শিশুশ্রম নিরসনে সমন্বিত পদক্ষেপের আহ্বান

আগের সংবাদ

ভারত-আমেরিকার বৈচিত্র্যময় অংশীদারত্ব গড়ার প্রত্যয় : হোয়াইট হাউসে মোদি-বাইডেন বৈঠক শেষে যৌথ ঘোষণা

পরের সংবাদ

ক্যাথলিন

প্রকাশিত: জুন ২৩, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জুন ২৩, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

সিঁড়ি দিয়ে নামতেই একটা কড়া ঘ্রাণ আমার নাকে ধাক্কা দিল। আমি চোখ বন্ধ করে ফেললাম। তারপিন তেলের সঙ্গে অন্য একটা কিছুর মিশ্রিত গন্ধ। সেই অন্য কিছুটা কী হতে পারে আমার নাক তা ঠাহর করতে পারছে না। আমি সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণের জন্য চোখ বন্ধ করলাম। উদ্দেশ্য সরল। চোখ বুজে দৃষ্টিশক্তি অনুপস্থিত হবে; আমার ঘ্রাণেন্দ্রিয় যদি আরেকটু সজাগ হয়। লাভ হলো না। আমি চোখ মেলে তাকালাম।
একটা অদ্ভুত চিন্তা আমার মাথায় খেলে গেল। এই গন্ধ মৃত্যুর। আমার কেন যেন মনে হলো এই বাড়িতে কেউ মারা গেছেন। এমন আজগুবি চিন্তা কেন মাথায় এলো এমন কথা ভাবতে ভাবতে আমি পরের সিঁড়িতে পা দেব।
পেছন থেকে ভদ্রমহিলা আমার কাঁধে হাত রাখলেন। বললেন সামনে খেয়াল করে নামতে। বেজমেন্টের দরজার কাছে ছাদ এক জায়গায় নিচু। মাথায় বাড়ি লাগবে।
আমি ঘুরে তাকে ধন্যবাদ দিলাম। উনি এই বাড়ির মালিক। সিঁড়ি দিয়ে নামতেই হাতের বাঁয়ে একটা লিভিং রুম। একপাশে একটা গোলটেবিল আর চারপাশে পিপে আকৃতির গোল চেয়ার। ক্যাথলিন বলল ওর বাবার নাকি ওয়াইনারি ছিল, সেখানে সেলারে এগুলো ভর্তি করে মদ রাখা হতো। ও যেহেতু টুকটাক ফার্নিচার বানাতে পারে, তাই নিয়ে এসে মাপ মতন কেটে এমন সুন্দর চেয়ার বানিয়েছে।
আমি মুগ্ধ হলাম। সেই ঘরে বেশ কিছু পেইন্টিং ঝোলানো। ব্যানফ ন্যাশনাল পার্কের নীল জল লেকের যেমন আঁকা ছবি আছে; তার পাশাপাশি চমৎকার কিছু অ্যাবস্ট্রাক্ট আছে। আমি একটা জিনিস লক্ষ করেছি, যারা সুন্দর অ্যাবস্ট্রাক্ট আঁকেন তাদের প্রাকৃতিক দৃশ্যের ছবি আমায় খুব একটা টানে না। ক্যাথলিন নিঃসন্দেহে সব্যসাচী। ওর আঁকা সব ছবি দেখেই আমি মুগ্ধ হচ্ছি।
এরপর একটা ছোট গেস্ট বেডরুম। জানালা ছোট হলেও দিনের বেলাতে আলোকিত দেখাচ্ছে। তারপরের ঘরটায় একটা সেলাই মেশিন রাখা। ক্রমাগত ক্যাথলিনের গুণপনার প্রমাণ পাচ্ছি আমি। তার পাশের ঘরটা কাঠের কাজ করার ঘর। একজন কাঠমিস্ত্রির যা লাগবে চেন থেকে শুরু করে সব আছে। তারপিনের গন্ধের উৎস একবার পরিষ্কার হলো। দিনের আলোতে রহস্য যেন জমাট বাঁধার সময় পায় না। সিঁড়ি দিয়ে নামতে অস্বস্তি তৈরি হয়েছিল তা খুব দ্রুত কেটে গেল।
