নম্বর জালিয়াতির অভিযোগ : নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রককে হাইকোর্টে তলব

আগের সংবাদ

ভোটের হাওয়া কোন দিকে? বরিশালে চার প্রার্থীর মধ্যে তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বিতার আভাস

পরের সংবাদ

বিভ্রম

প্রকাশিত: জুন ৯, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জুন ৯, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

তুমি তোমার বউ চালাতে পারোনি বাবা।
প্রতিদিনের মতো আজো রাতের খাবার খাচ্ছিলেন রাশেদুল হাসান। তিনজনের ছোট পরিবার। তিনি, তার স্ত্রী আর ২১ বছরের একমাত্র সন্তান রাজিব হাসান। দিনের বেলা বাসায় খাওয়া হয় না বন্ধের দিন ছাড়া। তাই রাতে অন্তত তিনজন একসঙ্গে খাবে এমন একটি রেওয়াজ তিনি চালু করেছেন অনেক আগে থেকে।
ইলিশ মাছের পেটির একটি অংশ ছিঁড়ে কাঁটা ফেলে ভাতের সঙ্গে মিশিয়ে লোকমাটা মুখে পুরতে গিয়েছিলেন হঠাৎ এমন একটি কথায় তা আর মুখে দেয়া হলো না। বাসনে ফের লোকমাটা রেখে মাথা তুলে এদিক-ওদিক তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করছেন শব্দটি কোথা থেকে এলো।
কী খুঁজছো? কথাটা তোমাকে আমি বলেছি।
হতভম্ব বাবা আবার বোঝার চেষ্টা করতে গিয়ে একবার তার ডান পাশের চেয়ারে বসা স্ত্রীর দিকে তাকালেন, তারপর উল্টোপাশের চেয়ারে বসা ছেলে রাজিবের দিকে দৃষ্টি ফেরালেন।
কী, কী, কী বলেছো? কথা আটকে যাচ্ছে রাশেদের।
বলছি তুমি স্বামী হয়ে নিজের স্ত্রীকে সঠিক পথে পরিচালিত করতে পারোনি।
ঝঃড়ঢ় ঘড়হংবহংব. আমার স্ত্রী তোমার কে? তোমার মাথা কি ঠিক আছে?
বলতে বলতে সামনে থাকা ভাতের বাসন সামনে ঠেলে দিলেন তিনি।
তোমার স্ত্রী আমার মা। কিন্তু তুমি তো তার লিগ্যাল গার্জেন তাই তোমাকে বললাম।
আর শোন মা, মায়ের দিকে ঘাড় ফিরিয়ে উদ্ধতভাবে বলে যায় রাজিব, তোমাকে বলছি, তোমার চালচলন ঠিক করতে হবে। তোমাকে বোরকা পরতে হবে বাইরে যেতে। পরপুরুষকে দেখা দিতে পারবে না তুমি। বেপর্দা চলতে পারবে না। অনেক গুনাহ করেছো জীবনে। এখন দ্বীনের পথে আসো।
স্থানুবৎ সামিনা কথা বলবার ক্ষমতাও হারিয়ে ফেলেছেন। বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে আছেন ছেলের মুখের দিকে।
রাশেদুল স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমার ছেলে তো চরম বেয়াদব হয়ে গেছে। কিছু না বলে, না বলে ওকে মাথায় তুলেছো। এখন দেখো তার পরিণতি।
সত্য কথা বলা কি পরিণতি বাবা? রাজিবের এই কথা শেষ না হতেই চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে সামিনা বললেন, চুপ কর বেয়াদব, কার সঙ্গে তর্ক করছিস?
