সংবাদকর্মী হিসেবে বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের খবর লেখার। স্পষ্ট মনে পড়ে, বঙ্গবন্ধুর সেই ঐতিহাসিক স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের প্রায় বছর দশেক পর তারই কন্যা যে দিন ঢাকার মাটিতে পা রাখলেন, সে দিন উদ্বেলিত লাখো মানুষ তাদের হৃদয়ের সবটুকু আবেগ দিয়ে স্বাগত জানিয়েছিল বঙ্গবন্ধুর রক্তকে। গণমানুষের সেই আবেগের মধ্যে ছিল অনেক স্বপ্নভঙ্গের পর নতুন এক স্বপ্নদেখা- নতুন আশায় বুক বাঁধা।
গণমানুষের সেই স্বপ্নভঙ্গ এবং প্রত্যাশার প্রেক্ষাপট কারো অজানা নয়। কেবল দলীয় নেতাকর্মী নন, বঙ্গবন্ধুবিহীন বাংলাদেশে তারই কন্যাকে স্বাগত জানাতে সেদিন বিমানবন্দরে জড়ো হয়েছিল সর্বস্তরের লাখো মানুষ; যে মানুষ জাতির পিতার ধমনী বহনকারীকে স্বাগত জানিয়েছে আবেগ ও ভালোবাসায়; যে মানুষ জাতির পিতার হত্যাকারীদের বিচার চায়, যে মানুষ সেনাপতি শাসন থেকে মুক্তি চায়, যে মানুষ মনেপ্রাণে জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের পুনঃপ্রতিষ্ঠা চায়, ফিরে পেতে চায় লাখো শহীদের বাংলাদেশকে।
১৯৭৫ সালে স্বাধীনতাবিরোধী ঘাতক চক্রের হাতে প্রায় সপরিবারে নিহত হলেন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জনক। ঘুরিয়ে দেয়া হলো সদ্য-স্বাধীন দেশের স্বাভাবিক ইতিহাসের চাকা। শুধু দেশের বাইরে অবস্থানের কারণেই বেঁচে থাকলেন শেখ হাসিনা ও শেখ রেহেনা। ভয়াবহ সে হত্যাকাণ্ড জাতিকে স্তম্ভিত এবং চরম হতাশায় নিমজ্জিত করে। সেই সুযোগে সেনাপতি শাসক জেনারেল জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে বাঙালির অসাম্প্রদায়িক জাতিসত্তার বিরোধীরা মুক্তিযুদ্ধের রক্তরঞ্জিত স্বদেশকে ক্ষতবিক্ষত করে চলে; গুঁড়িয়ে চলে পাকিস্তানি স্বৈশাসনের বিরুদ্ধে বাঙালির দীর্ঘ জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের এক একটি স্তম্ভ। যে আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছে, তাকে রাষ্ট্রীয় কূটকৌশলে ছিন্নভিন্ন করার প্রচেষ্টা চালালো হয়। চারদিকে এক সর্বগ্রাসী হতাশা তখন, শুধুই প্রশ্ন : বাংলাদেশ কি মুক্তি পাবে ভয়ংকর মহাপ্রলয় থেকে? আছেন কি কোনো ত্রাতা, যিনি হাল ধরবেন ঝড়ের উত্তাল সাগরে?
অতএব বঙ্গবন্ধু কন্যার রাজনীতিতে অধিষ্ঠানের মধ্যে বহু প্রার্থিত এক জাতীয় নবজাগরণ আছে, রাষ্ট্রের নবঅভিযাত্রা আছে, যার ধারাবাহিকতায় জাতীয় স্বাধীনতার হৃতগৌরব পুনরুদ্ধারের সেনাপতি হিসেবে আবির্ভূত হলেন শেখ হাসিনা। বলা বাহুল্য, বঙ্গবন্ধু কন্যার স্বদেশে ফিরে আসা বাংলাদেশের রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবনে নতুন যুগের সূচনা করে।

ইতিহাসের আর্শীবাদ
স্বাধীনতাবিরোধী দেশি-বিদেশি মহলের যোগসাজশে রাষ্ট্রের স্থপতিকে হত্যা করে বাংলাদেশকে যেভাবে অকেজো-অর্থহীন করার চেষ্টা হয়েছিল, স্বাধীনতার পরাজিত শত্রæ ও সাম্প্রদায়িক শক্তিকে যেভাবে পুনর্বাসিত করা হয়েছিল, বলা বাহুল্য, শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের মধ্য দিয়ে সেই ভয়ংকর অশুভ ধারার বিরুদ্ধে প্রথমবারের মতো প্রতিরোধ গড়ে ওঠে। বাংলাদেশ ক্রমান্বয়ে মাথা তুলে দাঁড়াবার শক্তি সঞ্চয় করে সামরিক ও নবজাগরিত সাম্প্রদায়িক আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে। ইতিহাসের সত্য এই, বঙ্গবন্ধুর এই জ্যেষ্ঠ কন্যা জাতির লুণ্ঠিত গৌরব পুনরুদ্ধারের সংগ্রামে অধিনায়কত্ব দান করেছেন- যা তার ঐতিহাসিক সাফল্য।
সে কারণেই তার রাজনীতিতে আসা এক আশীর্বাদ এবং একই সঙ্গে প্রতিপক্ষের জন্য অভিশাপও। ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়িতে গিয়ে ছোপ ছোপ রক্তের দুঃসহ চিহ্ন দেখতে হয়েছে তাকে বুকভাঙা কান্নায়। অথচ তার শোক করার সময় নেই! সময়ের কশাঘাত বাস্তবতায় ফিরিয়ে আনে তাকে; শোক ও রোদনকে পরিণত করতে হয় শক্তিতে। না, তিনি রোদন করতে আসেননি, এসেছেন বদ্ধ ইতিহাসের দুয়ার খুলে প্রিয় জন্মভূমিকে রাহুমুক্ত করতে; জাতির পিতার স্বপ্নের, মুক্তিযুদ্ধের লাখো শহীদের রক্তের বাংলাদেশকে পুনরুদ্ধার করতে। সে এক সুবিশাল চ্যালেঞ্জ; ইতিহাসের অমোঘ নিয়মেই যা তারই হাতে সমর্পিত। অতএব পিতা, মাতা, ভাই ও ভ্রাতৃবধূদের স্মৃতিতে শোক করার সময় কই!
ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী দলটিকে আঘাতের পর আঘাতে জর্জরিত করা হয়েছিল; ভুলিয়ে দেয়ার চেষ্টা হয়েছিল বঙ্গবন্ধুকে, বাঙালির ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে। সেই দুর্দিনে দেশের বাইরে অবস্থান করেও আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হলেন শেখ হাসিনা। অবিন্যস্ত দলকে সংগঠিত করা যেমন গুরু দায়িত্ব, তেমনি অসীম গুরুত্ববাহী কাজ ঘাতক বেষ্টিত শাসককুলের বিরুদ্ধে নিজেকে রক্ষা করা, বিধ্বস্ত বাংলাদেশকে জাগিয়ে তোলা এবং লাখো প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতাকে স্বমহিমায় পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা।
বলা বাহুল্য, সে দিনের সে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা সহজ ছিল না। মৃত্যুকে বারবার তুচ্ছজ্ঞান করেও শেখ হাসিনা তার অভীষ্ট দায়িত্ব সম্পাদন করেছেন; ঘাতকের বারংবারের হুমকি- আক্রমণেও পিছিয়ে আসেননি, পথভ্রষ্ট হননি; হলে অধঃপতনের গহ্বর থেকে বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে ফিরে পাওয়া সহজ হতো না।
রাহুমুক্তির পালা
এক মহাদুর্দিনে দিকভ্রান্ত স্বদেশের হাল ধরেছিলেন শেখ হাসিনা। স্বাধীনতাবিরোধী চক্রের হাতে জাতির জনকের হত্যাকাণ্ডের পর যে তমসা রাষ্ট্রকে গহিন কালোয় আচ্ছাদিত করে, সেই তমসা তাড়াতে প্রথম আলোর মশাল জ¦ালেন তিনি। সে মশাল, প্রাথমিক সংকট-সীমাবদ্ধতার পরেও দিকে দিকে আলোকিত করতে থাকে, শুরু হয় রাহুমুক্তির পালা। সব আবর্জনা দূর করতে নববর্ষের প্রভাতে যেমন বাঙালি একাকার হয়, নবপ্রতিশ্রæতিতে সমৃদ্ধ হয়, তেমনি এক শুভ প্রতিশ্রæতির বাতাস বইতে দেখি তার রাজনৈতিক অভিযাত্রায়।
আমার বিবেচনায় শেখ হাসিনার শাসনামলে মোড় ঘুরানো অর্জনের মৌলিক স্তরগুলোকে মূলত চার ভাগে ভাগ করা যেতে পারে। প্রথমত, জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের হৃত গৌরব পুনরুদ্ধার সংগ্রামে তার সাফল্য। দ্বিতীয়ত, সামরিক ও আধাসামরিক শাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম সফলতা। তৃতীয়ত, জাতির জনকের হত্যাকারী ও মুক্তিযুদ্ধের ঘাতক যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযুক্তদের আইনের হাতে সোপার্দ করা। এবং চতুর্থত, অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশকে প্রগতির সড়কে আনা।
এই একেকটি স্তরের সাফল্য আনতে সরকারপ্রধান শেখ হাসিনা অনেক ক্ষেত্রে কঠোর হয়েছেন, কৌশলী হয়েছেন, সামালোচিতও হয়েছেন; কিন্তু মুক্তিযুদ্ধবিরোধীদের পুনর্জাগরিত মঞ্চ গুঁড়িয়ে দিতে এবং জাতীয় স্বাধীনতার রক্তরঞ্জিত ইতিহাসের প্রতি দৃঢ়চিত্ত অবস্থান থেকে একটিবারের জন্যও বিচ্যুত হননি। লক্ষ্যে পৌঁছতে তিনি ছিলেন অবিচল- যদিও কিছু পথ ও পদ্ধতির সঙ্গে অনেকেই দ্বিমত পোষণ করেছেন।
বিলক্ষণ জানতেন তিনি, পথচ্যুত বাংলাদেশকে প্রার্থিত রাজনীতিধারায় ফিরিয়ে নিতে মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশকে স্বমহিমায় পুনঃপ্রতিষ্ঠার বিকল্প নেই; বিকল্প নেই জয় বাংলার পুনরাভিযানের, জাতির জনকের হত্যাকারী এবং মুক্তিযুদ্ধের পাকিস্তানপন্থি ঘাতক যুদ্ধারাধীদের বিচারের। অতএব দেশে ফেরার প্রথম দিন থেকে লক্ষ্য নির্ধারণে ভুল করেননি তিনি। সে যাত্রাপথ যত কণ্টককীর্ণই হোক না কেন, লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হয়েছেন তিনি- বলা যাবে না