শিশুশ্রম নিরসনে সমন্বিত পদক্ষেপের আহ্বান

আগের সংবাদ

ভারত-আমেরিকার বৈচিত্র্যময় অংশীদারত্ব গড়ার প্রত্যয় : হোয়াইট হাউসে মোদি-বাইডেন বৈঠক শেষে যৌথ ঘোষণা

পরের সংবাদ

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী : অসামান্য গদ্যশৈলীর রূপকার

প্রকাশিত: জুন ২৩, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জুন ২৩, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

রাজনৈতিক প্রবন্ধ সাহিত্যের উদ্দেশ্য হচ্ছে পাঠক মননে শ্রেণিশাসিত সমাজ সম্পর্কে কৌতূহল সৃষ্টি করা। যে শ্রেণিবিভক্ত সমাজে পাঠক বসবাস করে, সেই সমাজ সম্পর্কে এক ধরনের অজ্ঞতা, অস্পষ্টতা বা অমনোযোগিতায় আচ্ছন্ন থাকে তারা। রাজনৈতিক প্রবন্ধ সমাজের গতি-প্রকৃতির স্বরূপটি উদঘাটন করে পাঠকের সামনে তুলে ধরে এবং সে সম্পর্কে কৌতূহলী পাঠককে তাদের সামাজিক দায়-দায়িত্ব বোধের আলোর সামনে এগিয়ে যেতে সহায়তা করে। রাজনীতি অবশ্যই একটি জটিল বিষয়। তাই এ বিষয়টিকে পাঠকের সামনে বিশ্লেষণ করতে গেলে কেবল তত্ত্ব নির্মাণই প্রধান কাজ নয়, লেখকের ভাষা বা গদ্যশৈলীটিও হতে হবে শিল্পগুণে অন্বিত। জটিল শব্দ চয়ন, বাক্যবিন্যাস কুয়াশাচ্ছন্ন ভাব দ্বারা বিষয়বস্তুকে দুর্বোধ্য করে তুললে রচনার উদ্দেশ্যই ব্যর্থ হয়ে যায়। গদ্যের জটিলতার কারণে যদি বিষয়বস্তুর ভেতর পাঠক প্রবেশ করতে না পারল, তবে লেখক নিজের জন্য তো নয়, পাঠকের জন্যও কোনো সুসংবাদ বহন করতে পারেন না। যেহেতু রাজনৈতিক প্রবন্ধের উদ্দেশ্য নিছক জ্ঞানের চাষাবাদ নয়, শ্রেণি বিভাজিত সমাজে বিভিন্ন শ্রেণির গতি-প্রকৃতি নির্ণয় করে রাজনীতির সঠিক পথটিকে নির্দেশ করা, সেহেতু সেখানে রচয়িতার গদ্যরীতি ও প্রাঞ্জলতা দাবি করে। প্রাঞ্জলতার অর্থ এই নয়, তা জলো বা শ্রীহীন গদ্যকলা কৌশল।
বাংলাদেশের সাহিত্যে রাজনৈতিক ধারার প্রবন্ধ তথা প্রগতিশীল রাজনৈতিক প্রবন্ধের ইতিহাস খুব বেশি পুরাতন নয়। যদিও এর সূত্রপাত অভিভক্ত বাংলায় তবু নিজস্ব ধারাটি তৈরি হয়েছে পঞ্চাশের দশকের ঢাকা শহরকে কেন্দ্র করে। প্রকৃত অর্থে এর চূড়ান্ত বিকাশ ঘটেছে স্বাধীনতা-উত্তরকালে। কলকাতাকেন্দ্রিক বুদ্ধি চর্চার ধারা থেকে ঢাকাকেন্দ্রিক বুদ্ধি চর্চার ধারাটি যে স্বতন্ত্র, তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে ষাটের দশকের শেষ দিকে। কেননা পশ্চিমবঙ্গে দিল্লির