টিসিবির জন্য চিনি ও ভোজ্য তেল কিনবে সরকার

আগের সংবাদ

চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা কোন পথে : মূল্যস্ফীতি > ডলার সংকট > বৈদেশিক ঋণের সুদ ও ভর্তুকি ব্যয় > কর ও ব্যক্তি করদাতা বাড়ানো

পরের সংবাদ

স্বাধীন বাংলাদেশের গীরিফুল : বঙ্গবন্ধু ও নজরুল

প্রকাশিত: মে ২৬, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: মে ২৬, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

দার্শনিক কবি আল্লামা ইকবালকে যদি দ্বি-জাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে অর্জিত সাম্প্রদায়িক পাকিস্তানের স্বপ্নদ্রষ্টা কবি বলা যায় (পাকিস্তানের জাতীয় কবি), তাহলে অসাম্প্রদায়িক কবি, হিন্দু-মুসলমানের মিলনের কবি, বাঙালি জাতীয়তাবাদের কবি, স্বাধিকার, স্বাধীনতার কবি নজরুল, যিনি ১৯৪১ সালে তথা বাংলাদেশের জন্মের ৩০ বছর আগেই ঘোষণা করেছেন, ‘এই পবিত্র বাংলাদেশ, বাঙালির আমাদের…’, অনিবার্যভাবেই বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা কবি।
পূর্ব বাংলা যে স্বাধীন ‘বাংলাদেশ’ রাষ্ট্রে পরিণত হবে তা কাজী নজরুল ইসলাম তার দিব্যদৃষ্টিতে দেখতে পেয়েছিলেন সেই ব্রিটিশ আমলে, লীগ-কংগ্রেসের ধর্মভিত্তিক ভারত-পাকিস্তান বিভাজনের টাগ-অব ওয়ারের প্রাক্কালে। কল্পনায় দেখতে পেয়েছিলেন এই স্বাধীন দেশের স্থপতি, অনাগত-বীর সিপাহসালারকে। যার নাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা কবি নজরুল তার আভাস ‘আমি সৈনিক’ প্রবন্ধে এইভাবে দিয়েছেন, “রবীন্দ্রনাথ, অরবিন্দ, প্রফুল্ল­ বাংলার দেবতা। কিন্তু সেনাপতি কই? আমরা যে আশা করে আছি, কখন সে মহা-সেনাপতি আসবে? যার ইঙ্গিতে আমাদের মতো শতকোটি সৈনিক বহ্নি-মুখ পতঙ্গের মতো তার ছত্রতলে গিয়ে ‘হাজির-হাজির’ বলে হাজির হবে। হে আমার অজানা প্রলয়ঙ্কর মহা-সেনানী, আমি তোমায় দেখি নাই।”
কাজী নজরুল ইসলাম ১৯৪১ সালে ‘নবযুগ’ পত্রিকায় দেশের তথা বাংলার তৎকালীন অবস্থা সম্পর্কে লেখেন, ‘তার (বাংলার) মাঠের ধান, পাট, রবিফসল, তার সোনা, তামা, লোহা, কয়লা, তার সর্ব ঐশ্বর্য বিদেশি দস্যু বাটপারি করে, ডাকাতি করে নিয়ে যায়। সে বসে বসে দেখে। সে বলতে পারে না, ‘এ-আমাদের ভগবানের দান। এ-আমাদের মাতৃ-ঐশ্বর্য। খবরদার! যে রাক্ষস একে গ্রাস করতে আসবে, যে দস্যু ঐশ্বর্য স্পর্শ করবে, তাকে, প্রহারেণ ধনঞ্জয় দিয়ে বিনাশ করবো, সংহার করবো, বিনা ঔষধে পথ্য না পেয়ে ছেলেমেয়ে মরিবেনা, শিক্ষা পাইবে, দীক্ষা পাইবে, দাসত্ব করিবে না… এই মোর সাধ, সাধনা আমার, প্রার্থনা নিশিদিন, মানুষ রবেনা অন্ন-বস্ত্রহীন আর পরাধীন।’
