১০৪ কোটি টাকা আত্মসাৎ : হোমল্যান্ড লাইফের বিরুদ্ধে তদন্তের নির্দেশ

আগের সংবাদ

মনোনয়নে আ.লীগের গুরুত্ব তৃণমূল : চ্যালেঞ্জে শতাধিক এমপি, চাপের মুখে সাংগঠনিক সম্পাদকরা, জেলার পর উপজেলা নেতাদের সঙ্গে বৈঠক

পরের সংবাদ

বিস্মৃতির অন্তরালে শহীদ সাবের

প্রকাশিত: মার্চ ৩১, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: মার্চ ৩১, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

দেশজুড়ে চলছে স্বাধীনতার মার্চ মাস। সাড়ম্বরে পালিত হলো আমাদের স্বাধীনতা দিবস। শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসেও স্মরণ করা হয়ে থাকে দেশ মাতৃকার সাহসী বীর সন্তানদের। নানান কর্মসূচি ছাড়াও দৈনিক পত্রিকাগুলোতে বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করে জাতির আত্মত্যাগী বীর সন্তানদের স্মরণ করা হয়। তাঁদের অবদান প্রভৃতি স্মৃতিচারণের মধ্য দিয়ে শ্রদ্ধা জানানো হয়। দেশের সকল পত্রিকায়, টেলিভিশনে, অনলাইনে তাঁদের নাম প্রকাশিত হয়, কত লেখা ছাপা হয়। এসব দেখে খুবই আনন্দ পাই। তবে মনে কষ্ট লাগে, যখন দেখি সে স্মরণের তালিকা থেকে এমন এক ব্যক্তিত্বের নাম বাদ পড়ে যায়, স্বাধীনতা আন্দোলনে যাঁর অবদান কোনো অংশে কম নয়। তিনি শহীদ সাবের, যিনি দৈনিক সংবাদ অফিসে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর লাগিয়ে দেয়া আগুনে একাত্তরের ৩১ মার্চ পুড়ে মর্মান্তিকভাবে প্রাণ হারিয়েছিলেন। সাহিত্য চর্চার মাধ্যমে যিনি স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্ন ছড়িয়ে দিয়েছিলেন মানুষের মাঝে। সংবাদপত্র জগতের মানুষ হয়েও সংবাদপত্র তাঁকে প্রায় ভুলেই বসেছে।
সাহিত্যিক সেলিনা হোসেন সম্পাদিত ‘শহীদ সাবের রচনাবলী’ পড়লে মনে বিস্ময় জাগে কত অল্প বয়স থেকে দেশ ও জাতির কথা, সাধারণ মানুষের কথা, তাঁদের সুখ-দুঃখের কথা, তাঁর ভাবনায় আসত। এত অল্প বয়সে জেল জুলুমের শিকার হয়েছেন। সমষ্টিগত মানুষের অধিকার ও মর্যাদাপূর্ণ জীবন প্রত্যাশা করতেন শহীদ সাবের। এই কারণেই অল্প বয়সে তাঁর রাজনৈতিক চেতনাবোধ এতটা প্রখর হয়ে উঠেছিল যে জেল-জুলুমকে উপেক্ষা করে সমষ্টিগত মানুষের মুক্তির লক্ষ্যে একপ্রকার জীবন উৎসর্গ করে গেছেন। মাত্র ১৬ বছর বয়সে চট্টগ্রামে তৎকালীন কমিউনিস্ট পার্টির ছাত্র-সংগঠন ছাত্র ফেডারেশনের সভায় বক্তৃতা দানকালে গ্রেফতার ও বন্দিত্ব বরণ করেন শহীদ সাবের।
