শিশুশ্রম নিরসনে সমন্বিত পদক্ষেপের আহ্বান

আগের সংবাদ

ভারত-আমেরিকার বৈচিত্র্যময় অংশীদারত্ব গড়ার প্রত্যয় : হোয়াইট হাউসে মোদি-বাইডেন বৈঠক শেষে যৌথ ঘোষণা

পরের সংবাদ

মধুসূদন মনন

প্রকাশিত: জুন ২৩, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জুন ২৩, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

শৈশবে-অর্জিত কৃষ্টি-সত্য-বঙ্গ-ভারতবর্ষীয় ঐতিহ্য-জ্যোতি, মানবিক জীবন-শিল্পায়ত যোজনা মধুসূদনের মননে সংহত হলেও প্রতীচ্যের ‘অ্যালবিয়ন’-এর অর্থাৎ গ্রেট ব্রিটেনের ইহকালিক সুষমা তথা বিশ্ববীক্ষার ওজস্বী সংবৃতি মাইকেল মধুসূদন দত্তের সৃজন-সত্তাকে অলঙ্কৃত করেছিল। উল্লেখ্য, সনাতনী রামায়ণ-মহাভারতের ধর্মসত্য আহরণ- কৃষ্টিপোষক মাতা জাহ্নবী দেবীর যতœময় তত্ত্বাবধান (ঐ, পৃ. ৬), কলকাতার হিন্দু কলেজে (১৮৩৭-৪৩ খ্রি.-এর ৯ ফেব্রুয়ারিতে খ্রিস্টধর্ম-গ্রহণ পর্যন্ত) অর্জিত ‘মানবমন্ত্র’ (ঐ)- অভিষেক, বিশপ্স কলেজে শিক্ষাকাল (১৮৪৪-৪৭ খ্রি.)-এ ‘ক্লাসিক রুচি, শিল্পচেতনা ও বহুভাষাশিক্ষার প্রেরণা’ (ঐ) তার বুদ্ধিজৈবনিক সত্তাকে করে তুলেছিল জগজ্জ্যোতির্ময়। তবে ‘খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ, হস্টেলে থাকা, বাবার পুনর্বিবাহ, লেখাপড়ার খরচ বন্ধ করে দেওয়া- পরপর অনেক তিক্ত ঘটনা’ [গোলাম মুরশিদ, আশার ছলনে ভুলি : মাইকেল জীবনী, প্রথম সংস্করণ (দ্বিতীয় মুদ্রণ), ২০০৮ খ্রি., পৃ. ১৪৪] মধুসূদনের অন্তরাত্মাকে কষ্টদীর্ণ করেছিল!
উল্লেখ্য, বিশ্ব-প্রজ্ঞা-সঞ্জীবিত তৃষ্ণা-ধারক বিদ্রোহী মধুসূদন ‘পারিবারিকভাবে আয়োজিত বিবাহকে এড়িয়ে মরিয়া হয়ে খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করেছিলেন।’ (দ্র, ঐ, পৃ., ৯০) নিজের ধর্মান্তরের মুহূর্তে পরম-প্রশান্তি-তৃষ্ণার্ত ‘মাইকেল মধুসূদন দত্ত’ গাইবার জন্যে নি¤েœাক্ত ‘হীম’ (ঐুসহ)-টি রচনা করেন :
খড়হম ংঁহশ রহ ংঁঢ়বৎংঃরঃরড়হদং হরমযঃ,
ইু ংরহ ধহফ ংধঃধহ ফৎরাবহ,-
ও ংধি হড়ঃ,- পধৎবফ হড়ঃ ভড়ৎ ঃযব ষরমযঃ
ঞযধঃ ষবধফং ঃযব নষরহফ ঃড় ঐবধাবহ.
*
ও ংধঃ রহ ফধৎশহবংং, জবধংড়হ’ং বুব
ডধং ংযঁঃ,- ধিং পষড়ংবফ রহ সব;-
ও যধংঃবহবফ ঃড় ঊঃবৎহরঃু
ঙ’বৎ ঊৎৎড়ৎং ফৎবধফভঁষ ংবব..
