শিশুশ্রম নিরসনে সমন্বিত পদক্ষেপের আহ্বান

আগের সংবাদ

ভারত-আমেরিকার বৈচিত্র্যময় অংশীদারত্ব গড়ার প্রত্যয় : হোয়াইট হাউসে মোদি-বাইডেন বৈঠক শেষে যৌথ ঘোষণা

পরের সংবাদ

কাজী শোয়েব শাবাবের কবিতা নিয়ে কথা

প্রকাশিত: জুন ২৩, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জুন ২৩, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

সাম্প্রতিক সময়ে পাওলো কোয়েলহোর লেখা একটি উপন্যাসের চরিত্র অনেকটা এরকম, যেন একটি মেয়ে আকাশ ধরতে চায়, স্বপ্ন দেখে সমুদ্রের ধারে তার একটি বাসা হবে, সন্তান হবে, সে বিখ্যাত হবে…; এই ধরনের স্বপ্নীল বাস্তবতা মাথায় এবং মনে রেখে সে টেলিভিশন দেখা এবং নানা ধরনের ইরোটিক ম্যাগাজিন পড়া শুরু করে। এরই মধ্যে কয়েকটি ছেলের সঙ্গে তার শারীরিক সম্পর্ক ঘটে। কিন্তু তাতেও সে তার উদ্যমতা টিকিয়ে রাখতে না পেরে শহর থেকে দূরে একটি সি বিচে যায়। সেখানে তার সঙ্গে কিছু অচেনা চরিত্রের সঙ্গে আলাপচারিতায় সে খুব সহজেই সুইজারল্যান্ডের একটি অভিজাত হোটেলে দামি ফ্যাশনেবল কলগার্লের কাজেও আপত্তি জানায় না। সে অনেক দিন এসব কাজে রত থাকার পর হঠাৎ রাস্তায় একজন আর্টিস্টের সঙ্গে দেখা হয়। আর্টিস্ট তাকে থামতে বলে; আর্টিস্ট বলে- তার মধ্যে একটি আলো আছে। এভাবে সেই চিত্রশিল্পীর সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা হয়। এই আর্টিস্ট হচ্ছে সেই ছেলে, যাকে সে শৈশবে স্কুলে যাওয়ার পথে হারিয়ে ফেলেছিল। ছেলেটি মেয়েটিকে চিনতে পারে, কিন্তু মেয়েটি ছেলেটিকে চিনতে পারে না। অর্থাৎ ছেলেটি তার শৈশবেরই ক্লাসমেট। একদিন একা নিরপেক্ষ ঘরে তাদের মধ্যে শারীরিক ঘনিষ্ঠতা হয়। শারীরিক ঘনিষ্ঠতার কিছুদিন পর মেয়েটি সিদ্ধান্ত নেয়, সে তার পূর্বের সব কাজ ছেড়ে ব্রাজিলে তার গ্রামের বাসায় চিরায়তভাবে চলে যাবে এবং প্লেনেও ওঠে। ভাবে আর পাঁচজন পুরনো প্রেমিক যেভাবে তার শরীরকে মূল্য দিত এই ছেলেও হয়তো সেভাবে তার পথ বেছে নেবে। কিন্তু ফ্লাইট ছাড়ার পূর্বে সে দেখে ছেলেটি তার জন্য ফুল হাতে অপেক্ষা করছে। অর্থাৎ সমুদ্র থেকে মুক্তি। সমুদ্র থেকে মুক্তি বলছি এই কারণে, মানুষ সমুদ্রের দিশাহারা ঢেউয়ের তাল সামলাতে না পেরে আবার তীরেই ফিরে আসে। সমুদ্র মেয়েটির কাছে ছিল কারাগার, যার ঢেউয়ের গড়ানিতে ছিল বাঁধনমুক্তির স্বপ্ন, আকাশ ছোঁবার ইচ্ছা। উপরোক্ত গল্পের সঙ্গে কবি কাজী শোয়েব শাবাবের একটি কবিতার ভাবনা সম্পূর্ণ মিলে যায়। কারণ, চেশোয়াভ মিউশ বলছেন, ‘হাজারটা গদ্যের ভার বহন করতে পারে কবিতার একটি লাইন।’ অর্থাৎ ব্রাজিলিয়ান নভেলিস্ট পাওলো কোয়েলহো যে বাস্তবতাকে তার ‘ইলেভেন মিনিটস’ নভেলে লিখেছেন, যে দর্শনকে তিনি তার উপরোক্ত সামান্য বর্ণনার প্রয়াসে আরক্ত উপন্যাসে বর্ণীল আমেজে ব্যক্ত করেছেন, তা আমাদের কবিতা বোঝার বা কবিতার শব্দরূপ নয়, ধ্বনিরূপ নয়, অন্তর্গত ব্যঞ্জনাগত রূপও নয়, শুধু যদি কবিতার দর্শনের রূপ নিয়ে বিচার করি তাহলে কাজী শোয়েব শাবাবের এই কবিতার সঙ্গে তার বিষয়বস্তু শুধু নয়, তার দেখার ধরন যে এত অভিনব, যা ব্রাজিলিয়ান রাইটার পাওলো কোয়েলহোর এই উপন্যাসের দর্শনের সঙ্গে একাত্ম না হয়ে পারে না। শোয়েব শাবাবের কবিতার শিরোনাম ‘অ্যাকুরিয়াম থেকে সমুদ্র বহুদূর’। কবিতাটি এমন-
ওপরে নীল আলো
নিচে পাথরের কুচি
ডুবে যাওয়া পুরোনো হারানো জাহাজ
কুমিরের মুখ থেকে অবিরাম বুদবুদ
অবিকল ঘাসের মতো প্লাস্টিক ঝাড়
মাঝখানে এক হাত জলের গভীরতা
খাবি খায় চারটি রঙিন মাছ
চারপাশে সমতল কাচের দেয়াল।

