টিসিবির জন্য চিনি ও ভোজ্য তেল কিনবে সরকার

আগের সংবাদ

চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা কোন পথে : মূল্যস্ফীতি > ডলার সংকট > বৈদেশিক ঋণের সুদ ও ভর্তুকি ব্যয় > কর ও ব্যক্তি করদাতা বাড়ানো

পরের সংবাদ

আজানে বিমুগ্ধ কবি

প্রকাশিত: মে ২৬, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: মে ২৬, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

কবি নজরুল জন্ম নেন পল্লীর এমন এক বাড়িতে যার অদূরেই ছিল মসজিদ। কবির জন্মলগ্নে (১৮৯৯) বাড়ির মসজিদ থেকে আজান দেয়া হয়। সেই ক্ষণ স্মরণ করে তিনি লেখেন (১৯৪২), “অবিশ্বাসীরা শোনো, শোনো, সবে জন্ম-কাহিনী মোর, / আমার জন্মক্ষণে উঠেছিল ঝঞ্ঝা-তুফান ঘোর। / উড়ে গিয়েছিল ঘরের ছাদ ও ভেঙ্গেছিল গৃহ-দ্বার, / ইসরাফিলের বজ্র-বিষাণ বেজেছিল অনিবার। / ‘আল্লাহু আকবর’ ধ্বনি শুনি প্রথম জনমি আমি, / আল্লাহ নাম শুনিয়া আমার রোদন গেছিল থামি। / সেই পবিত্র ধ্বনি রনরনি উঠিছে এ ধমনীতে / প্রতি মুহূর্তে চেতন ও অচেতন আমার এ চিতে।/… কত গিরি কত অরণ্য কত সাগর মরুর পারে / জন্মক্ষণের বিষাণ আজান শুনিয়াছে বারে বারে।” আজানকে তিনি বলেন ‘বিষাণ আজান’। ‘বিষাণ’ শব্দটি নজরুল সাহিত্যে ঐশ্বরিক ধ্বনির সঙ্গে সম্পৃক্ত। আজানের মধ্যে স্রষ্টার মহা-আহ্বান তিনি শুনেছেন, সে আহ্বান চিরকাল তিনি লালন করেছেন বুকের মাঝে পরম ভক্তিভরে, সামনে এগিয়ে যাবার অনুপ্রেরণা হিসেবে, ‘শুনিতাম কার মহা-আহ্বান, কাহার প্রেমের টানে / কেবলই অগ্রপথে চলিয়াছি … / সে কি আল্লাহ্? পরম পূর্ণ আমার স্বামী?’ জন্মলগ্নে যে আজানের আবহে তিনি ধরায় আসেন; সাহিত্য জগতে প্রবেশের সময়েও সেই আজান তার পাথেয়। তার প্রথম প্রকাশিত কবিতা ‘মুক্তি’তে, ‘আজান যখন শহুরে দের ভাঙলো ঘুমের ঘোর, / অবাক হয়ে দেখলো সবাই চেয়ে / শুকনো নিমের গাছটা গেছে ফলে-ফুলে ছেয়ে!’ কবি মানসে পাতাঝরা নিমগাছ ফুলে-ফলে ছেয়ে যায় আজানের প্রহরে। তরুশাখা পল্লবিত হওয়ার সঙ্গে আজানের প্রহরের এক জাদুকরী সম্পর্ক স্থাপন করেন তিনি। আজানের ধ্বনি তার প্রাণে তরঙ্গ তোলে, ‘দূর আজানের মধুর ধ্বনি বাজে বাজে / মসজিদেরই মিনারে। এ কী খুশীর অধীর তরঙ্গ উঠল জেগে / প্রাণের কিনারে \’
