‘নারীরা জায়েদ খানে আটকায়’ বলায় লিগ্যাল নোটিস

আগের সংবাদ

পিতার সমাধিতে ফুলেল শ্রদ্ধা : টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর সমাধিতে কন্যা হাসিনা-রেহানা

পরের সংবাদ

আগস্টের রক্তপাত ও ষড়যন্ত্রের খতিয়ান

প্রকাশিত: আগস্ট ১৫, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: আগস্ট ১৫, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

বাংলাদেশের জনজীবনে আগস্ট মাস নিছক কোনো শোকের মাস নয়, এ মাস এক বিভীষিকার- যা যুগের পর যুগ দেশের শান্তি ও স্বাধীনতাপ্রিয় মানুষকে তাড়িত করবে। আমরা যদি ইতিহাসের দিকে তাকাই- দেখতে পাই পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের অনুচরেরা এই আগস্ট মাসে পুরো শক্তি নিয়ে নির্মমতা চালাতে থাকে ১৯৭১ সালে, যার ফলে বাংলাদেশের সব প্রান্তে বধ্যভূমির সৃষ্টি হয়, বাংলার মাটি রঞ্জিত হয় স্বাধীনতাকামী গণমানুষের রক্তে। একই সঙ্গে হানাদার পাকিস্তানি ও তাদের স্থানীয় অনুচরেরা চালাতে থাকে নির্বিচার নারী ধর্ষণ ও লুণ্ঠন। আমরা জানি, পাকিস্তানি সৈন্যদের এই হত্যাযজ্ঞ শুরু হয় ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের রাত থেকে ঢাকা নগরীতে তাদের কুখ্যাত ‘অপারেশন সার্চ লাইট’ নামের সামরিক অভিযানের মধ্য দিয়ে।
বাঙালির ইতিহাসের প্রথম স্বাধীন রাষ্ট্র নানা কারণেই ব্যতিক্রম। বাংলাদেশ রাষ্ট্র তার স্বাধীনতার ৫০ বছর উদযাপন করছে। মহাসমারোহে জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী পালন করেছে। কিন্ত বাংলাদেশ আজো বিদেশি বা দেশি ষড়যন্ত্রকারীদের হাত থেকে রেহাই পেয়েছে বলে মনে করার কারণ নেই।
আমরা যদি আরো আগের ইতিহাসের দিকে তাকাই, দেখতে পাই, ব্রিটিশ ভারতের বিভক্তি এই আগস্ট মাসেই। ১৯৪৭ সালের আগস্টে ধর্মের নামে ভাগ হলো ব্রিটিশ ভারত, যার মধ্যে রোপিত হলো রক্তাক্ত এবং অবধারিত পরিণতির বীজ। পূর্ব বাংলা হয়ে গেল পূর্ব পাকিস্তান, যা ২৩ বছর ধরে থাকল পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর লুণ্ঠন ও নিপীড়নের ক্ষেত্র হিসেবে। এই লুণ্ঠন ও নিপীড়ন কেবল রাজনৈতিক অধিকারের ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ থাকল না, ছড়িয়ে গেল ভাষা, কৃষ্টি ও সংস্কৃতির সব অঙ্গনে। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর পরই ভাষার দাবিতে প্রাণ দিতে হলো বাঙালিকে। যুক্ত পাকিস্তান যে ২৩ বছর টিকে থাকল, সেই পাকিস্তানের মাটিতে অনুষ্ঠিত হলো কেবল একটি সাধারণ নির্বাচন। ১৯৭০ সালের ডিসেম্বরে। সে নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক পরিষদে ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করল। কিন্তু যে পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠী বাঙালিদের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক বানিয়ে রাখতে চায়, তারা কোনো বাঙালিকে অর্থাৎ শেখ মুজিবকে কেন ক্ষমতায় বসতে দেবে?