আমি শহীদ সাবেরের একমাত্র অনুজ। স্বাধীনতা দিবসের বিশেষ সংখ্যায় কেন জানি শহীদ সাবেরকে খুঁজছিলাম। কিন্তু সেখানে শহীদ সাবেরকে খুঁজে পেলাম না। বাংলা একাডেমির সভাপতি সেলিনা হোসেন সম্পাদিত শহীদ সাবেরের রচনাবলী গ্রন্থটি সংগ্রহে ছিল। ওই গ্রন্থটি পড়ে ছুটির দিনটি কাটানোতেই মনটা ভরে উঠল। তাঁর রচনায় শহীদ সাবেবকে অমর করে রেখেছেন সাহিত্যিক সেলিনা হোসেন। স্বাধীনতার মাসের এ মাহেন্দ্রক্ষণে তাঁকে জানাই শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা। বহুল পরিচিত সাংবাদিক, সাহিত্যিক শহীদ সাবের উপেক্ষিত হলো। তবে তিনি হারিয়ে যাবার নয়। মুগ্ধ হলাম। পড়লাম পরাধীন ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস। চট্টলার বিপ্লবী সন্তান সূর্য সেনের কথা। ১৯৩০ সালে তাঁর নেতৃত্বে সশস্ত্র অভ্যুত্থানের ঘটনা। তিরিশের ঘটনা ও শহীদ সাবেরের জন্মলগ্ন এ সময়টা তাঁর জীবনের দিক-দর্শন ইঙ্গিতপূর্ণ বক্তব্য। নইলে শহীদ সাবের আর দশজন সাধারণ মানুষের মতো বৃহৎ জনারণ্যে হারিয়ে যেত। দৈনিক আজাদী পত্রিকায় প্রকাশিত উল্লেখযোগ্য ঘটনাপঞ্জিতে ‘বিশ শতকের চট্টগ্রাম’ নামে একটি প্রবন্ধে ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে চিরস্মরণীয় নাম মাস্টার দা সূর্য সেনের পাশে স্থান পেল শহীদ সাবেরের নাম (১ জানুয়ারি, শনিবার ২০০০ খ্রি.)। ১৯৯৫ সালে দৈনিক আজাদীর ৩৫তম বর্ষপূতি বিশেষ সংখ্যা ‘হাজার বছরের চট্টগ্রাম’-তেও চট্টগ্রামের এই কৃতিসন্তানের অবদানের কথা গুরুত্বের সাথে তুলে ধরা হয়েছে, শিরোনাম ছিল, ‘একটি সংগ্রামমুখর জীবনের প্রতীক শহীদ সাবের’। দৈনিক আজাদীর এই মহৎ কাজের জন্য দেরিতে হলেও কৃতজ্ঞতা স্বীকার করছি।
স্বাধীনতার এ মাসে শহীদ সাবেরকে শ্রদ্ধার শ্রদ্ধাঞ্জলি জানিয়ে স্বরণ করছি। তাঁর জন্ম ১৯৩০ সালের ১৮ ডিসেম্বর, আর মৃত্যু ১৯৭১ সালের ৩১ মার্চ। দেশ বিভাগের পর শহীদ সাবের চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুল থেকে ১৯৪৯ সালে মেট্রিক পাস করেন। লেখার ক্ষমতা, বক্তৃতার ক্ষমতা এবং রাজনৈতিক সচেতনতায় তিনি ছিলেন অসাধারণ একজন। স্কুলে পড়ার সময়ই শহীদ সাবের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত পড়েন। কলকাতার পার্ক সার্কাসে ‘ছোটদের আসর’ নামে একটি সংগঠন ছিল। শহীদ সাবের ছিলেন এই সংগঠনের লাইব্রেরিয়ান। এ সময় তিনি ‘ছন্দশিখা’ একটি দেয়াল পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। সাতচল্লিশের দেশভাগে নিজ জেলায় ফিরে এসে চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুল থেকে মেট্রিক পাশ করেন। ম্যট্রিক পাশের পর তিনি চট্টগ্রামে মুকুল ফৌজ আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হন। কলেজে অধ্যয়নকালে শহীদ সাবের প্রগতিশীল রাজনীতির সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত হন। তিনি মেট্রিক পাশ করার পর চট্টগ্রাম সরকারি কলেজের প্রথম বর্ষ আইএ ক্লাশে ভর্তি হন। ছাত্র রাজনীতির প্রতি আগ্রহ সাবেরকে নিয়ে যায় ছাত্র