পরাধীনতার বিপরীত শব্দ ‘স্বাধীন’। কাজী নজরুল ইসলাম তার কবিতায়, ছোটগল্পে, উপন্যাসে, সংগীতে, বক্তৃতায়, নাটকে, রাজনীতিতে, সংগ্রামে গণমানুষের মুক্তি তথা স্বাধীনতার জন্য লড়াই করে গেছেন। ৪০ বছর পর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠেও ১৯৭১-এর ৭ মার্চে একই ঘোষণা শুনি।
‘সোনার বাংলা শ্মশান কেন’? পূর্ব বাংলার সোনালি আঁশ পাট, চা, চামড়া, কাগজ বিদেশে রপ্তানি করে, পূর্ববাংলার সম্পদ লুণ্ঠন করে, এ অঞ্চলকে পশ্চিমারা অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু করে ফেলেছে। সুজলা, সুফলা, শস্য-শ্যামলা সোনার বাংলাকে শ্মশান করাচিতে রঙমহল- ক্লিফটন তৈরি করছে। আমাদের বেলা কিছু না, তারা ‘তারবেলা’ বাঁধ তৈরি করেছে। লাহোর পিন্ডিকে বালাখানায় পরিণত করেছে। অতঃপর বঙ্গবন্ধু পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি পশ্চিম পাকিস্তানের অবাঙালি শাসকগোষ্ঠীর এসব সীমাহীন জুলুম, নির্যাতন, অর্থনৈতিক শোষণ, লুণ্ঠনের বিরুদ্ধে কঠোর প্রতিবাদ, আন্দোলন ও স্বাধীনতার ডাক দিলেন,
‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম
এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’।
একজন বিপ্লবী কবি, স্বপ্নদ্রষ্টা। একজন বিপ্লবী সিপাহসালার সে স্বপ্নের বাস্তবায়ক। স্থপতি- পুরুষ।
কাজী নজরুল ইসলাম তার আধ্যাত্মিক দৃষ্টিপটে বাঙালি জাতির ত্রাণকর্তা বঙ্গবন্ধুকে তার নেতৃত্বদান দেখতে পেয়েছিলেন। কবি তার, ‘জয় হবে’ কবিতায় অদম্য মনোবল নিয়ে লেখেন-
‘বন্ধু গো তোল শির!
তোমারে দিয়াছি বৈজয়ন্তী বিংশ শতাব্দীর।
মোরা যুবদল, সকল আগল ভাঙিতে চলেছি ছুটি,
তোমারে দিয়াছি মোদের পতাকা, তুমি পড়িওনা লুটি’।
চাহিনা জানিতে- বাঁচিবে অথবা মরিবে তুমি এ-পথে,
এ-পতাকা বয়ে চলিতে হইবে বিপুল ভবিষ্যতে।’
বঙ্গবন্ধুর সাহসিক নেতৃত্বে, সংগ্রামে বাংলাদেশ নামের ভূখণ্ড জন্ম নিয়েছে। অতঃপর তাকে জীবনও দিয়ে হয়েছে। নজরুলের ভবিষ্যদ্বাণী, ‘বাঁচিবে অথবা মরিবে তুমি এ-পথে’, শতভাগ সত্যে পরিণত হয়ে রইল। কবি স্রষ্টা। কবি দ্রষ্টা। (তবে সব কবি নয়)

দুই.
