জেসমিনের মৃত্যু নিয়ে ১১ র‌্যাব সদস্যকে জিজ্ঞাসাবাদ

আগের সংবাদ

ঢাকায় নিয়ন্ত্রণহীন শব্দসন্ত্রাস : উপেক্ষিত হাইকোর্টের নির্দেশনা > কানে কম শোনেন ৫৬ ভাগ ট্রাফিক পুলিশ

পরের সংবাদ

রুচির দুর্ভিক্ষ : সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রতিক্রিয়া

প্রকাশিত: এপ্রিল ১, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: এপ্রিল ১, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

‘রুচির দুর্ভিক্ষের মধ্য দিয়ে হিরো আলমের উত্থান’- খ্যাতিমান নাট্যব্যক্তিত্ব মামুনুর রশীদের মন্তব্যকে ঘিরে সোশ্যাল মিডিয়ায় তীব্র আলোচনা-সমালোচনা তৈরি হয়েছে। এ নিয়ে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন হিরো আলমও। এদিকে মামুনুর রশীদের বক্তব্যকে সমর্থন করে তারকাশিল্পীদের পাশাপাশি অভিনয় শিল্পী সংঘ ও ডিরেক্টরস গিল্ড থেকে বিবৃতি প্রকাশ করা হয়েছে। সবকিছু মিলিয়ে এই প্রতিবেদন সাজিয়েছেন মাহফুজ রহমান

মামুনুর রশীদ
আপনারা যারা সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করেন, তারা দেখেছেন, আমার একটি উক্তি নিয়ে হাজার হাজার কমেন্ট হচ্ছে। ‘আমি বলেছি, রুচির দুর্ভিক্ষ চলছে- সেই দুর্ভিক্ষের মধ্য দিয়ে হিরো আলমের উত্থান হয়েছে। এই উত্থান জাতির জন্য, আমাদের সংস্কৃতির জন্য ভয়ংকর। এই উত্থানের মূলে আমাদের রাজনীতি আছে, আমাদের মিডিয়ার একটা বড় ভূমিকা আছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় আমাকে অনেকেই অভিযুক্ত করেছেন, এই রুচির দুর্ভিক্ষের জন্য আমরাও দায়ী। হ্যাঁ, আমরাও অবশ্যই দায়ী। কিন্তু যারা অভিযুক্ত করছেন, তারা জানেন না, আমরা যারা ৫০ বছর ধরে নাটক করছি, তারা কী কষ্ট করে রাতের পর রাত নিজের জীবনকে বিপন্ন করে রক্ত-ঘাম করে থিয়েটার করেছি। নাট্য সংস্কৃতির মধ্যে শুধু নাটকের লোক নয়, আমরা দর্শককেও রুচিবান করতে পারিনি। রুচির দুর্ভিক্ষ দর্শকের মধ্যেও হচ্ছে। তারা এখন যেসব নাটক বা অনুষ্ঠান পছন্দ করছে, আমরা সেই বিষয়গুলো কল্পনাও করিনি বা ভাবিনি। নাট্যসংস্কৃতির বিষয়টিকে এখন গুরুত্ব দেয়া প্রয়োজন।’ যে অনুষ্ঠানে আমি বলেছিলাম- ‘রুচির দুর্ভিক্ষ চলছে’ সেখানে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরও ছিলেন। যখন আমি বলেছি, আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিটা ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে। তিনিও সেটা স্বীকার করেছেন।
(বিশ্ব নাট্য দিবসের অনুষ্ঠানে মামুনুর রশীদের মন্তব্য)

নাসির উদ্দীন ইউসুফ
অর্ধশতাব্দী পূর্বে শিল্পাচার্যের উচ্চারণ ‘রুচির দুর্ভিক্ষ’ এ সত্য একালে ধ্বনিত হলো নাট্যকার মামুনুর রশীদের কণ্ঠে। মামুনুর রশীদের প্রতি কতিপয় ব্যক্তির অশ্লীল বাক্যবাণ প্রমাণ করে কি চরম রুচির দুর্ভিক্ষকালে আমাদের বসবাস।