অতএব বাঙালির নেতা ডাক দিলেন সর্বাত্মক গণপ্রতিরোধের। কিন্তু পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠী ক্ষমতা হস্তান্তরে বাধ সেধেই কেবল ক্ষান্ত হলো না, তারা দেশের সেনাবাহিনীকে নামাল রাতের অন্ধকারে বাঙালি জনগোষ্ঠীর অধিকারের দাবি চিরতরে নস্যাৎ করতে। সেই থেকে শুরু হলো বাংলার মাটিতে এক রক্তাক্ত অধ্যায়। এ পরিস্থিতিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতার

ঘোষণা দিলেন। তাকে গ্রেপ্তার করে সেদিন পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে বিচারের সম্মুখীন করা হলো। শুরু হলো ঐতিহাসিক মুক্তিযুদ্ধ। সে গণযুদ্ধে লাখো মানুষ শহীদ হলেন, তিন লাখেরও ওপর নারী নিগৃহীত হলেন পাকিস্তানি সেনা ও তাদের এ দেশীয় অনুচরদের হাতে।
বাঙালিকে পাকিস্তানিরা ভীতু ও কাপুরুষ ভেবেছিল, ধরে নিয়েছিল শত অত্যাচারেও তারা প্রতিরোধ করতে ব্যর্থ হবে। কিন্তু পাকিস্তানিদের সেই ভাবনা ব্যর্থ করে দিল দেশপ্রেমীক বাঙালি জনতা। তারা রুখে দাঁড়াল সর্বশক্তি নিয়ে। মুক্তি বাহিনীর সর্বাত্মক প্রতিরোধে দেশের সব প্রান্তে পাকিস্তানিরা কোণঠাসা হলো। এরপর ডিসেম্বর মাসে মুক্তি বাহিনী ও ভারতীয় মিত্র বাহিনীর যৌথ অভিযানে বাংলাদেশের মাটি চূড়ান্তভাবে হানাদার মুক্ত হলো। ৯৩ হাজার পাকিস্তানি সৈন্য ঢাকার মাটিতে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হলো।
কিন্তু এরপরও বাংলাদেশ রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র বন্ধ হলো না। স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি ও একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীরা সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করে তোলার ষড়যন্ত্র অব্যাহত রাখল।
৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধ ছিল নির্বিচার হত্যাযজ্ঞ ও নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে বাঙালি গণমানুষের সশস্ত্র মনোজাগতিক বিস্ফোরণ। ইতিহাসের সত্য এই, ভয়ংকর সেই নির্মমতায় পাকিস্তানকে মদত জুগিয়েছে সেদিনকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরকার ও কমিউনিস্ট চীনসহ কয়েকটি রাষ্ট্র। ইতিহাসের সত্য আরো এই, সেই দুর্দিনে এগিয়ে এসেছিল প্রতিবেশী ভারত, তার সর্বস্তরের মানুষ ও সরকার। তারা বাংলাদেশের এক কোটি বিপন্ন মানুষকে আশ্রয় দিয়েছে, বাংলাদেশের মুক্তি বাহিনীকে সর্বাত্মক সহায়তা জুগিয়েছে। ফলে পাকিস্তানি বর্বরতার বিরুদ্ধে গণমানুষের যুদ্ধ এগিয়ে গেছে। এরপর মুক্তিযুদ্ধের শেষ অংশে দুই দেশের যৌথ সামরিক কমান্ড গঠনের মধ্য দিয়ে মুক্তি ও মিত্র বাহিনীর যৌথ অভিযানে পাকিস্তান হানাদার বাহিনী আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়েছে।
প্রতিবেশী ভারতের সেই ভূমিকার কথা সর্বাগ্রে উচ্চারণ করেছেন বাংলাদেশের জাতির পিতা। ১৯৭৪ সালে ১৮ জানুয়ারি আওয়ামী লীগের দ্বিবার্ষিক কাউন্সিল অধিবেশনে তিনি বলেছেন- ‘ভারতের ১৪ হাজার জওয়ান বাংলার মাটিতে রক্ত দিয়ে বাংলার মানুষকে বাঁচিয়েছিল। কিন্তু কখনোই কোনো উপনিবেশিক মানসিকতা ছিল না ভারতের। তাই পাক বাহিনীকে পরাস্ত করেও ভারতীয় সেনা এক মুহূর্তও থাকেনি বাংলাদেশে।’ আরো বলেছেন- ‘বাংলদেশের স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি ভারতবিরোধিতার নামে দেশটিকে দুর্বল করার খেলায় মত্ত’।