কাজী নজরুল ইসলাম গণমানুষের কবি। বিশ্বের নির্যাতিত মজলুম মানুষের কবি। স্বাধিকার, স্বাধীনতা আন্দোলনের কবি। বাঙালি জাতীয়তাবাদের কবি। (প্রথম ভারতীয় জাতীয়তাবাদের কবি এবং ভারতের স্বাধীনতা ঘোষণার কবিও কাজী নজরুল ইসলাম)। মানবতাবাদী কবি। বিশ্বের একমাত্র অসাম্প্রদায়িক ও ধর্মনিরপেক্ষ কবি। সাম্যবাদী কবি। বাঙালির জাতীয় সাহিত্যের (যে সাহিত্য ধর্ম, বর্ণ, জাতপাত, সম্প্রদায়ের ঊর্ধ্বে থেকে সবার কথা, সুখ, দুঃখ, আনন্দ, বিরহ, সমাজ সংস্কৃতি, স্বাধিকার, স্বাধীনতার কথা বলে) রচয়িতা কবি। বাংলা সাহিত্য নবযুগ আনয়নের কবি। যুগ-প্রবর্তক কবি। বিপ্লবের কবি। স্বাধিকার আন্দোলন ও সংগ্রামী চেতনার কবি। রেনেসাঁর কবি। শুধু তৎকালীন বৃহত্তম বাংলা কেন, তার সমকালে এবং বর্তমানেও বিশ্বে কোনো কবি সাহিত্যিকের মাঝে এতগুলো গুণের সমাহার পরিদৃষ্ট নয়।
লীগ-কংগ্রেসের ধর্মভিত্তিক ভারত বিভাজন আন্দোলন, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, হিন্দু ব্রাম্মণ্যবাদী কুলীন মাড়োয়ারি ও আশরাফ পুঁজিবাদী সামন্তপ্রভু পাঞ্জাবি- সিন্ধিদের চক্রান্ত কবি নজরুলকে আশাহত করেছে। তিনি উপলব্ধি করলেন, বানরের এই পিঠাভাগে বাঙালি আর বাংলার কোনোই লাভ হবে না। এটি হবে ক্ষমতাপ্রাপ্ত লীগ-কংগ্রেসের শোষণের ক্ষেত্রভূমি। আরো উপলব্ধি করলেন, পশ্চিমবাংলা গান্ধী- নেহরু-প্যাটেল-শ্যামা প্রসাদদের চুঙ্গলে এমনভাবে ফেঁসে গেছে যে, তারা আর কোনোদিন স্বাধিকার, স্বাধীনতার ধারক বাহক হতে পারবে না।
নজরুল ইসলামের এই উপলব্ধি আজ সর্বজনস্বীকৃত। নজরুল ভাবনার ৭৭ বছর পরও তার বাণীরই পুনরুক্তি শুনি- ‘চরকা খাদি সত্যাগ্রহ ও অহিংসনীতি সাম্রাজ্যবাদী শাসকশক্তিকে উৎখাতের পন্থা ছিল না। সে জন্য প্রয়োজন ছিল শক্তির প্রয়োগে মুক্তিসংগ্রাম ও গণবিদ্রোহ…। এই রাজনৈতিক বিচ্যুতি, বলা যায় আদর্শগত বিচ্যুতির দায় লীগ-কংগ্রেস বা জিন্নাহ-গান্ধী কারো কম নয়। সম্প্রদায়বাদী রাজনৈতিক ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো তো ঘৃণা-বিদ্বেষের তরবারি হাতে নিয়েই মাঠে নেমেছিল।
হিন্দু মহাসভা বা রাষ্ট্রীয় সেবক সংঘ (আরএসএস) পরবর্তীকালে শিবসেনা ও বিজেপি, অন্যদিকে মাদ্রাসা ও আঞ্জুমানে ওলেমা ও ধর্মীয় সংগঠনগুলো এবং পরবর্তীকালে মুসলিম লীগ-রাজনীতি হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে অসাম্প্রদায়িক বিভাজন ঘটাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে’। (দেশ বিভাগ, ফিরে দেখা- আহমদ রফিক)।
তবে নজরুল ইসলামের ভাবনাজুড়ে স্থান নিয়েছিল পূর্ববাংলা তথা পূর্ববঙ্গ। এখানের বিপ্লবী মানুষ।
অন্তর্দৃষ্টিতে কবি দেখতে পেলেন ধর্মের নামে চাপিয়ে দেয়া কোনো মেকি স্বাধীনতার জুয়ালে এ-এলাকার চির-বিদ্রোহী মানুষগুলোকে শোষণ করে কেউ পার পাবে না। ধর্ম, বর্ণের ঊর্ধ্বে উঠে একদা এ-জাতি তাদের নিজস্ব আবাসভূমি, তাদের স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন করবেই।
পাকিস্তান সৃষ্টির ছয় বছর পূর্বে এবং বাংলাদেশ সৃষ্টির ৩০ বছর পূর্বে, পূর্ববঙ্গে এক স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখেছিলেন বিদ্রোহী কবি, স্বপ্নদ্রষ্টা, দার্শনিক কাজী নজরুল ইসলাম।