আফজাল হোসেন
শিল্পাচার্য যখন রুচির দুর্ভিক্ষের কথা বলেছিলেন, তখন তেলেবেগুনে জ¦লে ওঠা মানুষ কম ছিল, নাকি ছিলই না। অমন কথায় কারো গায়ে ফোস্কা পড়েছিল- এমনটা শোনা যায়নি। তখন কি তাহলে সবার গায়ের চামড়া মোটা ছিল? নাকি তখন কথাটা অনুধাবন করবার সাধ্য ছিল মানুষের, তাই উচ্চবাচ্য না করে স্বীকার করে নিয়েছিল, মন্তব্যটা ভুল নয়। এখন রুচির দুর্ভিক্ষের কথা বললে মানুষ রে রে করে তেড়ে আসবে। দাঁতভাঙা জবাব দিতে একাট্টা হয়ে হামলে পড়বে। এমন উদাহরণই উপযুক্ত প্রমাণ, সত্যি সত্যিই আমাদের এখন রুচির দুর্ভিক্ষ চলছে। সময়টা বড় অদ্ভুত, এক দল ছড়ি ঘুরিয়ে অহরহ চোখ রাঙাচ্ছে। যখন-তখন নিজেদের রুচি, জ্ঞান অনুযায়ী যেমন খুশি তেমন বলে, করে যাচ্ছে- তাতে রা নেই কারো। কিন্তু যে মানুষের প্রগতিশীল ভূমিকা রয়েছে, সামাজিক সাংস্কৃতিক উন্নয়নের জন্য যার অবদান অশেষ- তার এক মতামতে ফেনিয়ে উঠছে গেল গেল রব। যুক্তির মন থাকলে স্বীকার করতেই হয়, নানা রকমের অবনতিকেই এখন ইনিয়ে-বিনিয়ে উন্নতি বলে দাবি করার অভ্যাস তৈরি হয়ে গেছে। সে অভ্যাস আমাদের এতটাই সাহসী বানিয়ে দিয়েছে, নির্দ্বিধায় বুক ফুলিয়ে যার যেমন ইচ্ছা- তেমনটা করা, বলা যায়। সেই করা বা বলায় অনুসারী তৈরি হয়, বিপুল করতালি পেয়ে স্বেচ্ছাচারের উদ্যম বাড়ে। কোনোদিক থেকেই এসব কাণ্ড বাধাগ্রস্ত হয় না, বিপরীতে সামাজিক স্বীকৃতি বলে গণ্য করা হয়। এই ভয়ংকর নীতিহীন কর্মকাণ্ডে তারাই ঘি ঢালে, যারা বিবেক বোধ বন্ধক রেখে নিজ উন্নতির সোপান ভেঙে চলেছে। দু’পক্ষ পরস্পরের হয়ে ওঠে এক লক্ষ্যে- বিশেষ হতে হবে। সব স্বাভাবিকতা তছনছ করে দিয়ে শুধু নিজ নিজ স্বার্থরক্ষা, অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার বেশরম চেষ্টা, এটাই বড় মাপের রুচিহীনতা, রুচির দুর্ভিক্ষ। জ্ঞানহীনের রুচিহীনতার চেয়ে জ্ঞান থাকা মানুষের রুচিহীনতা অনেক বেশি ভয়ানক। এই দু’পক্ষ মেড ফর ইচ্ছা আদার কাপল হলে সমাজের দায়িত্বশীল মানুষদের ওপর হামলা, মর্যাদা তছনছের চেষ্টা চলতেই থাকবে, সগৌরবে।

চঞ্চল চৌধুরী
তথাকথিত কিছু অসৎ রাজনীতিবিদদের কারণে যেমন রাজনীতি কলুষিত, তেমনি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আপনার বা আমার সমর্থনে গজিয়ে ওঠা ভাইরাল ব্যক্তিদের কারণে সংস্কৃতি কলুষিত হচ্ছে। এর জন্য অন্য কেউ দায়ী নয়। দায়ী আপনি বা আমি, দায়ী আমাদের নি¤œ মানসিকতা। আপনি কাকে অনুসরণ করবেন বা সমর্থন দেবেন বা কে হবে এই দেশে আপনার রাজনৈতিক বা সাংস্কৃতিক আদর্শ, চূড়ান্ত ভাবনার এই সময়টুকুও বোধ করি পেরিয়ে যাচ্ছে। আমাদের ক্ষেত্রে বিষয়গুলো অবজ্ঞা করার মতো হলেও আমাদের সন্তানরা ভবিষ্যতে অনুসরণ বা শ্রদ্ধা করার মতো কাউকে পাবে না। পরিচিত হতে হবে আপনার রুচিতে জন্ম দেয়া কোনো ভাইরাল বিনোদন ব্যক্তির উত্তরসূরি হিসেবে। কারণ আপনি বা আমি ঠিক-বেঠিক বা উচিত-অনুচিতের পার্থক্য ভুলে সস্তা বিনোদন প্রিয় জাতিতে পরিণত হয়ে গেছি। বুঝতে পারছেন কী সামনে কতটা অন্ধকার? চুপ করে থাকা রাজনীতিক, সংস্কৃতিবান এবং রুচিশীলদের বলছি- প্রস্তুত থাকুন, আপনাকে যে কোনো উপায়ে টেনেহিঁচড়ে নিচে নামানো হবে, তাই এখনো সময় আছে মুখ খুলুন, প্রতিবাদ করুন। এই ব্যর্থতা প্রথমত রাষ্ট্রের, দ্বিতীয়ত তথাকথিত সংস্কৃতি কর্মীদের, যাদের নৈতিক দায়িত্ব ছিল জাতিকে সঠিক পথ দেখানো, সঠিক গন্তব্যে পৌঁছে দেয়া।

