তুরাগ : মাদক কারবারির হাতে ছুরিকাহত এসআই

আগের সংবাদ

বাজারে ক্রেতার নাভিশ্বাস

পরের সংবাদ

যুদ্ধের প্রথম দিনগুলি : এ এফ এম মাহবুবর রহমান

প্রকাশিত: মার্চ ২৬, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: মার্চ ২৬, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

একাত্তরের ছাব্বিশে মার্চ ইয়াহিয়া খানের ভাষণে যখন আমাদেরকে শাস্তি দেয়ার বীভৎস হুমকি দেয়া হলো, তখন অস্ত্র হাতে তুলে নেয়া ছাড়া উপায় ছিল না। সাতাশে মার্চ সকালে ওদের সঙ্গে সরাসরি সংঘাত। ওরা ইপিআইডিসি রোডে। আমরা খুলনা নিউজপ্রিন্ট মিলের অভ্যন্তরে। ‘যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে’ আমরা শত্রæর মুখোমুখি। ওদের হাতে ভারী অস্ত্র, মেশিনগান; ওদের সঙ্গে নেভির গানবোট কামান। আমাদের সামনে থেকে ওদের মেশিনগানের অবিশ্রান্ত গুলি, পেছন থেকে নৌবাহিনীর গোলাবর্ষণ। আমাদের পাখিমারা বন্দুক ওদের ভারী অস্ত্রশক্তির কাছে তুচ্ছ। হিংস্র দানবের অনুচরেরা আমাদের পাঁচজন সহযোদ্ধাকে রক্তস্রোতে ডুবিয়ে শহীদ করলো। অকল্পিত ভয়াবহতায় বিমূঢ় সকলে- আপন গৃহে আপনি অবরুদ্ধ।
বাসার সামনে থাকতেন সিকিউরিটি অফিসার সাঈদ সাহেব- বয়স ষাট, প্রাক্তন সেনা, প্যারাট্রুপার। গত কয়েক মাসের ঘটনা প্রবাহে কখনো কোনো কথা বলেননি। আজ শহীদ সহকর্মীদের লাশ মাটি চাপা দিয়ে ত্রস্তে নদীর ধার দিয়ে দক্ষিণ দিকে চলে গেলেন (একেবারে ভারতে, মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন)। সারাদিন চারদিকে ইতস্তত বিক্ষিপ্ত গুলির আওয়াজ। শুধু রাইফেল বন্দুকের গুলি নয়। মেশিনগানের গুলিও আছে। একটানা ঠ্যা ঠ্যা গুলি- পাকিস্তানি মিলিটারির গুলি; সাধারণ বাঙালির হাতে অমন মেশিনগান নেই। সারা বিকাল, সন্ধ্যা আতঙ্কে কাটল। রাতে গুলি একটু কমল।
নিউজপ্রিন্ট মিলটা প্রায় একশ একর জমির ওপর। সব সীমানায় উঁচু পাচিল; শুধু পূবে নদীর দিকে পাচিল নেই। নদীর কাছে এক বাসায় বিশ্বাসবাবু থাকতেন। আটাশ তারিখ সকালে বললেন, এই বদ্ধ জায়গায় থেকে মরা যাবে না। তিনি চলে গেলেন নদীর ওদিক দিয়ে। ততক্ষণে আবার ভয়ংকর গুলিগোলা শুরু হয়ে গেছে। আতঙ্ক বাড়ছে। কী করব, কোথায় যাব! চারদিকে শুধু গুলি আর গুলি। আমরা কি শুধু প’ড়ে প’ড়ে মার খাব! কোনো দিশা নেই। কোনো দিক থেকে কোনো নেতার কোনো নির্দেশ আসছে না। সকলেই দিশাহারা। হাঁটতে হাঁটতে পশ্চিমে জুনিয়র কলোনির দিকে গেলাম। লোকজন ইতস্তত বিক্ষিপ্তভাবে জটলা করছে। বাইরে দূরে আগুনের কুণ্ডলী, ধোঁয়া দেখা যাচ্ছে। নিউজপ্রিন্টের পাচিলের গায়ে, দূরে