নম্বর জালিয়াতির অভিযোগ : নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রককে হাইকোর্টে তলব

আগের সংবাদ

ভোটের হাওয়া কোন দিকে? বরিশালে চার প্রার্থীর মধ্যে তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বিতার আভাস

পরের সংবাদ

গোপন চিঠি

প্রকাশিত: জুন ৯, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জুন ৯, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

একটি চিঠি রিয়ার জীবনের সব রং পাল্টে দেয়। ৯ মাসের যুদ্ধ শেষ। সবাই গ্রামে ফিরে আসে। শুধু রাজা আসে না। সবার ধারণা রাজা আর নেই। যুদ্ধে শহীদ হয়েছে। রিয়া মেনে নিতে পারে না। ওর বিশ্বাস রাজা বেঁচে আছে। একদিন ফিরে আসবে। দেখতে দেখতে দুই বছর গড়ায়। দুই বছরের মাথায় রিয়ার নামে একটা চিঠি আসে।
চিঠির বিষয়টা অন্য সবার কাছে গোলমেলে মনে হয়। কিন্তু রিয়ার কাছে তা মনে হয় না। রাজা যখন যুদ্ধে যায়, তখন রিয়া সাত মাসের অন্তঃসত্ত্বা। রাজা বলেছিল, মেয়ে হবে। রিয়া বলেছিল, ছেলে হবে। রাজা অনাগত মেয়ের নাম রেখেছিল আনা। রিয়া ছেলের নাম রেখেছিল রাতুল।
‘তোমার রাতুল কেমন আছে? কত বড় হলো?’ রাজা চিঠিতে জানতে চেয়েছে। এরপর আর কিসের সন্দেহ! রাতুল বা আনার কথা ওরা দুজন ছাড়া আর কারো জানার কথা না।
রিয়া চিঠিটা বুকে জড়িয়ে ধরে বলে, ‘রাতুল না, আনা। তোমার কথাই ঠিক হয়েছে। মেয়ে হয়েছে। তোমার মুখ পেয়েছে। গায়ের রং পেয়েছে আমার।’
রিয়ার চোখে খেজুরে রসের মতো আনন্দ অশ্রæ টপটপ করে পড়ে।
মায়ের চোখে পানি দেখে আনা বলে, ‘মা তুমি কাঁদছ কেন?’ দাদি বলল, চিঠি এসেছে। বাবা বেঁচে আছে। ফিরে আসবে।’
‘হ্যাঁ, মা। তোর বাবা বেঁচে আছে।’
‘আসবে না?’
‘আসার কথা তো চিঠিতে লেখেনি।’
‘তুমি তাড়াতাড়ি আসার কথা লিখে দাও।’
‘কীভাবে লিখব। ঠিকানা তো দেয় নাই। কোথা থেকে চিঠিটা এসেছে, বুঝতে পারছি না।’
‘তা হলে এমনি এমনি একদিন চলে আসবে। তুমি আর কেঁদো না। এতদিন তো শুধু দিন-রাত কেঁদেছ।’
মা-মেয়ের এ কথার মধ্যে রিয়ার শ্বাশুড়ি জড়িনা বেগম ঢুকে পড়ে। বলে, ‘তুমি সেদিন ভাই বাড়ি গেলা। কেন, কিছু তো বললে না।’
দু’গ্রাম দূরে রিয়ার বাবার বাড়ি। বাবা-মা বেঁচে নাই। বাঁচার মধ্যে বেঁচে আছে এক ভাই হাবিবুল্লা। সুবিধা-অসুবিধার কথা রিয়া ভাইকে গিয়ে বলে। চিঠিটা পাওয়ার পরে রিয়া ছুটে গেছে হাবিবুল্লার কাছে।
‘ভাইয়ের কাছে আপনার ছেলের চিঠির কথা বলতে গেছিলাম।’
‘শুনে কী বলল?’
