নারী ইউএনওকে কাদের সিদ্দিকীর বাধায় আসকের নিন্দা

আগের সংবাদ

৫ সিটি করপোরেশন নির্বাচন : আ.লীগের গলায় ‘কোন্দল’ কাঁটা

পরের সংবাদ

প্রাইভেট কার

প্রকাশিত: মে ৩, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: মে ৩, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

শরাফত স্যার বললেন, অঙ্কটা খুব মনোযোগ দিয়ে করবে। ভুল যেন না হয়।
শিবলু অঙ্কে মনোযোগ দিল। কিছুক্ষণ গভীর মনোযোগে অঙ্কের দিকে তাকিয়ে থেকে মাথা তুলল। ভীষণ ভাবনাকাতর মুখ নিয়ে জানালায় চেয়ে রইল।
শরাফত স্যার চোখ গোল করে তাকালেন শিবলুর দিকে। তারপর দাঁত কিড়মিড় করে বললেন, কী হলো? অঙ্ক করা বাদ দিয়ে ওভাবে বসে রইলে যে?
শিবলু যেন এই জগতে নেই। ভিন্ন কোনো জগতে চলে গেছে। শরাফত স্যার একটা কড়া ধমক দিলেন। শিবলু ভিন গ্রহ থেকে ধপ করে পৃথিবীতে পড়ল। বলল- স্যার, অঙ্কটা করতে গিয়ে মাথায় অন্য চিন্তা এসে গেল।
– কী অন্য চিন্তা?
– এখানে বলেছে, বাসা থেকে করিমের স্কুলের দূরত্ব সাত মাইল। সে তিন মাইল বাসে গেল, দুই মাইল সাইকেলে গেল, বাকি পথ হেঁটে গেল। সে কত মাইল হেঁটে গেল?
– ঠিকই তো আছে। কত মাইল হেঁটে গেল বের করো।
– স্যার, এর চেয়েও বড় প্রশ্ন যে মাথায় খোঁচা দিচ্ছে।
– বড় প্রশ্ন!
– স্যার, করিম বাস থেকে নেমে সাইকেল পেল কোথায়? কে তাকে সাইকেল দিল? আবার দুই মাইল সাইকেলে গিয়ে বাকি পথ হেঁটে গেল কেন? পুরো পথটা সাইকেলে গেলে সমস্যাটা কী ছিল? মাঝপথে সাইকেলটা রাখলই বা কোথায়?
– সেসব তোমাকে ভাবতে হবে না। তুমি অঙ্ক করো।
– এতসব প্রশ্ন মাথায় নিয়ে অঙ্ক করা যায় না স্যার।
– তাহলে পরের অঙ্কটা করো।
শিবলু পরেরটা করতে গেল। একটু পর আবার আগের মতোই চিন্তামগ্ন হয়ে জানালায় তাকিয়ে বসে রইল। শরাফত স্যারের ধৈর্যের বাধ ভেঙে যাচ্ছে। তারপরও নিজেকে সামলে বললেন, আবার বসে রইলে যে? অঙ্ক করছো না কেন?
– স্যার, এটাতেও মহাসমস্যা।
– এটাতে আবার কী সমস্যা?
– দশ ফুট উচ্চতার একটা তৈলাক্ত বাঁশে একটা বানর পাঁচ ফুট উঠে তিন ফুট নেমে যায় …।
– ঠিকই তো আছে।
– স্যার, বাঁশটাতে তেল মাখিয়ে রাখল কে? কী তেল মাখানো হয়েছে সেখানে? আজকাল খাঁটি সরিষার তেল তো পাওয়াই যায় না। সয়াবিন তেলের যা দাম …।
– চুপ করো! তোমার যা অবস্থা দেখছি, তাতে তোমাকে আমার পড়ানোই হবে না। আমি চলে যাব।
শিবলুর মুখটা বিষণ্ন হলো। বিষণ্ন কণ্ঠে বলল- এমন কথা বলবেন না স্যার। এর আগের টিচাররা এ রকম কথা বললে আমি খুব খুশি হতাম। কিন্তু আপনার কথা শুনে আমার খুব মন খারাপ লাগছে। আপনি চলে গেলে আমি অঙ্কে ¯্রফে দুইটা কাঁচাগোল্লা পাব।
কাঁচাগোল্লা! শরাফত স্যার হাঁ হয়ে গেলেন। বললেন- সবাই বলে, রসগোল্লা বা আণ্ডা পাব। তুমি কাঁচাগোল্লা বলছো কেন?
– স্যার, আমাদের গ্রামের বাড়ি নাটোর। নাটোর কাঁচাগোল্লার জন্য বিখ্যাত। তাই আমাদের মুখে এটা এসে যায়। স্যার, এবার গ্রামে গেলে আপনার জন্য পাঁচ কেজি কাঁচাগোল্লা নিয়ে আসব।
– তুমি আমাকে ঘুষ দিতে চাচ্ছো?
শিবলু কিটকিট করে হাসতে লাগল। এবার সত্যিই শরাফত স্যারের মেজাজ পুরোপুরি খারাপ হয়ে গেল। মেজাজ খারাপ হওয়ারই কথা। অঙ্ক না করে টালবাহানা করছে। আবার ঘুষ দিতে চাচ্ছে। শরাফত স্যার কঠিন কণ্ঠে বললেন, ঘুষের মধ্যে গেলে এতদিন আমার ভালো একটা চাকরি হয়ে যেত। আমাকে এভাবে প্রাইভেট পড়িয়ে বেঁচে থাকতে হতো না। তোমাদের মতো ত্যাঁদড় ছেলে …।