পূর্ববঙ্গের বিপ্লবী সত্তাকে উপলব্ধি করে কবি লিখলেন,
‘পদ্মা মেঘনা বুড়িগঙ্গা বিধৌত পূর্বদিগন্তে,
তরুণ অরুণ বীণা বাজে তিমির বিভাবরী অন্তে।
ব্রাম্ম মুহূর্তের সেই পুরবাণী
জাগায় সুপ্তপ্রাণ, জাগায় নবচেতনা দানি,
সেই সঞ্জীবনী বাণী তার
ছড়ায় পশ্চিমে, সুদূর অনন্তে।
উর্মীছন্দা শত-নদীস্রোত ধারায়,
নিত্য-পবিত্র সিনান- শুদ্ধ পূরব বঙ্গ,
ঘন-বন-কুন্তলা প্রকৃতির বক্ষে
সরল সৌম্য শক্তি-প্রবুদ্ধ-পূরব বঙ্গ।
আজি শুভলগ্নে তারি বাণীর বলাকা,
অলখ- ব্যোমে মেলিল পাখা,
ঝঙ্কার হানি যায় তারি…’
পূর্ব বাংলার সঙ্গে তার প্রেমের সম্বন্ধ। ভালো লাগা, ভালোবাসার সম্বন্ধ। গান, কবিতা, গজলগীতি, রাজনীতির সম্বন্ধ। বৈবাহিক সম্বন্ধ। এখানের মানুষ, মানুষের মন মনন, সামাজিক, সাংস্কৃতিক পরিবেশ তাকে মুগ্ধ করেছে। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে পূর্ব বাংলার মানুষের বিপ্লব, বিদ্রোহ কবিকে ভীষণভাবে আকৃষ্ট করেছিল।
নজরুল এ কথা জানতেন যে, ‘দশের নাড়ি-নক্ষত্রের সঙ্গে আত্মিক যোগ স্থাপিত না হলে কোনো কবির পক্ষে দেশের সমস্যাবলীকে কাব্যের রসায়নে সিক্ত করে সত্যিকার কাব্য-সাহিত্য সৃষ্টি করা সম্ভব হয় না।’ নজরুল এই সমাজের মানুষ আর সে সামাজিক পরিস্থিতি থেকে তার কাব্যের খোরাক সংগ্রহ করেছেন। তাদের চাওয়া-পাওয়া, তাদের দুঃখ দৈন্য, হতাশা, ক্ষোভ, আন্দোলন, বিক্ষোভ, স্বাধিকার, স্বাধীনতার লড়াই সংগ্রামকে, তথা তার কালকে কাব্যে চিত্রিত করেছেন। যা তার কালের কোনো কবির পক্ষে সম্ভব হয়নি।
কাজী নজরুল বিশ্বাস করতেন, বাঙালিকে তার আত্ম-পরিচয়ে বলীয়ান করতে হবে। ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা মুক্ত, ভারতীয় জাতীয়তাবাদ মুক্ত করতে হবে। তার বাংলা ভাষাই যে শ্রেষ্ঠ ভাষা, তা বোঝাতে হবে। (যদিও রবীন্দ্রনাথ বাংলাকে ভারতের রাষ্ট্রভাষা করার বিপক্ষে মত প্রদান করেছিলেন। বাঙালি জাতীয়তাবাদ স্বীকার না করে ভারতীয় জাতীয়তাবাদে আমৃত্যু আস্থাবান ছিলেন) তাই কাজী নজরুল ইসলাম বাংলাভাষা ভিত্তিক ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদ’ সৃষ্টি করার জন্য, বাঙালিকে জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ করার জন্য, বাঙালির ছেলেমেয়েকে ছোটবেলা থেকে শুধু এই মন্ত্র শেখাতে আহ্বান জানিয়েছেন,
‘এই পবিত্র বাংলাদেশ, বাঙালির আমাদের।
দিয়ে প্রহরেণ ধনঞ্জয়, তাড়াবো আমরা করিনা ভয়,
যত পরদেশী দস্যু ডাকাত, রামাদের, গামাদের।
বাংলার জয় হোক। বাঙালির জয় হোক।
বাংলা বাঙালির হোক’। (এরই প্রেক্ষিতে বাংলাদেশ আজ বাঙালির ‘জাতি-রাষ্ট্র’)
যুগ যুগ ধরে বিচ্ছিন্ন, বিভক্ত, সাম্প্রদায়িক দুই শক্তি হিন্দু মুসলমানকে এককাতারে দাঁড় করাতে, ভাই ভাই হয়ে গেলে মিলাতে কাজী নজরুল ইসলামের ছিল অফুরান মানবিক প্রচেষ্টা। তিনি জানতেন, এই বৃহৎ দুই জাতির মিলন ছাড়া ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদ’ এবং স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখা অলিক।
তাই তিনি ‘কাণ্ডারী হুশিয়ার’-এ লিখলেন,
‘হিন্দু না মুসলিম ওরা! জিজ্ঞাসে কোনজন!
