‘নারীরা জায়েদ খানে আটকায়’ বলায় লিগ্যাল নোটিস

আগের সংবাদ

পিতার সমাধিতে ফুলেল শ্রদ্ধা : টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর সমাধিতে কন্যা হাসিনা-রেহানা

পরের সংবাদ

চিরদিন তোমার আকাশ

প্রকাশিত: আগস্ট ১৫, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: আগস্ট ১৫, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

নদীর পাড়ে সে।
কত বছর আগে?
একা সে নয়। সে আর মান্না।
কত বছর আগে?
চল্লিশ, বেয়াল্লিশ, তেতাল্লিশ, সাতচল্লিশ?
কার্তিকের নদী। ছোট হয়ে গেছে। ভিডিও শুট করলে ভিজুয়াল হতে পারে গানের, শান্ত নদীটি, পটে আঁকা ছবিটি।
নদী শান্ত। ছোট ছোট ঢেউ। পাল তোলা কিছু নৌকা নদীতে। মনে হচ্ছে ভেসে যাচ্ছে মস্ত কিছু রাজহাঁস। গুন টেনে যাচ্ছে কিছু মাল্লা। পাড় ধরে ধরে।
রোজ এই দৃশ্য তারা দেখে। আসক আলির ঘাটে বসলেই দেখা যায়। তারা পড়ে এইটে। মান্না বৃত্তি পরীক্ষা দেবে। সে গাধা। তারা বন্ধু। বিড়ি সিগারেট ধরেছে এবং আরো কিছু বয়স অনুচিত অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে। গোপন করার মতো কিছু ঘটনা দেখেছে এবং কিছু ঘটনায় লিপ্ত হয়েছে। ব্যাপার না। আসক আলির ঘাটে বটগাছ আছে, কদম গাছ আছে। তাদের এই আড়াল আবডালটুকু দরকার। সিগারেট টানে তারা লুকিয়ে। স্টার, ক্যাপস্টান, ব্রিস্টল সিগারেট। ডানহিল সিগারেট টেনেছে একদিন। ফিল্টারঅলা লন্ডনী সিগারেট। মুস্তফা তার মেজো দুলাভাইয়ের প্যাকেট থেকে কব্জা করে দিয়েছিল। মুস্তফা সিগারেট খায় না।
সন্ধ্যা কার্তিকের কিংবা আশ্বিনের, কিংবা পৌষ কিংবা শ্রাবণের, তাদের কোনো বিবেচনা কিংবা চিন্তার ব্যাপার হয়ে ওঠেনি তখনো। অদূর সুদূর ভবিষ্যৎ চিন্তা আরো পরে। আসক আলির ঘাটে বসে তারা কখনো ভাবেনি পাল তোলা নৌকা আর তারা দেখবে না। গুনটানা মানুষ দেখবে না। নদী ভরে যাবে ইঞ্জিনের নৌকার কুৎসিত শব্দদূষণে।
আসক আলির ঘাটে বসে থাকত না তারা কিছু দেখবে বলে কখনই। না নদী, না পালতোলা নৌকা, না দূরের নীল রঙের পাহাড়। তবুও কিছু দৃশ্য কি সবসময় দেখা হয়ে যায় না? তদ্বির করে মানুষ ক’টা দৃশ্য দেখে পৃথিবীর? দেখবে বলে প্রস্তুতি নিয়ে কোন দৃশ্যটা দেখে আদৌ?
সে কোনোরকম তদ্বির এবং প্রস্তুতি ছাড়া দেখল।
নদীর এপাড়ে তাদের মফস্বল শহর। ওপারে সবুজ নিবিড় পাড়া গাঁ। ইলেকট্রিসিটি নেই। পাকা সড়ক নেই। দিনের আলো যতক্ষণ থাকে দেখা যায় সবুজের হরেক রকমের ঝলক। সেই ঝলক থেকে নেমে এলো মেয়েটা। নয়-দশ বছর হবে বয়স। হাওয়াই মিঠাই রঙের শাড়ি পরে আছে। কাঁধে এলুমিনিয়ামের রুপালি কলসি। এলুমিনিয়ামকে তারা বলে সিলভার। সিলভারের কলসি।