আমি নিশ্চিত রাতের বেলা এমন ঘ্রাণ পেলে আমি নানারকম অর্থ বের করতাম। আলোতে যার পরিষ্কার উত্তর থাকে; আঁধার যেন তাই আমাদের চোখে ধোঁয়াশা করে দেখায়। আমরা কল্পনায় তার সঙ্গে আরও যোগ করে একটা অতিলৌকিক ব্যাখ্যা খোঁজার জন্য ব্যস্ত হয়ে যাই।
গতকাল রাতে আমাদের রিয়েল্টর বাড়ি দেখিয়েছেন। আমি ক্রমাগত খুঁত বের করে গেছি।
রান্নাঘর ছোট। ডাইনিং স্পেসের জায়গাটা খোলা নয়। মাস্টার বেডরুমের জানালাগুলো ছোট। ঘর দেখতে অদ্ভুত ধরনের অন্ধকার। পছন্দের মাঝে ব্যাকইয়ার্ড সুন্দর। তবে আমরা তো বাড়ির ভেতরে থাকব ব্যাকইয়ার্ডে নয়।
রান্না ঘরের দেয়ালটা ভেঙে ফেলা উচিত। আর এই ক্যাবিনেটে যে কুৎসিত জিনিসের মিউজিয়াম। এই পর্যায়ে রিয়েল্টর আমাকে বলল তুমি এই ভিন্টেজ এন্টিক জিনিসের কদর বুঝবে না।
আমি মনে মনে বললাম তুমি বুঝতে পারলেই হবে। এই বাড়ির মালিকের রুচির সঙ্গে তাল মেলাতে গেলে আমাকে টাইম মেশিনে চড়ে অতীতকালে যেতে হবে।
আমি হতাশ। আমার রিয়েল্টর হতাশ। এক পর্যায়ে আমি খাঁটি বাংলায় বললাম, ‘এই শহরে ভালোবাসা খুঁজে পাওয়ার চেয়ে ভালোবাসা খোঁজা কঠিন।’
হং, আমার রিয়েল্টর, আমার দিকে হতাশ চোখে তাকিয়ে রইলেন। একটু পরে মাতৃভাষায় কিছু একটা বললেন। আমার ধারণা তার অর্থ এ কোন পাগলের পাল্লায় পড়লাম।
মজার ব্যাপার হচ্ছে, গতকাল রাতে বাড়ি দেখতে এসে আমি যার রুচি নিয়ে এত নেতিবাচক কথা বলেছি বা ভেবেছি আজকে সেই ক্যাথলিন নিজেই আমাকে তার বাড়ি ঘুরিয়ে দেখাচ্ছে।
আমি ঠিক করলাম দিনের বেলা বাইরে থেকেই দেখব। ক্যাথলিন নামের ভদ্রমহিলা এক প্রকার জোর করেই আমাকে বাড়ির ভেতরে নিয়ে গেলেন। ড্রাইভে ওয়ের কাছাকাছি আমি দাঁড়িয়েছিলাম। এমন সময় দরজা খুলে বের হয়ে এলেন স্বর্ণকেশী ক্যাথলিন। জিজ্ঞেস করলেন, আমি বাড়ি কেনার ব্যাপারে আগ্রহী কিনা।
একটা ব্যাপার অবশ্য সত্য গতকাল রাতে অন্ধকারে বাসাটা যেমন ভূতুড়ে লেডি ম্যাকবেথের সেট মনে হচ্ছিল দিনের বেলাতে ঠিক তার বিপরীত চিত্র। প্রথম দিনে ঢুকতেই যে জায়গাতে নকল মানিপ্লান্ট গাছ দেখে আমার সস্তা মনে হয়েছিল; আজ সেখানে নরম রোদ অপূর্ব এক নকশা তৈরি করেছে। আমি ভাবলাম গ্রিক স্থাপত্যের মতো যেখানে থাম উঠে গেছে লিভিং রুমের কোনায়, ঠিক সেখানে রাখা হবে বাগানবিলাস গাছ। ঢুকতেই ঝাড়বাতির উল্টো পাশে যে একটা তাক আছে, ঐখানে নকল মানিপ্লান্টের বদলে আসল মানিপ্লান্ট রাখা যাবে। মানিপ্লান্ট গাছের আসল নাম হচ্ছে ডেভিলস আইভি।
আমি বলেই ফেললাম, ‘তুমি জানো ক্যাথলিন এই ডেভিলস আইভি নামক বিশ্রী নামটা কেন রেখেছে?’