আজানের সুর-লহরির সংমিশ্রণে গদ্য-সাহিত্যে নান্দনিক ব্যঞ্জনা সৃষ্টির সার্থক রূপকার কাজী নজরুল ইসলাম। আজানের ললিত মাধুর্য তার সাহিত্যকে করেছে মধুরতর। মৃত্যুক্ষুধা উপন্যাসে ভাগ্যহত মানুষের বেদনার সঙ্গে, আজানের সুরের অনুরণন ঘটিয়ে অপসৃয়মান গোধূলির বিষাদকে তিনি তুলে ধরেছেন, ‘মসজিদে সন্ধ্যার আজানের শব্দ কান্নার মত এসে কানে বাজে। ও যেন কেবলি স্মরণ করিয়ে দেয়- বেলা শেষ হয়ে এল, আর সময় নাই! … পথ মঞ্জিলের যাত্রী সশঙ্কিত হয়ে ওঠে! সন্ধ্যার নামাজ যেন মৃত দিবসের জানাজা সামনে রেখে তার আত্মার শেষ কল্যাণ-কামনা!’ একদিকে মৃত্যু, একদিকে ক্ষুধা নিয়ে ভোরের মøান আলোকে যখন মেজোবৌ ডুকরে কেঁদে উঠল তখন পার্থিব বেদনা ছাপিয়ে, “দূরে মুয়াজ্জিনের কণ্ঠে ভোরের নামাজের আহ্বান শোনা যাচ্ছিল ‘আসসালাতু খায়রুমমিনান্নৌম’- ওগো জাগো! নিদ্রার চেয়ে উপাসনা ঢের ভালো।” কুহেলিকা উপন্যাসেও আজানের ধ্বনি ব্যবহার করে সাঁঝবেলার অপরূপ দ্যোতনা সৃষ্টি করেছেন কবি, “মৃত দিবসের পাণ্ডুর মুখ সন্ধ্যার কালো কাফন দিয়া ঢাকা হইতেছে। সান্ধ্য আজান ধ্বনি তাহারি ‘জানাজা’র নামাজের আহ্বানের মতো করুণ হইয়া শুনাইতেছিল। মাথার উপর দিয়া চিৎকার করিতে করিতে ক্লান্ত বায়স উড়িয়া চলিতেছিল- যেন মৃত দিবসের শবযাত্রী।” নজরুলের রচনায় আজান প্রকৃতির সঙ্গে মিলেমিশে অপরূপ নান্দনিক শোভার সৃষ্টি করে। কখনো রাতের নিঝঝুম নিস্তব্ধতায় আজানের ঐকতান ভেসে আসে, ‘তিমির রাত্রি- … এশার আজান কেঁদে যায় শুধু- নিঃঝুম নিঃঝুম।’ নিঝঝুম রাতের আঁধার পেরিয়ে নব প্রভাতের উদয় হয়, প্রভাতি আজান স্বর্গীয় আলোয় উদ্ভাসিত করে এ পৃথিবী এ আকাশ, ‘নিখিল ঘুমে অচেতন সহসা শুনি আজান; / শুনি সে তকবীর ধ্বনি আকুল হল মন-প্রাণ; / বাহিরে হেরিনু আসি; বেহেশতী রৌশনীতে রে / ছেয়েছে জমিন ও আসমান।’ কবির কল্পনায় প্রভাতের আলোকরশ্মি ছড়িয়ে দেয় স্বর্গীয় স্নিগ্ধতা, আজানের ধ্বনি তারই বারতা বয়ে আনে। নিশাবসানের এ আজান কর্মপ্রেরণারও উৎস, ‘আঁধার মনের মিনারে মোর / হে মুয়াজ্জিন, দাও আজান! / গাফিলতির ঘুম ভেঙ্গে দাও, / হউক নিশি অবসান \’ আজান সব কাজে মানুষের নিত্যদিনের সংকেত।
গদ্যে যেমন, পদ্যে যেমন, ব্যক্তিগত পত্রেও তেমনই তিনি প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের সঙ্গে আজানের মধুরিমা মিশ্রিত করে এক অপূর্ব সাহিত্য সৃষ্টি করেছেন। দূর প্রবাসে নিদ্রিতা প্রিয়জনের কথা কল্পনা করে তিনি লিখেছেন, ‘আমি এখান থেকেই দেখতে পাচ্ছি- তার বাম পাশের বাতায়ন দিয়ে একটি তারা হয়তো চেয়ে আছে- গভীর রাতে মুয়াজ্জিনের আজানে আর কোকিলের ঘুম-জড়ানো সুরে মিলে তার স্তব করছে। – ওগো সুন্দর! জাগো! জাগো!’ নিশীথের শেষ প্রহরে কোনো নিদ্রিতার শয়নকক্ষে জানালা দিয়ে শুকতারা উঁকি দিচ্ছে, কোকিলের কুহুতান উঠছে, তারই সঙ্গে আজানের সুর ভেসে আসছে- দূরাগত আজানের সুর সে সৌন্দর্যকে ভরিয়ে দিয়েছে পবিত্র স্নিগ্ধতায়। শৈশবে শোনা শান্ত সুনির্মল আজানের সুর তার অন্তরে এমন স্থান করে নেয় যে আজীবন আজান তার চিন্তাচেতনার অপরিহার্য বিষয়বন্তু হয়ে রয়। সে আজান কখনো মধুর, কখনো বেদনা বিষাদ, কখনো সঞ্জীবনী সুধা আবার কখনো বেহেশতী রওশন।
কবি নজরুল ইসলাম ইসলামি রেনেসাঁর কবি। বিশ্ব-মুসলিম তখন পরাধীন, অথচ নিস্পৃহ; অতীত সংগ্রামের ইতিহাস স্মরণ করিয়ে তাদের পুনর্জাগরণের জন্য তিনি গেয়ে ওঠেন, ‘বাজল কি রে ভোরের সানাই নিদ-মহলার আধার পুরে / শুনছি আজান গগন তলে অতীত-রাতের মিনার চূড়ে।’ আজানের আহ্বানের মধ্যে তিনি মুসলিম-আন্তর্জাতিকতার সঙ্গে একাত্মতা অনুভব করেন, ‘মন্দ্রে বিশ্ব রন্ধ্রে রন্ধ্রে / মন্ত্র আল্লাহু আকবর! /জাগিয়া শুনিনু প্রভাতী আজান / দিতেছে নবীন মুয়াজ্জিন।’ নির্যাতিত মুসলিম বিশ্বকে তিনি নাড়া দেন, ‘ ঘুমায়ে কাজ¦া করেছি ফজর, / তখনো জাগিনি যখন জোহর, /হেলা ও খেলায় কেটেছে আসর, / মাগরেবের আজ শুনি আজান। / … আল্লাহু আকবর রবে পুন / কাঁপুক বিশ্ব দূর বিমান \’ আজানের আহ্বান নর ও নারী সকলের জন্য, ‘আয় রে ছুটে মুসলিম নারী, /… আমার আজান ধ্বনি বাজে / কুল মুমিনের বুকের মাঝে।’ অবরুদ্ধ নারীদের আজানের আহ্বান থেকে বঞ্চিত রাখার দৃঢ় প্রতিবাদ তার কবিতার মাধ্যমে, ‘হেরেমের বন্দিনী কাঁদিয়া ডাকে / … যেতে নারে মসজিদে শুনিয়া আজান, / বাহিরে ওয়াজ হয়, ঘরে কাঁদ প্রাণ; / ঝুটা এই বোরখার হোক অবসান- / আঁধার হেরেমে আশা-আলোক দেখাও \’
শ্রেণি-সংগ্রামের প্রয়োজনেও তিনি আজানের উপযোগিতা অনুভব করেন, ‘নব জীবনের নব-উত্থান- আজান ফুকারি এসো নকিব /… জাগে গৃহহীন, জাগে পরাধীন/ জাগে মজলুম বদ-নসিব! /… আজান ফুকারি এস নকিব!’ আজান তার কাছে জাতি-ধর্ম-বর্ণের ঊর্ধেŸ।
হাজার বছর আগে আজানের বাণীর প্রস্তাবক ছিলেন হজরত উমর। নজরুল তা স্মরণ করেন কাব্যময় সুষমায়, ‘তিমির রাত্রি- এশার আজান শুনি দূর মসজিদে, / প্রিয় হারা কার কান্নার মতো এ-বুকে আসিয়া বিঁধে! / আমির-উল-মুমেনিন, / তোমার স্মৃতি যে আজানের ধ্বনি- জানে না মুয়াজ্জিন! … ও-আজান ও কি পাপিয়ার ডাক? ও কি চকোরির গান? / মুয়াজ্জিনের কণ্ঠে ও কি ও তোমারি সে আহ্বান?’ এ আজান মনুষ্য সমাজের গণ্ডী পেরিয়ে ছড়িয়ে যায় প্রকৃতির মাঝে- পাপিয়ার ডাকে, চকোরির গানে।