একেবারে। প্রথমত সামরিক স্বৈরশাসনের আঘাতে জর্জরিত দলকে সংগঠিত করার উদ্যোগ নেন তিনি, সংকট-ব্যর্থতা ও সাফল্যের সিঁড়ি বেয়ে সামনে পা বাড়ান। কিন্তু সবকিছুর ছাপিয়ে ওঠে মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস- যা লুণ্ঠিত হয়েছিল ১৯৭৫-এর রক্তপাতের মধ্য দিয়ে। অতএব, ব্যক্তি বা পারিবারিক ট্র্যাজেডির বাইরে, জাতীয় ট্র্যাজেডি মুচনের কারণেই বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের বিচার সম্পন্ন করতে হয়েছে তাকে। এই বিচার কেবল জাতীয় কলঙ্ককেই মুছে দেয়নি, এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ রাষ্ট্র দৃঢ়চিত্ত হয়েছে, সামনে এগোবার সাহস পেয়েছে।
রাজনীতিতে তার অধিষ্ঠান ঘটে জেনারেল জিয়াউর রহমানের শাসনামলে যখন মুক্তিযুদ্ধের ঘাতক শিরোমণি পলাতক গোলাম আযমকে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়, পরীক্ষিত স্বাধীনতাবিরোধীদের পরিকল্পিতভাবে পুনর্বাসন করা হয়। এরপর ক্ষমতায় বসেন আরেক জেনারেল, হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ, যিনি তার পূর্বসূরির পথ ধরেই রাষ্ট্রকে মৌল ইতিহাস ধারা থেকে দূরে সরিয়ে রাখেন। এই দুই জেনারেল পালাক্রমে বঙ্গবন্ধুর ঘাতক ও মুক্তিযুদ্ধবিরোধী উগ্র সাম্প্রদায়িক শক্তিকে প্রশ্রয় দেন, পুনর্বাসন করেন এবং সাম্প্রদায়িকতাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দান করেন। এ সময় বিশেষত ১৯৯০ সালে জেনারেল এরশাদের স্বৈরশাসনবিরোধী গণআন্দোলনের প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশের নবীন প্রজন্মের মনোজগতে এক নীরব বিপ্লবের সূত্রপাত ঘটে, তারা জাতীয় স্বাধীনতার ইতিহাস খুঁজতে চেষ্টা করে, বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের বিচারের দাবিতে সরব হয়।
কিন্তু ১৯৯১-এর নির্বাচনে শেখ হাসিনার সম্ভাব্য রাষ্ট্রক্ষমতার আরোহনকে ঠেকানো হয়। আরো পাঁচ বছর পর ১৯৯৬ সালে প্রথমবার রাষ্ট্রক্ষমতায় বসে ঝড়ের নদীতে নৌকার পাল ধরেন তিনি; দীর্ঘ একুশ বছর পর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় বসে। চারদিকে তখন শকুনিদের থাবা। প্রশাসনসহ রাষ্ট্রজীবনের সব স্তরে বসা মুক্তিযুদ্ধবিরোধীরা যে করেই হোক নতুন সরকারকে ব্যর্থ করতে বদ্ধপরিকর। সে এক সুবিশাল চ্যালেঞ্জ।
এরই মধ্যে অনেকটা আকস্মিকভাবে জাতীয় সংবাদ সংস্থা অর্থাৎ বাসসের হাল ধরতে হলো আমাকে, শুনেছি তারই নির্বাচনে। সংস্থাটিতে তখন পাহাড় সমান সংকট। প্রধান সম্পাদক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে প্রথম দেখা করতে গেয়েছি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে। তিনি স্বাগত জানালেন, মনোযোগ দিয়ে প্রতিটি সংকট বৃত্তান্ত শুনলেন এবং সংস্থায় বাংলা সার্ভিস প্রবর্তনসহ বাসসকে আধুনিকায়নের পথে এগিয়ে নিতে সব পদক্ষেপ নিতে বললেন। তারই প্রতিশ্রæতির ফলে জাতীয় সংবাদ সংস্থার নবগঠিত বাংলা সার্ভিস গতিলাভ করল, যুগপ্রাচীন টেলিপ্রিন্টার পরিবর্তন হয়ে কম্পিউটার বসল। বহুবিধ বিদেশি বার্তা ও ফিচার সংস্থার সঙ্গে চুক্তি সম্পন্ন করা গেল। শেখ হাসিনা অক্ষরে অক্ষরে তার প্রতিশ্রæতি রাখলেন।