বলতে বলতে সামনের দিকে হাত তোলার চেষ্টা করলেন যেন রাজিবের গালে চড় বসাতে চাইছেন; কিন্তু টাল সামলাতে পারলেন না। প্রথমে টেবিল তারপর চেয়ার ধরে নিজেকে সামলাতে চেষ্টা করলেন। তাতে কাজ হলো না। চেয়ারসহ পড়ে গেলেন মেঝেতে।
বাপ-বেটা দুজনেই ছুটে এসে ধরার চেষ্টা করেছিল তার আগেই তিনি পড়ে গেলেন। রাশেদুল দ্রুত তাকে তোলার চেষ্টা করলেন কিন্তু পারছিলেন না। রাজিবও মায়ের মুখের ওপর পড়ে বারবার বলার চেষ্টা করছে, সরি মা, সরি মা। রাশেদুল বললেন, সেন্স নেই।
দুজনে ধরাধরি করে বেডরুমে নিয়ে গেল। বিছানায় শুইয়ে দিয়ে রাশেদ সামিনার মুখে পানি ছিটাতে ছিটাতে বললেন, ডাক্তার ডাকো, হারিআপ।
বলে নিজেই ছুটে গিয়ে মোবাইল তুলে নিলেন হাতে। প্রথমে ফোন করলেন বন্ধু ডাক্তার রায়হানকে। ভাগ্য ভালো তাকে হাসপাতালেই পাওয়া গেল। রায়হানই বলল, অ্যাম্বুলেন্স পাঠাই, ভাবিকে হসপিটালে নিয়ে আসো।
মোবাইল রেখে রাশেদ ভাবছিল এখন তার কী করা উচিত। আর কাউকে কি জানানো দরকার? আশপাশে কাউকে? রাশেদ জানে এখন পাড়ার একজনকে বললেই পুরো পাড়া একত্রে এসে হাজির হবে ঘরে। তাদের কী বলবে সে। যা ঘটেছে তা বলবে? সামিনা কি বেশি উত্তেজিত হওয়াতে সেন্স হারিয়েছে? হাসপাতালে গেলে নিশ্চয়ই ঠিক হয়ে যাবে। পাড়ার মানুষ ঘটনাটি না জানলেই ভালো। পরিবারের মানইজ্জত রক্ষা হয়। আর পুরো বিষয়টি এত আকস্মিক ও দ্রুত ঘটে গেল যে রাশেদ নিজেই বুঝে উঠতে পারছে না আসলে কী ঘটছে।
মিনিট দশেক কেটে গেছে সামিনার হুঁশ ফেরেনি। রাশেদ মুখে পানি ছিটিয়ে আরেকবার চেষ্টা করে দেখল। রাজিব মায়ের পায়ের কাছে বসে বিড়বিড় করে কিছু একটা পড়ছে। সম্ভবত সে-ও বুঝতে পারছে না তার কী করা উচিত। এমন সময় দূর থেকে অ্যাম্বুলেন্সের শব্দ শোনা গেল।
অ্যাম্বুলেন্স আসছে, আমি নিচে গিয়ে দেখছি। কথাটা কার উদ্দেশে বলা বোঝা গেল না। বলেই দোতলা থেকে নিচে নামতে সিঁড়ির দিকে গেলেন রাশেদ। বাড়ির সামনে কিছুটা খোলা জায়গা আছে। সেখানে একটা কাঁঠালচাপা গাছ আছে। অনেক বছরের। আর আছে একটি কৃষ্ণচূড়া গাছ। বছরের এই সময়ে কৃষ্ণচূড়া গাছে ফুল আসে। অনেক দূর থেকে লালে লাল হয়ে থাকা রাশেদদের বাড়িটা সবার চোখে পড়ে। সিঁড়ি বেয়ে দ্রুত নামছিল রাশেদ। কোনো কারণে আজ চারপাশটা অনেক নীরব বলে মনো হলো অন্য দিনের তুলনায়। কয়েকটি কাক কোনো কারণ ছাড়াই ডানা ঝাপটাল আর তার স্বরে কা কা করে ডেকে উঠল। নির্জনতার মধ্যে কাকের এই ডাকে রাশেদের মন এক অজানা আশঙ্কায় শিউরে উঠল।
চট্টগ্রাম নগরের পাথরঘাটার ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় রাশেদদের বাড়িটা। দাদা জীবনে অনেক কিছু করে, অনেক জায়গা বদল করে দেশভাগের পরপরই বাড়িটা কিনেছিলেন এক অ্যাংলো ইন্ডিয়ান পরিবার থেকে। স্থানীয়ভাবে ওরা ফিরিঙ্গি নামে পরিচিত। একটি সময়ে পাথরঘাটার এই দিকটায় আর আলকরণে প্রচুর পর্তুগিজ পরিবার বাস করত। এ দেশে তাদের অনেকে বিয়েথা করে স্থায়ী হয়ে গিয়েছিল। ব্রিটিশরা চলে যাওয়ার পরে তাদের অনেকে এই দেশ ছাড়তে শুরু করে।