*
ও’াব নৎড়শবহ অভভবপঃরড়হ’ং ঃৎবহফবৎবংঃ ঃরবং
ঋড়ৎ সু নষবংঃ ঝধারড়ঁৎ’ং ংধশব;-
অষষ, ধষষ ও ষড়াব নবহবধঃয ঃযব ংশরবং,
খড়ৎফ ! ও ভড়ৎ ঞযবব ভড়ৎংধশব! [ইবহমধষ ঐঁৎশধৎঁ, ১৩ ঋবনৎঁধৎু, ১৮৪৩, নগেন্দ্রনাথ সোম, মধু-স্মৃতি,
প্রথম বিদ্যোদয় সংস্করণ ; কলকাতা : বিদ্যোদয় লাইব্রেরি, ১৯৮৯, পৃ., ২৫
মূলত ‘হিন্দু সভ্যতার অবক্ষয় এবং ঐতিহ্যসর্বস্বতার তুলনায় খ্রিস্টধর্মের ঔদার্য এবং খ্রিস্টীয়-ইউরোপের আধুনিকতা তার মন এবং মননশীলতাকে উদ্বুদ্ধ করেছিল’ (গোলাম মুরশিদ, পূর্বোক্ত, পৃ. ১৪১)।

এক.
বোধায়ত সত্য : তারুণ্য-সম্ভূতি প্রিয়-প্রিয়ার দ্বৈত-অদ্বৈত-সংবেদনার ফাগুনকেই পুষ্ট করে। কৈশোর ও তারুণ্যে মধুসূদনেরও বাসনাজুড়ে ছিল ইউরোপীয় ললনার সোহাগ-সুমিত তৃষ্ণার আলপনা, ছিল ‘উচ্ছ¡াস ও গীতলতার প্রাচুর্য’ (ঐ, পৃ. ৪৬)! তার কবিতা-রূপমা :
ও ষড়াবফ ধ সধরফ, ধ নষঁব বুবফ সধরফ
অং ভধৎ ধ সধরফ পধহ ব’বৎ নব, ঙ
ইঁঃ ংযব, ড়ভঃ রিঃয ফরংফধরহ ৎবঢ়ধরফ
গু ভড়হফহবংং ধহফ ধভভবপঃরড়হ ঙ.
ঋড়ৎ যবৎ ও ংরমযবফ ধহফ ধহফ ব’বৎ ংযধষষ ংরময
ঞযড় ংযব ংযধষষ হব’বৎ নব সরহব, ঙ.
ঋড়ৎ ঃযরং ংধফ যবধৎঃ’ং ংঃধৎষবংং ংশু
ঘড়হব নঁঃ যবৎংবষভ পধহ ষরমযঃ, ঙ. [ চড়বসং ১৯, মাইকেল মধুসূদন দত্ত রচনাসমগ্র তপন রুদ্র সংকলিত ও সম্পাদিত, পৃ. ৩৮৩]
তবু তিনি ছিলেন স্বদেশ-প্রেম-সমুদ্ভাসিত এক মহাপ্রাণ! তার মনন-সন্দীপনায় পশ্চিম-মুগ্ধতা আর স্বদেশ-প্রোজ্জ্বল সংস্কার-মুক্ত অনুভাবনার যুগপৎ প্রবর্তনাই সুসংহত হয়েছিল। ব্যক্তিক-পারিবারিক কষ্টাশ্রয়কে অতিক্রম করে মধুসূদন তার চিরায়ত শিল্পায়োজনকে প্রগাঢ় করেছিলেন।

দুই.
তারুণ্য-প্রভুত্বধারণকারী মধুসূদন ১৮ জানুয়ারি, ১৮৪৮ খ্রি.-এ মাদ্রাজে গমন করেন। মনন-সংগঠনার প্রগাঢ়-প্রসন্নতায় প্রাণময় হয়ে ওঠেন তিনি। ১৯৫৬ খ্রি. পর্যন্ত অবস্থান করেন ঐ পরিসরে। শিক্ষক, সাংবাদিক ও কবি-রূপমায় তিনি হয়ে ওঠেন ঐশ্বর্য-সন্দীপ্ত। বিদ্যাবিভূষিত জনমণ্ডলীর প্রাণায়তন স্পর্শ করে তার সৃজন-বৃত্ত। ১৮৪৮ খ্রি.-এ তিনি পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হন রেবেকা ম্যাকট্যাভিশের (জন্ম : ১৮৩১ খ্রি. মৃত্যু : ২২ জুলাই, ১৮৯২ খ্রি.) সাথে। ‘দীর্ঘ প্রতীক্ষা-শেষে একজন রক্তমাংসের শ্বেতাঙ্গিনীকে পেয়ে তরুণ কবির কবিত্ব এবং প্রেম উভয়ই দ্রুত উথলে উঠেছিল।’ (ঐ, পৃ. ১০২)
