নম্বর জালিয়াতির অভিযোগ : নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রককে হাইকোর্টে তলব

আগের সংবাদ

ভোটের হাওয়া কোন দিকে? বরিশালে চার প্রার্থীর মধ্যে তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বিতার আভাস

পরের সংবাদ

শ্রেষ্ঠ কথাশিল্পী সেলিনা হোসেন

প্রকাশিত: জুন ৯, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জুন ৯, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

বর্তমান সময়ের বাংলা কথাসাহিত্যের ধারায় অন্যতম শ্রেষ্ঠ কথাশিল্পী সেলিনা হোসেন। দীর্ঘ পঞ্চাশ বছরের সাধনায় ইতোমধ্যে তিনি নির্মাণ করেছেন নিজস্ব একটি ভুবন। পাঠককে চিনিয়েছেন নিজস্ব সত্তার সংগ্রাম। তার ঔপন্যাসিক প্রতিবেদন বিষয়গৌরবে যেমন বিশিষ্ট, তেমনি প্রকরণ প্রসাধনেও। ইতিহাসের গভীরে সন্ধানী আলো ফেলে ঔপন্যাসিক প্রতিবেদন সৃষ্টিতে তার সিদ্ধি কিংবদন্তিতুল্য। বস্তুত, ইতিহাসের আধারেই তিনি সন্ধান করেন বর্তমানকে শিল্পিত করার শিল্প-উপকরণ। সমকালীন জীবন ও সংগ্রামকে উপন্যাসের শব্দস্রোতে ধারণ করেই সেলিনা হোসেনের শিল্প-অভিযাত্রায় মৌল-অনিষ্ট। এ ক্ষেত্রে শ্রেণি অবস্থান এবং শ্রেণি সংগ্রাম চেতনা প্রায়শই উঠে আসে তার ঔপন্যাসিক বয়ানে, তার শিল্প আখ্যানে। কেবল শ্রেণি চেতনা নয়, ঐতিহ্যস্মরণও তার উপন্যাস সাহিত্যের একটি সাধারণ লক্ষণ। উপন্যাসে তিনি পৌনঃপুনিক ব্যবহার করেছেন ঐতিহাসিক উপাদান কখনোবা সাহিত্যিক নির্মাণ।
ইতিহাসের নান্দনিক প্রতিবেদন সৃষ্টিতে সেলিনা হোসেনের সিদ্ধি আকাশস্পর্শী। এ ক্ষেত্রে তার ‘চাঁদবেনে’, ‘নিরন্তর ঘণ্টাধ্বনি’, ‘কাঁটাতারে প্রজাপতি’, ‘গায়ত্রী সন্ধ্যা’, ‘সোনালি ডুমুর’, ‘প্রভাতি’ উপন্যাসের কথা স্মরণ করতে পারি। এসব উপন্যাসে সেলিনা হোসেন ইতিহাসকে সমকালের সঙ্গে বিমণ্ডিত করেছেন- ইতিহাসের কঙ্কালেই নির্মাণ করেছেন সমকালের জীবনবেদ। ইতিহাস ও শিল্পের রসায়নে সেলিনা হোসেন পারঙ্গম শিল্পী। তার উপন্যাস পাঠ করলে বিস্মৃত হতে হয় কোনটা ইতিহাস আর কোনটা কল্পনা।
সাহিত্যিক নির্মাণকে ভেঙে নতুন সাহিত্য সৃষ্টির ধারায় সেলিনা হোসেন রেখেছেন প্রাতিস্বিক প্রতিভার স্বাক্ষর। বাংলা সাহিত্যের আদি নিদর্শন চর্যাপদ অবলম্বনে তিনি রচনা করেছেন ‘নীল ময়ূরের যৌবন’, ‘মনসামঙ্গল’ কাব্য ভেঙে নতুন করে গড়েছেন ‘চাঁদবেনে’, আর ‘চণ্ডীমঙ্গলের’ ছায়ার নির্মাণ করেছেন ‘কালকেতু ও ফুলরা’। মূল রচনা ভিন্ন ভিন্ন প্রেক্ষাপটে রচিত হলেও সেলিনা হোসেনের হাতে তা এক অভিন্ন সূত্রে গ্রন্থিত হয়েছে এই ত্রয়ী উপন্যাসে। তিনটি উপন্যাসের মাঝেই শোনা যায় শ্রেণিসংগ্রাম চেতনার অভিন্ন এক সুর।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সেলিনা হোসেনের ঔপন্যাসিক প্রতিভাকে প্রাণিত করে নিরন্তর। তাই ঔপন্যাসিক প্রতিবেদন নির্মাণে তিনি বারবার ফিরে যান গৌরবোজ্জ্বল একাত্তরের কাছে। এ ক্ষেত্রে তার ‘হাঙর নদী গ্রেনেড’, ‘যুদ্ধ’ এসব উপন্যাসের কথা আমরা স্মরণ করতে পারি। মুক্তিযুদ্ধের সাধারণ মানুষের জাগরণটাকেই ধরতে চেয়েছেন সেলিনা হোসেন। বাংলাদেশে জীবনী-উপন্যাস রচনাতে সেলিনার অবদান বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয়। রবীন্দ্রনাথের পূর্ববঙ্গ-বাসের দিনগুলোকে নিয়ে তিনি রচনা করেন ‘পূর্ণ ছবির মগ্নতা’, ইলা মিত্রের জীবন সংগ্রাম নিয়ে ‘কাঁটাতারে প্রজাপতি’, গালিবের কবিপ্রতিভা নিয়ে ‘যমুনা পারের মুশায়রা’ প্রভৃতি।
সেলিনা হোসেনের উপন্যাসে নারীর জন্য নিজস্ব একটি অবস্থান রচিত হয়েছে। নারীকে প্রাকৃতিক লৈঙ্গিক পরিচয়ে না দেখে তিনি দেখেছেন সামাজিক জেন্ডার দৃষ্টিকোণে। ফলে তার নারীরা হতে পেরেছে ব্যক্তিত্বমণ্ডিত ও স্বাধীন নির্বাচনক্ষম। তার ছোটগল্পেও আমরা এ প্রবণতা বিশেষভাবে লক্ষ করি। প্রসঙ্গত প্রণিধানযোগ্য ‘মতিজানের মেয়েরা’ গল্পগ্রন্থ। ছোটগাল্পিক হিসেবে সেলিনা হোসেন উপন্যাসের মতোই, প্রতিস্বিকতাঋদ্ধ।
কেবল কথাকার হিসেবেই নয়, একজন প্রাবন্ধিক এবং গবেষক হিসেবেও সেলিনা হোসেনের ভূমিকা আমাদের স্মরণ করতে হয়। এ ক্ষেত্রে তার ‘স্বদেশে পরবাসী’, ‘ঊনসত্তরের গণআন্দোলন’, ‘একাত্তরের ঢাকা’, ‘নির্ভয় করো হে’, ‘বাংলাদেশের মেয়ে শিশু’, ‘ঘর গেরস্থির রাজনীতি’ প্রভৃতি গ্রন্থের কথা বলা যায়। সম্পাদক হিসেবেও সেলিনা হোসেনের অবদান বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তার একক ও যৌথ সম্পাদনায় জেন্ডার বিশ্বকোষ, নারীবিষয়ক একাধিক গ্রন্থ বাংলাদেশে নারীচর্চায় বিশেষ অবদান রেখেছে। শিশু সাহিত্যিক হিসেবেও সেলিনা হোসেনের অবদান উল্লেখ করতে হয়। শিশু-কিশোরের জন্য তিনি লিখেছেন অনেকগুলো বই। এ ক্ষেত্রে ‘সাগর’, ‘গল্পে বর্ণমালা’, ‘কাকতাড়–য়া’, ‘বর্ণমালার গল্প’, ‘অন্যরকম যাওয়া’, ‘আকাশপরী’, ‘যখন বৃষ্টি নামে’, ‘জ্যোৎস্নার রঙে আঁকা’, ‘ছবি’, ‘মেয়রের গাড়ি’, ‘মিহিরনের বন্ধুরা’, ‘এক রুপোলি নদী’, ‘গল্পটা শেষ হয় না’, ‘চাঁদের বুড়ি পান্তা ইলিশ’- এসব বইয়ের কথা স্মরণ করতে পারি। তার ভ্রমণসাহিত্য ‘দূরের দেশ কাছের দেশ’ও ভিন্ন এক সেলিনা হোসেনকে পাঠকের সামনে তুলে ধরে।