বাড়িটা দেখতে বেশ অভিজাত। পর্তুগিজ স্থাপত্যের নিদর্শন এই বাড়ি। অনেকে মনে করে পাথরঘাটা গির্জার সমসাময়িক এই বাড়িটি। রাশেদের দাদা বাকি জীবন এখানে কাটিয়ে পরলোকে গমন করেছেন। রাশেদের বাবা-মার জীবনও কেটেছে এখানে। রাশেদরা দুই ভাই এক বোন। বড় ভাইটি মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হয়েছে। একমাত্র বোন আমেরিকায় স্যাটেল হয়েছে অনেক বছর আগে। তার দেশে ফিরে আসার সম্ভাবনা নেই। রাশেদই আগলে রেখেছে বাপদাদার বাড়িটা। আশপাশে এখনো কিছু খ্রিস্টান পরিবার বাস করে, তবে সংখ্যায় দিন দিন কমছে ওরা। আছে অনেক হিন্দু পরিবার। তবে মুসলিমের সংখ্যা বাড়ছে দিন দিন। কেউ বাড়ি বিক্রি করলে কিংবা পুরনো বাড়ি অ্যাপার্টমেন্ট হলে সেখানে আসছে মুসলিম পরিবারগুলো। কাজেই একসময় এই এলাকায় মুসলিমের সংখ্যা কম থাকলেও এখন অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। নতুন মসজিদ গড়ে ওঠা আর পুরনো মসজিদের আয়তন বৃদ্ধি হওয়া দেখেও তা সহজে বোঝা যায়।
রাশেদদের বাড়িতে ঢোকার গলিটা এখনো বেশ ছোট। একটু বড় সাইজের গাড়ি হলে ঢোকা মুশকিল হয়ে পড়ে। ডিগ্রিতে পড়ার সময় একটা ভ্যাসপা কিনেছিলেন রাশেদ। অনেক বছর সে গাড়িটাই চালিয়েছেন। ছেলেটিকে যখন উইলিয়াম ক্যারি স্কুলে ভর্তি করা হলো তখন তাকে আনা-নেয়ার জন্য একটা করোলা গাড়ি কিনেছিলেন। কিন্তু গলিতে প্রতিদিন জ্যাম লেগে ঝামেলা হতে থাকায় তা বিক্রি করে আরেকটি বাজাজ ভ্যাসপা কেনেন তিনি। মাসিক ভাড়ায় একটি বেবিট্যাক্সিতে ছেলে উইলিয়াম ক্যারিতে আসা-যাওয়া করত।
রাতের বেলা বলে গলিতে অ্যাম্বুলেন্সটা ঢোকানো যাবে; কিন্তু তার আগে মূল সড়ক থেকে চিনিয়ে দিতে হবে চালককে। তবে এরচেয়ে এ মুহূর্তে রাশেদের কাছে জরুরি যা, তা হলো অ্যাম্বুলেন্সের সাইরেন বন্ধ করা। পাড়ার লোকদের বিষয়টি জানাতে সংকোচ বোধ করছে রাশেদ।
এই পাড়ায় রাশেদের পরিবারকে একটু সমীহের চোখে দেখা হয়। পাড়ার অনেক কিছুর সঙ্গে এই বাড়ির সম্পর্ক দীর্ঘদিনের। পাড়ার ছোটদের হোক বা বড়দের হোক যেকোনো অনুষ্ঠানের রিহার্সালের জায়গা দরকার? আছে রাশেদদের বাড়ির ছাদ বা নিচের তলার কোনো একটি রুম। নাটকের রিহার্সাল হবে তার জন্যও দুয়ার খোলা। অনেক সংগঠন তাদের ছোটখাটো আয়োজন রাশেদদের ছাদেই করে ফেলত। কোনো সংগঠন বা পাড়ার যুবকরা মিলে সাহিত্য আসর করবে অথচ হলো ভাড়া করার টাকা নেই। রাশেদদের ছাদ ছিল তাদের শেষ ভরসা। শুধু জায়গা পাওয়া যেত তা নয়, আপ্যায়নের দায়িত্বও বহন করত তারা। যে কারণে এই পরিবারে সবার যাতায়াত ছিল অবারিত। ঈদ হোক, পূজা হোক সকাল থেকে খাবার নিয়ে হাজির হতো অনেকে। কারো ঘরে ভালো রান্না হলো তার ভাগও বিলি হতো এই ঘরে।

রাশেদ তাদের পারিবারিক ব্যবসা দেখাশোনা করে। দাদার আমল থেকে তাদের সাইকেলের ব্যবসা। সাইকেল, সাইকেল পার্টস আমদানির সঙ্গে খুচরা বিক্রির দোকান আছে একটি সিটি কলেজ মোড়ে। সকাল থেকে রাতের ৮টা পর্যন্ত সেখানেই কাটাতে হয় তাকে। সামিনা ইউনেস্কোর শিশুবিষয়ক একটি উন্নয়ন সংস্থায় কাজ করে।