দাম্পত্যজীবনে মধুময় অভিব্যক্তি প্রকাশিত হয তার এই সময়ে (১৮৪৮ খ্রি.-এর আগস্ট-সেপ্টেম্বর) লিখিত কবিতায়। উল্লেখ্য, ঞরসড়ঃযু চবহঢ়ড়বস নামে গধফৎধং ঈরৎপঁষধঃড়ৎ পত্রিকায় তার চারটি প্রেমের কবিতা প্রকাশিত হয়। (পত্রিকা থেকে সংগ্রহ করে এই কবিতাগুলো প্রথমে প্রকাশ করেন নগেন্দ্রনাথ সোম) ‘মেইল অরফান অ্যাসাইলাম’-এ পঞ্চাশ টাকারও কম বেতনের অতি কষ্টের চাকরি করা- ‘কবিতায় সাংসারিক অভাবকে গ্রাহ্য না করা, আর গর্ভবতী স্ত্রীকে নিয়ে ঘর করা’(ঐ) এক কথা ছিল না। ১৮৪৮ খ্রি.-এর ৩০ আগস্টের পর মধুসূদনের জীবনে বেদনার্ত আর একটি পরিবর্তন দৃশ্যদীপ্ত হয়। অহঃযধবঁস পত্রিকার মন্তব্য-সূত্রে জানা যায় যে, ‘মাদ্রাজ স্কুল’-এ চাকরি নেবার পর মধুসূদন তার সহকর্মী জর্জ হোয়াইটের মাতৃহারা তিন সন্তানের প্রতি ‘সহানুভূতিশীল’ হয়ে পড়েন। কারণ হোয়াইট স্ত্রীর মৃত্যুর পর পরিণয়-সূত্রে আবদ্ধ হন ষোলো বছর বয়সি এক কিশোরীকে। উল্লেখ্য, ঐ তিন সন্তানেরই অন্যতম ছিলেন হেনরিয়েটা (জন্ম : ১৯ মার্চ, ১৮৩৬ খ্রি.)। হেনরিয়েটার প্রতি মধুসূদনের সহানুভূতিই ক্রমান্বয়ে পর্যবসিত হয় প্রণয়ে। অনুসন্ধানে এ তথ্য উজ্জ্বল যে, হেনরিয়েটার সঙ্গে প্রেম এবং রেবেকার সঙ্গে দাম্পত্যজীবন-সংরক্ষণ সমান্তরালভাবেই গতিমান ছিল। দ্বৈত জীবন (ঐ, পৃ. ১৪৬)-আবহই ছিল দৃশ্যমান। তবে এক পর্যায়ে রেবেকা জ্ঞাত হন যে, তার প্রিয় মধু হেনরিয়েটার প্রণয়ে আত্মহারা! তিনি এই বিশ্বাসঘাতকতাকে মেনে নিতে পারেননি। অতঃপর তিনি আর ‘মাইকেলের সঙ্গে ঘর করতে রাজি হননি।’ (ঐ) ‘পক্ষীমাতার মতো দুই পাখার নিরাপত্তা দিয়ে রক্ষা করতে চেয়েছিলেন, তার অতো ত্যাগ স্বীকার সত্ত্বেও তাদের পারিবারিক জীবনের গতি স্বচ্ছন্দ হতে পারেনি !’ (দ্র., ঐ, পৃ. ১৪৭-১৪৮) হেনরিয়েটা যাতে কোনোদিনও যাতে তার মধুকে বিবাহ করতে সক্ষম না হন, হয়তো সে-কারণেই চার সন্তানের জননী রেবেকা বিবাহ-বিচ্ছেদে অনীহা প্রকাশ করেন। উল্লেখ্য, ‘অভিমানিনী নারী’ (ঐ, পৃ. ১৪৭) রেবেকা কিন্তু স্বজন ও বন্ধুদের অনীহা-সত্ত্বেও ‘কৃষ্ণাঙ্গ’ মধুসূদনকে আপন করেছিলেন।
মধুসূদন তবুও ছিলেন সাহিত্য-সৃজন-মনন-সম্পৃক্ততায় সন্দীপ্ত! ‘জীবনের নগ্ন বাস্তবতার মধ্যে- অভাব আর অনটনের সঙ্গে লড়াই করে’ (ঐ, পৃ. ১০৩) তিনি রচনা করেন ঈধঢ়ঃরাব খধফরব (১৮৪৯) এবং ঠরংরড়হং ড়ভ ঃযব চধংঃ– ধ ঋৎধমসবহঃ (১৮৪৯). ঈধঢ়ঃরাব খধফরব-র ভাষা, ছন্দ ও উপমা-অলঙ্কার বস্তুতই সদ্বৃবহৃত। অবশ্য সমালোচক ডিঙ্কওয়াটার বেথুন উল্লেখ করেছিলেন যে, তিনি যদি ইংরেজি-চর্চার মাধ্যমে যে ‘রুচি ও মেধা’ অর্জন করেছেন, তা যদি তার নিজের ভাষার মানোন্নয়ন এবং কাব্যভাণ্ডার সমৃদ্ধ করার কাজে ব্যয় করেন, তাহলে দেশের অনেক বেশি সেবা করতে পারবেন। (ঐ, পৃ. ১১৮) পরবর্তীতে ‘মিল্টন ও কালিদাসের সাথে তার তুলনা শুনে তিনি হয়ে ওঠেন আত্মবিশ্বাসী’ (ঐ, পৃ., ১১৯)। জরুরধ : ঊসঢ়ৎবংং ড়ভ ওহফব কাব্যনাট্যে (১৮৫০ খ্রি.-এর ১২ জানুয়ারি মোট ন’টি দৃশ্য প্রকাশিত হয়) তিনি প্রণয়কাহিনী- ‘মানবিক আগ্রহের কাহিনী’ (ঐ, পৃ. ১২৪)-র বিস্তারণ ঘটিয়েছেন হিন্দু-মুসলিম-গ্রিক পুরাণের আশ্রয়ে।

তিন.