কেন্দ্রীয় শাসন এবং পূর্ববঙ্গ (বাংলাদেশ) পাকিস্তানি শাসনে থাকার ফলে বাংলার দুটি অংশেরই সামাজিক ও রাজনৈতিক রূপরীতির পরিবর্তন ঘটে। কেবল রাজনৈতিক বাস্তবতা নয়, সাংস্কৃতিক তথা বাংলাভাষার সাহিত্যের বিষয় এবং রূপগত স্বতন্ত্রধারাটিও স্পষ্ট হয়ে পড়ে সে সময়। রাজনৈতিক ধারার প্রবন্ধের ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর থেকে শুরু করে গোপাল হালদার, বিনয় ঘোষ, আবু সায়ীদ আইয়ুব এবং আরো অনেকে বিষয়-ভাবনা এবং রূপান্তরীতির বিবর্তন ঘটিয়েছেন। কিন্তু বাঙালি জাতির আলাদা রাষ্ট্রের দীর্ঘ জন্ম-যন্ত্রণা এবং জন্মের ধারাবাহিক কম্পন-প্রকম্পনের মধ্য দিয়েই নতুন অভিযাত্রার স্বতন্ত্র রূপ রাজনৈতিক ধারাটি প্রবন্ধ সাহিত্যে স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হয়ে ওঠে। এ ক্ষেত্রে স্মরণ করা যায় ড. আহমদ শরীফ, বদরুদ্দীন উমর, রণেশ দাশগুপ্ত, সরদার ফজলুল করীম, দেবেন শিকদার, ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, আবুল কাসেম ফজলুল হক এবং পরবর্তী সময়ে ফরহাদ মজহার, আহমদ ছফা এবং আরো অনেককে। আমার লেখার উদ্দেশ্য রাজনৈতিক ধারার লেখালেখির বিষয়-ভাবনা নয়, রূপরীতি তথা গদ্য স্টাইলটি। তবে এটিও সত্য, সাহিত্যের রূপরীতি শূন্য আকাশের মেঘের মতো ভাসমান কিছু নয়, বিষয় ভাবনাকে আশ্রয় করেই তার বিকাশ ঘটে।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ধারার প্রবন্ধের প্রকাশভঙ্গির ক্ষেত্রে কতগুলো লক্ষণ স্পষ্ট। বিপুলসংখ্যক লেখাই দুর্বোধ্য, অস্পষ্ট, নিরস, কুহকী এবং অলংকারবর্জিত অসুন্দর গদ্যে তৈরি। কারো কারো গদ্যরীতিটি আক্রমণাত্মক। এর ফলে গদ্য হয়ে পড়েছে সৌন্দর্যহীন, কর্কশ এবং স্থ’ূল। দু-একজনের গদ্যরীতি মিষ্টি কথায় আক্রান্ত বা পাণ্ডিত্যের ভারে গম্ভীর থাকায় পাঠকের জন্য পঠন-পাঠনে দূরতিক্রম্য। এমন বহু রচনাই পাওয়া যায়, সে সবের রচয়িতাগণের উদ্দেশ্য মহৎ। কিন্তু নিজেদের অভ্যাস হেতু রচনা হয়ে ওঠে উদাসীন গদ্য বা ক্লান্ত গদ্যের রূপ। বিষয় ভাবনা অপূর্ব হওয়া সত্ত্বেও বহু রচনার গদ্যের রূপরীতি কুয়াশাচ্ছন্ন ভাববাদ প্রচারের গদ্যরীতিতে আক্রান্ত। এর ফল দাঁড়ায় এই, পাঠক শ্রেণি বুঝতে পারেন না প্রবন্ধকার কী বলতে চাচ্ছেন। রাজনীতি তথা প্রগতিবাদের কথা বলতে গিয়ে চাতুর্যপূর্ণ বাকভঙ্গি প্রয়োগ করে বাংলাদেশে কেউ কেউ তরুণ পাঠক শ্রেণিকে বিভ্রান্ত করে চলেছেন।