‘চিঠিতে তো ঠিকানা দেয় নাই। ঠিকানা থাকলে খুঁজে দেখতে পারত, সেই কথা বলল।’
‘আমার ওতো সেই কথা। ঠিকানা দেয় না ক্যান? মার জন্য পরান না পোড়ে, মেয়েডার কথা মনে কইরে তো একবার আইতে পারে।’
এত দুঃখের মধ্যেও রিয়ার মুখে হাসি ফোটে। লাজ নম্র ভাবে বলে, ‘আম্মা, মেয়ের কথা জানব কীভাবে? মেয়ে হয়েছে তা কি আপনার ছেলে জানে?’
‘জানব না কেন। যাওয়ার সময় তো তুমি পোয়াতি ছিলে, দেখে যায়নি?’
‘মেয়ে না হয়ে, ছেলে ওতো হতে পারত। বলবেন, সন্তানের কথা মনে পড়ে না?’
জরিনা বেগম রিয়ার কথার অর্থ বুঝতে পারে না। তাই আর কোনো কথা না বাড়িয়ে পাক ঘরের দিকে যায়। যাওয়ার সময় হাতের লাঠিটা খুঁজে পায় না। আনা লাঠিটা এনে দাদির হাতে ধরে দেয়।
রিয়াও রাজার না আসার কোনো কারণ খুঁজে পায় না। ভাবে, তার ওপর কি কোনো অভিমান করে আসে না, না অন্য কিছু? রিয়ার পুরনো কথা মনে পড়ে, যুদ্ধে যাওয়ার আগের দিন রিয়াকে খুব করে কাছে চেয়েছিল। রিয়া যায়নি। সেদিন ওর প্রচণ্ড শরীর খারাপ ছিল। রাজাকে এ কথা বুঝিয়ে বলেছিল, কিন্তু রাজা বুঝতে পারার পরেও মনটা ভার করেছিল। এসব কথা রিয়ার মনে পড়ে, আর রিয়া কষ্ট পায়। আবার মনকে বুঝ দেয়, রাজা তো এত অবুঝ না। এত অল্প কারণে সে সন্তান, বউ, মা, সবার কাজ থেকে দূরে সরে থাকবে?
রিয়াদের পাশের বাড়ির ভাবি, মুনমুন। রিয়ার বয়সি। বন্ধুর মতো। নতুন বিয়ে হয়েছে।
সব শোনার পরে মুনমুন বলে, রাজা ভাই কোথাও বিয়ে করে, সেখানে থেকে গেল নাতো?
এ কথা শুনে রিয়া বলে, ও মুক্তিযোদ্ধা। দেশ স্বাধীন করেছে। মুক্তিযোদ্ধারা এ কাজ করতে পারে?
মুনমুনকে মুখে এ কথা বললেও, মুনমুনের কথা শুনে রিয়ার ভেতরটা খচ করে ওঠে। এ কথাটা তো রিয়া ভেবে দেখেনি। মুক্তিযুদ্ধের সময় কত জায়গায় গেছে, কোনো সুন্দরী মেয়ের পাল্লায় পড়ে, সেখানে আটকে যায়নি তো। অথবা এমনও হতে পারে, মানবিক কারণে কোনো বীরঙ্গনার কাছে রয়ে গেছে।
রিয়ার ভাঙা মনে, নদীর ঢেউয়ের মতো কত কথা ভেসে আসে। সারা দিন সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে রিয়ার সময় কাটে। তবে ওর দৃঢ় বিশ্বাস রাজা একদিন ফিরে আসবে। এর মধ্যে আরো তিনটা চিঠি এসেছে। সব চিঠিই সংক্ষিপ্ত। কেমন আছ, মা কেমন আছে, রাতুল কেমন আছে, ওর বয়স এখন কত হলো, স্কুলে যায়? নিজের কথা কিছুই লেখে না। রিয়ার খুব জানতে ইচ্ছা করে রাজা কেমন আছে। না আসুক, ও যদি ঠিক ঠিক জানতে পারত, ও বেঁচে আছে এবং ভালো আছে, তাতেই ও শান্তি পেত।