মাদ্রাজ-পর্ব অতিক্রম করে দীর্ঘদিনের জন্যে কলকাতায় অবস্থান-প্রত্যাশী (দ্র., ঐ, পৃ. ১৪৬) মধুসূদন ১৮৫৬ খ্রি.-এ ২ ফেব্রুয়ারি কলকাতার বিশপ্স কলেজে সমুপস্থিত হন।
মধুসূদনের মনন-দর্পণ-সম্পর্কিত সম্বুদ্ধ সমালোচনা : স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক ব্যবহারে কোনটা বিবেচনা এবং কোনটা অবিবেচনা, বলা শক্ত। কারণ আন্তরিক প্রণয় থেকেও মানুষ মানুষকে নিষ্ঠুরতম আঘাত দিতে পারে। সুতরাং কেবল রেবেকাকে ত্যাগ করলে তার একটা ব্যাখ্যা দেয়া সম্ভব হতো। কিন্তু চার-চারটি অপোগণ্ড অসহায় সন্তানকে তিনি কোন বিবেচনায় চিরদিনের জন্যে ত্যাগ করেছিলেন, তা বোঝা মুসকিল। তিনি এদের জন্যে এক গাদা টাকাকড়িও রেখে আসেননি। কারণ ২০ ডিসেম্বর, ১৮৫৫ খ্রি.-এর চিঠিতে তিনি নিজেকে একটা ‘ঢ়ড়ড়ৎ ফবারষ’ বলে আখ্যায়িত করেছেন..(উদ্ধৃত : ঐ, পৃ. ১৪৭)
কলকাতার সৃজনপর্বে মধুসূদন হয়ে ওঠেন ‘ঐহিক জীবনবাদ ও পুরুষকারের বিঘোষিত মহিমার প্রতিমূর্তি’। (আহমদ শরীফ রচনাবলি-১, সম্পাদক : আহমদ কবির, প্রথম প্রকাশ-দ্বিতীয় মুদ্রণ; ঢাকা : আগামী প্রকাশনী, ২০১০ খ্রি., পৃ. ১৬৭) তিনিই ‘বাংলার সমাজে ও সাহিত্যে, মননে ও মেজাজে প্রথম সার্থক বিদ্রোহী ও বিপ্লবী, পথিকৃৎ ও যুগ¯্রষ্টা’ (ঐ, পৃ. ১৭১)।
অমিত্রাক্ষর ছন্দের রূপমাধুরী- ‘রেনেসান্সের মানবিকতার প্রতিফলন’ (গোলাম মুরশিদ, পূর্বোক্ত, পৃ. ২৬১) ‘তিলোত্তমা সম্ভব কাব্য (১৮৬০ খ্রি.)’ ‘চিত্তোত্থিত দ্ব›দ্ব-সংশয়’ (আহমদ শরীফ রচনাবলি-১, পৃ. ১৬৯)-অতিক্রমী অন্তর্লোকের রূপমূর্তি। ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ (১৮৬১ খ্রি.)-এ ‘সিপাহী বিপ্লবের পর যে-নতুন জাতীয়তাবাদী চেতনা জন্ম নিচ্ছিল, রাম-রাবণের সংঘর্ষ দিয়ে কবি সেটাকেই প্রতিফলিত করতে চেয়েছিলেন এবং এ ক্ষেত্রে তার আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি স্বভাবতই রামের বদলে রাবণের পক্ষ নিয়েছে।’ [ড. জধফরপব, দদঢবহড়ঢ়যরষরধ ধহফ ীবহড়ঢ়যড়নরধ : গরপযধবষ গধফযঁংঁফধহ উধঃঃধ’ং গবমযহধফ-নধফয কধনুধ’’ রহ জ. ঝহবষষ ধহফ ও.