ক্যাথলিন বলল, ‘প্রকৃতি নানারকম রহস্য লুকিয়ে রাখে। এই আপাত নিরীহ দর্শন গাছ বিষাক্ত। মানুষের জন্য বিষাক্ত নয়, তবে বিড়াল এই গাছের পাতা খেলে বিষক্রিয়া হবে। এটা একটা কারণ হতে পারে।’
‘হতে পারে। প্রকৃতি সব রহস্য উন্মোচন করার জন্য রাখেনি।’
‘তুমি একটা অদ্ভুত কথা জানো? আমরা যে সবুজ শাক খেতে চাই না, এর কারণ আমাদের জিনে বহন করা পূর্ব-পুরুষদের স্মৃতি। মানুষ যখন গুহাতে বাস করত, তারা তো শিকার করে খাদ্যের জোগাড় করত। শিশুদের রেখে যেত নিরাপদ আশ্রয়ে। যদি কোনো গুল্ম লতা বিষাক্ত হয়, তা যদি সন্তান খেয়ে ফেলে এই আশঙ্কা তাদের মনেও কাজ করত। শিশুদের তারাই শিখিয়েছিল যেন সবুজ পাতা দেখলেই সাবধানী হয়।’
‘এসব তথ্য আগে জানলে খুব উপকারে আসত। এখন জেনে কী লাভ ক্যাথলিন? আমার মা জোর করে বিভিন্ন রঙের শাক খাওয়াতেন।’
এসব কথা বলতে বলতে আমরা দুজনে একটা সেকেলে ক্যাবিনেটের সামনে এসে দাঁড়ালাম। সূ² কারুকাজ করা ক্যাবিনেটের ভেতরে বোন চায়নার তৈজসপত্র। আমার নানির কথা মনে পড়ে গেল। কত বাহারি নকশার ডিনার সেট যে ওনার ছিল। যেগুলো বের করার কোনো উপলক্ষ কখনোই আসেনি। সেগুলো কেমন সুকেশে বন্দি থেকে গেল। জীবন আসলেই অদ্ভুত। প্রতিদিন বেঁচে থাকাই যে উপলক্ষ এটা আমরা ভুলে যাই।
ক্যাথলিনের কথায় আমার ধ্যান ভঙ্গ হলো। ও হাসিমুখে বলল, ‘এগুলো আমার সারা জীবনের সংগ্রহ।’
আমি হাসলাম, ‘আসলে বোন চায়না নাম শুনলেই কেমন হাড়ের মাঝে শিরশির করে। তোমাকে ঠিক বোঝাতে পারব না। তোমার টি সেট আমার পছন্দ হয়েছে। টিপটের সঙ্গে কেমন ম্যাচিং করা মিল্ক পট, সুগার পট দেখে খুব ভালো লাগছে।’
‘ঠিক আছে। তুমি যদি চাও আমি বাড়ির সঙ্গে উপহার হিসেবে এই টি সেট রেখে যাব।’
‘আরে না। আমি উপহার চাইনি। অনেক ধন্যবাদ তোমাকে।’
আমরা দুজনে হেঁটে এবার রান্নাঘরের সামনে দাঁড়ালাম। ও দূরে আঙুল তুলে দেখাল বাড়ির পেছন থেকে কমিউনিটির ক্লাব দেখা যায়। ব্যাকইয়ার্ড যতœ করে ল্যান্ডস্কেপিং করেছে।
আমার মনের কথা বুঝেই যেন ক্যাথলিন বলল, ‘আমি তোমাকে এই মালির ফোন নম্বর দিয়ে যাব। আসলে এত বড় বাড়ি। যে মেয়েটা নিয়মিত ক্লিন করতে আসত তার ঠিকানাও দেব। তোমার অনেক সুবিধা হবে।’
আমার মালি বা সহকারী রাখার সামর্থ্য নেই। ক্যাথলিনের কথা শুনেই বোঝা যায় বংশীয় ধনী।
ফর্মাল ডাইনিং ঠিক ব্যবহার করা হয়নি। আমি ঠিক করলাম এখানেই বসাব ডাইনিং টেবিল।
ফর্মাল ডাইনিং থেকে ঘুরে একটা কাচের দরজা ঠেলে আমরা একটা ঘরে ঢুকলাম। সেই দরজার ওপরে গøাস পেইন্টিং করা হয়েছে। লম্বা লেজের দোয়েল পাখির মতো দেখতে একটা পাখি। এখানে বলে ম্যাগপাই। ঘরের ভেতরে একটা ফরাসি ঝাড়বাতি ঝুলছে। সেখানে বিশাল এক পিয়ানো রাখা।
‘এ বাড়িতে পিয়ানো বাজায় কে?’