নদী থেকে কলসি ভরে নিয়ে পাড়ের নিবিড় সবুজে আবার বিলীন হলো মেয়ে।
কতক্ষণের দৃশ্য? সে কি তখন মনে করেছিল, এই দৃশ্যটা তার মনে থেকে যাবে? থেকে গেছে। বহু বছর পর ঘুমিয়ে মাত্র আবার সে স্বপ্নে দেখল দৃশ্যটা। তার ঘুম ভাঙল এবং দৃশ্যটাকে তার মনে হলো অভিঘাতময়। বহুযুগ আগের এক দুপুরে গেল সে। নগ্ন আর্কিমিডিসকে দেখল রাস্তায়। তার বয়সি আর্কিমিডিস। ‘ইউরেকা! ইউরেকা!’ বলে ছুটছেন। বাথটাবে বসে সূত্র পেয়ে গেছেন, কাপড় চোপড়ের কথা মনে নেই, উদ্বাহু বেরিয়ে পড়েছেন। বাথটাব মাথায় নিয়ে যে বেরিয়ে পড়েননি!
তার ঘরে একটা এন্টিক ঘড়ি আছে। দালির ‘পার্সিসটেন্স অব মেমরি’ ছবির ঘড়ির মতো, এই ঘড়ি যে কোনদিন গলে যেতে পারে। সময় দেখল সে। রাত বেশি হয়নি। একটা এক কি দুই হবে বাজে। তার মানে ঘুমিয়ে ঘণ্টাও কাটেনি। ভালো হয়েছে। ভালো হয়েছে আর্কিমিডিস! ভালো হয়েছে ইউরেকা! সে উঠে এক মগ কফি বানাল। একটা মারলবোরো লাইট সিগারেট ধরাল এবং তার অন্ধকার স্টুডিওতে ঢুকল। লেট দেয়ার বি নাইট। আলো জ্বালাল। রং ভর্তি ঘর ঝিক করে উঠল। কিছু আঁকা, কিছু অর্ধেক আঁকা, কিছু না আঁকা ক্যানভাস এখানে ওখানে। সে কি এখন ছবি আঁকতে বসবে? বসবে। এখন না আঁকলে আর হবে না। এই ছবি তবে ছিল তার মাথায়! হক ভাই থাকলে বলতেন, করোটির ভেতরে। সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক। তাকে প্রশ্রয় দিতেন হক ভাই। তার পেইন্টিং দেখেছিলেন এবং ক্রিটিক লিখবেন বলেছিলেন।
দিন তারিখ মনে নেই তার। সে মনে রাখতে পারে না। কার্তিকের দিন ধারণা মাত্র। নদী শীর্ণ ছিল, সেটা অগ্রহায়ণ পৌষ মাঘেও হতে পারে। পৌষ মাঘ হলে অবশ্য কুয়াশার স্মৃতি থাকত মাথায়। নাকি ছিল? কুয়াশা ছিল?
ছিল হয়তো। রোদও ছিল। অনেক রোদ ছিল। সেদিন বিরাট একটা ঘটনা ঘটেছিল তাদের নিরালা মফস্বল শহরে। আগের দিন থেকেই তারা জানত। রিকশা নিয়ে মাইকিং করেছিল শহরের বিখ্যাত মাইকম্যান বোঁচাদা।
সেদিন তার ঘুম ভেঙেছে সুবেহ সাদেকে। আর একটু সকাল হতেই সে হাঁটা দিয়েছে ডাকবাংলোর দিকে। সুলতান ভাইয়ের চায়ের দোকান থেকেই দেখে মানুষ। মানুষ আর মানুষ। ডাকবাংলোর সামনে, রাস্তায়, মাঠে। শহরের মানুষ, গাঁওগঞ্জের মানুষ। এত মানুষ এত সকালে! ঘুরে ঘুরে মানুষ দেখছিল সে। সবুজ ডুরে শাড়ি পরা এক বুড়িকে দেখল। মস্ত এক লাউ নিয়ে বসে আছে মাঠে। বুড়ি কী মনে করেছে? বাজার বসেছে?