মাসুম রেজা
রুচির দুর্ভিক্ষের প্রসঙ্গে আমি মনে করি মামুন ভাই কারো নাম উল্লেখ না করলেও পারতেন, তবে রুচির দুর্ভিক্ষের বিষয়টি তিনি যথাযথভাবেই বলেছেন। এই কথাটির জন্য তার ব্যক্তি জীবন নিয়ে যেভাবে ব্যবচ্ছেদ করা হচ্ছে তাতে রুচির দুর্ভিক্ষ নিয়ে আলাদাভাবে কিছু বলার দরকার পড়বে না। মামুন ভাই তার সাক্ষাৎকারে এটাও বলেছেন; অবকাঠামো উন্নয়নের যে বন্যা বয়ে যাচ্ছে, তার সঙ্গে রুচি এবং সংস্কৃতি উন্নয়নের প্রচেষ্টাও নিতে হবে। রুচির এই দুর্ভিক্ষ কাদের কারণে হয়েছে, কেন হয়েছে তার হয়তো একটা গঠনমূলক আলোচনা উত্থাপন করা যেত মামুন ভাইয়ের এই কথার প্রসঙ্গে, তা না হয়ে যেটা হচ্ছে তা কি ঠিক হচ্ছে।

শাহানাজ খুশি
এখন কিছু জানার দরকার হয় না মামুন ভাই! কিছু না জানা মানুষগুলো, জানা মানুষকে হিংসাত্মক প্রতিপক্ষ বানিয়ে ফেলছে। সে প্রতিপক্ষের জিঘাংসা কত নোংরা হতে পারে, তা আজ দুদিন সোশ্যাল মিডিয়ায় দেখা যাচ্ছে! যা বাকরুদ্ধ করে দেয়! মামুন ভাই, আপনার হাতে তৈরি এ সংস্কৃতি অঙ্গন আলোকিত করা কত শিল্পী! শুধু রুচির নয়, বিবেকের বিকলাঙ্গতা কতটা, তা কি আর বলবার দরকার আছে। স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের তুখোড় আপনাকে টিকটকের ভাঁড় জনকদের তুলনায় দাঁড় করিয়েছে যারা, তারাও তারই অনুসারী! শিল্প দিয়ে শিল্পীর প্রতিযোগিতা করা যায়, যাদের সে সঞ্চয় নাই, তারাই নিচতায় হরিলুট শুরু করে। সুন্দর কিছু শুরুর আগে কুৎসিত কিছু কালক্ষেপণ হয়, এটা নিশ্চয় তেমন সময়। বাংলাদেশের এত সমৃদ্ধ সংস্কৃতির ধারক, বাহক অথবা উদাহরণ নিশ্চয় এরা হতে পারে না! যারা আপনার ব্যক্তিজীবন অতি কথ্য দিয়ে আপনাকে হেয় করতে চেয়েছে, সেটা তাদের দীনতা এবং ব্যর্থতার আক্রোশ! শিল্পী এবং শিল্পকে মোকাবেলা করতে শৈল্পিক, কথা, যুক্তি আচরণই লাগবে, এটা তারা জানে না। তাদের এ দীনতাকে ক্ষমা করবেন আপনি। ভাগ্যিস আপনি কোন সরকারি মন্ত্রণালয়ে, টিভি চ্যানেলে, কোনো সরকারের আনুকূল্যের প্রতিষ্ঠানে নাই এবং কোনোদিন ছিলেনও না। যদি সেটা থাকতেন, তাহলে কি বলত এই মন্তব্যকারীরা? ৭০ ঊর্ধ্ব প্রায় ৮০’র কাছাকাছি একজন নাট্য প্রাণমানুষ যে তার একটা জনম বিলিয়ে দিয়েছে নাটক, শিল্পের জন্য। বিনিময়ে উল্লেখ করবার মতো কিছুই নেয়নি কখনো! এখনো এই বয়সে তাকে সংসারের জন্য অভিনয় করতে হয়, লিখতে হয়, এই শিল্প থেকে কিছুই সঞ্চয় করেনি বলেই, তার অসুস্থতায় আমরা তার শিল্প সন্তানরা তার হাত ধরে তার পাশে দাঁড়িয়ে যাই, তার তুলনা এবং মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে এ কোন অশৈল্পিক দুর্বৃত্ত অন্ধকার, আমাদের কবে, কোন মোহে এত বিবেক এবং রুচির বিকালঙ্গতা হলো? আপনার সন্তানদের আপনি বরাবরের মতো, নিজ গুণে ক্ষমা করবেন মামুন ভাই।