গোয়ালখালী কাশীপুর, রাস্তা আর রেললাইনের পাশের বস্তিতে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। চারদিকে আগুন, চারদিকে গুলি। চারদিক থেকে মৃত্যু যেন গ্রাস করছে। সাতই মার্চ সকলেই মনে করেছিল যে শেখ মুজিব স্বাধীনতা ঘোষণা করবেন। তা করেননি। কী লাভ হলো? আলোচনার নামে কালক্ষেপণ করে রাশি রাশি অস্ত্র আর সৈন্য এনে হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছে। এখন এই আগুন, এই গুলি! আকাশবাণী কলকাতা শুধু ভয়াবহ খবরই দিচ্ছে- এখানে এত মারা গেছে ওখানে অত মারা গেছে, এখানে এই বীভৎসতা, ওখানে ঐ নৃশংসতা। বাঁচার তো কোনো পথই দেখি না। এরই মাঝে একজন খবর দিলেন- সবাই চট্টগ্রাম রেডিও শোনেন, মেজর জিয়া স্বাধীনতা ঘোষণা করেছে। চট্টগ্রাম রেডিও সেন্টার ধরার চেষ্টা করলাম। দুপুর বারোটার দিকে হঠাৎ স্টেশনটা খুলল। ক্ষীণ শব্দ। চিৎকার করে আহ্বান করা হচ্ছে- যার যা অস্ত্রশস্ত্র আছে তাই নিয়ে লালদীঘির ময়দানে চলে আসুন। এমনি অনেক উত্তেজিত কথাবার্তা। একসময় একটা বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর- মেজর জিয়া বলছি; বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয়েছে; আমাদের মহান নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষ থেকে বিশ্বের সকল রাষ্ট্রের কাছে আহ্বান জানাচ্ছি আমাদের স্বীকৃতি দিতে এবং পাকিস্তানি বাহিনীর আক্রমণের বিরুদ্ধে আমাদের সকল প্রকার সহযোগিতা করতে। তিনি সঠিক কী বলেছিলেন তা মনে করতে পারি না, তবে এই রকমই কিছু বলেছিলেন। বাংলা-ইংরেজি দুটিতেই। তার সেই ভাষণ, তার সেই কণ্ঠস্বর মৃতপ্রায় মানুষকে মুহূর্তের মধ্যে প্রাণ শক্তি ফিরিয়ে দিল, শুধু আমাকে নয় সমগ্র জাতিকে প্রাণ শক্তিতে উজ্জীবিত করল, একবারে চাঙ্গা হয়ে উঠলাম সকলে। প্রতিরোধ শুরু হয়ে গেছে। বাঁচার আশা আছে। বাঁচব। সবাই মিলে রুখে দাঁড়াতে হবে। যুদ্ধ করতে হবে।
উনত্রিশ তারিখের সকাল নয়টার দিকে নদীর দিক থেকে মাইকে বাঙালির ঘোষণা ভেসে আসল। চঞ্চল হয়ে উঠলাম। ভাবলাম নিশ্চয়ই বাঙালিদের আহ্বান জানানো হচ্ছে যুদ্ধে যোগ দিতে, হয়তো বলা হচ্ছে কোথায় কখন যেতে হবে। ঘর থেকে দৌড়ে ছুটে বেরিয়ে আসলাম। কিন্তু হায়! নদীতে পাকিস্তান নৌবাহিনীর গানবোটের আওয়াজ। তা থেকে পরিষ্কার বাংলায় হুঁশিয়ারি দেয়া হচ্ছে : পাকিস্তানি পতাকা বাদে আর যে সব পতাকা উড়ছে সব নামিয়ে ফেলুন। কণ্ঠস্বর বাঙালির, কোনো জড়তা নেই। এই হুঁশিয়ারি মুহুর্মুহু দিতে দিতে গানবোটটি দক্ষিণ থেকে নদী দিয়ে উত্তর দিকে চলে যাচ্ছে। যেসব কালো পতাকা আর