গ.চ. জধবংরফব(বফং.), ঈষধংংরপং ড়ভ গড়ফবৎহ ঝড়ঁঃয অংরধহ খরঃবৎধঃঁৎব. ঐধৎৎধংংড়রিঃু ঠবষধম : ডরবংনধফবহ, ১৯৯৮. উদ্ধৃত : গোলাম মুরশিদ, পূর্বোক্ত] ‘ব্রজাঙ্গনা কাব্য’(১৮৬১ খ্রি.)-এ মধুসূদনের ব্রজাঙ্গনা তার ‘বিরহবোধের উপাদান খুঁজছে প্রকৃতিতে- অন্তরে নয়।’ (আহমদ শরীফ রচনাবলী-১, পৃ. ঐ) ‘বীরাঙ্গনা কাব্য’ (১৮৬২ খ্রি.)-এ ‘প্রকৃতি-চালিত ঋজু ও অসংকোচ-বাসনার প্রকাশই অভিনন্দিত হয়েছে ভোগলিপ্সু কবির কাছে।’(ঐ)
মধুসূদনের প্রথম বাংলা রচনা ‘শর্মিষ্ঠা’ (১৮৫৯ খ্রি.) নাটকের কাহিনীটি মহাভারত মহাকাব্যের আদিপর্ব থেকে আহরিত। মধুসূদনের ব্যক্তিজীবনের চিত্রদীপ্তি প্রকটিত এ নাটকে। নাট্যচরিত্র যযাতির সঙ্গে দেবযানী ও শর্মিষ্ঠার যেমন নৃতাত্ত্বিক পার্থক্য রয়েছে, তেমনি ‘মাইকেলের সঙ্গে রয়েছে রেবেকা ও হেনরিয়েটার নৃতাত্ত্বিক পার্থক্য’ (দ্র.: গোলাম মুরশিদ, পূর্বোক্ত, পৃ., ১৫৯)। নাটকের আঙ্গিক এবং ভাবধারায় পাশ্চাত্য প্রভাব লক্ষ্যিত। নাটকের চিরন্তন প্রেম-ত্রিভুজের প্রামাণ্যই কবির ব্যক্তি-জীবন ও নাট্যায়োজন!
মধুসূদন ‘পদ্মাবতী’ (১৮৬০ খ্রি.) নাটকের কাহিনী-সৃষ্টি, চরিত্র-নির্মাণ, সংলাপ-সংরচনা তথা নাট্য-পরিবেশ-সৃষ্টিতে কৃতিত্ব অর্জন করেছেন। ‘তিনি গ্রিক পুরাণের স্বর্ণ আপেলের কাহিনী দেশীয় দেবদেবীর নাম দিয়ে দেশীয় চেহারায় চালিয়ে দিয়েছিলেন।’ (ঐ, পৃ ১৬৯) তাতে তার মনন-সম্ভুষিত ‘বিদেশি রুচি তৃপ্ত হয়’। (ঐ) ‘একেই কি বলে সভ্যতা?’ (১৮৬০ খ্রি.) ও ‘বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ’ (১৮৬০ খ্রি.) প্রহসন দুটিতে মধুসূদন বৃহত্তর হিন্দু সমাজের অভ্যন্তরীণ নষ্টামি আর ভণ্ডামির স্বরূপ-উন্মোচন করেন। ‘নির্ভেজাল হাসির মাধ্যমে তিনি একই সঙ্গে কশাঘাত করলেন অত্যাধুনিক নব্যশিক্ষিতদের আর ধর্মের নামে যারা ভণ্ডামি করতো, সেই রক্ষণশীলদের।’ (ঐ, পৃ. ১৭১ খ্রি.) শিলাপানুগ এ প্রক্রিয়াটি ছিল মধুসূদনের মনন-সম্পাতের এক বিশ্বস্ত প্রামাণ্য! তার ধ্যানে ও মননে ছিল সমাজ-সন্দর্শনের ওজস্বী অভিজ্ঞতা।