তাদের একমাত্র সন্তান রাজিব এই পরিবারে, এই পরিবেশেই বড় হয়েছে। পাড়ার ছেলে-বুড়ো সবার কোলেপিঠে বেড়ে উঠেছে বলে সবার স্নেহের দৃষ্টিও ছিল তার প্রতি। খেলাঘরের ভাইবোনদের সঙ্গে কেটেছে তার ছেলেবেলা। লেখাপড়ায় ছিল ভালো। ফলে ও লেভেল পাস করল ভালো নম্বর নিয়ে। এ লেভেল শেষে ভর্তি হলো একটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে।
ছেলেকে নিয়ে সামিনার খুব দুশ্চিন্তা ছিল না। একটি মাত্র দুর্ভাবনা ছিল তার। ছেলে যেন মাদকে আসক্ত না হয়। পাড়ার উঠতি বয়েসি অনেকের নাম শোনা যাচ্ছে যারা মাদকের পাল্লায় পড়েছে। অথচ তাদের বাবা-মা সমাজে কত সম্মানীয়। সামিনা তাই এ ব্যাপারে কঠোর দৃষ্টি রাখত। ইউনিভার্সিটিতে ভর্তির কয়েক মাস পর থেকে ছেলে যখন মসজিদে গিয়ে নিয়মিত নামাজ পড়া শুরু করল তখন যেন সে হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছিল। একদিন রাশেদকে বলেই ফেলল, আমার ছেলেটা খুব ল²ীসোনা একটা। বাজে ছেলেদের সঙ্গে মিশে কখন আবার কী নেশা ধরে তা নিয়ে খুব চিন্তায় থাকতাম। ও ওসবে নেই। মসজিদ আর ঘর ছাড়া কোথাও যায় না। শুধু ওর এক বড় ভাইয়ের বাসায় যায়। ছেলেটা রাজিবকে খুব খেয়াল রাখে।
অ্যাম্বুলেন্সটি সশব্দে তার পাশে ব্রেক করলে যেন সম্বিত ফিরে পায় রাশেদ। গাড়ির চালকই জিজ্ঞেস করে, ভাই এটা কি গুর্খা ডাক্তার লেন?
রাশেদ হ্যাঁ সূচক মাথা নেড়ে বলে, আওয়াজটা বন্ধ রাখবেন। ব্যাক করে গাড়ি এই গলিতে ঢোকাবেন। আমাকে ফলো করে আসুন।
রাশেদ অন্যমনষ্ক থাকায় খেয়াল করেনি এতক্ষণ পাড়ার বেশ কয়েকজন তার আশপাশেই ছিল। অ্যাম্বুলেন্স আর তার চালকের সঙ্গে রাশেদের কথা বলা দেখে অনেকে বুঝে গেছে কিছু একটা ঘটেছে। অনেকে কৌতূহল নিয়ে এগিয়ে এসে রাশেদকে প্রায় ঘিরে ধরল। তাদের অনেকের প্রশ্নের জবাবে খুব ছোট্ট করে বলল শুধু, রাজিবের মায়ের জন্য।
ততক্ষণে অ্যাম্বুলেন্স বাড়ির সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। স্ট্রেচার নিয়ে দুজন নেমে এসে বলল, রোগী কোথায় স্যার।
সঙ্গে আসুন, বলে সিঁড়ি বেয়ে নিজের ঘরের দিকে এগিয়ে গেল রাশেদ। ভেতরে ঢুকে হাসপাতালের লোক দুটিকে দাঁড়াতে বলে শোবার ঘরে ঢুকল সে। ঢুকেই ভূত দেখার মতো আঁতকে উঠল সে। সামিনার হুঁশ ফেরেনি বোঝা যাচ্ছে বটে, এখনো শোয়া সে। তবে তাকে এরই মধ্যে বোরকা পরানো হয়েছে। মায়ের পাশে বসে এখনো বিড়বিড় করছে রাজিব। রাশেদ ভাবল রাজিব একা তার মাকে বোরকা পরালো কীভাবে।
লোক দুজন স্ট্রেচারে করে সামিনাকে তুলে নিয়ে অ্যাম্বুলেন্সে তুলল। রাজিব নিজে থেকেই বসল সামনে। পেছনে সামিনার সঙ্গে রইল রাশেদ। তার আরেক পাশে হাসপাতালের সে দুজন লোক।
রাতের সড়কে তেমন বেশি যানবাহন নেই। ফলে রাস্তায় কোথাও আটকালো না গাড়ি। নির্বিঘেœ পৌঁছে গেল ম্যাক্স হাসপাতালে। ঢোকার মুখেই তাদের জন্য অপেক্ষায় ছিল ডা. রায়হান। সামিনাকে খুব দ্রুত নেয়া হলো ইমার্জেন্সি লেখা রুমটায়। রায়হানসহ কয়েকজন ডাক্তার এগিয়ে গেলেন সেদিকে। রুমের বাইরে দাঁড়িয়ে রইল রাশেদ একা।
কয়েক মিনিট পরই রায়হান বেরিয়ে এসে রাশেদের সামনে দাঁড়াল। বলল, সম্ভবত স্ট্রোক করেছে। কী হয়েছিল?