বাংলাদেশের পতাকা উড়ানো হয়েছিল, সাতাশে মার্চেই তা সব নামানো হয়ে গেছে। তা সত্ত্বেও এমন হুমকি। পরিষ্কার বাংলায়, বাঙালির কণ্ঠে। কে আছে এমন বাঙালি যে এই সময়ে এমন হুঁশিয়ারি দিয়ে বেড়াচ্ছে? নেভির গানবোট। নেভিরই কোনো বাঙালি হবে। হায় রে! আধা ঘণ্টা পরে আবার উত্তর দিক থেকে ঐ গানবোটটির ফেরার আওয়াজ পাওয়া যেতে লাগল। এক সময় বুম বুম দুটি বিশাল আওয়াজ। ঐ গানবোট থেকেই। নদীর অপর পাড়ে সেনহাটিতে একটা মন্দির ছিল। মন্দিরের ওপরে বাংলাদেশের পতাকা উড়ছিল। গানবোট থেকে গোলা ছুড়ে মন্দিরের মাথা উড়িয়ে দিয়ে পতাকা ধূলিস্যাৎ করা হলো।
রেডিও পাকিস্তানের খবরে বলা হলো যে শেখ মুজিবুর রহমান গ্রেপ্তার হয়েছেন। খবরটি কবে প্রথম বলা হয় আজ আর তা মনে নেই। খবরটা আমরা কেউই বিশ্বাস করিনি, কারণ বিশ্বাস করতে চাইনি। ফেব্রুয়ারি থেকে যে টালবাহানা পাকিস্তান সরকার করে আসছিল তাতে খুব পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল যে, নির্বাচনে জিতেও বাঙালিরা দেশটি পরিচালনা করতে পারবে না, পশ্চিম পাকিস্তানিরা সেই সুযোগ দেবে না, শাসন ত্রাসন ছাড়া পশ্চিম পাকিস্তান আমাদের আর কিছু করবে না। তাই আর নয়, এবার স্বাধীনতা ছাড়া আর বিকল্প নেই। সবাই ভেবেছিল যে সাতই মার্চেই শেখ মুজিব স্বাধীনতার ঘোষণা দেবেন এবং সে স্বাধীনতা রক্ষার লড়াইতে নেতৃত্ব দেবেন। সুতরাং তার গ্রেপ্তার হওয়ার প্রশ্নই আসে না। জাতির এই প্রত্যাশাই প্রতিধ্বনিত হলো চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র থেকে। প্রচার করা হলো যে শেখ মুজিব গ্রেপ্তার হননি।
চারদিকে মৃত্যুপুরী। আতঙ্ক বাড়তে থাকে। মনে সংশয় জাগে যে অখ্যাত এক মেজরের স্বাধীনতা ঘোষণার কী মূল্য আছে ? বিশ্ববাসী তার কথা শুনে আমাদের বাঁচাতেই বা আসবে কেন! দরকার তো রাজনৈতিক নেতাদের; রাজনৈতিক নেতৃত্বের। তারা কোথায়? একটা আশার খবর পাওয়া গেল এই যে, সেনাবাহিনীর বেঙ্গল রেজিমেন্ট আর ইপিআর বাহিনীর সৈন্যরা বিদ্রোহ করে পাকিস্তানি সৈন্যদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে- যে যেখান থেকে পারছে। তাদের জন্য খাওয়া-দাওয়া পাঠানো দরকার।
যুদ্ধ শুরুর তিন দিন পর তিরিশ তারিখ সকালে ঘর থেকে বের হয়ে গেলাম আমার কর্মস্থল হার্ডবোর্ড মিলে- নিউজপ্রিন্টের ভেতর দিয়ে। আরো দু-চারজন এলেন। সবার মুখে মৃত্যুর খবর। আলমনগর রেলগেটের কাছে রাস্তার গায়ে ঝুপড়ি ঘরে থাকত আমাদের শ্রমিক হামিদ। মিলিটারির গুলিতে নিজের ঘরের মধ্যেই মারা গেছে সে; হামিদের মতো আরো কতজন কে জানে! ইপিআইডিসি রোডটা