কিন্তু সংস্থায় আদর্শিক প্রতিপক্ষরা ছিলেন সংগঠিত এবং শক্ত যোগাযোগসম্পন্ন। অতএব তারা একের পর এক আঘাত হানলেন। সে আঘাত ঠেকাতে শক্ত ভূমিকা নেয়া ছাড়া উপায় রইল না আমার। এরই মধ্যে আমার নিয়োগ চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে মামলা করে বসলেন তারা। জাঁদরেল ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ তাদের উকিল। সরকারবিরোধী পত্রিকাগুলো সে খবর ছেপে তাদের উৎসাহিত করল। রিটে দাবি করা হলো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বুড়ো-প্রবীণদের বাদ দিয়ে তরুণ একজনকে নিয়োগ দিয়ে আইন ও রীতি ভেঙেছেন। আগে কখনোই আমি মামলা-মোকাদ্দমায় পড়িনি। সে এক চরম বিড়ম্বনা জীবনের! কী করব ভেবে পাচ্ছিলাম না। অতএব ছুটলাম শ্রদ্ধেয় ব্যারিস্টার আমীর উল ইসলাম ও ব্যারিস্টার তানীয়া আমীরের কাছে। শুনলাম নেত্রী আগেই কথা বলেছেন যাতে আমার পক্ষে মামলাটি তারা হাতে নেন। সেই মামলা চলল সাত বছর।
বিচারপতি লতিফুর রহমানের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ২০০১ সালের নির্বাচনে সুপরিকল্পিতভাবে হারানো হলো আওয়ামী লীগকে। আনা হলো বিএনপি-জামাতের জোটকে। নির্বাচনে হেরে শেখ হাসিনা বিরোধী দলের নেত্রী হলেন। সরকারের সিদ্ধান্তে বছরের পর বছর আমার বেতন-ভাতা বন্ধ থাকল। চাকরিচ্যুত করা হলো। কিন্তু সংস্থার আইনে আমার নিয়োগটি মোটেও অবৈধ ছিল না বলে শেষ পর্যন্ত হাইকোর্ট এবং পরবর্তীতে সুপ্রিম কোর্ট থেকে আমি বিজয়ী হলাম। কিন্তু আর ফেরা হলো না আমার কর্মস্থলে।
যুদ্ধাপরাধ বিচার ও শেখ হাসিনার দৃঢ়তা
১৯৭১ সালে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসরদের হাতে বাংলাদেশের মাটিতে যে নির্বিচার নৃশংসতা ঘটে- তা ছিল দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ পরবর্তীকালে বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম গণহত্যা। এর শিকার হয়েছে ৩০ লাখ বাঙালি। নির্যাতিত হয়েছে কয়েক লাখ নারী। শহর থেকে গ্রাম পর্যন্ত নির্বিচারে জ¦ালানো হয়েছে ঘরবাড়ি। ফলে ১ কোটি মানুষকে তাদের ঘরবাড়ি ফেলে ভারতের মাটিতে আশ্রয় নিতে হয়েছে, কাটাতে হয়েছে প্রায় এক বছরের শরণার্থী জীবন।
সে কারণে ন্যায় বিচারের স্বার্থে হানাদার পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও তাদের স্থানীয় ঘাতক অনুচরদের বিচারের প্রশ্নটি ছিল সভ্যতার দাবি, একই সঙ্গে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার দাবি। কিন্তু ১৯৭১ পরবর্তী আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি সেই খুনি ও ধর্ষকদের আইনের হাতে সোপর্দ করার পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। এরই মধ্যে ১৯৭৪ সালের ত্রিপক্ষীয় চুক্তির ফলে বাংলাদেশ যে ১৯৫ জন পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধী চিহ্নিত করে, তারাসহ ৯৩ হাজার পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দি দেশে ফিরে যায়। এদিকে আইন করে বন্ধ করা হয় বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচার। দালাল আইনের আওতায় বিচারাধীন, এমনকি দণ্ডিত অপরাধীদেরও জেল থেকে মুক্তি দেয়া হয়। সেই থেকে দেশে চলতে থাকে বিচারহীনতার এক সংস্কৃতি। একদিকে নির্বিচার গণহত্যা ও নারী ধর্ষণের কোনো বিচার হলো না, অন্যদিকে বিচার বন্ধ থাকল জাতির পিতার হত্যাকারীদের। অথচ অপরাধের বিচার না হলে মানুষের অপরাধবোধ জেগে ওঠে, সমাজ কুলষিত হয়, সভ্যতা বিপন্ন হয়।
কিন্তু শেখ হাসিনার দৃঢ়চিত্ত নেতৃত্ব বিচারহীনতার অমানবিক সংস্কৃতিকে উপড়ে ফেলে। তিন দশকেরও বেশি সময়ের ব্যবধানে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচার সম্পন্ন করা ছিল এক বড় দৃষ্টান্ত, যা জাতিকে দায়মুক্তি দিয়েছে। শেখ হাসিনার সাহসী ও দৃঢ় প্রত্যয়ী নেতৃত্বে জাতির পিতার ঘৃণ্য ঘাতকরা কৃত অপরাধের দায়ে দণ্ডিত হয়েছে, যা সমকালীন বাস্তবতায় সাধারণ কাজ ছিল না। অন্যদিকে দেশীয় আইনের আওতায় যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠনের মধ্য দিয়ে একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধীদের ঐতিহাসিক বিচার প্রক্রিয়াটি তিনি কেবল শুরু করেননি, দেশি-বিদেশি চাপ ও ষড়যন্ত্রের বিস্তৃত জাল উপেক্ষা করে এগিয়ে নিয়েছেন সাহস ও বিচক্ষণতায়। এই দুটি কাজ, যা অভাবিত ভাবা হতো একসময়, বাঙালি জাতিকে দৃঢ়চিত্ত করেছে, বাংলাদেশকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে সাহায্য করেছে; একই সঙ্গে জাতীয় স্বাধীনতার লাখো শহীদ ও লাখো বীর সৈনিকের আত্মাকে সম্মানিত করেছে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডের পর একটি বড় মনস্তাত্ত্বিক সংকট জাতিকে পর্যুদস্ত করতে থাকে। সে সংকট ছিল অসহায়ত্বের, কিছু করতে না পারার। ১৯৮০ দশকের শুরু থেকে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও আদর্শিক চেতনা পুনরুদ্ধারের প্রশ্নে নতুন প্রজন্মের মধ্যে মনস্তাত্ত্বিক পুনর্জাগরণ লক্ষ্য করা যায়। দীর্ঘকালীন বিচারহীনতা, সামরিক শাসন ও সাম্প্রদায়িক শক্তির পালাক্রমিক আধিপত্য এই পুনর্জাগরণকে বেগবান করে। ইতিহাস যেন নিজের শক্তিতে বলীয়ান হয়ে তার সত্যকে আবিষ্কার করে। এরই ফলে নতুন প্রজন্মের মধ্যে যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচারের দাবি সোচ্চার হতে থাকে। মোড় ঘুরানো এই পুনর্জাগরণে মুখ্য রাজনৈতিক ভূমিকা রাখেন বঙ্গবন্ধুর কন্যা। আওয়ামী লীগের ২০০৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করার সুস্পষ্ট অঙ্গীকার আসে। লক্ষণীয়, বাংলাদেশের অভ্যুদ্বয়ের পেছনে সাংবিধানিক ও আইনগত ভিত্তি দিয়েছিল ১৯৭০ সালের নির্বাচনী রায়, ঠিক একইভাবে যুদ্ধাপরাধের যুগান্তকারী বিচার শুরু করার পেছনে ভিত্তি জুগিয়েছে আরেকটি জাতীয় নির্বাচনের রায়- যা অনুষ্ঠিত হয় ২০০৮ সালের শেষ প্রান্তে। সে নির্বাচনে নতুন প্রজন্মের ভোটদাতা বিপুলভাবে রায় প্রদান করে গণহত্যা, মানবতাবিরোধী অপরাধ ও যুদ্ধাপরাধের বিচার অনুষ্ঠানের পক্ষে।
নির্বাচনে বিপুলভাবে বিজয়ী হওয়ার পর ২০০৯ সালের ২৯ জানুয়ারি জাতীয় সংসদে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের সর্বসম্মত প্রস্তাব পাস করা হয়। এরপর ২০১০ সালের ২৫ মার্চ, পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের ৩৯ বছর পর যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযুক্তদের বিচারের জন্য গঠন করা হয় ট্রাইব্যুনাল। এই ট্রাইব্যুনারের আওতায় আসে মুক্তিযুদ্ধকালীন গণহত্যা, ধর্ষণ, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ এবং শান্তির বিরুদ্ধে অপরাধ- যা সারাবিশ্বেই আন্তর্জাতিক অপরাধ হিসেবে স্বীকৃত। পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রায় চার দশক পর, বিশেষ করে মূল অভিযুক্তরা যখন রাজনৈতিক ও অর্থনেতিকভাবে সবল ও শক্ত যোগাযোগসম্পন্ন, তখন তাদের বিরুদ্ধে এমন একটি বিচারিক উদ্যোগ, সব অর্থেই সাধারণ কোনো উদ্যোগ ছিল না। বরং তা ছিল বহুলাংশেই এক নতুন মুক্তিযুদ্ধ। অনস্বীকার্য, শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ নেতৃত্ব সেই অসম্ভবকে সম্ভব করেছে।