মধুসূদন ‘কৃষ্ণকুমারী’ (১৮৬১ খ্রি.) নাটকের কাহিনীটির মূল কাঠামো ঔ.ঞড়ফ-এর ঞযব অহহধষং ধহফ অহঃরয়ঁরঃরবং ড়ভ জধলধংঃযধহ(ঢ়ঢ়. ৪৬১-৬৫) থেকে গ্রহণ করলেও তা ছিল তার ‘নিজেরই রচনা’। এ নাটকে তিনি ‘সূ² মানবিক সম্পর্কের টানাপড়েনকে অসীম সহানুভূতির সঙ্গে অঙ্কন করেছেন রাজনীতির পটভূমিতে।’(ঐ, পৃ. ১৯১) অবশ্য তার সৃজনশৈলীতে সমুদ্দীপ্ত ছিল শেক্সপীয়রীয় শিল্প-প্রজ্ঞার আবহ।
‘চতুর্দশপদী কবিতাবলি’তে (১৮৬৬ খ্রি.) সম্ভুষিত হয়েছিল মধুসূদনের ‘মানস-ভ্রমণের বৈচিত্র্য’। [মাইকেল মধুসূদন দত্ত রচনাসমগ্র (তপন রুদ্র সংকলিত ও সম্পাদিত, পূর্বোক্ত, পৃ. ৯) ‘মনে-প্রাণে রোম্যান্টিক হওয়া সত্ত্বেও তিনি সারাক্ষণ চর্চা করতেন ধ্রæপদী ভাষা এবং সাহিত্য।’ (গোলাম মুরশিদ, পূর্বোক্ত, পৃ. ২৬১) ইতালিয়ান পণ্ডিত-কবি পেত্রার্কার ‘সনেট’-এর শিল্প-সৌকুমার্যকে আত্মঃস্থ করেছিলেন তিনি। ‘চতুর্দশপদী কবিতাবলী’-তে কবির ‘নস্টালজিক স্মৃতি’ (ঐ, পৃ. ২৬২) এবং ‘স্বদেশের মাটি-মানুষ’(ঐ)-ও শিল্প-জ্যোতির্ময়-স্বরূপ্য লাভ করেছে। মধুসূদনের অসমাপ্ত গদ্যরচনা ‘হেকটর-বধ’ (প্রকাশকাল : ১৮৭১ খ্রি.)। এটি ছিল মহাকবি হোমারের ‘ইলিয়ড’ কাব্যের কাহিনীকে সংক্ষিপ্তভাবে বাংলাভাষায় রূপান্তরিত করার প্রয়াস। মধুসূদনের মনন-পরিকল্পনায় উচ্ছ¡সিত হয়েছিল প্রাচ্য-প্রতীচ্যের মহাকাব্যিক মানবিক ঐশ্বর্যের পারাবত-শুদ্ধি! তার উদ্দেশ্য ছিল ‘কবিপিতা (হোমার)-র ‘মহত্ত্ব ও দেবোপম শক্তি’ [মাইকেল মধুসূদন দত্ত রচনাসমগ্র (তপন রুদ্র সংকলিত ও সম্পাদিত, পূর্বোক্ত, পৃ. ১০)-সমন্বিত অলঙ্কৃত সঞ্চয়কে মাতৃভাষা বাংলায় সৌন্দর্য-সংহত করা।
‘মায়াকানন’ (প্রকাশকাল : ১৮৭৪ খ্রি.) নাটক-প্রণয়নে কবি মুক্ত-মনস্বিতা-সমৃদ্ধ শব্দ-প্রয়োগ ও মৌখিক বাক্যরীতিকেই ধারণ করেছিলেন। জীর্ণ দেহে সংসার-পরিপালনে অশক্ত হয়ে শ্রম-সম্মানীর বিনিময়ে তিনি রচনা করেন এ নাটক। এ-সময়ে এ প্রক্রিয়ায় তিনি শিশুপাঠ্য অনেক কবিতাও রচনা করেছিলেন।

চার.