অর্ধচন্দ্রাকার। দক্ষিণে খুলনা পলিটেকনিকের রেল গেট থেকে শুরু করে উত্তরে কাশীপুরে যেয়ে শেষ হেয়েছে, প্রায় আড়াই মাইল। পাশে অজস্র ঝুপড়ি ঘরের বস্তি, বাঁশের বেড়া আর গোলপাতার ছাউনি। পুরো বস্তি জলছে। নদীর কাছে দাঁড়িয়ে কথা বলছিলাম। গন্ধ ভেসে আসছে। মানুষের পচা লাশের গন্ধ। নদী দিয়ে লাশ ভেসে যাচ্ছে। একটি-দুটি নয়। লাশের পরে লাশ, সারি সারি লাশ। নদীর পুরো প্রশস্ততাজুড়ে বিক্ষিপ্ত লাশ। গুনে শেষ করা যাবে না। পুরুষের লাশ, মেয়েদের লাশ, যুবতীর লাশ। এ লাশের শেষ নেই। প্রায় সবই বিহারিদের লাশ। জোয়ারের পানিতে কিছু লাশ নদীর পাড়ের ঢালে এসেছিল, ভাটির টানে পানি নেমে গেছে; লাশ ঢালে আটকে আছে। লাশের গন্ধে পুরো বাতাস দুর্গন্ধময়।
একত্রিশ তারিখ সকালে সহকর্মী আবুল হোসেন সাহেব তার পরিবার নিয়ে উপস্থিত হলেন আমার বাসায়। খালিশপুরে বিহারি পট্টির গায়ে একটা একতালা বাসায় থাকতেন আবুল হোসেন সাহেব। প্রায় দুই বর্গমাইলজুড়ে খালিশপুরের বিহারি বস্তি। ছোট ছোট ঠাসাঠাসি কয়েকশ ঘর। নদীতে যে অজস্র লাশ ভাসছে তার অধিকাংশ হয়তো এই বিহারিদের লাশই হবে। সাতাশ তারিখ থেকে পাকিস্তানি মিলিটারিরা নির্বিচারে মারছে। এর মাঝে কখন কীভাবে এত বিহারি নিহত হলো সে এক বিস্ময় বটে। তিরিশ-একত্রিশ তারিখ থেকে বিহারিরা পাল্টা হামলা করতে থাকল। বিহারিদের প্রতি-আক্রমণ দেখে আবুল হোসেন সাহেব ঘর ছেড়েছেন। বৌ-ছেলেমেয়ে নিয়ে ঐ গুলি, ঐ আগুনের মাঝ দিয়ে নিউজপ্রিন্টের সাত-আট ফুট উঁচু পাচিল ডিঙ্গিয়েছেন। বিপদে পড়লে মানুষ অনেক কিছুই পারে। ওদের পেয়ে আমরাও একটু আশ্বস্ত হলাম। বিকালের দিকে তিনি আর আমি বের হলাম দৌলতপুরে তার বাড়ি যাবার উপায় খুঁজতে। নদীর ধারে গেলাম, জেটির কাছে। গন্ধ। ভৈরব নদীতে ভেসে চলা আর পাড়ে আটকে থাকা মৃত মানুষের পচা লাশের সেই গন্ধ। কিছু মানুষ সঙ্গে নিয়ে নিউজপ্রিন্ট মিলের ডাক্তার খুরশিদী চরে আটকে থাকা কিছু লাশ নদীর পাড়ে কাদার মধ্যে গর্ত করে মাটি দিয়েছেন। ডাক্তার খুরশিদী অবাঙালি, ধার্মিক সদালাপী, সকলেই তাকে ভালো জানে। নদীর ওপারে চন্দনীমহল গ্রাম। কেউ কেউ নদী পার হয়ে চন্দনীমহলে আশ্রয় নিয়েছে, কেউ-বা রূপসা নদী ধরে বাড়ির উদ্দেশে গেছেন। যারা চন্দনীমহল যাচ্ছে, গ্রামবাসী তাদের আশ্রয় দিচ্ছে, খাওয়াচ্ছে, যতœ করছে, যথাসাধ্য সাহায্য করছে তারা যেন যথাসম্ভব নিরাপদে যেতে পারে। বিপদের সময় এই সাহায্য ছিল অসামান্য।