– স্যার, ত্যাঁদড় কী? এটা কি বাঁদরের মতো কোনো প্রাণী।
শরাফত স্যার মাথা নিচু করে বসে রইলেন। শিবলুর মনটা এবার সত্যিই খারাপ হলো। তার কারণে স্যার হয়তো মনে কষ্ট পেয়েছেন।
শিবলু বলল- স্যার, আপনি ভুল বুঝেছেন। এটা ঘুষ না। এটা হলো ভালোবাসা। ছাত্র-শিক্ষক লেনদেনটা হলো বাবা-মা আর সন্তানের লেনদেনের মতো। গত ক্লাসে ইংরেজিতে ভালো করায় আপনি আমাকে একটা গল্পের বই আর একটা কলম দিলেন। কেন দিলেন স্যার? এটা কি ঘুষ?
শরাফত স্যারের রাগ পানি হয়ে গেল। লেখাপড়ায় মনোযোগ না দিলেও ছেলেটার চিন্তাভাবনা গোছাল। শরাফত স্যারের কণ্ঠ ধরে আসছিল। তিনি কিছু বলতে পারছিলেন না। তার গলার কাছে কান্না আটকে আছে। চাকরি-বাকরি হয় না বলে কত অপমান, উপহাস। অথচ ছেলেটা তার জন্য কত ভালোবাসা ধরে রেখেছে বুকে।
দরজায় ঠকঠক। শিবলুর মায়ের গলা- স্যারের নাস্তা নিয়ে যাও।
শরাফত স্যার বললেন- তোমার মাকে বলো, আমি এখন নাস্তা খাব না। আমি ডিমের ওমলেট আর দুইটা পরোটা খেয়ে এসেছি। চাও খেয়ে এসেছি।
– তাই বলে নাস্তা ফিরিয়ে দেব? আপনি না খেলে আমি খাব।
শিবলু গিয়ে নাস্তা নিয়ে এলো। চায়ে ভিজিয়ে বিস্কুট খেতে খেতে শিবলু বলল- স্যার, আমার বাবার অফিসের বড় কর্তার ড্রাইভারের ছয়তলা দুইটা বাড়ি আছে। দুইটা গাড়িও আছে। আর বড় কর্তার পিয়নের ছয়তলা বাড়ি আছে চারটা। চারটা গাড়ি।
শরাফত স্যার কিছু বললেন না। আবার ঘুষ-দুর্নীতির প্রসঙ্গ নিয়ে এসেছে। ছেলেটা কী বোঝাতে চায়?
শিবলু বলল- স্যার, অন্তত একটা কলা খান। কলা শরীরের জন্য ভালো। তাৎক্ষণিক এনার্জি দেয়।
– আমার এখন এনার্জি লাগবে না।
– স্যার, আপনি কি আমার ওপর খুব বেশি রাগ করেছেন?
– না।
– স্যার, অঙ্ক হতে পারত বাস্তবতার ভিত্তিতে।
– মানে?
– যেমন একটি অফিসের বড় কর্তার ড্রাইভারের যদি ছয়তলা দুইটি বাড়ি এবং দুইটি গাড়ি থাকে, তার পিয়নের যদি ছয়তলা চারটা বাড়ি ও চারটা গাড়ি থাকে তাহলে বড় কর্তার কয়টা বাড়ি ও কয়টা গাড়ি আছে? তৈলাক্ত বাঁশের ব্যাপারটা পুরোই আজগুবি। কিন্তু এই অঙ্কটায় মোটামুটি একটা হিসাব বের করা যাবে।
– কিছুই বের করা যেত না।
– কেন স্যার?
– কারণ, খোঁজ নিলে দেখা যাবে সেই বড় কর্তার দেশে তেমন কিছু নেই।
– নেই!
– এমনকি তার বউ, ছেলেমেয়েও দেশে নেই। তারা আছে ইউরোপ-আমেরিকায়। কানাডা, আমেরিকা, ইউরোপের বিভিন্ন দেশে আছে তাদের বাড়ি, গাড়ি, ফ্ল্যাট, ব্যবসা। সুইস ব্যাংকের ভল্ট ফুলেফেঁপে উঠছে তাদের টাকায়। ড্রাইভার, পিয়নের সম্পদের সঙ্গে তুলনা করে বড় কর্তার সম্পদের হিসাব বের করা পুরোপুরি অসম্ভব।
শিবলু মাথা নিচু করল। সে ভেবেছিল, খুব যুক্তিসংগত কিছু বলেছে। এখন দেখে ব্যাপারটা অনেক জটিল। এ রকম অঙ্ক কেউ করতে পারবে না।
শরাফত স্যার পরিবেশটাকে একটু হালকা করতে চাইলেন। অঙ্কের জটিলতা থেকে বের হয়ে আসতে চাইলেন। বললেন- বলো তো যে গান লেখে তাকে কী বলে?
– গীতিকার।
– যে সুর করে…
– সুরকার।
– যে ছড়া লেখে…
– ছড়াকার।
– যে গল্প লেখে…
– গল্পকার।
– যে স্বর্ণের কাজ করে…
– স্বর্ণকার।
– আর যে আমার মতো প্রাইভেট পড়িয়ে বেঁচে থাকে?
– প্রাইভেট কার।
– হাহাহাহা।
– হয় নাই স্যার?
– হয়েছে। আজ তাহলে এ পর্যন্তই থাক। আগামীকাল থেকে ঠিকঠাক মতো অঙ্ক করতে হবে। কোনো অপ্রাসঙ্গিক চিন্তা আনা যাবে না।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়