এই যে চারপাশে নানা রকম প্রতিবন্ধকতা, সেসব অত্যন্ত সচেতনতার সঙ্গেই অতিক্রম করতে পেরেছেন সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। আমার পক্ষে তার সম্পর্কে লেখা অনেকটা দুঃসাধ্য। কেননা তার সাহিত্য চিন্তা, সমাজচিন্তা এমনকি ব্যক্তিগত প্রবন্ধ থেকেও রাজনীতিকে আলাদা করা প্রায় অসম্ভব। ভাষা যে জীবন বিচ্ছিন্ন নয়, রাজনীতি নিরপেক্ষ নয়, তা টের পাওয়া যায় সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর প্রবন্ধ পাঠ করলে। আর এই যে রাজনীতির জীবন কথক, তার গদ্যরীতিটিও একেবারেই আলাদা এবং নিজস্ব। কথা সাহিত্যের ভুবনে তার বিচরণের অভিজ্ঞতা রয়েছে বলেই অথবা দীর্ঘদিনের গদ্যচর্চার ফলে নিজের জন্য আলাদা একটি গদ্যের ভুবন বা রূপরীতি তিনি আবিষ্কার করে নিয়েছেন গদ্যটি তার পরিপাটি বলেই জটিলতামুক্ত। জটিল শব্দ চয়ন বা বাক্য বন্ধন তার স্বভাবে নেই। ইংরেজি সাহিত্যের মেধাবী অধ্যাপক হিসেবে তার গদ্যে ইংরেজি শব্দ ব্যবহারের আশঙ্কা ছিল কিন্তু তা ঘটেনি। এমনকি প্রচলিত তৎসম শব্দের বহুল ব্যবহার এবং সংস্কৃত প্রত্যয় বা ধাতুজাত শব্দও তিনি যথাসম্ভব পরিহার করেছেন। ব্যাকরণের শব্দতত্ত্ব ও রূপতত্ত্ব সম্পর্কে তার সচেতনতা অবাক করার বিষয়। কেননা তিনি বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ছাত্র ছিলেন না।
সমাজবাদী দর্শনের আলোকে প্রবন্ধ রচনা অত্যন্ত জটিল সাহিত্যকর্ম। দ্ব›দ্বমূলক বস্তুবাদের জটিল প্রক্রিয়ায় সমাজ ও রাষ্ট্রকে পূর্বে শনাক্ত করতে হয়, তারপর শুরু নিজের লেখাটি। কাজ করা কিন্তু ভোগের তৃষ্ণাকে দমন করা। খ্যাতির মোহ সেখানে অদৃশ্য। কেননা সমাজবাদী রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা নিজের জন্য বা আত্মরতির জন্য সাহিত্য রচনা করেন না, উদ্দেশ্যটা হচ্ছে সমাজ। সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী জানেন তার লেখালেখির উদ্দেশ্য পাঠকের স্নায়ুতে মাদক রস কিংবা আমোদ-প্রমোদ রস প্রবেশ করানো নয়, পাঠকের চিন্তার অনুশীলন দ্বারা সামাজিক সত্যের সামনে দাঁড় করানো। আমার মনে হয়, সামাজিক সেই সত্যকে জনগণের মধ্যে জাগিয়ে তোলার উদ্দেশ্যেই তিনি সাহিত্য জীবনের শুরুতে কথাসাহিত্যের নির্মাণকাজে হাত দিয়েও সরে আসেন প্রবন্ধ সাহিত্যে। কারণ, তার চোখের সামনে তখন পঞ্চাশের আর ষাটের দশক। এ দেশের মানুষের