অভিনয় শিল্পী সংঘের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘আমাদের শিল্প-সাহিত্য, নাটক ও চলচ্চিত্রে সাম্প্রতিক রুচির যে অবনমন, যে ধরনের বিষয়বস্তু প্রাধান্য পাচ্ছে ও আলোচিত হচ্ছে, তা নিয়ে তিনি (মামুনুর রশীদ) শঙ্কিত হয়ে বলেছেন, আমাদের রুচির দুর্ভিক্ষ চলছে। উদাহরণ হিসেবে প্রতীকী অর্থে একটি নাম বলেছেন। তিনি কোনোভাবেই কোনো ব্যক্তিকে উদ্দেশ করে বলেননি বলেই আমরা বিশ্বাস করি। মামুনুর রশীদ তার সমগ্র জীবন উৎসর্গ করেছেন বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক বিকাশে। একটি বিশেষ সম্প্রদায় মামুনুর রশীদের বলা একটি শব্দ, লাইনকে ব্যবহার করে যেভাবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিদ্বেষ ছড়াচ্ছেন, বিভাজন তৈরি করছেন, তা ভীষণ নিন্দনীয় এবং অগ্রহণযোগ্য। যে বা যারা এই কাজটি করছেন, তারাই শিল্প ও সংস্কৃতির প্রধান শত্রæ। আমরা এর তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছি। আমরা মামুনুর রশীদের সঙ্গে একমত। রুচি ও মূল্যবোধের ভীষণ অবক্ষয় চলছে। অদ্ভুত আঁধার এক পৃথিবীতে আজ।’

টেলিভিশন নাট্য নির্মাতাদের সংগঠন ডিরেক্টরস গিল্ড বিবৃতিতে বলেছে, ‘সংস্কৃতির বাতিঘর মামুনুর রশীদ যে রুচির দুর্ভিক্ষের কথা বলেছেন, তা যে কতটা প্রকট এবং কতটা ভয়ংকর পর্যায়ে পৌঁছেছে, তা বুঝতেই পারা যেত না সোশ্যাল মিডিয়ায় আমাদের সংস্কৃতির বাতিঘরকে হেয় করবার যে রুচিহীন উল্লাস চলছে তা না দেখলে। বোঝাই যেত না আমরা কী পরিমাণ রুচির দুর্ভিক্ষের মধ্যে নিমজ্জিত আছি। দীর্ঘ ছয় দশক ধরে আমাদের সংস্কৃতি চর্চায় নিবেদিত ও পরীক্ষিত লড়াকু মানুষ শ্রদ্ধেয় মামুনুর রশীদকে হেয় করবার প্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে এটা পরিষ্কার যে সুস্থ বাঙালি সংস্কৃতিচর্চা ও বিকাশে সারাদেশের সাংস্কৃতিক জাগরণের মধ্য দিয়ে সুস্থ সাংস্কৃতিক বোধসম্পন্ন মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী মানবিক বোধসম্পন্ন সৃজনশীল বাংলাদেশ গড়ে তুলবার সংস্কৃতিকর্মীদের যে লড়াই চলছে, সেই দীর্ঘদিনের লড়াই এবং লক্ষ্যকে ব্যাহত করবার সুপরিকল্পিত অপপ্রচার ও অপচেষ্টা এটা।’

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়