উল্লেখ্য, মধুসূদন ১৮৬২ খ্রি.-এর ৯ জুন বিলেতে গমন করেন আইনশাস্ত্র-অধ্যয়নের উদ্দেশ্যে। ‘ক্যান্ডিয়া’ (গোলাম মুরশিদ, পূর্বোক্ত, পৃ. ২৩০) জাহাজে চড়ে ১২ জুন মাদ্রাজ-অতিক্রম করেন তিনি। সেদিন রেবেকা আর চার সন্তান কি তার মনন-বৃত্তকে অস্থির এবং ক্রন্দনসিক্ত করেনি? সমুচ্চ আশা আর অতিক্রমী প্রতিভা-সঞ্চয়নী শক্তি-ধারক মধুসূদন ১৬ জুলাই শনিবার সূর্য ওঠার পূর্বেই তিনি ‘সিলোন’ জাহাজে পৌঁছন সাউথ্যাম্পটন বন্দরে। দুপুরে ‘পৌঁছে যান তার স্বপ্নে-দেখা লন্ডন নগরীতে’ (ঐ, পৃ. ২৩২)।
লন্ডনে ‘চিরদিনের বেহিসেবী কবি’ (ঐ, পৃ. ২৩৯) অর্থ-সংকটে পড়েন মধুসূদন। মধুসূদনের সম্মতিতে ১৮৬৩ খ্রি.-এ হেনরিয়েটাও আর্থিক অনটনে বিপর্যস্ত হয়ে দুটি সন্তানকে নিয়ে লন্ডনের উদ্দেশে যাত্রা করেছিলেন। বিদ্যাসাগর ও শুভানুধ্যায়ীদের পরামর্শ ও অর্থ-আদায়ে সহায়তা লাভ করে (ঐ) হেনরিয়েটা মধুসূদনের নিকট পৌঁছান ১৮৬৩ খ্রি.-এর মে মাসে।
কলকাতা থেকে পৈতৃক বাড়ি-বিক্রয়ের টাকা-সহ অন্যান্য ‘পাওনা টাকা’ (ঐ, পৃ. ২৪০) যথাযথভাবে না পাওয়ায় ‘অ্যাডভেঞ্চারের মনোভাব’ (ঐ, পৃ. ২৪১)-পোষণকারী কবি ১৮৬৩ খ্রি.-এর ১৭ জুন ‘গ্রেজ ইন’-এর ‘ট্রিনিটি টার্ম’-এর লেখাপড়া শেষ করে লন্ডন থেকে ‘সম্পূর্ণ অজানা’(ঐ, পৃ. ২৪৩) ফ্রান্সের ভার্সাই শহরের দিকে ধাবিত হন। মুক্ত মনীষা-সঞ্জীবিত মধুসূদন ‘সম্ভবত তখনকার ইংরেজ সমাজের বর্ণবাদ’কে (দ্র. ঐ, পৃ. ২৪১) অন্তরায়ত করতে পারেননি। কিন্তু ভার্সাইতে তার জীবনের পরবর্তী আড়াই বছরে তিনি ‘কোনো কাজ পাননি।’ (ঐ, পৃ. ২৪৪) অবশ্য ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের আর্থিক প্রেমানুকূল্য লাভ করেছিলেন তিনি। অশন-বসন-অনটনক্লিষ্টতার ভারে পারিবারিকভাবে সুস্থিত না হতে পারলেও তিনি কিন্তু তার শিল্প-সৃজনী অভিপ্রায় এবং মননশীলতাকে নিঃশেষ করেননি! তিনি ফরাসি, ইতালীয় ও জার্মান ভাষায় নৈপুণ্য অর্জন করেন ভার্সাইতে অবস্থানকালেই।
মধুসূদন ১৮৬৫ খ্রি.-এ ব্যারিস্টারি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ১৮৬৭ খ্রি.-এ স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন পরিবারকে বিদেশে রেখে ‘স্বেচ্ছাকৃত’ (ঐ, পৃ. ১৯৭) ঋণের ভার নিয়ে। কলকাতায় শুরু করেন আইন-ব্যবসায়। ‘১৮৬৮ খ্রি.-এর মাঝামাঝি নাগাদ’ (ঐ, পৃ. ৩১০) ব্যারিস্টারিতে তিনি বেশি নাম করেন। কিন্তু ‘ভোগবাদী ভাবধারায় বর্ধিত কবির জীবনে আয় ও ব্যয়ের সমতা বিধান হতো না।’ (তপন রুদ্র সংকলিত ও সম্পাদিত, পূর্বোক্ত, পৃ. ৭) ১৮৬৯ খ্রি.-এর মে মাসের প্রথমার্ধে সন্তানদের নিয়ে কলকাতায় পৌঁছন হেনরিয়েটা। তিনি পর্যবেক্ষণ করেন- ‘প্রৌঢ়ত্ব’ (গোলাম মুরশিদ, পূর্বোক্ত, পৃ. ৩১৬) তার ৪৫ বছর বয়সি প্রাণোপম মানবকে আপাদমস্তক অধিকার করেছে! জীবনতৃষ্ণার্ত কবি কলকাতা হাইকোর্টের প্রিভি কাউন্সিল আপিলের অনুবাদ বিভাগে পরীক্ষকের চাকরি পান, পরে ১৮৭২ খ্রি.-এর মার্চের মাঝামাঝি মানভূমের পঞ্চকোট-রাজের ম্যানেজার হন। কিন্তু অবমাননাকর পরিস্থিতির শিকার হয়েই কলকাতায় ফেরেন তিনি। ‘অসুস্থ ও অশক্ত’ (তপন রুদ্র সংকলিত ও সম্পাদিত, পূর্বোক্ত, পৃ. ৯) কবির ঋণ ও পাওনাদারের প্রাপ্য ছিল ‘সেকালের মাপে প্রায় অবিশ্বাস্য- ৪২ হাজার টাকা।’ (গোলাম মুরশিদ, পূর্বোক্ত, পৃ. ৩২৯) হেনরিয়েটা মানসিক-শারীরিকভাবে ভেঙে পড়েন! বিবিধ পীড়া ভর করে মধুসূদনেরও শরীরী-সত্তায়! মুমূর্ষু অবস্থায় তাকে কলকাতার জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। অসুস্থ হেনরিয়েটা আদরভরা সন্তানদের শোকবিহ্বল করে তিনি মৃত্যুবরণ করেন ২৬ জুন, ১৮৭৩ খ্রি.-এ। আর ২৯ জুন মৃত্যু হয় প্রাণ-বিপ্লবী মধুসূদনের!