যুদ্ধাপরাধ বিচারের প্রক্রিয়াটি প্রবল জনসমর্থনে সিক্ত হলেও এর বিরুদ্ধে দেশ ও বিদেশে সমালোচনার সৃষ্টি করা হয়। অভিযুক্তরা বিপুল অর্থ বিনিয়োগ করে ‘লবিস্ট’ নিয়োগ করে। ফলে নানা দেশে বিচার প্রক্রিয়াটি সমালোচনার মুখে পড়ে। পাকিস্তান প্রকাশ্যেই বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। দেশটি সরকারিভাবেই কেবল বিচারের বিরোধিতা করে না, তাদের ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলিতে সব আন্তর্জাতিক রীতিনীতি ভেঙে বিচারের বিরুদ্ধে প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। অন্যদিকে বিচার প্রক্রিয়াকে প্রতিহত করতে যুদ্ধাপরাধীদের রাজনৈতিক সমর্থক দলগুলো সহিংস পথ অবলম্বন করে। কিন্তু শেখ হাসিনার সুদৃঢ় রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত অটল থাকে। ফলে সব চাপ উপেক্ষা করে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল সামনে এগিয়ে যায়।
১৯৯২ সালে রাজাকার শিরোমণি পাকিস্তানি নাগরিক গোলাম আযমকে জামায়াতের আমির ঘোষণা করা হলে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে বীর মুক্তিযোদ্ধা ও শীর্ষ বুদ্ধিজীবীদের সমন্বয়ে গঠিত হয় একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি। এই আন্দোলনকে এগিয়ে নিতে যে ‘জাতীয় সমন্বয় কমিটি’ গঠন করা হয়, তার মূল রাজনৈতিক শক্তি ছিলেন শেখ হাসিনা। তারই প্রত্যক্ষ নির্দেশনায় সমন্বয় কমিটিতে আওয়ামী লীগ থেকে যুক্ত হন আব্দুর রাজ্জাক এবং জাসদ থেকে কাজী আরেফ আহমেদ। খালেদা জিয়ার শাসনামলে ঢাকার সোহরাওয়ার্দীতে বসে ঐতিহাসিক গণআদালত। প্রতীকী সে আদালতে লাখো মানুষের সমর্থনে গোলাম আযমের অপরাধকে মৃত্যুদণ্ডতুল্য বলে ঘোষণা দেয়া হয়। ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়ায় খালেদা জিয়ার সরকার নির্মম দমন-পীড়ন শুরু করে, ২৪ জন বরেণ্য জাতীয় ব্যক্তিত্বের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা রজু করে। সে পরিস্থিতিতেও দৃঢ়চিত্ত ভূমিকা রাখেন শেখ হাসিনা।
১৯৯২ সালের ১৬ এপ্রিল বিরোধীদলীয় নেত্রী হিসেবে জাতীয় সংসদে তিনি যে বক্তব্য রাখেন, তার কিয়দংশ এখানে তুলে ধরা যেতে পারে। শেখ হাসিনা বলেন, ‘… গণআদালত যে রায় দিয়েছে তাতে তারা কিন্তু আইন নিজের হাতে তুলে নেয়নি, মাননীয় স্পিকার। যেহেতু তারা আইন নিজের হাতে তুলে নেয়নি সেহেতু নিশ্চয়ই তাদেরকে বেআইনি বলার কোনো অধিকার নেই, কোনো অবকাশ নেই। এই যুদ্ধাপরাধীর (গোলাম আযমের) অপরাধগুলো (গণআদালতের রায়ের কাগজ দেখিয়ে) লিপিবদ্ধ আছে এবং এই সকল অপরাধে যিনি অপরাধী তার শাস্তি মৃত্যুদণ্ডতুল্য। … তাই আমার আবেদন মাননীয় স্পিকার, এখনো সময় আছে দলমত নির্বিশেষে সবকিছুর ঊর্ধ্বে উঠে আসুন, যেভাবে একমত হয়ে আমরা একাদশ ও দ্বাদশ সংশোধনী পাস করেছি, আসুন সেভাবে কাজ করি। যারা স্বজন হারিয়েছেন, স্বজন হারানোর ব্যথায় যাদের হৃদয় এখনো ব্যথিত, আসুন আমরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে এই সিদ্ধান্ত মেনে নেই।’