ফেডারেশনে। এই সংগঠনটি তখনকার দিনে পূর্ব বাংলার একমাত্র অসাম্প্রদায়িক ছাত্র সংগঠন ছিল। এই প্রতিষ্ঠানটির সাথে কমিউনিস্ট পার্টির ঘনিষ্ঠ সংযোগ ছিল। ফলে রাজনৈতিক দিক থেকে শহীদ সাবের প্রগতিশীল চিন্তার বাহক ছিলেন, ছাত্র ফেডারেশনের আদর্শ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষবাদের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। এই দিকে ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ সরকার গণতান্ত্রিক আন্দোলনের কণ্ঠরোধে বদ্ধপরিকর। মুসলিম লীগ সরকারের দমননীতির বদৌলতে বন্দি হলেন প্রগতিশীল চিন্তার বাহক শহীদ সাবের। পূর্ব বাংলা জুড়ে চলছিল কমিউনিস্টদের দমনাভিযান।
চট্টগ্রাম সেন্ট্রাল জেলে শহীদ সাবের রাজবন্দি একজন পলিটিক্যাল ভেটেনো। দেশের রাজনৈতিক অর্থনৈতিক সাংস্কৃতিক সার্বিক পরিস্থিতি ক্রমাগত অবনতির মুখে। মুসলিম লীগ সরকারও মারমুখী হয়ে উঠল। একদিকে যেমন আওয়ামী মুসলিম লীগের অভ্যুদয় পূর্ব বাংলার মুসলিম লীগ রাজনীতির একচেটিয়া প্রভাবকে টলিয়ে দিল, অন্যদিকে তেমনি, ১৯৫১ সালের মধ্যে মুসলিম লীগের একচেটিয়া প্রভুত্বকে খর্ব করে ঢাকাসহ পূর্ব বাংলার প্রায় সব জেলায় সংগঠিত হলো নতুন গণতান্ত্রিক চেতনায় উদ্ধুদ্ধ ছাত্র ও যুব সংগঠন। মুসলিম লীগ সরকারের জনবিরোধী নীতির বিরুদ্ধে এই নবগঠিত ছাত্র ও যুব সংগঠন রুখে দাঁড়াল। সরকার শহীদ সাবেরকে চট্টগ্রাম জেল থেকে খাপড়া ওয়ার্ডের হত্যাকাণ্ডের পর আতঙ্কের রাজশাহী সেন্ট্রাল জেলে নিয়ে গেল।
১৯৫১ সালে শহীদ সাবের রাজশাহী সেন্ট্রাল জেল থেকে আইএ পাশ করেন। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে শহীদ সাবেরকে ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে নিয়ে এলো। শহীদ সাবেরের বন্দিত্ব নিয়ে সাবেক পূর্ব পাকিস্তান আইন সভায় প্রশ্ন উঠল। কিন্তু ক্ষমতাসীন সরকার অটল মনোভাব পোষণ করলেন। আপোসহীন দৃঢ়চেতা অঙ্গীকারাবদ্ধ চরিত্রের অধিকারী শহীদ সাবের বন্ডে সই দিয়ে জেল থেকে বেরিয়ে আসতে অস্বীকার করে বসলেন। তাঁর বাবা বন্ড দিয়ে ছেলেকে বের করতে চেয়েছিলেন। শর্ত ছিল যে স্পেশাল ব্রাঞ্চের বিনানুমতিতে সাবের ঢাকার বাইরে যেতে পারবেন না। শহীদ সাবের ১৯৫৫ সালে জগন্নাথ কলেজ থেকে বিএ পাশ করেন। এরপর ঢাকার ওয়েস্ট এন্ড হাইস্কুলে কিছুকাল সহকারী শিক্ষক পদে চাকরির পর তিনি দৈনিক সংবাদ-এর সহকারী সম্পাদক পদে যোগ দেন। এসময় তিনি ফেডারেল ইনফরমেশন সার্ভিসের (সিএসএস) পরীক্ষায় পুরো পাকিস্তানের মধ্যে প্রথম স্থান অধিকার করেন। কিন্তু রাজনৈতিক কারণে জেলখাটা কমিউনিস্ট তাই তাঁকে নিয়োগ দেয়া হয়নি। তাঁকে সম্মানজনক পেশা থেকে উদ্দেশ্যমূলক বঞ্চিত করা হয়।