কাণ্ডারী বল, মরিছে মানুষ। সন্তান মোর মা’র’।
লিখলেন,
‘মোরা একই বৃত্তে দুটি ফুল, হিন্দু মুসলমান,
মুসলিম তার নয়নমণি, হিন্দু তাহার প্রাণ।’
অতঃপর বাঙালির মনে সাহস সঞ্চার করার জন্য লিখলেন,
‘আমার সোনার বাংলা কাঙাল কিসে বল?
যেথা মরাই মরাই ধানের ভিটে,
উঠানেতে পদ্ম ফোটে,
গোঠে গোঠে ধেনু ছুটে, দুধে সুধা পরিমল।
আমার সোনার বাংলা কাঙাল কিসে বল?’…
‘কোন দেশেরই তরুলতা সকল দেশের চাইতে শ্যামল?
কোন দেশেতে চলতে গেলে দলতে হয়রে দুর্বাদল?
সে আমাদের বাংলাদেশ।’
অতঃপর স্বাধীন, সার্বভৌম বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা কাজী নজরুল ইসলাম সাহসিক ঘোষণা করলেন, “বাঙালি যেদিন ঐক্যবদ্ধ হয়ে বলতে পারবে, ‘বাঙালির বাংলা’, সেইদিন তারা অসাধ্য সাধন করবে।”
জাতির জনক বঙ্গবন্ধুই তৎকালীন পূর্বতো বাংলা বা পূর্ব পাকিস্তানে পশ্চিমাদের শোষণের বিরুদ্ধে বাঙালি জাতিকে জাগিয়ে তুলতে, সংগ্রামে উদ্ধুদ্ধ করতে, দেশকে স্বাধীন করতে হিন্দু-মুসলিম-বুদ্ধ-খ্রিস্টানকে একত্রিত করে বাঙালি নজরুল ইসলামের ১৯৪১ সালে ঘোষিত জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে এমন কথাগুলোই বজ্রকণ্ঠে বারবার উচ্চারণ করেছিলেন।
পূর্ব বাংলা যে স্বাধীন ‘বাংলাদেশ’ রাষ্ট্রে পরিণত হবে তা কাজী নজরুল ইসলাম তার দিব্যদৃষ্টিতে দেখতে পেয়েছিলেন। দেখতে পেয়েছিলেন এই স্বাধীন দেশের স্থপতি, অনাগত-বীর সিপাহসালারকে। যার নাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে পূর্ব বাংলার বাঙালিরা অসাধ্য সাধন করেছে। স্বাধীনতা সংগ্রাম করেছে। নিজেদের ৩০ লাখ তাজা প্রাণ বিসর্জন দিয়ে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ অর্জন করেছে।
কাজী নজরুল ইসলাম