পহেলা এপ্রিল সকালে আবুল হোসেন সাহেবের আত্মীয় বাড়ি খোঁজার উদ্দেশ্যে নদী পার হলাম। নদীর পাড়ে কখনো কখনো নৌকা এসে ভিড়ছিল, যাত্রী পার করার জন্য। ভাসমান লাশের সারি আড়াআড়ি ডিঙ্গিয়ে নদী পার হলাম। পাড়েই কাদার ওপর একটি লাশ। যুবতীর। বিবস্ত্র, কাত হয়ে পড়ে আছে। পেট বোধ হয় ছুরি দিয়ে ফাড়া, নাড়িভুঁড়ি বেরিয়ে এসেছে। শরীরের উপরে একটা কাক বসে ভুঁড়িটা ঠোকরাচ্ছে। মাথার লম্বা চুল খুলে খুলে পড়ছে। মরার পর মনে হয় মানুষের চুলই আগে পড়ে। ডাঙ্গায় উঠে উত্তর দিকে হাঁটলাম। চন্দনীমহল, সেনহাটির মন্দির পেরিয়ে দীঘলিয়া গ্রামে আবুল হোসেন সাহেবের আত্মীয়ের বাড়ি। সবাই এই বাড়িতেই আশ্রয় নেব। বাসায় ফিরে আবার নৌকায় উঠে লাশের মাঝ দিয়ে নৌকায় ভেসে ভেসে আমরা উজানে যাচ্ছি। আমরা ভাসছি, লাশও ভাসছে। প্রায় দুই মাইল, পুরো পথটাই লাশের মাঝ দিয়ে চলতে চলতে এক সময় দীঘলিয়া পৌঁছলাম।
দৌলতপুর, খালিশপুর, খুলনা সর্বত্র থেমে থেমে গুলির আওয়াজ। সারদিন নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে থাকি। দূরে ওপারে দৌলতপুর থানার সামনের গলিতে কদাচিৎ দু-একজন মানুষ দেখা যায়। আমি দেখি লাশ। লাশগুলো জোয়ারের সময় উত্তর দিকে যায় আবার ভাটার সময় দক্ষিণে। অনেক লাশই নিরাবরণ। মাথা, হাত, পা পানির নিচে; শুধু গলা থেকে পেটের নিচ অবধি ভাসে চিৎ হয়ে। ছোট-বড় বিভিন্ন মাপের লাশ- পুরুষ, রমণী, নানা বর্ণের। একটা সুন্দর মেয়ের লাশ, চিৎ হয়ে ভেসে যাচ্ছে; মেয়েটি অবশ্যই অবাঙালি : বিশ-পচিশ বছর বয়স হবে, সোনার বরণ গায়ের রং; নিরাবরণ দেহ ভাসে নদীর জলে। কোন পাষণ্ড এমন অপরূপ সৃষ্টিটিকে মারতে পারে ভেবে অবাক হতাম। হয়তো এই লাশটা দেখার জন্য বার বার নদীর ধারে আসি। নদীতে কত লাশ? শত শত বা হাজার হাজার? ভৈরব নদীটা প্রায় তিনশ গজ চওড়া। প্রতি বিশ-ত্রিশ গজ অন্তর একটা লাশ ভেসে যাচ্ছে। দক্ষিণে লবণচোরা থেকে উত্তরে শিরোমনি বা আরো উত্তর পর্যন্ত প্রায় দশ মাইল এই লাশের সারি। সব লাশই স্রোতের বরাবর লম্বালম্বি ভাসছে, সব লাশেরই মাথা উত্তর দিকে পা দক্ষিণ দিকে। জোয়ার-ভাটা সব সময় এমন। বড় সুশৃঙ্খল এ লাশের মিছিল। শৃঙ্খলাই তো প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন ইয়াহিয়া খান চক্র। লাশের শৃঙ্খলা? কত লাশ ভাসে, কত লাশ ডুবে গেছে, আর কত লাশ পাড়ে আটকে আছে। কানে বাজে সেই ভাষণ- রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেবো; এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাআল্লাহ। কার রক্ত, কত রক্ত? এখানে এখন বাঙালির রক্ত, বিহারির রক্ত, পাঞ্জাবির রক্ত। রক্তে সয়লাব। এত রক্ত দেখে তিনি কি স্থির থাকতে পারতেন! এই কি তিনি চেয়েছিলেন?