মুক্তি প্রত্যাশা প্রকাশের পরিপক্ব কাল। এমনিকালে তৃণমূল মানুষ ও নতুন তৈরি হতে থাকা দুর্বল মধ্যবিত্তের জন্য রাজনীতির সঠিক পথের আবশ্যকতাই ছিল জরুরি, কবিতা কিংবা গল্পের চেয়ে। আর সেই পথটা হলো সমাজব্যাখ্যা। সেই উদ্দেশ্য থেকেই বুদ্ধিদীপ্ত প্রতিভা, পরিশীলিত রুচি এবং ধারালো যুক্তিকে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী তার শিল্প নির্মাণের উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করেন। একটু মনোযোগ দিয়ে পাঠক যদি তার রচনা পাঠ করেন, তবেই লেখকের শিল্প কৌশলটি ধরতে পারবেন। দ্ব›দ্বমূলক বস্তুমূলক বস্তুবাদের সূত্র-উপসূত্র এবং অনুগামী সূত্রগুলোকে তিনি প্রথমেই ছড়িয়ে দেন চলমান সমাজ জীবন ও রাজনীতিতে। তারপর গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেন সমাজস্থিত শ্রেণিগুলোর আচরণ ও গতি-প্রকৃতি। নিরীক্ষণ বা পর্যবেক্ষণের পর বিশ্লেষণের কাজে হাত দেন তিনি। এমনকি রাজনৈতিক ব্যক্তির কাজ-কর্ম ও জীবনকে তিনি পর্যবেক্ষণ করেন মনস্তাত্ত্বিক দ্ব›দ্বমূলক কৌশলে এবং শ্রেণির প্রতিনিধি হিসেবে বিবেচনা করে। ‘তাজউদ্দীন আহমদের অবস্থান’, জিয়াউর রহমানের রাজনৈতিক ভূমিকা’, ‘শেখ মুজিবের অঙ্গীকার’, ‘বিদ্যাসাগরের কাজ’ ‘আমার পিতার মুখ’ ইত্যাদি প্রবন্ধ তার দৃষ্টান্ত।
যে কোনো লেখাই (প্রবন্ধ) যখন সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী লিখতে বসেন, তখন তার গদ্য রূপটি হয়ে ওঠে একের ভেতর বহু রূপ। কখনো গল্পের প্রতীকী ব্যঞ্জনায় কিংবা কখনো কবিতার শব্দ ও ছন্দের অনিবার্য বিন্যাসে সমাজের স্বপ্ন ও আগামী কল্পনার রূপকে নিজের করে নিয়ে তিনি পাঠকের সামনে তুলে ধরেন। তার রচনায় ‘উত্তম পুরুষ’ রীতিতে বলা গদ্য এবং ‘সর্বজ্ঞ লেখকের দৃষ্টিকোণ‘ থেকে বলা গদ্যগুলো পাঠ করলে বোঝা যায়, গদ্যরীতিটি সুনির্দিষ্ট বিষয়ের জন্যই উপযুক্ত। তাই মনোযোগী এবং কৌতূহলী পাঠক ভুলে যান তিনি গদ্য কবিতা নাকি গল্প নয়তো প্রবন্ধ পাঠ করছেন। প্রবন্ধের গঠনরীতিটি যে মন্ময় বা তন্ময় উপবিভাগ রয়েছে, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর গদ্যের ভেতর তা মিলেমিশে একাকার হয়ে সম্পূর্ণ আলাদা রীতিতে পরিণত হয়। সেই গদ্যরীতিটিই তার নিজস্ব কণ্ঠস্বর। তার এই গদ্যশৈলীর পেছনে কাজ করে নিজস্ব গভীর শ্রেণিজ্ঞান বা শ্রেণি চেতনা। সেই জ্ঞানে ঋদ্ধ বলেই তিনি মধ্যবিত্ত