স্বাধীনতার কবি। ভারতের স্বাধীনতা-ঘোষণার কবি। খাদি, চরকারবিরোধী সংগ্রামের কবি। (যদিও রবীন্দ্রনাথ ছিলেন এর ঘোর বিরোধী। তার মতে, ‘পড়ে পাওয়া, কেড়ে নেওয়া স্বাধীনতায় আমি বিশ্বাস করি না। মনের স্বাধীনতাই বড় স্বাধীনতা।’ পরাধীন দেশে ‘মনের স্বাধীনতা’ অর্জন কোনো অত্যাশ্চার্য গুনে সম্ভব, তা কারো জানা নেই)
নজরুলের ‘সাম্যবাদী’ কবিতাগুচ্ছে গণতন্ত্র, মানবতাবাদ, অসাম্প্রদায়িকতা তথা ধর্মনিরপেক্ষতা, সাম্যবাদ, সমাজতন্ত্রের কথা দ্ব্যর্থহীনভাবে উচ্চারিত হয়েছে।
আমাদের সংবিধানেও স্বাধীন দেশের জাতির পিতা, সেই গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতাকে রাষ্ট্রীয় মূলনীতি হিসেবে প্রতিস্থাপন করেছেন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের স্বপ্নের সেই সিপাহসালার। তার কল্পিত স্বাধীন সার্বভৌম ‘বাংলাদেশ’র রূপকার। স্থপতি।
জাতীয় কবি নজরুল ইসলাম তার স্বপ্নের স্বাধীন বাংলাদেশের যে অপরূপ রূপের বন্দনা করেছেন তা তুলনাহীন। এরই রূপকার বঙ্গবন্ধু। কবি শুধু এর রূপই অঙ্কন করেননি, স্বাধীন এ-দেশের মাটিতে অন্তিম শয্যায় শায়িত হওয়ার বাসনাও ব্যক্ত করেছেন তার কবিতায়। মহান আল্লাহ কবির শেষ ইচ্ছাও পূরণ করেছেন।
“নমঃ নমঃ নমো বাংলাদেশ মম
চির-মনোরম চির-মধুর,
বুকে নিরবধি বহে শত নদী
চরণে জলধির বাজে নূপুর।
শিয়রে গিরিরাজ হিমালয় প্রহরী,
আশিস মেঘবারি সদা তার পড়ে ঝরি।
যেন উমার চেয়ে এ আদরিনী মেয়ে,
উড়ে আকাশ ছেয়ে মেঘ-চিকুর।
গ্রীষ্মে নাচে বামা কালোবোশেখী ঝড়ে,
সহসা বরষাতে কাঁদিয়া ভেঙে পড়ে,
শরতে হেসে চলে শেফালিকা তলে,
গাহিয়া আগমনী গীতি বিধুর।
হরিত অঞ্চল হেমন্তে দুলায়ে
ফেরে সে মাঠে মাঠে শিশির ভেজা পায়ে,
শীতের অলসবেলা পাতাঝরার খেলা
ফাগুনে পরে সাজ ফুল-বধুর\
এ দেশের মাটি-জল-ফুল ও ফলে
যে রস যে সুধা নাহি ভূ-মণ্ডলে,
এই মায়ের বুকে হেসে খেলে সুখে,
ঘুমাবো এইবুকে স্বপ্নাতুর।’

তিন.