দিন তিনেক অপরিচিতের বাড়ি থেকে অস্বস্তি লাগল। নিউজপ্রিন্টের বাসায় ফিরে যাব। নৌকা নিলাম। ছইওয়ালা নৌকা। চৌঠা এপ্রিল সকাল এগারোটা, আমরা দুজন মাত্র যাত্রী নির্জন নদীতে, আর ভাসছে লাশ চারদিকে। আমি আর ফিরোজা বেগম ছইয়ের মুখেই বসলাম। পেছনে শীর্ণকায় প্রৌঢ় মাঝি ধীরে ধীরে বৈঠা বাইছে লাশের মাঝ দিয়ে। যে আমি জীবনে কোথাও কোনো অপমৃত্যুর কথা শুনলে ভয়ে বাঁচতাম না, লাশ দেখা তো দূরের কথা লাশের ত্রিসীমানায় যেতাম না, সেই আমি এখন ক্ষত-বিক্ষত শত শত লাশের মাঝ দিয়ে চলেছি অনুভূতিবিহীন। নৌকা পশ্চিম পাড়ে এসেছে। গোয়ালপাড়া পাওয়ার স্টেশনের পেছন দিয়ে যাচ্ছি। পাওয়ার স্টেশনের জেটিতে এক তরুণকে দুজন লোক ধরেছে। দুজন দুদিকে লোকটার দুহাত প্রশস্ত করে টেনে ধরল; অন্য আর একজন সামনে থেকে রাইফেলের গুলি করল; ঢলে পড়া রক্তাক্ত ছেলেটাকে দুজন চ্যাংদোলা করে নদীতে ফেলে দিল। আমি আমার হাতটা ছইয়ের ওপর এমনভাবে রাখলাম যেন এই ভয়াবহ দৃশ্য ফিরোজা বেগম দেখতে না পারে। নদীর ঢালে যত্রতত্র লাশ আটকে আছে। পচে স্ফীত হয়েছে। লাশের গন্ধে এখন আর বিচলিত হই না, সয়ে গেছে। এসে পৌঁছলাম নিউজপ্রিন্ট কলোনি ঘাটে। জেটিতে নৌকা ভিড়াব কিন্তু জেটিতে মিলিটারি ভরা। ওদের সবার হাতে অস্ত্র, হিংস্র চাহনি। মিলিটারিদের থেকে পঞ্চাশ হাত দূরে নৌকা ভিড়িয়ে এক হাটু কাদার মধ্যে নামলাম। ফিরোজা বেগমের বয়স তখন বিশ, গৌরবর্ণা, সুশ্রী। এটা যুদ্ধক্ষেত্র। যুদ্ধে ন্যায়-অন্যায় বলে কিছু নেই। মিলিটারিরা এসে যদি তাকে ছোঁ মেরে নিয়ে যায়! কী করব! ভয়, শঙ্কা, আতঙ্ক কিছুই আর তখন নেই। কাদা ভেঙে দুজনে উপরে উঠলাম। কারো বাসায় ঢুকার উপায় নেই, মিলিটারি আসার ভয়ে সবাই দরজা-জানালা বন্ধ করেছে। আমরা দুজন, কারো মুখে কোনো কথা নেই, খানিকটা হেঁটে বাসায় পৌঁছলাম। ঘরে ঢুকে ফিরোজা বেগম বলল- জানো, নদীর পাড়ে একটা লোককে গুলি করে নদীতে ফেলে দিল, তুমি দেখলে ভয় পা’বা তাই আমি এমনভাবে বসে ছিলাম যেন তুমি না দেখতে পারো।
দুপুরে আমার নিজ গ্রাম থেকে দুজন এই আগুন এই লাশ পার হয়ে আমার বাসায় উপস্থিত, আমাদের নিয়ে যেতে। পাঁচই এপ্রিল সকালে ইপিআইডিসি রোড দিয়ে আলমনগর গোয়ালখালী হয়ে বিহারি এলাকা এড়িয়ে যশোর রোডে উঠলাম, রাস্তায় কোনো জনমানব, নেই যানবাহন নাই, যদি কিছু পাওয়া যায় এই আশায় দৌলতপুরে গেলাম। আলমনগর, গোয়ালখালী, কাশীপুর দৌলতপুর সবখানে রাস্তা রেললাইনের পাশে যত বস্তি সব আগুনে জ¦লছে। কোথাও দাউ দাউ, কোথাও ধোঁয়া; মানুষ নেই। আগুনের মধ্য দিয়ে চলছি। এ আগুন জ¦লছে আজ আট-নয় দিন- একটা স্বাধীন-সার্বভৌম দেশের অন্তিম জ¦লা। মিলিটারিরা রাস্তার পাশে এসব বাঁশের খুঁটি, বাঁশের বেড়া আর গোলপাতার ছাউনিগুলো সব জ¦ালিয়ে দিচ্ছে যেন এখানে লুকিয়ে থেকে অকস্মাৎ কেউ চলমান মিলিটারি বহরে গুলি করতে না পারে। অথবা জ¦ালাচ্ছে প্রতিশোধের হিংস্রতা চরিতার্থের জন্য। এসব বস্তিতে কলকারখানার নিম্ন আয়ের শ্রমিকেরা থাকে, অনেকে বৌ-বাচ্চা নিয়ে থাকে, বৌয়েরা সাধারণত অন্যের বাসায় কাজ করে। আগুন লাগাবার সময় তারা কে কোথায় ছিল, কীভাবে কোথায় গেল, কত জন মরল কে জানে!