‘আমি আগে পিয়ানো তোমার ছিলাম। এই গ্র্যান্ড পিয়ানোটা আমার অনেক শখের জান? অনেক দাম দিয়ে কিনেছিলাম। এক সময় এই বাড়িতে আমি পিয়ানো বাজানো শেখাতাম। কমিউনিটির ছেলে-মেয়েরাই আমার কাছে শিখতে আসত। এখন যেখানে যাব, সেখানে এই পিয়ানোর কোনো স্থান নেই।’, এই কথা বলে ও একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
আমার মনটাই খারাপ হয়ে গেল। হয়তো এবার গিয়ে ওল্ড হোমে উঠবে।
বিদায় নেয়ার সময় ক্যাথলিন বলল, ‘আমরা দুজন চল্লিশ বছর এ বাড়িতে থেকেছি। বাড়ির প্রথম ক্রেতা ছিলাম আমি আর বিলি। পাখিদের যেমন জোড়া ভেঙে যায়, আমাদেরও তাই হয়েছে। আমি এখন এই বাড়ি এ জন্যই বিক্রি করছি।’
আমি ধরে নিলাম কোনো কারণে দুজনের বিচ্ছেদ হয়েছে। এখানকার লোক ব্যক্তিগত প্রশ্ন পছন্দ করে না।
ওই বাড়ি থেকে কাছাকাছি একটা কফি শপে আমার রিয়েল্টর এর সঙ্গে দেখা করার কথা হয়েছিল। স্টারবাক্সে বসে কফিতে চুমুক দিচ্ছি এর মাঝে হং উপস্থিত।
আমি হাসিমুখে বললাম, ‘আমার খুব পছন্দ হয়েছে।’
‘তবে যে গতকালকে বললে ওই এন্টিক ঠাসা ভূতুড়ে বাড়িতে তুমি থাকবে না।’
‘গতকাল রাতের কথা আলাদা। এখন দিনের বেলাতে একটা বিরাট পরিবর্তন ঘটে গেছে। বাড়ির মালিক ক্যাথলিন আমাকে এতক্ষণ ধরে বাড়ি ঘুরিয়ে দেখিয়েছে।’
হং জিজ্ঞেস করল, ‘তোমাকে কে বাড়ি দেখিয়েছে?’