যুদ্ধের পর পর রিয়া কত আশা নিয়ে অপেক্ষা করেছিল, দেশ স্বাধীন করে রাজা গ্রামে ফিরবে, গ্রামের সব মানুষ দৌড়ে আসবে, জানতে চাবে, কয়টা মিলিটারি মেরেছে, কোথায় কোথায় যুদ্ধ করেছে? তার নিজের মধ্যেও কত কথা জমে আছে। এসব কথা বলার জন্য মন সব সময় ছটফট করে।
রিয়া একটা সরকারি প্রাইমারি স্কুলের পড়ায়। যুদ্ধের সময় স্কুলটা বন্ধ ছিল। এখন আবার খুলেছে। যত সময় রিয়া স্কুলে থাকে, তত সময় সবকিছু ভুলে থাকে। বাড়ি ফিরে এলে সব চিন্তা, পুরনো কথা, ঝাঁকে ঝাঁকে মনে পড়তে থাকে। কোনো কাজে মন বসাতে পারে না। কাজে ভুল হয়। শাশুড়ির গালমন্দ খায়। কী করবে। বিনাবাক্যে সবকিছু হজম করে। সামনে মে মাসে আনার বয়স চার বছর হবে। ও এখন সব কিছু বোঝে। বিশেষ করে মায়ের কষ্ট। তাই সব সময় আনা মায়ের কাছে কাছে থাকে। যখন যেটা চায়, এগিয়ে দেয়। রিয়াও এই মেয়েকে আঁকড়ে ধরে বেঁচে আছে। ওর মধ্যে আশার আলো দেখে। মেয়েকে নিয়েই বেশ ছিল। কিন্তু এতদিন পরে রাজার চিঠি পেয়ে, নতুন করে আশা জাগে মনে।
ময়মুননেছা সারারাত ঘুমাতে পারেন না। শুধু এপাশ ওপাশ করেন। বয়স হলে যা হয়। পা ফোলা, মাজা ব্যথা, মাথা ব্যথা লেগেই থাকে, তার ওপর দুচোখে ভালো করে দেখতে পান না। আবছা আবছা দেখেন। দিন দিন শরীরটা খারাপ হচ্ছে, নড়াচড়া করতেও কষ্ট হয়। ভোররাতের দিকে একটু ঘুমান, তাই প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠতে দেরি হয়ে যায়। নামাজ কাজা হয়। বাবরের ঘুম ভেঙে যায় সেই সকালে। পাখি ডাকা ভোরে। ঘুম থেকে উঠে বাবর নিজের হাতে আটারুটি বানায়, পাঁচমিশালি সবজি রান্না করে। চায়ের পানি চুলায় দেয়, তারপর ময়মুননেছার জন্য অপেক্ষা করে, কখন ঘুম থেকে উঠবে। ঘুম থেকে ওঠার পর ময়মুননেছাকে প্রথমে চা দেবে, একটু পরে নাস্তা। একই সঙ্গে সেও নাস্তা সেরে নেবে। এটা নিত্য দিনের রুটিন।