শ্রেণি থেকে ওঠে আসা পাঠক শ্রেণি এবং সাধারণ মানুষের বোধ বা অনুভবের ভাষাকে বুঝতে পারেন। তার গদ্য পাঠ করলে বুঝতে কঠিন হয় না, কেবল বিষয় ভাবনায়ই নয়, গদ্যের শিল্পরীতির সঙ্গে ক্রমাগত দ্ব›েদ্বর ভেতর দিয়ে প্রচলিত গদ্যের রূপান্তর ঘটিয়ে নিজের কৌশলটি আত্মস্থ করেছেন লেখক শ্রমে ও মেধায়। আর একটি তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় লক্ষ্য করার মতো বাংলাদেশ তো বটেই, পশ্চিম বাংলায়ও বহু পাঠক আছেন, যারা সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর রাজনৈতিক দর্শনে আগ্রহী এবং তার গদ্যের মুগ্ধ পাঠক।
আমার মনে হয় বাংলাদেশের মার্কসীয় রাজনৈতিক সাহিত্যের সঙ্গে পাঠকের গভীর সম্পর্ক গড়ে না ওঠা কিংবা ক্রমাগত দূরত্ব সৃষ্টি হওয়ার পেছনে অন্য বহু কারণের সঙ্গে শিল্প না হয়ে ওঠা গদ্যও অনেকটা দায়ী। পার্টি রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত তত্ত্বীয় সাহিত্যগুলোর পাতা উল্টালে তা সহজেই অনুমান করা চলে। সেসব নিরস গদ্য তরুণকর্মীর হৃদয়ে পাঠাভ্যাসের প্রেরণা জোগায় না। আর একটি বিষয় পাঠকমাত্রই কৌতূহল প্রকাশ করবেন। সেটি হচ্ছে শাসক-শোষক শ্রেণির প্রতিনিধিদের শিল্পচর্চা। বাংলাদেশের বুর্জোয়া বুদ্ধিজীবীরা সুখপাঠ্য উল্লেখ করার মতো কোনো বই-পুস্তক অতীতেও লিখতে পারেননি, বর্তমানেও নয়। বুর্জোয়া বা পুঁজিবাদী বিশ্বের দিকে তাকালে অবাক হতে হয়, সেসব দেশ মেধাবী, রুচিশীল, সংস্কৃতিবান, পরিশ্রমী বুদ্ধিজীবী জন্ম দিতে সক্ষম হয়েছে যারা স্বশ্রেণির স্বার্থে উচ্চাঙ্গের রাজনৈতিক পুস্তক লিখেছেন এবং লিখছেন। শাসনের উচ্চাসনে বসেও এ কাজটি তারা অনেকেই পরিশ্রমের সঙ্গে করেছেন। অন্যদিকে আমাদের মেধাশূন্য, অর্ধশিক্ষিত, অসংস্কৃত শাসক-শোষক শ্রেণি শিল্প চর্চার এই শূন্যতা পূর্ণ করছে পেশিশক্তির চর্চার দ্বারা। এরই মধ্যে নানা কলাকৌশলে ছাপানো যে দু’চারটে পুস্তক বাজারে দেখা যায় সে সবের গদ্য কেবল অবশিষ্টই নয়, রীতিমতো অবিশ্বাস্য মূর্খতায় পূর্ণ। ক্লান্ত রাজনীতিবিদ কিংবা অবসরপ্রাপ্ত আমলাদের কেউ কেউ ইংরেজি-বাংলায় পুস্তক রচনা করছেন। এসবের ভাষা অত্যন্ত দুর্বল। এই প্রত্যাশাটা আমরা করতে পারি বাম রাজনীতিবিদদের কাছে। জনগণের মুক্তির ভাষাটি তাদের জানার কথা। কিন্তু সেখানেও তেমন একটা আশার আলো দেখা যায় না। তারা যতটা করেন। রাজনীতির চর্চা ঠিক ততটা