গণআদালতের রায়কে সমর্থন জানিয়ে তিনি আরো বলেন, ‘এই মহান সংসদের অধিকার রয়েছে। জাতি সেই অধিকার দিয়েছে। এই সংসদ সার্বভৌম সংসদ। সেই লক্ষ্যে- একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধাচারণ, যুদ্ধ ও গণহত্যাসহ মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ সাধন, বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পরও পূর্ব পাকিস্তান পুনরুদ্ধারের সঙ্গে জড়িত থেকে বাংলাদেশের বিরোধিতা, বিদেশি নাগরিক হওয়া সত্ত্বেও ষড়যন্ত্রমূলকভাবে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলের উদ্দেশ্যে রাজনৈতিক তৎপরতায় লিপ্ত পাকিস্তানি নাগরিক গোলাম আযমের বিরুদ্ধে ১৯৯২ সালের ২৬ মার্চ জনগণের যে মতামত প্রতিফলিত হয়েছে, তাকে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ আন্তর্জাতিক ক্রাইমস অ্যাক্ট ১৯৭৩ অনুসারে ট্রাইব্যুনাল গঠন করে, তার বিরুদ্ধে আনীত অপরাধগুলো বিচারের জন্য, আইনগত পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য আমি আপনার মাধ্যমে এই সরকারের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি। একই সঙ্গে বাংলাদেশ জাতীয় সংসদে জনগণের ওই মতামত প্রতিফলনকারী গণআদালতের উদ্যোক্তাদের বিরুদ্ধে জারিকৃত অসম্মানজনক মামলা দায়ের করার জন্য দুঃখ প্রকাশ করে ওই মামলা প্রত্যাহার করার জন্য আমি আপনার মাধ্যমে সরকারের কাছে আবেদন জানাচ্ছি।’
জাতীয় সংসদে সেদিন দীর্ঘ বিতর্ক চলে গণআদালতের রায় নিয়ে। খালেদা জিয়ার সরকার বাধ্য হয়ে ২৯ জুন ১৯৯২ বিরোধী দলের সঙ্গে ৪ দফার চুক্তি স্বাক্ষর করে। সে চুক্তিতে গোলাম আযমের বিচার ও গণআদালতের উদ্যোক্তাদের বিরুদ্ধে মামলা প্রত্যাহারের কথা ছিল। কিন্তু সে চুক্তির বাস্তবায়ন করেনি সেদিনের সরকার!
মোট কথা, ১৯৭১ এবং ১৯৭৫-এর ঘাতকদের বিচারের দাবি ছিল সত্য ও ন্যায়ের সংগ্রাম, মনুষ্যত্বের সংগ্রাম। এ সংগ্রাম ছিল সভ্যতার বোধ সৃষ্টি ও তাকে সুরক্ষা দেয়ার সংগ্রাম, যাকে সাহস ও দৃঢ়তায় সম্পন্ন করার বিচক্ষণতা দেখিয়েছেন শেখ হাসিনা।
স্মরণযোগ্য, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে যে ‘ন্যুরেমবার্গ ট্রায়াল’ ও ‘টোকিও ট্রায়াল’ বসে, তারও মূল দাবি ছিল সভ্যতার বোধ সৃষ্টি করা। সেই বিচারে মিত্র পক্ষের প্রধান আইনজীবী জাস্টিস জ্যাকসনের ভাষ্য ছিল এ রকম : ‘মানব জাতিকে যুদ্ধের অভিশাপ থেকে মুক্ত করার জন্য যুদ্ধাপরাধের বিচার প্রয়োজন। এই বিচার না হলে সমাজে সভ্যতার বোধ প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না।’ অন্যদিকে গণহত্যার মতো সুপরিকল্পিত ব্যাপক হত্যাকাণ্ডগুলোর বিচার না করা গেলে তা আবারো ফিরে আসে। যেমন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ইউরোপের মাটিতে নাজি বাহিনীর বর্বরতার নৃশংসতা মাত্র কয়েক যুগের মাথায় বাংলাদেশ, রুয়ান্ডা, বসনিয়া-হারজেগোভিনা ও কম্বোডিয়াসহ নানা দেশে ফিরে এসেছে।
অনস্বীকার্য, সব দেশেই যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের সঙ্গে জড়িয়ে আছে মানবতার লড়াই, সভ্যতার লড়াই। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে আরো আছে জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের ভাবাদর্শ প্রতিষ্ঠার লড়াই, ইতিহাসের লড়াই এবং বাঙালি জীবনের আদর্শিক ভিত্তির লড়াই ও ভবিষ্যৎ। সে লড়াইকে এগিয়ে নিয়েছে শেখ হাসিনার প্রাজ্ঞ রাজনৈতিক নেতৃত্ব।
উপসংহার