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম স্বাধীন, সার্বভৌম বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন। এই স্বপ্নকে সাকার করার জন্য কবিতায়, গানে, সাম্যবাদী চেতনায়, রাজনীতি, আন্দোলন, সংগ্রাম করেছেন। বঙ্গবন্ধু কবির ‘বাংলার জয় হোক’ থেকে স্বাধীনতা সংগ্রামের বজ্রশপথ ‘জয় বাংলা’ সেøাগান গ্রহণ করেছেন। (পরবর্তীতে নজরুল ইসলামের স্বাক্ষরিত ঘোষণায় গঠিত ‘বঙ্গীয় কৃষক শ্রমিক দল’র আদলে জাতির পিতার ‘বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক দল’ (লীগ) গঠন।
জাতির পিতা কবিকে ভারত থেকে স্বাধীন বাংলাদেশে নিয়ে এসে তাকে বিরাট আঙনবিশিষ্ট প্রকাণ্ড বাড়ি দিয়েছেন। দিয়েছেন জাতীয় কবির মর্যাদা। (কবির বাড়িতে প্রতিদিন সকালে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হতো। সুতরাং এ-কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, কবিকে বাংলাদেশের নাগরিকত্বও দেয়া হয়েছিল। এবং এটি কবিকে চিকিৎসার জন্য পিজি হাসপাতালে নেয়ার দিন পর্যন্ত চালু ছিল। শেখ কামাল দিনে দুই বার করে জাতীয় কবির বাসভবনে গিয়ে তার খোঁজ-খবর নিতেন। প্রায়ই জাতির পিতা সপরিবার কবিকে দেখতে আসতেন)।
বাংলাদেশে জাতীয় মর্যাদায় জাতীয় কবির ৭৩তম জন্মদিন পালন করা হয়। সেদিন জাতির পিতার পক্ষ থেকে যে সম্মাননা সম্ভাষণ পেশ করা হয়, তাতে তিনি দীপ্তকণ্ঠে ঘোষণা করেছেন, ‘কাজী নজরুল ইসলাম বাঙালির স্বাধীন জাতিসত্তার ঐতিহাসিক রূপকার।’ (১৯৭৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কবিকে ‘ডি-লিট’ উপাধি প্রদান করেন।)
এক্ষণে জানা দরকার, কী কী গুণাবলী থাকলে একজন কবি, জাতিসত্তার কবি হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেন। (১) তাকে হতে হবে (১) অসাম্প্রদায়িক, (২) ধর্মনিরপেক্ষ, (৩) গণতন্ত্রকামী, (৪) সাম্যবাদী, (৫) স্বাধীনতাকামী, (৬) জাতীয় সাহিত্যের রচয়িতা।
এসব গুণাবলীর একচ্ছত্র অধিকারী ছিলেন তৎকালীন ভারতে একমাত্র কাজী নজরুল ইসলাম।
সর্বোপরি আমাদের বাঙালি জাতি যে (১) হিন্দু (২) মুসলিম (৩) বৌদ্ধ (৪) খ্রিস্টান- এই চার ধর্মাবলম্বী সম্প্রদায় নিয়ে গঠিত, সেই বাঙালি জাতির মধ্যেই জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটানোর জন্য তিনি বীজমন্ত্র দিয়েছিলেন, ‘এই পবিত্র বাংলাদেশ বাঙালির আমাদের…’
বলেছিলেন, ‘বাঙালি যেদিন সম্মিলিত কণ্ঠে বলতে পারবে এই বাংলাদেশ আমার, সেদিন তারা অসাধ্য সাধন করবে।’
তার সেই ভবিষদ্বাণী বাস্তবে রূপ নিল কবির স্বপ্নের সিপাহশালার, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতীয়তাবাদী নেতা, স্বাধীনতা-সংগ্রামের মহানায়ক শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃৃত্বে বাঙালিরা বুকের তাজা রক্ত দিয়ে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ স্থাপনের মাধ্যমে।
এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা লেখেন, ‘স্বাধীনতা, এ-শব্দটাকে বুকে ধারণ করে তিনি যে নির্দেশনা দিয়েছিলেন, তা দেশের মুক্তিকামী মানুষ অক্ষরে অক্ষরে পালন করে বিজয় অর্জন করেছিল।’ (ভাইয়েরা আমার- শেখ হাসিনা। দেশ পত্রিকা)
কাজী নজরুল ইসলাম স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্ন যেমন দেখেছিলেন, (যা জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে সাকার হয়েছে)।
তেমনি বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও জাতীয় কবি বিদ্বেষী বাংলাদেশের একটি সম্প্রদায়ের বিষয়ে স্বপ্ন দেখেছিলেন। (যা আজ কথিত ও চিহ্নিত বুদ্ধিজীবীদের মাধ্যমে সাকার হচ্ছে) সে স্বপ্নের কথা তার ‘সমস্যা পূরণ’ প্রবন্ধে এভাবে ব্যক্ত করেছেন , “অছিমদ্দীন তোমার ভাই হয়, আমার পুত্র।
বিপিন চমকিয়া উঠিয়া কহিলেন, ‘যবনীর গর্ভে?’
কৃষ্ণগোপাল কহিলেন, হ্যাঁ, বাপু।”

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়