করেন না রাজনৈতিক সাহিত্যের চর্চা। তাদের মধ্যে রাজনৈতিক সাহিত্য চর্চার বিষয়টি ঐতিহ্য হিসেবে গড়ে ওঠেনি। এ বিষয়ে তারা অমনোযোগী। এই শিল্প চর্চার বিষয়টিতে অন্য অনেকের সঙ্গে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর রয়েছে পার্থক্য। তিনি প্রতিনিয়ত যে চর্চা করেন, তার প্রমাণ তার ক্রমবিকাশমান গদ্যশৈলী। কেবল কবিতা বা গল্পের ক্ষেত্রেই নয়, প্রবন্ধের ক্ষেত্রেও অভিধানের মৃত শব্দের শিলাস্তূপ থেকে শব্দ বাছাই করে নিয়ে একজন সৃষ্টিশীল প্রবন্ধকারকেও গদ্যদেহে প্রাণ সঞ্চার করতে হয়। সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী চলমান রাজনীতির বহুমুখী সত্যকে নিছক জ্ঞানের বিষয় না করে ভাবের সঙ্গে বিষয় মিশিয়ে রস সৃষ্টিতে সক্ষম। তার প্রবন্ধের গদ্যশৈলী কবিতার মতো অলংকার বহুল। চিন্তার সঙ্গে যুক্তি এবং সূ² অনুভবের সঙ্গে যুক্ত করে কৌতুক। ‘দুই বাঙালির লাহোর যাত্রা’ প্রবন্ধে পাকিস্তান প্রস্তাবের বিষয়টি লেখক এভাবে বর্ণনা করছেন, ‘হক সাহেবের প্রস্তাবটি তার নিজের ছিল না। ধারণা নয়, ভাষাও নয়, সবই মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর। মঞ্চে ওঠার আগে প্রস্তাবটি হক সাহেব দেখেনওনি, তিনি তৈরি প্রস্তাব পড়ে দিয়েছিলেন শুধু। বলা তাই সম্ভব যে তিনি এটি উপস্থাপন করেননি, তাকে দিয়ে উত্থাপন করিয়ে দেয়া হয়েছে, কণ্ঠ তার স্বর অন্যের।’ (নির্বাচিত রাজনৈতিক প্রবন্ধ : পৃ. ৪৪) এই গদ্য পাঠক চিত্তে যেমনি কৌতূহল সৃষ্টি করে তেমনি করে কৌতুক। অন্যদিকে ‘কণ্ঠ এবং স্বর‘ শব্দ দুটি গভীর ব্যঞ্জনা কবিতার মতো হয়ে ওঠে। লেখক গদ্যের শরীরের চিত্রকল্পের আবহ নির্মাণ করে কাব্যের কৌতুক রস পরিবেশনের ভেতর দিয়ে তীব্র শ্লেষ সৃষ্টিতেও দক্ষ। যেমন- ‘মুসলমান সমাজে মাকড়সার জাল বোনা অনেকটাই চলল; শাস্ত্র নিয়ে তর্ক হলো। পুঁথি সাহিত্যের চর্চা হলো। কিন্তু বুর্জোয়া বিকাশের উদার আলো তেমন দেখা গেল না।’ (বেকনের মৌমাছিরা : নির্বাচিত প্রবন্ধ : পৃ. ১৬২)।
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী যখন দূর বা নিকট অতীতের ইতিহাসের কথা লেখেন তখন তিনি নিছক তথ্য সন্ধানী ঐতিহাসিক ব্যক্তি হয়ে ওঠেন না। নিরাসক্ত ভাবে সমাজের চালচিত্রও রূপায়ন করেন না। নিষ্পাপ দর্শকের মতো কেবল চোখ ভরে দেখেই যান না। ক্ষুধাতুরের মতো শুধু ইতিহাসের আস্বাদ গ্রহণ করেন