আজান তার জীবাত্মার নিত্য-সঙ্গী, এ আজান তাকে ভক্তি-ক্ষীরে ডুবিয়ে দেয়; এ আজান অবিনশ্বর, “অ-কাজের সে কাজের মাঝে ডুবে যখন থাকি, / … বুঝেও বুঝি নাকো এ যে এক পা এক পা করে / পলে পলে গোরের দিকেই যাচ্ছি ক্রমে সরে। / শুনি তখন আজানের কি বজ্র-গভীর স্বর- / ‘আল্লাহু আকবর’ – ‘আল্লাহু আকবর!’ / … বুঝি আর সে নাই বা বুঝি, তবু প্রাণের মাঝে / চঞ্চল সে গুমরে মরে কী আকুলতা যে! /… ওগো পাগল-উদাস-করা পবিত্র আহ্বান, / কেমন করে ভক্তি-ক্ষীরে ডুবিয়ে দাও জান! / বক্ষে কিসে পাগল-ঝোরার উজান বয়ে যায়, / ভোর বেলাকার আবছায়া আর সাঁঝের মøানিমায়; / দুপুর বেলায় রোদ আর বৈকালের পূরবী / রাতের ডাকে ছড়াও বিশ্বে কতই সুরভি। / মাটির মানুষ প্রভুর কাজে পাছে করি হেলা, / তাইতো তুমি ডেকে ডেকে জাগাও পাঁচই বেলা। / … ওগো পূত! ওগো গম্ভীর! ওগো উদাস ডাক! / ওগো আজান! তোমার বিষাণ বিশ্বে বেজে যাক- / যতদিন না ইসরাফিলের প্রলয় বিষাণ বাজে, / এমনি করে ব্যাকুল স্বরে দিন-দুনিয়ার মাঝে।”
আজান শুধু কাব্যসৃষ্টির উপাদান নয়; আজান তার কর্মময় জীবনেরও অংশ। শিশু দুখু মিয়া নিজের বাড়ির মসজিদে শখ করে আজান দিয়ে থাকবেন। তার তিরিশ বছর বয়সে অভিভাষণে তিনি বলেন, ‘আমি … ফজরে মুয়াজ্জিনের সুরে সুর মিলিয়ে আজান দেই।’ উনিশশ একচল্লিশ সালের তেইশে অক্টোবর ঈদুল ফিতরের দিন কলকাতা বেতারে তিনি স্বকণ্ঠে আজান দিয়েছেন- বেতারে সেইই প্রথম আজান ধ্বনি।
সচেতন জীবনের শেষ প্রান্তে, স্রষ্টাতে আত্মনিবেদিত কবি আল্লার ধেয়ানে বিনিদ্র রজনী শেষে সুদূর মিনারে শোনেন সেই আহ্বান, ‘তব দেওয়া এই তনু মন প্রাণ মোর যাহা কিছু আছে, / তুমি জান, কেন নিবেদন করে দিয়াছি তোমার কাছে।/ … সব ভুলে যাই, কিছু মনে নাই, খেলিতেছিলে কি খেলা, / আমারি মতন ঘুমাইতে কারে দাও নি? / তব নাম লয়ে সুদূর মিনারে কে ডাকিছে ভোর বেলা?’ আজানে বিমুগ্ধ কবির অন্তিম বাসনা ছিল, ‘মসজিদেরই পাশে আমার কবর দিও ভাই। / যেন গোরে থেকেও মুয়াজ্জিনের আজান শুনতে পাই \’ মসজিদের পাশেই তিনি সমাধিস্থ হয়েছেন।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়