বাবর মুক্তিযুদ্ধের সময় রান্নার কাজ করত। ও ছিল মুক্তিবাহিনীর কুক। সবাই যুদ্ধে গেলে কে মুক্তিযোদ্ধাদের রান্না করে খাওয়াবে? বাজার করবে? ওদের দলের নেতা রায়হান ভাই, বাবর, রাজা ও মতিকে আলাদা করে বলেছিল, এরা ক্যাম্পে থাকবে, বাজার করবে, রান্না করবে, প্রয়োজন মতো মালপত্র এক ক্যাম্প থেকে অন্য ক্যাম্পে নেয়া-আনা করবে। বাবর এতে মন খারাপ করে না, বরং উৎসাহ নিয়ে রান্নার কাজ করতে থাকে। ওখানে রান্নার করতে করতে, এখন আর কোনো অসুবিধা হয় না। মাছ, মাংস, তরিতরকারি সব কিছুই রান্না করতে পারে। ময়মুননেছার রহিমা নামে সতেরো-আঠারো বছরের একজন কাজের মেয়ে ছিল, বাবর আসাতে ময়মুননেছা তাকে বিদায় করে দিয়েছেন। এতদিন বাবর ছিল না, ময়মুননেছাকে রহিমা অনেক জ¦ালিয়েছে। ঠিক মতো রান্না করে না, সময় মতো খাবার দেয় না। শুধু পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে বেড়ায়। বাবর আসার পর, বাবরের কাছে রহিমার নামে হাজার রকম নালিশ করেছেন ময়মুননেছা।
যুদ্ধ শেষ হওয়ার পরে সবাই গ্রামে ফিরে আসে, কিন্তু বাবর ফিরে আসে না। তখন সবাই বলাবলি করে, বাবর আর বেঁচে নেই। এ কথা শুনে ময়মুননেছার মন ভেঙে যায়। সারাক্ষণ ছেলের জন্য কাঁদতে থাকেন। নাওয়া-খাওয়া ছেড়ে দেন। শরীর আরো ভেঙে পড়ে। তাকে দেখার আপন বলে কেউ নেই। ওই সময় রহিমাও ছিল না। পাশের বাড়ি থেকে কখনো কেউ খাবার দিলে, খান, না দিলে না খেয়ে থাকেন। পাড়াপড়শি আফসোস করে, বলে, একটা মাত্র ছেলে, তা যুদ্ধে গেল, আর ফিরে এলো না। বুড়ির কী কপাল। স্বামী মারা গেল নৌকা ডুবে, আর একমাত্র ছেলেডা গেল যুদ্ধে মরে। বুড়ি আর কয় দিন বাঁচবে?
ঠিকই ময়মুননেছা রোগে, শোকে, না খেয়ে প্রায় মরে যাচ্ছিলেন, এমন সময় একদিন ছেলে ফিরে আসে। ছেলেকে পেয়ে ময়মুননেছা বেঁচে ওঠেন, বেঁচে থাকার অবলম্বন খুঁজে যান।
আসলে যে ফিরে আসে, সে রবি। বাবর বেঁচে নেই। অক্টোবর মাস। যুদ্ধ প্রায় শেষ দিকে। ওরা মদনপুর প্রাইমারি স্কুলে ক্যাম্প করেছে। মদনপুর থেকে মাইল তিনেক দূরে মতিহার রেলস্টেশন, ওখানে মেলেটারিরা ঘাঁটি করেছে। ওই ঘাঁটিতে মুক্তিবাহিনীর সবাই অপারেশনে গিয়েছে। রবিরা রাতের রান্না করে রেখেছে, অপারেশন শেষ করে সবাই এসে রাতের খাবার খাবে। অনেক রাত হয়ে যায়, তখনো অপারেশন থেকে কেউ ফিরে আসে না। ওদের আসতে দেরি দেখে রবিরা খেয়েদেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে, শেষ রাতের দিকে হঠাৎ বিকট শব্দ। প্রথমে রবিরা ভেবেছিল, ওদের স্কুল ঘরে কী মেলেটারিরা আক্রম চালাল? না, একটু পরেই ওরা টের পায়, রান্না করার গ্যাসের সিলিন্ডার বাস্ট হয়ে আগুন ছড়িয়ে পড়েছে স্কুল ঘরে। ঘুম থেকে উঠে তাড়াতাড়ি করে ওরা রুম থেকে বের হতে পারে না। তিনজনই মারাত্মকভাবে আহত হয়। ওদের শরীরের বেশির ভাগ অংশ পুড়ে যায়। অপারেশন থেকে ফিরে এসে সবার এই অবস্থা দেখে, কাছের একটা হাসপাতালে নিয়ে ওদের ভর্তি করে দেয়। কিন্তু রবি ছাড়া অন্য দুজন দুদিন পরেই মারা যায়। রবিকেও দীর্ঘদিন ওখানে থেকে চিকিৎসা নিতে হয়। সেরে উঠতে প্রায় বছর খানেক সময় লেগে যায়। রবি, বাবরে বাড়ির ঠিকানা জানত। শুধু ঠিকানা না, বাড়িতে ওর একমাত্র মা আছে, মায়ের অনেক বয়স হয়েছে, ভালো করে চোখে দেখতে পান না। এসব কথাও জানত। ওরা যখন অবসর পেত, তখন একে অন্যে বাড়ির গল্প করত। রাজা, রবিকে ওর বাড়ির কথা, স্ত্রীর কথা সব বলেছে। এভাবে নিজেদের কথা শেয়ার করে, একে অন্যের খুব কাছের হয়ে উঠেছিল। রবি সেরে উঠে, ঠিকানা মতো অন্য দুই বন্ধুর জিনিসপত্র পৌঁছে দিতে প্রথমে বাবরদের বাড়ি আসে, এসে নিজের পরিচয় দেয়ার আগেই ময়মুননেছার হাউমাউ করে কান্না দেখে, বাবর যে মারা গেছে সে কথা বলার সাহস পায় না। নিজের পরিচয়ও দিতে পারে না। রবিও সব ভুলে ময়মুননেছাকে মা বলে জড়িয়ে ধরে। এতদিন পরে আসা তার ওপর আগুনে হাত-মুখের অনেক অংশ পুড়ে যাওয়ায় গ্রামের মানুষও বাবর আর রবিকে আলাদা করতে পারে না। আর ময়মুননেছা তো আগের থেকেই চোখে কম দেখতেন। তাই রবি, বাবর হিসেবেই এখানে, ময়মুননেছার কাছে থেকে যায়। তাছাড়া ওর তো কোথাও যাওয়ার জায়গাও ছিল না। ছোট সময় বাবা-মাকে হারিয়েছে। পরে নানা বাড়িতে বড় হয়েছে। কিন্তু নানা মারা যাওয়ার পরে ও বাড়িতেও জায়গা হয় না। এবাড়ি, ওবাড়ি জায়গির থেকে যখন মেট্রিক পরীক্ষা দেবে তখনই যুদ্ধ শুরু হয়, অন্য বন্ধুদের সঙ্গে চলে যায় ভারতে।
এখন ওর শুধু চিন্তা, কখন রাজার জিনিসপত্র তার পরিবারের কাছে পৌঁছে দেবে। অনেকবার যাওয়ার কথা বলেছে, কিন্তু ময়মুননেছা একদিনের জন্যও ছেলেকে হাত ছাড়া করতে চান না। তাছাড়া রাজাদের বাড়ি গিয়ে কী-ইবা বলবে! কোনো স্ত্রী কি স্বামীর মৃত্যু সংবাদ সহজভাবে মেনে নিতে পারে?