‘কে আবার? ক্যাথলিন।’
‘জিসাস। তুমি এসব কী বলছ? তোমার মাথা ঠিক আছে? তুমি কাকে দেখেছ? ওই বাড়ির মালিক ক্যাথলিন দুই মাস আগে মারা গেছেন। বিলি মারা গেছেন তারও আগে। তারপর এই বাড়ি বিক্রি করার জন্য রিয়েল্টরকে দিয়েছে। আমি তোমাকে এত কথা আগে বলিনি, তুমি শুনলে পিছিয়ে যেতে।’
আমি হতভম্ব হয়ে বসে রইলাম। আমি সোশ্যাল মিডিয়াতে ঢুকলাম বাড়ির ঠিকানা আর ক্যাথলিনের নাম দিয়ে অবিচ্যুয়ারিগুলো খুঁজতে থাকলাম। অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার সংবাদে ক্যাথলিনের একটা ছবিও পাওয়া গেল।
একটু পরে ছবি পেলাম ওর। আমি বললাম, ‘এই স্বর্ণকেশী আমাকে আজকে বাড়ি ঘুরে দেখিয়েছেন। এই যে দ্যাখো।’
হং অবিশ্বাস নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইল।
আমি আর হং দুজনেই ওই বাড়িতে ফেরত গেলাম। বাড়িতে কেউ নেই। বাড়ির দরজায় চেক করলাম। এই বাড়িতে ক্যামেরা লাগায়নি কেউ। এক বয়স্ক ভদ্রলোক কুকুর নিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন, তাকে ডাক দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম কাউকে ঢুকতে বা বেরোতে দেখেছেন কিনা। উনি জানালেন কাউকে দেখেননি।
আমরা স্থির করলাম, ওই বাড়ি কেনার প্রয়োজন নেই। এমন গল্প প্রচলিত থাকলে সেই বাড়ির দাম বাড়বে না।
আমার অবশ্য ক্যাথলিন আর বিলিকে নিয়ে কৌতূহল স্তিমিত হলো না। আমি ওদের ব্যাপারে খোঁজখবর নিতে থাকলাম। বিলি মারা গেছে চার বছর আগে। এটা বের হলো পুরনো সংবাদপত্রের আর্কাইভ থেকে। বিভিন্ন ইভেন্টে ফান্ড রেইসিং করত। এমন টুকরো খবর আর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ইনফরমেশন নিয়ে ওদের জীবন ছবি আকার চেষ্টা চালিয়ে গেলাম। আমি এর ব্যাখ্যা খুঁজতে থাকলাম।
হং খোঁজ নিয়ে জানাল, ওই বাড়ি একটা বিজনেসের নামে কেনা হয়েছে। টাইটেল ট্রান্সফার হয়েছে একটা ইনকরপোরেটেড প্রতিষ্ঠানের নামে।
প্রায় মাসখানেক পরে আমি অফিস নিয়ে বেশ ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। আমি একদিন ব্রিক নামের একটা আসবাবপত্রের দোকানে গেছি। বাড়িতে বই রাখার জায়গা নেই। সারি সারি বুশেলফ দেখছি পছন্দ হয় না। এমন সময় আমি ভূত দেখার মতো চমকে উঠলাম। আমার সামনে ক্যাথলিন দাঁড়ানো। তবে ওর চুলের রং বাদামি।
আমি চমকালেও ওর সামনে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আমার ভুল না হলে তোমার নাম ক্যাথলিন’।
ভদ্রমহিলা হাসিমুখে উত্তর দিলেন, ‘তোমার ভুল হচ্ছে আমার নাম এন্ড্রিয়া’।
আমার পরিষ্কার মনে আছে, মহিলার ডান গালে একটা জরুল ছিল। এনার সঙ্গে আমার আগেও দেখা হয়েছে। আমি তাকে দূর থেকে অনুসরণ করতে থাকলাম। একটা স্টারবাক্সে উনি গাড়ি থামিয়ে ঢুকলেন। এই রহস্যভেদ আমাকে করতেই হবে।
আমি লাইনে তার পেছনে দাঁড়ালাম। ব্যারিস্টা যখন আমার নাম জিজ্ঞেস করল, আমি বললাম ক্যাথলিন। এবার মহিলা আমার দিকে চমকে তাকালেন।

আমি মুখে হাসি রেখে বললাম, ‘ক্যাথলিন আসলে আমাদের দুজনেরই খুব পরিচিত। তাই নয় কি?’
মহিলা বুঝলেন তার জারিজুরি ফাঁস হয়ে যাবে। তবে আমার গল্প শোনার কৌতূহল তখনো যায়নি। উনি ছোট একটা নিঃশ্বাস ফেলে আমার সঙ্গে এক টেবিলে বসলেন।
আমি বললাম, ‘তুমি আমাকে মিথ্যা বলেছিলে কেন? তুমি ক্যাথলিন সেজে আমাকে কেন ভয় দেখালে?’
‘তুমি কিছুই প্রমাণ করতে পারবে না মেয়ে। শুধু শুধু আমার সময় নষ্ট করছ। যেদিন তুমি আমাকে ওই বাড়িতে দেখেছ বলে দাবি করছ, সেদিন আমার একটা শক্ত এলিবাই আছে। আমি ঠিক প্রমাণ করে দেব আমি এই শহরে ছিলাম না। ছিলাম রেড ডিয়ারে। অন্তত চারজন এর সাক্ষ্য দেবে’।
‘আমি কিছুই প্রমাণ করতে চাই না। আমি শুধু জানতে চাই তুমি কেন এমন করলে?’