খুব বেশি দেখা বা কথা বলার সুযোগ হয়নি আমার শেখ হাসিনার সঙ্গে। লেখালেখির নিভৃত জীবনযাপনেই স্বাছন্দ্য আমার। তবে সাংবাদিকতার সুবাদে বার কয়েক দেখা হয়েছে। যতবার হয়েছে, ততবারই দেখেছি তাকে সাবলীল, বঙ্গবন্ধুর পাওয়া মেজাজ ও অন্তরঙ্গতায় ভরা খাঁটি বাঙালি হিসেবে। এক-দুবার নববর্ষের শুভেচ্ছা বিনিময়ের দিনে অভ্যাগতদের সঙ্গে প্রাণখোলা কথাবার্তা বলতে দেখেছি তাকে। এমনই খোলামেলা যে অনেকেই ভয় পেয়ে যান, বলতে থাকেন, এতটা খোলামেলা হতে যান কেন তিনি! কিন্তু শেখ হাসিনা কোনোকিছু লুকোবার চেষ্টা করেন- এমনটা ভাবা ঠিক নয়। যা তিনি ভাবেন- তাকে রাখঢাকের প্রয়োজন বোধ করেন না। এতেই তার স্বাতন্ত্র্যতা।
শেখ হাসিনাকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আমি দেখি না কেবল। প্রধানমন্ত্রী হন অনেকেই, হবেনও। তাকে দেখি আমি বাংলাদেশ রাষ্ট্র জনকের বেঁচে যাওয়া দুই কন্যার একজন হিসেবে, যিনি রাষ্ট্রকে তার ছিনতাইকৃত গৌরব ফিরিয়ে দেয়ার মহাসমরে নেতৃত্ব দিয়েছেন। ১৯৭৫-এর রক্তপাতের পর যে ভয়ংকর স্বদেশ, জেগে ওঠা যে ‘নব্য পাকিস্তান’ (!), তারই বিপরীতে বাঙালির রাষ্ট্রকে আজকের বাস্তবতায় ফিরিয়ে আনার যে সাহসী ও প্রজ্ঞাবান নেতৃত্ব- তারই সর্বাধিনায়কের নাম শেখ হাসিনা।
আমার বিশ্বাস, সামাজিক ও অর্থনৈতিক যুদ্ধের পাশাপাশি একটি বড় রাজনৈতিক যুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়ে চলেছেন তিনি। সে যুদ্ধ কতটা প্রয়োজনীয়, কতটা ভয়ংকর এবং কতটা ঝুঁকিপূর্ণ- তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কাজেই ভয়ংকর ঝুঁকি নিতে হয়েছে তাকে। ব্যক্তি ও পারিবারিক জীবনের সুখ ও স্বাচ্ছন্দ্য পরিত্যাগ করতে হয়েছে। দৃঢ়চিত্তে মোকাবিলা করতে হয়েছে প্রভাবশালী দেশি-বিদেশি মহলের প্রতিরোধ ও প্রতিবন্ধকতা। সেই বিপদসঙ্কুল পথে সামনে এগোবার যে সাহস, এই যে দৃঢ়তা- তার সবটাই দেখাতে পেরেছেন শেখ হাসিনা।
সবাই জানি, গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি বিকাশে সরকারের রাজনৈতিক বিরোধীদের স্বাধীন ও উন্মুক্ত কার্যক্রম জরুরি। এছাড়া রাষ্ট্র গণতান্ত্রিক, মানবিক ও আধুনিক হয় না। কিন্তু বাংলাদেশ রাষ্ট্রের দুর্ভাগ্য এই যে, পাঁচ দশক পরেও রাষ্ট্রের অস্তিত্ববিরোধীরা আজো সর্বাংশে সক্রিয়। গণতান্ত্রিক অধিকারের আবরণে এরা রাষ্ট্রের ইতিহাস ও মৌলিক চেতনার প্রতিপক্ষ হিসেবে নিজেদের আবির্ভূত করে; রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে নিত্যনতুন যুদ্ধ চাপিয়ে পুরনো প্রভুর জয়গান করে! কাজেই যে বাংলাদেশ লাখো শহীদের রক্তে অর্জিত তাকে সুরক্ষা দিতে হবে বৈকি।
অনেক অর্জনের পরেও বাংলাদেশ আজ এক কঠিন বাস্তবের মুখোমুখি। অসাম্প্রদায়িক জাতিসত্তার বিরোধীরা মুক্তিযুদ্ধপন্থিদের দীর্ঘ পালাক্রমিক শাসনের পরেও আজো কেন সক্রিয়- তা ভেবে দেখার দাবি রাখে বৈকি। অতএব আত্মতুষ্টির সুযোগ কম। দীর্ঘস্থায়ী সমরে জেতার প্রস্তুতি প্রয়োজন; প্রয়োজন আদর্শিক যোদ্ধা তৈরির কৃতিত্ব। রাজনীতি কেবলই সেøাগানসর্বস্ব হয়ে উঠুক- তা কাম্য হতে পারে না। এই প্রক্রিয়া সাময়িক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে সক্ষম বটে, কিন্তু বৃহৎ আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য সামর্থ্য হারায়। ভুলে গেলে চলবে না, অসাম্প্রদায়িক জাতিসত্তার প্রতিপক্ষরা প্রাথমিকভাবে পরাস্ত হলেও তারা দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধে লিপ্ত। অতএব রাজনৈতিক যুদ্ধের পাশাপাশি সাংস্কৃতিক যুদ্ধকে এগিয়ে নেয়ার বিকল্প নেই; চাই বাঙালি জীবনের নবজাগৃতি।
লেখক : মুক্তিযোদ্ধা, সাহিত্যিক, মুক্তিযুদ্ধ গবেষক ও জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়