বাপ, চায়ের পানি ফুটছে? ঘুম ঘুম চোখে ময়মুননেছা বাবরকে বলেন। বাবরকে বাপ ছাড়া কথা বলেন না। রবি-ই এখন বাবর।
ময়মুননেছা ছেলে ফিরে আসার পর থেকে ছেলেকে একনজর চোখের আড়াল করতে চান না। মনে করেন, ছেলে কোথাও গেলে একমুহূর্তও তিনি বাঁচবেন না। এতদিন বাবর না থাকাতে, ওর মনে একটা ভয় ঢুকেছে। পারলে ছেলেকে বুকের মধ্যে আঁকড়ে ধরে বসে থাকেন।
বাবরও পারতপক্ষে মাকে ছেড়ে দূরে কোথাও যায় না। শুধু মাছ, তরিতরকারি কিনতে শুক্র ও সোম হাটবারে হাটে যায়। এছাড়া সব সময়ই মায়ের চোখের সামনে থাকে। যখন যেটা লাগে এগিয়ে দেয়। খাবার সময় এক গøাস পানি হাতে করে দাঁড়িয়ে থাকে, গলায় ভাত ঠেকলে, কখন মা পানি চান। মা মাঝে মধ্যে বিছানা থেকে উঠতে পারেন না, তখন বাবর ভাত নলা করে মাকে খাইয়ে দেয়। মাছ বেছে দেয়। খাওয়ার পর গামছা দিয়ে মুখ মুছে দেয়।
একবার বাবর ময়মুননেছাকে বলে, ‘মা, আমি দুদিনের জন্য একটু রাজবাড়ী যাব। আমার এক বন্ধুর বাড়ি। যুদ্ধের সময় আমরা একসঙ্গে ছিলাম। থাকব না, গিয়েই চলে আসব। যেতে একদিন, আসতে একদিন। এই দুদিন আপনি একা থাকতে পারবেন না?’
ছেলের কথা শুনে ময়মুননেছা বলে, বাপ, যুদ্ধে যাওয়ার আগে তুই তো আমারে, তুই-তুই করে কথা বলতি, এখন আপনি-আপনি করে কথা বলছিস ক্যান? এ কথার কোনো উত্তর দিতে পারে না রবি। ময়মুননেছার মুখের দিকে হাঁ করে চেয়ে থাকেন।
ছেলের রাজবাড়ী যাওয়ার কথা শুনে ময়মুননেছা খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করে দেন। শুধু খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করে বসে থাকেন না, আরও শক্ত কথা বলেন, ‘তুই যদি আমারে ফেলায় কোনো খানে যাস, তাহলে আইসে তুই আমার মরামুখ দেখবি। তোর যদি কোথাও যেতে হয়, তয়, আমার মরার পরে যাস। তখন কে তোরে বাধা দেবে।’
এ কথার পর রবি আর রাজবাড়ী যাওয়ার কথা মুখে আনে না। কয়েকদিন মুখ কালো করে বসে থাকে। কিন্তু ময়মুননেছাকে বুঝতে দেয় না। আড়ালে-আবডালে মন খারাপ করলেও ময়মুননেছার সঙ্গে হেসে হেসে কথা বলে, নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে।
রবির রাজবাড়ী যাওয়া হয় না। তাই ও চিঠি লেখে। চিঠিতে রাজার মৃত্যুর কথা লিখতে পারে না। তাই অন্য কথা লেখে। যা পড়ে রিয়া বেঁচে থাকার প্রেরণা পাবে।
রাজার কাছ থেকে রিয়া আগে যেখানে মাসে দু-তিনটে চিঠি পেত, এখন সে চিঠির সংখ্যা কমে তিন মাসে-চার মাসে একটা চিঠি আসে। চিঠির আকারও কমে এসেছে। কেমন আছ, ছেলে কেমন আছে, গাভীটা বিয়াইছে কিনা, পালে এখন কয়টা হাঁস-মুরগি আছে? এসব কথা জানতে চায়।