বাংলাদেশের সাহিত্যের ধারায় সেলিনা হোসেন প্রকৃত প্রস্তাবেই নিজস্ব একটা ভুবন নির্মাণ করেছেন। সাহিত্যিক হিসেবে সামাজিক দায়বদ্ধতাকে তিনি বিস্মৃত হননি। ফলে তার সকল রচনার পশ্চাতেই থাকে একটা সামাজিক অঙ্গীকার, থাকে একটা প্রগতিশীল ভাবনা। তার শিল্পী মানসে সব সময় সমর্থক ইতিহাসচেতনা জাগ্রত থাকে বলে মানুষকে তিনি ম্যাক্রো-ভাবনায় পর্যবেক্ষণ করতে সক্ষম হয়েছেন। মাইক্রো-ভাবনা নেই বলে তার মানুষরা কখনো খণ্ড-জীবনের আরাধনায় মুখর হয়নি, হয়নি নষ্ট জীবনের উপাসক।
সেলিনা হোসেনের জীবনভাবনা ও সাহিত্যসাধনা নিয়ে ইতোমধ্যে গবেষণা শুরু হয়েছে। ভবিষ্যতে এ ধারা যে আরো বেগবান হবে- এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়। বক্ষ্যমান রচনা সেলিনা হোসেনের সাহিত্যকর্ম মূল্যায়ন নয়, বরং মূল্যায়নের একটি প্রাথমিক খসড়া মাত্র। ভবিষ্যতে এ বিষয়ে বিস্তৃত আলোচনার অবকাশ আছে।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়