ইতিহাসগতভাবে আগস্ট মাস একটি রক্তাক্ত মাস। ১৯৭১ এর আগস্টে পাকিস্তান বাহিনী ও তাদের বাঙালি অনুচরেরা চালাতে থাকে ধারাবাহিক গণহত্যা, নারী ধর্ষণ ও লুণ্ঠন। মুক্তিযোদ্ধারা প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করলে এই মাত্রা বাড়তে থাকে। স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াতে ইসলামীর নেতৃত্বে গড়ে তোলা রাজাকার, আলবদর বাংলার মাটিকে রক্তাক্ত করে চলে। ফলে লাখ লাখ মানুষ দেশান্তরিত হয়। শুরু হয় বিশ্ব ইতিহাসের এক মর্মান্তিক শরণার্থী সংকট। ঠিক এ সময়ে আমেরিকার নিউইয়র্ক নগরীতে গড়ে ওঠে এক অভিনব প্রতিরোধ। আগস্ট মাসের ১ তারিখে বাংলাদেশের বিপন্ন মানবতার পাশে এগিয়ে আসেন কিংবদন্তি মার্কিন গায়ক জর্জ হ্যারিসন ও ভারতের পণ্ডিত রবিশঙ্কর। বিপন্ন মানুষের পাশে দাঁড়াতে আয়োজন করা হয় ঐতিহাসিক ‘বাংলাদেশ কনসার্ট’। এতে যোগ দেন পরবর্তী নোবেল বিজয়ী বব ডিলনসহ বহু নামিদামি কণ্ঠশিল্পী।
১৯৭১ সালের আগস্টের প্রায় প্রতিটি দিন ছিল রক্তাক্ত। মার্চ থেকে যে গণহত্যার শুরু, তা আগস্টে এসে সারাদেশে বিস্তৃত হয়। পরবর্তী অনুসন্ধানে প্রায় সব হত্যাকাণ্ডের বিবরণ নথিভুক্ত আছে, যার বিস্তারিত উল্লেখ সম্ভব নয় সংক্ষিপ্ত লেখাতে। আগস্টের ৩ তারিখে ঝিনাইগাতী উপজেলার গারো পাহাড়ের পাদদেশ নকসী রক্তাক্ত হয়ে ওঠে পাকিস্তানি বর্বরতায়। পাকিস্তানি সৈন্যদের সঙ্গে মিলে নকসীর মাটিতে ব্যাপক নিধনযজ্ঞ চালায় রাজাকার ও আলবদররা। ৪ আগস্ট ঘটে আটোয়ারির গণহত্যা। এই এলাকার দামোর ইউনিয়নের কমপক্ষে ২৫ জন নিরীহ মানুষকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় পাকিস্তানি সেনাছাউনিতে। নির্মম অত্যাচারের পর তাদের হত্যা করা হয়। একই দিন শহীদ হন ৮ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা চুয়াডাঙ্গায়। নির্বিচার গুলিবর্ষণে রক্তাক্ত হন গ্রামবাসী।
৭ আগস্ট ঠাকুরগাঁও জেলার রুহিয়া ইউনিয়নের রামনাথ হাটের গণহত্যা সেখানকার মানুষ কখনোই ভুলতে পারে না। নিষ্ঠুর পন্থায় গ্রামবাসীকে তুলে নেয়া হয় এবং বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করা হয় শিশু ও কিশোরদের। দুদিন ধরে চলা এই বর্বরতায় নিহতদের কবর দেয়া হয় স্থানীয় নুরুল ইসলামের বাড়িতে। শুধু তাই নয়, নেত্রকোনা জেলার দুর্গাপুরে শুধু জানাজায় অংশ নেয়ার অপরাধে হানাদার পাকিস্তানি সৈন্যরা নির্বিচার গণহত্যা চালায়। ১৬ আগস্ট এখানকার সোমেশ্বরী নদী পাড়ে সৈন্যদের মেশিনগানের গুলিতে ঝাঝরা করে দেয়া হয় অসংখ্য নিরীহ গ্রামবাসীর শরীর। তারপর লাশ ভাসিয়ে দেয়া হয় সোমেশ্বরীর পানিতে।