রিয়া এ রহস্যের কূলকিনারা বুঝতে পারে না। রিয়া ভাবে, বছরের পর বছর একটা চিঠি দিলে-ই সব দায়িত্ব শেষ হয়ে যায়? হয়েছে মেয়ে, বেচারা ছেলে ভেবে বসে আছে। কীভাবে তার ভুল ভাঙাবে? কীভাবে বলবে আনা এ বছর ক্লাস সিক্স থেকে সেভেনে উঠেছে। তার এ অ-বলা কথা রিয়ার ভেতরে গোঙরাতে থাকে। কাউকে বলতেও পারে না, সইতেও পারে না। শুধু ভেতরে ভেতরে দগ্ধ হতে থাকে।
এতদিনে রিয়ার বিশ্বাসের চির ধরা শুরু হয়েছে। রাতে শুয়ে শুয়ে রিয়া নিজেকে নিজে প্রশ্ন করে, মানুষটা সত্যি কি বেঁচে আছে? এতদিনে তাকে, তার সন্তানকে দেখতে মন চায় না। আর যখন চিঠি দেয়, তা ঠিকানা দিতে ক্ষতি কী? এ প্রশ্নের উত্তর কে এনে দেবে রিয়াকে।
এর মধ্যে শ্বাশুড়ি রিয়াকে একদিন বলে, ‘দেখো বউমা, তোমার স্বামী নাই, তুমি একা থাকো, আমি কি তোমাকে সারা জীবন পাহারা দিয়ে রাখতে পারব? তোমাকে কত বললাম, আরেকটা বিয়ে করো। তুমি শুনলে না। এই চিঠি চিঠি খেলাটা ভাঁওতাবাজি। এটা তোমার পরিচিত কেউ একজন, সব জেনেশুনেই তোমার সঙ্গে ছলচাতুরি করছে। সামনে আসতে পারছে না, আড়ালে থেকে ডুগডুগি বাজাচ্ছে।
আনা স্কুল থেকে হাফাতে হাফাতে দৌড়ে আসে। ওর হাতে একটা খাম। খামটা মায়ের হাতে দিয়ে বলে, ‘মনে হয় বাবার চিঠি। তাড়াতাড়ি খোল। দেখ কী লিখেছে। মনে হয় বাড়ি আসার কথা লিখেছে। ’
রিয়া চিঠিটা হাতে নেয় না। একটু রাগত স্বরে মেয়েকে বলে, ‘তোর বাবার চিঠি তুই নে। আমার অই চিঠি নিয়ে কোনো কাম নাই।’
আনার মুখটা কালো হয়ে যায়। কী করবে বুঝতে পারে না। চিঠিটা হাতে করে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। আনার এখন যা বয়স তাতে অনেক কিছু বুঝতে পারে। মায়ের কষ্ট বুুঝতে পারে। কী করে মায়ের কষ্ট একটু কমাবে বুঝতে পারে না। একদিন আনা বলে, ‘মা, আমি আর পড়ব না। তোমার কষ্ট দেখে আমার আর ভালো লাগে না। আমি গ্রামে গ্রামে বাবাকে খুঁজব। যেখানে থাকে, সেখান থেকে বাবাকে খুঁজে আনব। বাবাকে পেলে তোমার কষ্ট কমবে, তোমার মুখে হাসি ফোটবে। বাবাকে পেলে আমারও ভালো লাগবে। আমাদের আর কোনো দুঃখ থাকবে না।
আনা কথা শেষ করতে পারে না। রিয়া আনার মুখটা চেপে ধরে। তার পর বলে, ‘পড়ব না, এ কথা কোনো দিন বলবি না। তোর দিকে চেয়েই আমি বেঁচে আছি। আমি তোকে পড়ালেখা শেখায়ে বড় করব। তুই আগে বড় হ। তারপর পারলে বাবাকে খুঁজে বের করিস।’
বিয়ে করো, বিয়ে করো, শ্বাশুড়ির এ কথা শুনে রিয়ার গায়ে ঘেন্না ধরে। কিন্তু শ্বাশুড়ির মুখের ওপর কিছু বলে না। ধৈর্যের পরীক্ষা দেয়। যখন রাজার কোনো খোঁজখবর ছিল না তখন বলেছে ঠিক আছে, এখন রাজার চিঠি এসেছে, এখন বিয়ের কথা বললে গায়ে আগুন ধরারই কথা। এসব পুরনো কথা, নতুন কথা, ভাবতে ভাবতে রিয়া সারা রাত ঘুমাতে পারে না। কোনো কোনো দিন কখন সকাল হয় বুঝতে পারে না।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়