ঘাটে গিয়ে আরো তাজ্জব হলো সে। নদী ভর্তি নৌকা দেখল। নৌকা ভর্তি মানুষ দেখল। এরকম আর দেখেনি। এত নৌকা! একটা থেকে একটায় উঠে হেঁটে নদী পার হয়ে যাওয়া যাবে। দেখা হয়ে গেল রুমেন, বাপি, খোকন, নাসের, রাজিব, লিখন এবং মান্নার সঙ্গেও। তারা একসঙ্গে থাকল মাঠের নৈঋতে। এখান থেকে সব দেখা যাবে। তবে কখন? বাদ্যবাজনা হচ্ছে এখানে ওখানে, মাইক বাজছে, সেøাগান দিচ্ছে মানুষ। তারা উৎকর্ণ থাকল একটা কি কয়েকটা হেলিকপ্টারের শব্দের জন্য।
‘একটা না তিনটা।’ বাপি বলল।
‘তিনটা না দুইটা, চ্যালেঞ্জ।’ রুমেন বলল।
রুমেনের কথা ঠিক হতে পারে। রুমেনের আব্বা এলাকার আওয়ামী লীগ নেতা।
সেøাগান, বাদ্যবাজনা, মাইকের আওয়াজে হেলিকপ্টারের শব্দ তারা শুনল না। হেলিকপ্টার দেখলও না। পরে শুনল হেলিকপ্টার পিটিআই স্কুলের মাঠে নেমেছিল। তিনটা না, দুটা না, একটা হেলিকপ্টার। পিটিআই স্কুল থেকে ডাকবাংলো। বঙ্গবন্ধু আসলেন গাড়িতে। রুমেনের আব্বা আবদুর রইস চাচা বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে গাড়ি থেকে নামলেন। সেøাগান মুখর হলো মাঠ ঘাট নদী। ডাকবাংলোর সামনে বানানো মঞ্চে বঙ্গবন্ধু ভাষণ দিতে উঠলেন।
সে এই প্রথম দেখল বঙ্গবন্ধুকে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। মুক্তিযুদ্ধের আগে কয়েকবার এসেছেন, মুক্তিযুদ্ধের পরও একবার এসে ভাষণ দিয়ে গেছেন তাদের শহরে। শেষবার রুমেন মান্না বাপি খোকনরা দেখেছে। সে দেখেনি। জ্বর ছিল তার। এখন সে দেখল! অপার বিস্ময়ের সঙ্গে দেখল জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে।
সেই দিনের সেই ভাষণের কথা এখনো কিছু মনে আছে তার। কাঁটা দিয়ে ওঠে শরীর। ভাষণ না, এত বছর পর এখন মনে হয় ওংকার।
কফি শেষ করে রং নিল সে। এক্রিলিক। ব্রাশ, পেলেট, স্পেটুলা নিল। রং চাপাল একটা ত্রিশ-চল্লিশ ক্যানভাসে। লাল, নীল, হলুদ, সবুজ, হাওয়াই মিঠাই রং। সে এখন জানে সে কী আঁকবে।
ওং, স্ট্রোক এবং অন্তর্গত উচ্ছ¡াস। কতক্ষণ ধরে সে আঁকল?
সুবেহ সাদেক হলো, নূরের হাওয়া দিল।
পেইন্টিং সম্পূর্ণ।
অবয়বধর্মী আঁকার ধরন না তার। পিওর অ্যাবস্ট্রাক্ট পেইন্টিং করে। এই প্রথম অবয়বধর্মী কিছু আঁকল। বোঝা যায় কিছু অবয়ব। সবুজ, রুপালি, হাওয়াই মিঠাই রঙের। সব মিলিয়ে একটা তর্জনী যেনবা। পাহাড়ের থেকে উঁচু তর্জনী। শিরোনাম কী হবে এই ছবির?
রবীন্দ্রনাথ আছেন কী করতে? শিরোনাম ঠিক করে দিলেন, ‘চিরদিন তোমার আকাশ।’
মান্না আছে শহরেই। কলেজের অধ্যাপক। অস্তিত্ববাদ পড়ায় ছেলেমেয়েদের। এই সময় ঘুম থেকে উঠে পড়ে এবং আধঘণ্টা পৌনে এক ঘণ্টা হাঁটে মাস্টারমশাই।
কল দিল সে।
মান্না ধরল, ‘কী রে? তুই এত সকালে?’
‘ঘুমাই নাই।’
‘তা তো বুঝছি। ঘুমাস নাই, কী করছিস?’