১৯৫৮ সালের শেষের দিকে শহীদ সাবেরের মানসিক বৈকল্য ঘটে। তিনি আমৃত্যু আর সুস্থ হননি। শহীদ সাবেরের উল্লেখযোগ্য সাহিত্যকর্মের মধ্যে রয়েছে: কারাগারে বসে লেখা রোজনামচা ‘আরেক দুনিয়া থেকে’ (কলকাতার নতুন সাহিত্য পত্রিকায় চৈত্র ১৩৫৭ সংখ্যায় প্রকাশিত), গল্প সংকলন ‘এক টুকরো মেঘ’ (১৯৫৫), শিশুসাহিত্য ‘ক্ষুদে গোয়েন্দার অভিযান’ (১৯৫৫), অনূদিত গ্রন্থ ‘ইসকাপনের বিবি’, ‘পাগলের ডায়রি’, ‘কালো মেয়ের স্বপ্ন’। শহীদ সাবের দৈনিক সংবাদ অফিস ভবনেই থাকতেন। ১৯৭১ সালের ৩১ মার্চ সকালে পাকিস্তানি সেনারা বংশালস্থ দৈনিক ‘সংবাদ’ অফিস পুড়িয়ে দিলে সংবাদ অফিসে থাকা শহীদ সাবের ওই আগুনে পুড়ে মারা যান।
তিনি বাংলা সাহিত্যে অবদানের জন্য স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলা একাডেমি পুরস্কার (মরণোত্তর, ১৯৭২, ছোটগল্প), চট্টগ্রামস্থ কক্সবাজার সমিতির কক্সবাজার পদক (১৯৮৯), কক্সবাজার সাহিত্য একাডেমী পুরস্কার (মরণোত্তর-২০০৩), কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের কক্সবাজার পদক (মরণোত্তর-২০০৪) এবং সবুজ বাংলা সংসদ পুরস্কার (মরণোত্তর-২০১১) পান শহীদ সাবের। তাছাড়া স্বাধীনতার পর তাঁর ছবি ব্যবহার করে শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মরণে ২ টাকা দামের ডাকটিকেট প্রকাশ করে বাংলাদেশ সরকার। এ ছাড়া জাতীয় প্রেস ক্লাবে এবং পিআইবিতে যে তের জন শহীদ সাংবাদিকের স্মৃতিফলক লাগানো আছে সেখানে শহীদ সাবেরের নামও রয়েছে।
দেশ মাতৃকার প্রতি শহীদ সাবেরের দায়িত্ববোধ এবং বাঙালির সৃজন ও মনন বিকাশে তাঁর অবদান গৌরবদীপ্ত অহংকার হয়ে থাকবে।
সাহিত্যিক সেলিনা হোসেন তাঁর লেখনিতে শহীদ সাবেরকে মূল্যায়ন করতে গিয়ে যে কথাগুলো ব্যক্ত করেছেন সেটা পুরোপুরি সত্য। যে সমাজ ব্যবস্থায় আমরা বাস করি, সেখানে বঞ্চনাই আমাদের জীবনের একমাত্র সত্য। উপেক্ষিত শহীদ সাবের সে সমাজ ব্যবস্থার কোনো ব্যতিক্রমী ইতিহাস নয়। শহীদ সাবের যা হতে পারতেন, তা হতে পারেননি। বৈরী সমাজব্যবস্থা তাঁকে পথ আগলে দাঁড়িয়ে রুদ্ধ করেছে। অথচ এই ব্যবস্থা ভাঙতেই তিনি যেমন প্রত্যক্ষ সংগ্রামে যুক্ত ছিলেন, তেমনি সাহিত্যকে অবলম্বন করেই ভাঙতে চেয়েছিলেন ব্যবস্থাটিকে। শহীদ সাবের পাকিস্তানি রাষ্ট্র ও ব্যবস্থার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিলেন বলেই স্বীয় যোগ্যতার মর্যাদা পাননি। তাঁর স্বপ্ন শাসক বদলের স্বপ্ন ছিল না। ছিল সমষ্টিগত মানুষেরও মুক্তি। আজ ৩১ মার্চ শহীদ সাবেরের ৫৩তম হত্যা দিবসে আমার অগ্রজকে কেবল স্মরণ করে নয়, তাঁর কাক্সিক্ষত স্বপ্ন বাস্তবায়নের আহ্বান জানাই সকল দেশপ্রেমিক ও জনপ্রেমী মানুষের কাছে।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়