ঠিক একইভাবে এবং ক্রমাগতভাবে গণহত্যা ঘটে সিলেট, চট্টগ্রাম, খুলনা, ময়মনসিংহ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, রংপুর, দিনাজপুরসহ দেশের প্রতিটি এলাকায়। যে বধ্যভূমিগুলো আজো সাক্ষী হয়ে আছে সেই পৈশাচিক নিষ্ঠুরতার। ১৮ আগস্ট ঘটে আরেক হত্যাযজ্ঞ বানিয়াচং উপজেলার প্রত্যন্ত কাগাপাশা গ্রামে। কাগাপাশা ইউনিয়নের হিন্দু অধ্যুষিত মাকালকান্দি রক্তাক্ত হয়। পাকিস্তানি সৈন্যদের হাতে এই হত্যাকাণ্ড চলে স্থানীয় পুলিশ ও রাজাকার সদস্যদের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায়। অতর্কিত হামলা চালিয়ে পাকিস্তানি সৈন্যরা গ্রামবাসীকে একসঙ্গে দাঁড় করায় এবং সবাইকে গুলি করে হত্যা করে। বাকিদের যত্রতত্র খুন করা হয়।
নোয়াখালীর গোপালপুর রক্তাক্ত হয় ১৯ আগস্ট। প্রায় দুইশ পাকিস্তানি সৈন্য স্থানীয় বাজারে আগুন ধরিয়ে দেয়, এবং পলাতক লোকজনকে আটক করে কমপক্ষে ৫৬ জনকে একসঙ্গে গুলি করে। একইভাবে ময়মনসিংহের গৌরীপুর উপজেলার শালিহর গ্রামে ১৪ জন হিন্দু-মুসলমানকে নির্মমভাবে হত্যা করে পাকিস্তানি সৈন্যরা ২১ আগস্ট। ২৮ আগস্ট আখাউড়া উপজেলার গঙ্গাসাগর দীঘির পাড়ে দাঁড় করিয়ে হত্যা করা হয় বহু মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের নিকট আত্মীয়দের।
১৯৭১ সালের আগস্টের শেষ দিনটি ছিল মঙ্গলবার। সেদিন নরসিংদী ও সুনামগঞ্জের মানুষের কাছে এক ভয়াবহ দিন। দিনের শুরুটা ছিল মুক্তি বাহিনীর। তারা শিবপুর থানায় একটি সফল অভিযান পরিচালনা করে। সে যুদ্ধে বহু সংখ্যক পাকিস্তানি অফিসার ও সেনা মৃত্যুবরণ করে। কিন্তু যুদ্ধে হেরে যাওয়ার পর মুক্তি বাহিনীর সদস্যরা চলে যাওয়ার পর কাপুরুষের মতো পাকিস্তান বাহিনী নিরীহ গ্রামবাসীর ওপর চড়াও হয়। রাজাকার, আলবদর ও শান্তি কমিটির সদস্যদের সঙ্গে নিয়ে চালাতে থাকে গুলি বৃষ্টি। এতে শহীদ হন ১২৬ জন নিরীহ গ্রামবাসী। এরপর চলে গোটা গ্রামে নির্বিচার লুণ্ঠন। শেরপুরের নখলা উপজেলার নারায়ণখোলাতে একই সময় হত্যা করা হয় অর্ধশত মানুষকে।
সুনামগঞ্জ জেলার জগন্নাথপুর উপজেলার মিরপুর ইউনিয়নে শ্রীরামশি গ্রামে চলে আরেক হত্যাযজ্ঞ ১৯৭১ সালের ১ আগস্ট। স্থানীয় রাজাকারদের সহায়তায় নারকীয় তাণ্ডব চালানো হয় এলাকায়। নিহত হয় একশর ওপর নিরীহ গ্রামবাসী।
গণহত্যা ও নির্বিচার নারী নির্যাতনের ১৯৭১ শেষ হয় ৯ মাসে। হানাদার সৈন্যদের আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। কিন্তু স্বাধীনতার মাত্র তিন বছর সাত মাস তিন দিনের মাথায়, একই আগস্টেই স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি আঘাত হানে বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ওপর। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট তারা হত্যা করে বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের প্রায় সব সদস্যকে। দেশের বাইরে থাকায় জাতির পিতার দুই কন্যা বেঁচে যান। এরপর মুক্তিযুদ্ধের লুণ্ঠিত গৌরব পুনরুদ্ধার আন্দোলনের মুখ্য নেতা শেখ হাসিনাকেও বারবার হত্যা করার চেষ্টা চলে। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট উপর্যুপরি গ্রেনেড ছুড়ে বঙ্গবন্ধু কন্যাকে হত্যা করা সম্ভব না হলেও ঘাতকরা আইভী রহমানসহ ২৪ জনকে হত্যা করতে সক্ষম হয়। নির্বিচার গ্রেনেড আক্রমণে আহত-পঙ্গু হয় অসংখ্য নেতাকর্মী।