উচ্ছ¡সিত সে বলল, ‘কী করছি? পেইন্টিং করছি। বহুদিন ধরে তোরে বলতেছি না বঙ্গবন্ধুরে নিয়া একটা পেইন্টিং ঘুরতেছে মাথায়?’
‘হ্যাঁ।’
‘সেই পেইন্টিং! মাত্র শেষ করে তোরে কল দিলাম। বাহাত্তরের শেষ দিকে না তেয়াত্তরে মনে নাই, বঙ্গবন্ধু আমাদের শহরে আসছিলেন, মনে আছে তোর? ডাকবাংলো থেকে ভাষণ দিছিলেন-।’
‘মনে আছে না? বাহাত্তরে না তেহাত্তরে, ফেব্রুয়ারি মাসের এক সকালে। ভাষণ সুদ্ধা মনে আছে ব্যাটা। …আমি তো প্রধানমন্ত্রীর গদি নেবার চাই নাই। আমি তো ফাঁসির কাষ্ঠের দড়ি নিয়েছিলাম বাংলার মানুষের জন্য।’ মান্না বলল।
সে বলল, ‘আপনারা আমাকে ভালোবাসেন আমি জানি। এদেশের হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, আপনারা সুখে বাস করবেন। পাশাপাশি বাস করবেন। ভাই ভাই বাস করবেন। কোনো মতে যেন সাম্প্রদায়িকতা বাংলার মাটিতে আর না হয়।’
মান্না বলল, ‘তাহলে আমি হার্টফেল করে মারা যাব।’
সব মনে আছে। মান্নার, তারও।
‘সেইদিনের বিকালটা তোর মনে আছে মান্না? বঙ্গবন্ধু চলে যাওয়ার পর সুনসান হয়ে গিয়েছিল শহর। বিকালে আমরা অনেকক্ষণ আসক আলির ঘাটে বসে থাকলাম।’ সে বলল।
মান্না বলল, ‘মনে আছে রে।’
‘মেয়েটারে দেখছিলি? ওই পাড়ের?’
‘মেয়ে? কোন মেয়ে?’
‘নয়-দশ বছর হবে বয়স। হাওয়াই মিঠাই রঙের শাড়ি পরেছিল। সিলভারের কলসি ছিল কাঁখে। নদী থেকে পানি নিয়া সে মিলায়ে গেছিল আবার ওইপাড়ের সবুজে।’
‘মনে নাই রে। আমি দেখি নাই।’
তবে মান্নার জন্য ছিল না দৃশ্যটা। আর কোনো দৃশ্য ছিল। ওই সময় মান্না অবশ্যই আর কোনো দৃশ্য দেখেছে। ব্যাপার না। সব মানুষ এক দৃশ্য কখনোই দেখে না।
সেই বুড়িটা। সবুজ ডুরে শাড়ি। এত মানুষের মধ্যেও বঙ্গবন্ধু ঠিকই বুড়িকে দেখেছিলেন। ভাষণ থামিয়ে কাছে ডেকে নিয়েছিলেন। মঙ্গলকাটার বুড়ি। নিজের গাছের লাউ এনেছিল বঙ্গবন্ধু ‘শেখের পুতের লাগি।’
বাতি আগেই নিভিয়ে দিয়েছে, স্টুডিওর জানালা খুলল সে। সুবেহ সাদেকের রং আছে এখনো। নূরের হাওয়া আছে এখনো। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের একাংশ দেখা যায় তার স্টুডিও থেকে। সবুজ দেখা যায়, স্বাধীনতাস্তম্ভ দেখা যায়। গøাস টাওয়ার। উঠে আছে আকাশে।
কিছু লাল রং ধরল আকাশের পূবে।
স্বাধীনতাস্তম্ভ সোনালি দেখাচ্ছে।
স্বাধীনতাস্তম্ভ নাকি তর্জনী?
বঙ্গবন্ধুর তর্জনী দেখল সে।
সোহরাওয়ার্দী উদ্যান-রেসকোর্সের মাঠে,
তাদের নদীর পাড়ে,
সারা বাংলায়।

কৃতজ্ঞতা : বঙ্গবন্ধুর নির্বাচিত ভাষণের শ্রæতিলিপি ‘ওংকার সমগ্র’ গ্রন্থের সম্পাদক নির্ঝর নৈঃশব্দ্য

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়