মধুসূদনের মতো ‘আত্মবিশ্বাসী, ভাষাবিদ, ধারালো বুদ্ধির লোক’ (ঐ, ৩০১) ৪৯ বছর বয়সেই তিনি শারীরিকভাবে নিঃশেষিত হন ‘অতিরিক্ত কারণবারি পান, অপরিমিত এবং অখাদ্য খেয়ে উচ্চ রক্তচাপ ও হৃদরোগ অর্জন করে’! (ঐ, পৃ. ৩০৩) সত্যিই ‘ইউরোপে জীবন উপভোগ করার ‘উন্নত’ দৃষ্টান্ত প্রত্যক্ষ করে’ (ঐ, পৃ. ৩০২), ‘জীবনের গভীর আস্বাদ নেবার জন্যে’ (ঐ, পৃ. ৩০৩)-ই ছিল তার এমন ব্যাকুল ও কষ্টদীর্ণ মনন-সাধনা! ‘বিষয়বুদ্ধি-বর্জিত’ (ঐ, পৃ. ৩২৯) অমিতব্যয়ী ও বেহিসেবী মধুসূদনের জীবন-বিন্যাস-সম্পর্কে সত্য-সন্নিভ প্রণিধান :
অব্যাহত আর্থিক অনটন নিয়ে তিনি যে সারাক্ষণ দুশ্চিন্তা করতেন, তাও তার স্বাস্থ্যের ওপর খারাপ ফল ফেলেছিল। জীবনে তিনি বিশ্রামও কম করেছেন। ক্বচিৎ যখন অবসর পেয়েছেন, তখন মগ্ন হয়েছেন অধ্যয়ন এবং সাহিত্যচর্চায়। চরম প্রতিকূল অবস্থায়ও তিনি… লেখাপড়ায় মনোযোগ দিতে পারতেন… (ঐ, পৃ. ৩০৩)
মহাকাব্যিক জীবন-শিল্পায়োজক মধুসূদন অর্ধশত বছর বয়স পূর্ণ হওয়ার পূর্বেই আত্মনির্বাপিত হন! শিল্পচৈতন্যময় যুগ-শ্রীমান সারথি- নিরুপম মননশীল জীবনশিল্পী মধুসূদন অকালপ্রয়াত হন বাংলা সাহিত্য-সমৃদ্ধির সমুদ্ভাসক-রূপময়! তবু তার ‘আশা’ ছিল অসীম! জীবনের ‘নেশা’ ছিল অনন্ত! তার গীতময় উচ্ছ¡াস :
জীবন-প্রবাহ বহি কাল-সিন্ধু পানে ধায়
ফিরাবো কেমনে?
দিন দিন আয়ুহীন, হীনবল দিন দিন,-
তবু এ আমার নেশা ছুটিলো না… এ কী দায়!…
যশোলাভলোভে আয়ু কতো যে ব্যয়িলি হায়,
কব তা কাহারে? (গীতিকবিতা, তপন রুদ্র সংকলিত ও সম্পাদিত, পূর্বোক্ত, পৃ. ১৬০)

মাইকেল মধুসূদন দত্ত ে ২৫ জানুয়ারি, ১৮২৪-২৯ জুন, ১৮৭৩

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়