না। তিনি ঘটনা বা তার কার্যকারণের ওপর আলোকসম্পাৎ করে পাঠককে নিজের বোধের অংশীদার করে নেন। যেমন- ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনের কথা তিনি এভাবে বাণীবন্ধন করেন, ‘আমি উৎপাটিত নই, আমি বেড়ে উঠবো বৃক্ষের মতো, শেকড় প্রোথিত থাকবে ইতিহাস ও ঐতিহ্যের ভূমিতে, আকাক্সক্ষা ছিল এটাও।’ (বায়ান্নর আন্দোলন : নিঃরাজনৈতিক পৃ. ৪১)। গদ্যের এই বাণীভঙ্গিটি আবেগাত্মক অথচ প্রত্যয় দৃঢ় বাণীর মিশ্রণে তৈরি হয়েছে। পাঠকের স্বপ্ন ও উত্তেজনা সত্তার সঙ্গে একাকার হয়ে যায় এই কারণে, বিষয়বস্তুর সঙ্গে লেখকের ব্যক্তিত্বও মিশে একাকার হয়ে গেছে। রচনার সঙ্গে লেখক ব্যক্তিত্বের মেলবন্ধনের বিষয়টি সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর প্রতিটি প্রবন্ধে ছড়িয়ে আছে। ‘লেনিন কেন জরুরী’ প্রবন্ধে তাকে পাওয়া যায় কী অসীম বিশ্বাসে দৃঢ়। সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের বিপর্যয় লেখক চিত্তে ক্ষোভ-দুঃখ সৃষ্টি হয় কিন্তু আপন বিশ্বাসকে, ব্যক্তিত্বকে বিপর্যয়ে ঠেলে দেন না তিনি। তিনি লিখলেন, ‘যতদিন পৃথিবীতে শোষণ থাকবে ততদিন তিনি থাকবেন। মূর্তি ভাঙলেও তিনি অমর হয়ে রইবেন।…পৃথিবী যদি শোষণশূন্য হয় কখনো, লেনিন তখনো থাকবেন। তখন থাকবেন ইতিহাসের অন্তর্গত হয়ে।’ (নির্বাচিত প্রবন্ধ: পৃ. ২৭৬)। বাক্যটিতে বা অনুচ্ছেদটিতে কোথাও আবেগের উচ্ছ¡াস নেই, নাটকীয় বাণীবিন্যাসও নেই, রোমান্টিক অলীক স্বপ্নও নেই। আছে বিশ্ব বাস্তবতার সামনে দাঁড়িয়ে দূরদর্শী মানুষের চূড়ান্ত ব্যক্তিত্বের হিসাব। এই ব্যক্তিত্বই সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীকে দাঁড় করিয়ে দেয় তার শিল্প মানসে।
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর গদ্যের মধ্যে যে শব্দ ব্যঞ্জনা, সেখানে তার শিল্পের বহুমাত্রিকতা ধরা পড়ে। ‘বামদের পারা না-পারা’ প্রবন্ধে তিনি এভাবেই সাজান তার বাক্যকে অসাধারণ শব্দ ব্যঞ্চনায়, ‘উপমহাদেশের বিজ্ঞান তেমন এগোতে পারেনি। যন্ত্র এসেছে বিজ্ঞান ততটা আসেনি। তার কারণ গভীরভাবে প্রোথিত ভাববাদ।’ (বায়ান্নর আন্দোলন : নিঃরাজনৈতিক পৃ. ৯৯)। বাক্যস্থিত ‘যন্ত্র’ এবং ‘বিজ্ঞান’ শব্দ দুটির বহুমাত্রিক ব্যঞ্জনা পাঠককে গভীর তাৎপর্যের দিকে টেনে নিয়ে যায়। ‘যন্ত্র’ আর্থিক উন্নয়ন ঘটায় আর ‘বিজ্ঞান’ ঘটায় আত্মার উন্নতি। ছোট একটি বাক্য এবং ক্ষুদ্র দুটি শব্দ মিলে লেখক যেভাবে ব্যঞ্জনা সৃষ্টি করেন তা কেবল তার শিল্প মেধারই পরিচয় নয়, গভীর জীবন ও সমাজ প্রজ্ঞারও পরিচয়। লেখকের শিল্পের মাধ্যম এই নিজস্ব গদ্য স্টাইলটি ছড়িয়ে আছে তার অপরাপর রাজনৈতিক ধারার প্রবন্ধে। ‘বাঙালিকে কে বাঁচাবে’, ‘দ্বিজাতিতত্ত্বের সত্যমিথ্যা’, ‘জাতীয়তাবাদের স্বভাব চরিত্র’, ‘বাইরে বুর্জোয়া ভেতরে সামন্ত’, ‘সালচল্লিশের স্বাধীনতা’ ইত্যাদি অসংখ্য প্রবন্ধের শিল্প-পোশাক এই গদ্যশৈলী। প্রবন্ধের শিরোনাম নির্বাচনেও লেখককে পাই আমরা অলংকার শাস্ত্রের ঋদ্ধ শিল্পী হিসেবে। ‘স্বাধীনতার স্বপ্ন, সাম্যের ভয়’, ‘নোরা, তুমি যাবে কোথায়’ বা ‘বেকনের মৌমাছির’। প্রবন্ধের এ ধরনের কাব্যিক নামকরণ অবশ্যই বাংলা প্রবন্ধ সাহিত্যের নতুন মাত্রা। রচনার স্টাইল রচয়িতার মানস ব্যক্তিত্বের পরিচায়ক। সেই ব্যক্তিত্বের কারণেই রচনা হয়ে ওঠে ব্যাকরণ শুদ্ধ, ভাষায় গভীর, বুদ্ধিতে সূ², চিন্তায় পরিচ্ছন্ন, প্রকাশভঙ্গিতে স্নিগ্ধ। সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর রাজনৈতিক ধারার গদ্যের ভাষাটি তার অর্জিত ব্যক্তিত্বেরই প্রতিফলন। সেই ব্যক্তিত্বের কারণেই তিনি তার গদ্যের নির্মাণক্ষেত্রে কারিগরি বিদ্যাটি অর্জন করেছেন। তাই তিনি রাষ্ট্র আর সমাজকে নিজস্ব যে কৌশলে পর্যবেক্ষণ করেন, পাঠককেও দেখবার আর বুঝবার সেই ভঙ্গিটি শিখিয়ে দেন। বস্তুনিষ্ঠ প্রবন্ধকারদের মতো তিনি অর্জিত পাণ্ডিত্য, মেধা, জ্ঞান নিয়ে জনগণের শ্রদ্ধা আর ভক্তির পাত্র সেজে আত্মজ্ঞানের প্রচারক হয়ে নিজেকে অসামান্য করে জনগণের সঙ্গে দূরত্ব সৃষ্টি করতে পারেন না। অন্যদিকে ভাবনিষ্ঠ প্রবন্ধকারদের মতো লঘুকল্পনা আর হাস্যরসের রসিকজনও সাজেন না। উভয়ের সংমিশ্রণে তিনি হয়ে ওঠেন আপন ব্যক্তিত্বের ভেতর দিয়ে সৃষ্টিশীল গদ্যের রূপকার। পাঠকের একেবারে চেনা মানুষ। আপন মানুষ। বুর্জোয়া নন, উদারবাদী বুর্জোয়া নন; সামাজিক ন্যায় ও ঔচিত্যবোধের ব্যক্তিত্বসম্পন্ন অতি কাছের মানুষ। ২৩ জুন প্রিয় এই ব্যক্তিত্বের ৮৮তম জন্মবার্ষিকীতে মর্মান্তিক দেশভাগের হতভাগ্য শিকার আমি। ভিনদেশের নাগরিক হয়েও স্বদেশ ভুবনের পিছুটান এড়ানো সম্ভব হয়নি। হয়তো হবেও না আমৃত্যু। শ্রদ্ধেয় স্যারকে জন্মদিনে জানাই অফুরান শ্রদ্ধা-ভালোবাসা।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়