অতএব চক্রান্ত থেমে গেছে বলা ঠিক হবে না। চলছে আজো। সে কারণেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার লড়াই চালাতে হবে নিরবচ্ছিন্ন গতিতে। এই প্রক্রিয়ায় মুক্তিযুদ্ধের সব বন্ধু-সহযোগীর সমর্থন জরুরি। জরুরি জাতির মহান মুক্তিযুদ্ধের শত্রæমিত্রের মাঝে সীমানা নির্ধারণ। এতে ভুল হলে বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধীরা লাভবান হবে। ষড়যন্ত্র আরো শক্তিশালী হবে।
অতএব আগস্ট শুধু শোকের মাস নয়, আগস্ট বাঙালির হৃত চেতনা পুনরুদ্ধারের মাস, আগস্ট আত্মানুসন্ধান ও আত্মসচেনতার মাস, শোককে শক্তিতে রূপান্তরিত করার মাস।
অনস্বীকার্য, বাংলাদেশ রাষ্ট্রের কাছে তার জনকের হত্যাকাণ্ডের বিচার সম্পন্ন হওয়ার বিষয়টি যেমন বড় জাতীয় দায়মুক্তির, তেমনি দায়মুক্তি মুক্তিযুদ্ধের সময় যারা পাকিস্তানি সৈন্যদের বর্বরতার দোসর হয়ে মানবতার বিরুদ্ধে ঘৃণ্যতম অপরাধ করেছে, নির্বিচার গণহত্যা ও নারীর সম্ভ্রমহানি করেছে, ঘরবাড়ি জ¦ালিয়েছে, অপহরণ ও ক্ষতিগ্রস্ত করেছে লাখো নিরস্ত্র মানুষকে, সেই সব শীর্ষ অপরাধীদের বিচার সম্পন্ন করা।
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে এই কাজ দুটির সম্পাদনই কি মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যাশিত বাংলাদেশকে সুরক্ষা দান করবে?
আমার বিশ্বাস, না। এই দুই কাজের ওপর দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ সামনে এগোবার সিঁড়ি ফিরে পেয়েছে মাত্র, যে সিঁড়ি সরিয়ে নেয়া হয়েছিল। অতএব আত্মতুষ্টির সুযোগ কম। বিশ্বাস করি, বাংলাদেশের মতো একটি রাষ্ট্রের যাত্রাপথ অবারিত করতে প্রয়োজন একটি রেনেসাঁ, একটি নবজাগৃতি, একটি সাংস্কৃতিক নবজাগরণ, যা সাম্প্রদায়িকতার গ্রাস থেকে জাতিকে মুক্ত করবে, মানবিক করবে, স্লোগানের রাজনীতির বাইরে বেরিয়ে যুব তারুণ্যকে মানুষ করবে- বাঙালি করবে।
ইতিহাসের এই সত্য অনুধাবন করা জরুরি, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ, যা সব ধর্ম-বর্ণের মানুষকে একাত্ম করে জাতিকে স্বাধীনতার ময়দানে নামিয়েছিল, তা ছিল এই জনপদের এক নবজাগৃতি। যদিও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক নেতৃত্বের পথ ধরেই সে জাগৃতি ঘটেছিল, তথাপি তাকে নতুন মাত্রা দিয়েছিল বাংলার আবহমান সাংস্কৃতিক শক্তি- যার ভিত্তিমূলে ছিলেন লালন, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দ ও সুকান্ত।
১৯৭১ থেকে কয়েক দশকের ঘটনাপ্রবাহ দেখে আমার মনে হয়েছে, মুক্তিযুদ্ধের পুনরুদ্ধারকৃত চেতনার নবযাত্রাকে নিষ্কণ্টক করতে হলে রাজনীতির নতুন কুশীলবদের আদর্শিক বা সাংস্কৃতিকভাবে সশস্ত্র হতে হবে। নতুন যাত্রাপথ চিহ্নিত করতে হবে। আর সে কারণেই প্রয়োজন আদর্শিক ও ত্যাগী রাজনৈতিক কর্মী, যারা বঙ্গবন্ধু ও জয়বাংলাকে কেবল কণ্ঠে নয়, আত্মায় ধারণ করার সামর্থ্য অর্জন করবে।

হারুন হাবীব : মুক্তিযোদ্ধা, সাহিত্যিক ও সাংবাদিক
email: [email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়