দৌলতপুর বাসস্টান্ডে একটিমাত্র বেবিট্যাক্সি (অটোরিকশা) নিয়ে ড্রাইভার জবুথবু হয়ে বসে আছে। বললাম, ফুলতলা যাবেন। রাজি হলো। চারজন রওনা হলাম। রাস্তার কোথাও কেউ নেই, দোকানপাট সব বন্ধ। দৌলতপুর ছাড়িয়ে চললাম। যশোর-খুলনা রোড দিয়ে যশোরের দিকে। সামনে থেকে যদি মিলিটারি বোঝাই ট্রাক এসে যায় কী পরিণতি হবে তা কল্পনা করা কল্পনাশক্তিতেও কুলায় না; তাই সে কল্পনা করিও নাই। তবে বিহারিদের কথা ভাবলাম; রেলগেটে বিহারি থাকার আশঙ্কা ছিল, তেমন নজরে পড়লো না। ফুলতলা পার হয়ে পরের বিহারি বসতি রাজঘাটে যখন এলাম আমাদের বেবিট্যাক্সি দেখে দূর থেকে বিহারি যুবকেরা দাঁড়িয়ে পড়ল। সবাই যুবক, লুঙ্গি পরা খালি গা, সুঠাম দেহী। চলন্ত বেবিট্যাক্সি। আমার চোখ ওদের চোখে, ওদের চোখ

আমার চোখে। বেবিট্যাক্সিটা থামিয়ে যে কোনো নৃশংসতা ওরা করতে পারে। কিন্তু ভয় তখন আমার অনুভূতি থেকে উধাও হয়ে গেছে। ভয় যখন দূরে থাকে ততক্ষণই ভয়। ভয়ের মধ্যে ভয় থাকে না। বেবিট্যাক্সি পার হয়ে এলো। রাজঘাট, তালতলা পার হয়ে নোয়াপাড়া এলাম। আগের মতো ড্রাইভারকে বললাম, এতদূর যখন আসলেন আর একটু এগোয়ে বসুন্দিয়ার মোড় পর্যন্ত দিয়ে আসবেন নাকি? কী আশ্চর্য, সে এবারো রাজি হয়ে গেল। মিনিট বিশেক নির্জন যশোর-খুলনা রোড ধরে চালিয়ে পৌঁছে গেলাম বসুন্দিয়ার মোড়ে। যা দিলাম তাই নিল। গাড়ি ঘুরিয়ে দৌলতপুরের দিকে রওনা হলো। একবার ভাবলাম, একা একা ও এতদূর কীভাবে যাবে, তেলই বা আছে কিনা। নির্জন নিথর রাস্তায় ও দেখা দিয়েছিল আল্লার আশীর্বাদ হয়ে। আমরা হাঁটলাম বসুন্দিয়ার দিকে।
জনশূন্য বসুন্দিয়া বাজার। গাঙ্গ পার হয়ে গ্রামের পথে মাইল দেড়েক হাঁটার পর এক সাইকেল আরোহী যুবক বার্তা দিল যে ফিরোজা বেগমের আব্বার গুলি লেগেছে। ফিরোজা বেগমের কান্না শুরু হয়ে গেল। ওর আব্বা কালীগঞ্জে। এ যুবক কীভাবে খবর পেল? লোকটাকে ধমক দিলাম, চোখ ইশারাও দিলাম। সে বুঝে তার কথা ঘুরাতে চেষ্টা করল। তাতে কোনো কাজ হলো না। ফিরোজা বেগম কাঁদতেই থাকল, কাঁদতে কাঁদতেই হাঁটতে থাকল। এক সময় আমাদের জামদিয়া গ্রামে এসে পড়লাম। বাড়ি পৌঁছলাম। আব্বা-মা সবাই এখন গ্রামের বাড়িতে। অনেকেই এগিয়ে এলো। চার মাইল হেঁটে এসে পিতার দুঃসংবাদে ফিরোজা বেগম আছড়ে পড়তে থাকল। ওর আব্বা, ষাটের দশকে প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নূর আলী মিঞা, পহেলা এপ্রিল কালীগঞ্জ-ঝিনাইদহ মহাসড়কের ওপর পাকিস্তানি সৈন্যের গুলিতে শহীদ হন। দুঃসংবাদ বাতাসেরও আগে চলে।
আব্বার কপালে ব্যান্ডেজ। আমাদের যশোরের বাড়িতে মিলিটারি ঢুকে আব্বাকে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে জখম করেছে। বেয়নেটের খোঁচায় আব্বার যেখান থেকে রক্ত ঝরেছে কপালের সেখানে মাথায় সাদা ব্যান্ডেজ। উপস্থিত বয়োজ্যেষ্ঠ এক আত্মীয় খালিশপুরের খবর শুনলেন, ঢাকায় তার সন্তান কেমন আছে জানেন না। প্রলাপ বকতে থাকলেন- এই জন্যেই কি মানুষ ভোট দিয়েছিল?