‘তোমার কৌতূহল নিবৃত্ত করার দায় আমার নেই। তোমার ব্যাগের ফোনটা টেবিলে রাখো। আর তোমার আপেল ওয়াচ খুলে রাখো। যা বলব অব দ্য রেকর্ড। ক্যাথলিন আমার বোন। আমাদের দুজনের চেহারায় এত মিল ছিল না কখনোই, তবে বয়স বেড়ে এক রকম দেখায়। ব্যাপার হচ্ছে ওদের ওই বাড়ি ইনহেরিট করেছে ওদের একমাত্র সন্তান মার্ক। বখে গেছে অল্প বয়সেই। ওর শখ ছিল বাবা-মায়ের বাড়িতে ক্রিস্টাল মেথের ল্যাব বানাবে। তবে বাধ সাধল এখানকার উত্তরাধিকার আইন। এই বাড়ির পঞ্চাশ শতাংশের ওপর এখন মার্কের ট্যাক্স দিতে হবে। ও টাকা জোগাড় করতে মরিয়া হয়ে গেল। বাড়ি নিলামে উঠে গেল। মার্ক একটা ব্যাংক লুট করার পরিকল্পনা করছিল। আমার মনটাই খারাপ হয়ে গেল। আমি ঠিক করলাম ওই বাড়ি আমি কিনব। কারণ দুটো। বোনের বাড়ি আমার কাছে থাকল। পরের ক্রেতাকে মার্ক বিরক্ত করে মারত। ড্রাগে আসক্ত লোকে অনেক রকম খারাপ কাজ করতে পারে। তবে ও আমার কোনো ক্ষতি করবে না এই ব্যাপারে আমি নিশ্চিত। একটা ড্র্যাগ এডিক্টের জন্য আমার বোনের সম্মান নষ্ট হতো। আমি টাকা জোগাড় করেই ফেলেছিলাম বাধ সাধলে তুমি। নিজের ওপর সেধে বিপদ আনতে গেলে। তোমাকে নিবৃত্ত করতেই আমাকে ভয় দেখাতে হলো। আমার রিয়েল্টর আমাকে জানাল, বেশি দাম দিয়ে তুমি ওই বাড়ি কিনবে।
‘তুমি জানলে কী করে পরদিন দিনের বেলায় আমি উপস্থিত হবো?’
উনি হেসে ফেললেন, ‘ওই বাড়ির প্রতিটি হাতে আঁকা ছবির কাছে লুকোনো ক্যামেরা আছে। তুমি তো আর্ট পছন্দ করো। ছবির সামনে তোমার কথাবার্তা আমি শুনেছি। একটা কথা আমার কানে লেগেছে তুমি বাড়ির সব বদলে ফেলতে। আর দিনের আলোতে দেখতে চাও বাড়িটা কেমন। আমি একটা চান্স নিয়ে ফেললাম পরদিন। ক্লাবহাউস দিয়ে বাড়ির পেছন দরজা দিয়ে ঢুকলাম। বাকি গল্পটা তোমার জানা আছে।’
আমার সঙ্গে যা হয়েছে তার নাম প্রতারণা। একজন প্রতারকের কোনো যুক্তি আমার কাছে গ্রহণযোগ্য মনে হলো না।
আমি হাসিমুখে বললাম, ‘সমস্যা কী জানো এন্ড্রিয়া? আমার রেকর্ডিং ডিভাইস তো বন্ধ করেছ। তবে আমার মাথায় যা ঢুকেছে তা তো মোছা যাবে না। তোমাকে আমার আরেকটা পরিচয় দিই। আমার টুকটাক লেখালেখির অভ্যেস আছে। এত সুন্দর প্লট আমি কিছুতেই হাতছাড়া করব না। আমি উঠছি।’
হতবাক এন্ড্রিয়াকে রেখে আমি বের হয়ে এলাম। সঙ্গে এলো নতুন গল্পের প্লট।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়