পেছনের কাচে
প্রবাল-শৈবাল-সি উইডের সামুদ্রিক লোভ
চকচকে স্টিকার।
বোঝে না চারটি মাছ
মুখ ঘষে কাচে
সমুদ্রে যাবার পথ নেই কোনো
অ্যাকুরিয়াম থেকে সমুদ্র বহুদূর।

যে কবি কথা অব্যক্ত বা অল্প ব্যক্ত রেখে অনেক বলতে পারেন, তার কবিতার শক্তিমত্তা অনেক বেশি। যেমন- শামসুর রাহমানের কবিতা অনেকটা ইউরোপীয় ধরনের নাগপাশ ঘেরা, তার কিছু কবিতাকে ‘ক্যাটালগিং পোয়েম’ও বলা হয়, যেমন- ‘দুঃখ’ কবিতাটি। বিশ্বকবিতার স্বর বা ছায়া যেটাই বলা হোক না কেন, তা একমাত্র শামসুর রাহমানের কবিতায় আরাধ্য। কিন্তু পাশাপাশি শামসুর রাহমানের ‘দুঃখ’ কবিতার পাশে যদি আল মাহমুদের ‘প্রত্যাবর্তনের লজ্জা’ কবিতার কথা মাথায় রাখি তবে দেখব, আল মাহমুদ অনেক ক্ষেত্রে রাহমানীয় বয়ান সর্বস্বতাকে পরিত্যাগ করে ‘প্রত্যাবর্তনের লজ্জা’তে কথা অব্যক্ত বা অল্প ব্যক্ত রেখে অনেক বলতে পারেন, যা কাজী শোয়েব শাবাবের মধ্যে বিশেষভাবে লক্ষণীয়। কারণ, সালমাল রুশদি তার ‘মিডনাইটস চিলড্রেন’ নভেলের মহাকাব্যিক বর্ণনার এক জায়গায় বলেছেন, ‘নীরবতা, জলপতনের চেয়েও কোলাহলময়।’ শোয়েব আরেক জায়গায় বলছেন-
সেই ফিনিক্স পাখিটি আজও
কাছ দিয়ে কোথাও
উড়ে চলে গেলেজ্জ
জেসমিন সৌরভে ভরে ওঠে চারপাশ।
শোয়েবের জেসমিন ফুল ও ফিনিক্স পাখি কবিতা পড়লে শামসুর রাহমানের ইকারুসের আকাশ কবিতার ভাবনার সঙ্গে ফিনিক্স নেচার তুলনীয় মনে হয়। যেমন- ফিনিক্স পাখি উপরে উড়তে থাকে, উড়তে উড়তে পুড়ে ছাই হয়ে আবার সেই ছাই থেকে নতুন একটি পাখি জন্ম নেয়, যার নাম ফিনিক্স। অনেক কবিতার ভাবনাই এক, কিন্তু প্রকাশের অনন্যতার কারণেই তা টিকে থাকে। যেমন- এই কবিতার ভাবনার একাত্মতারই প্রকাশের সেকেলে ধরন হচ্ছে, আবুল হাসানের ‘মাড়ী ও মড়কে মরিনি কখনো’। লাইনটির আরো একটু উন্নত ধরন হচ্ছে, গ্রিক মিথলজি ব্যবহার করে শামসুর রাহমানের ‘ইকারুসের আকাশ’ কবিতার ভাবনাধর্ণাঢ্যতা ও প্রকাশপ্রকরণ আরো যদি একালীয় অভিবন আধুনিক শুধু নয়, বলা যায়- উত্তর আধুনিক সেকেলে প্রকাশের উত্তরণ তবে কবি শোয়েব শাবাবের জেসমিন ফুল ও ফিনিক্স পাখি কবিতাটি সম্পূর্ণ তুলে ধরার লোভ সামলাতে পারছি না-
তেইশ বছর আগে এক বনের ধারে
ফুটেছিল একটি ছোট্ট জেসমিন।
বাতাসে দোল খেতো
মিষ্টি সুবাসে তার মৌ মৌ করত
বনের ওপাশ।
সবুজ পাতার ফাঁকে মায়ের কোলে-
সারাদিন শুয়ে শুয়ে খিলখিল হাসি।

প্রজাপতি, মৌমাছি, ঘাসেদের সাথে
রাত-দিন খুনসুটি আর গল্প
একটু একটু করে ফুটে ওঠে জেসমিন
কেটে যায় দিন
আরও কিছু দিন……

হঠাৎ বনে কোথাও আগুন লাগে
ছড়িয়ে পড়ে দ্রুত দহন ও দাবানল
সবকিছু জ্বলে-পুড়ে ছাই!

আগুন নিভে গেলে
পড়ে থাকে ধূসর ছাই আর
পোড়া বৃক্ষকঙ্কাল…

ডানা ঝাপটে
ছাই থেকে উড়ে যায় ফিনিক্স পাখি
মেলে ধরে তার পাখিজন্মের ইচ্ছেডানা
বাধাহীন নিঃসীম দূর নীলিমায়…

কেটে গেছে তারপর অনেক বছর…

সেই ফিনিক্স পাখিটি আজও
কাছ দিয়ে কোথাও
উড়ে চলে গেলেজ্জ
জেসমিন সৌরভে ভরে ওঠে চারপাশ।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়