ছাব্বিশে মার্চ যেমন খালিশপুর থমথমে ছিল, যশোর শহরও তাই। আটাশ তারিখে আমাদের বাড়ির সামনের রবীন্দ্র নাথ রোডে মিলিটারি গাড়ি চলছিল। আমাদের বাড়ির পাশ থেকে এক যুবক একটা মিলিটারি গাড়ি লক্ষ্য করে ঢিল ছুড়ে। সঙ্গে সঙ্গে দশ-বারো জন সশস্ত্র মিলিটারি আমাদের বাড়ি ঢুকে পড়ে। আব্বা-মা ঘরে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দেন। ছোট বোন দুটি পেছনের দরজা দিয়ে দৌড়ে পালিয়ে যায়। মিলিটারিরা চিৎকার করতে থাকে, লাড়কা কাঁহা। (এই ‘লাড়কা কাঁহা’ হাঁক দিয়ে তারা বাড়ি বাড়ি যুবক ছেলেদের সন্ধান করেছে।) মিলিটারিরা দরজায় লাথি মারা শুরু করলে আব্বা দরজা খুলে দেন। তারা ঢুকে আব্বাকে বেয়নেট দিয়ে আঘাত করে। আব্বার কপাল কেটে রক্ত ঝরতে থাকে। তারা আব্বাকে বাড়ি থেকে ধরে বাইরে আনে, ট্রাকে উঠিয়ে নিয়ে চলে। আব্বার কপাল দিয়ে রক্ত ঝরে গেঞ্জি ভিজে যাচ্ছে। কিছু দূরে গিয়ে রক্তাক্ত আব্বাকে তারা ট্রাক থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়। রক্ত না ঝরলে বোধ করি নিয়েই যেত। তারপর?
আব্বাকে ফেলে ট্রাকটা আরো এগিয়ে গিয়ে সুধীর বাবুর কাঠগোলার সামনে দাঁড়ায়। আশপাশের থেকে লোকদের জড়ো করে। সুধীর বাবুর ভ্রাতৃগণ ব্রিটিশবিরোধী বিপ্লবী ছিলেন। এ মাটির মায়ায় তারা ওপারে যাননি। আমার আবাল্য ঘনিষ্ঠতম বন্ধু দেবব্রতর বাবা সুধীর বাবু সমাজসেবক, ক্রীড়া সংগঠক। মিলিটারিরা বাসা থেকে সুধীর বাবু আর তার ছেলে সত্যব্রত ঘোষকে (বাবু) ধরে ট্রাকে উঠিয়ে নিয়ে যায়। ওরা সেই যে গেল, আর ফেরেনি। নয় মাস যুদ্ধের পর দেশ স্বাধীন হলো। মাসিমা পথ চেয়ে থাকেন- স্বামী-সন্তান ফিরে আসবে। দেবব্রত বলত- আফগানিস্তান হয়েও তো আসতে পারে? কেউ আসেনি। মাসিমা সিঁদুর মোছেননি, শাঁখা খোলেননি অনেক বছর। স্বপ্ন দেখেছেন ওরা আসবে। স্বপ্ন ফুরিয়ে গেছে, ভেসে গেছে চোখের জলে; অবশেষে একদিন শাঁখা খুলেছেন, সিঁদুর মুছেছেন। বেদনাময় ছিল সেই ক্ষণ! আমদেরও স্বপ্ন ছিল। সে স্বপ্নের কী হয়েছে? কী পেয়েছি? যশোর সেনানিবাসে বেলের মাঠে তখন ছিল ছন-খড়ের বন। আজ আর নেই। তবু বেলের মাঠে শরতের কাশফুল যখন হাওয়ায় দোলে, ভাবি বুঝিবা ষোলো-সতেরো বছর বয়সের সাদা ধবধবে বাবুর মুখখানি দুলছে।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়