ভাতের টেবিলে রাজিবের সঙ্গে একটু কথা কাটাকাটি হচ্ছিল…
রাশেদের কথা শেষ করতে না দিয়ে রায়হান পাল্টা প্রশ্ন করল, ভাতের টেবিলে মানে? ভাবি কি বোরকা পরে ভাত খায় নাকি? আচ্ছা পরে কথা হবে। সমস্যা নেই। ভাবিকে আইসিইউতে নিয়ে যাচ্ছি। আমি কয়েকজন স্যারকে কল দিয়েছি। ভয় পেয়ো না।
এরই মধ্যে পাড়া থেকে অনেকে এসেছে। তাদের কেউ কেউ নিজে থেকেই ছোটাছুটি করছে। রাশেদ দেখল সামিনাকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে আইসিইউতে।
আইসিইউতে ঢুকতে পারল না রাশেদ। গেটম্যানকে অনুরোধ করার পর বলল, স্যার এসে আপনাকে ভেতরে নিয়ে যাবে। আপাতত অপেক্ষা করুন।
রাশেদ বসে আছে একটি আসনে। তার চতুর্দিকে পাড়ার বেশকিছু লোকজন। তারা রাশেদের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেছে কিন্তু তার কাছ থেকে কোনোরূপ প্রতিক্রিয়া না পেয়ে তারা কাছাকাছিই বসে রইল। একবার রায়হান এখানে এসে বলে গেছে, তিনজন সিনিয়র ডাক্তার কল করেছি। তারা আসছেন। স্ট্রোক করেছে বলে মনে হচ্ছে। ভয় পেয়ো না। রায়হান যেতে যেতেই খুব তাড়াহুড়া করে কয়েকজন ডাক্তার আইসিইউতে ঢুকলেন বলে মনে হলো।
একসময় রাশেদ উঠে গিয়ে একেবারে কোনার একটি চেয়ারে গিয়ে বসে। সেখানে পর্যাপ্ত আলোও নেই। তার মনে হলো সে অনেক দিন ধরে হাসপাতালের এই বারান্দায় বসে আছে। ভেতরে তার অসুস্থ স্ত্রী। তাকে দেখতে দিচ্ছে না।
তার মনে পড়ছে ২০/২২ বছর আগে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের গাইনি বিভাগের সামনে বসে আছে সে। তাদের প্রথম সন্তান ভূমিষ্ঠ হবে। ডাক্তাররা বলেছেন সকালেই সিজার অপারেশন করা হবে। বেশকিছু জটিলতা থাকায় প্রাইভেট হাসপাতালে না গিয়ে সরকারি হাসপাতালে আসতে হয়েছে। এখানে তার বন্ধু-পরিচিতজন আছেন বেশ ক’জন।
ঘটনার আকস্মিকতায় খেই হারিয়ে ফেলেছে রাজিব। বাবা-মার ওপর জমে থাকা ক্ষোভ আজ একসঙ্গে ঝেড়ে ফেলে অনুশোচনা হচ্ছে তার। বাবা-মা তার স্বাধীনতায় কোনোদিন বাধা দেয়নি। তার কোনো চাহিদাও অপূর্ণ রাখেনি তারা। এসব ভাবতে ভাবতে মায়ের জন্য এক বুক শূন্যতা গ্রাস করে তাকে। সে ছুটে যায় বাবা যেখানে বসে আছে সেখানে। বাবার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে হাউমাউ করে কাঁদে সে।
রাশেদের কোনো ভাবান্তর নেই। সে মাথা নিচু করে বসে থাকে। একসময় কান্না থামিয়ে রাজিব বলে, বাবা, মা’র অবস্থা কি খুব খারাপ? কী বলেছে ডাক্তার?
অনেক ক্লান্তি নিয়ে মুখটা সামান্য ওপরে তোলে রাশেদ। তারপর খুব নিম্ন কণ্ঠে বলে, আপনার মায়েরও কি অসুখ? আমার স্ত্রী অপারেশন থিয়েটারে। তার সিজার হচ্ছে। আমাদের প্রথম সন্তান হতে যাচ্ছে। আমি অনেকক্ষণ ধরে বাইরে বসে আছি ভেতরে ডাকছে না কেউ।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়