তুরাগ : মাদক কারবারির হাতে ছুরিকাহত এসআই

আগের সংবাদ

বাজারে ক্রেতার নাভিশ্বাস

পরের সংবাদ

মুক্তিযুদ্ধের ছোট গল্প > বীরাঙ্গনা অহল্যা : রুদ্র শাহীন

প্রকাশিত: মার্চ ২৬, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: মার্চ ২৬, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

গ্রীষ্মের সকাল।
তখনো ঊষার দুয়ার পুরোপুরি খুলেনি। গাছের ফাঁকে ফাঁকে বয়ে আসছে খণ্ড খণ্ড আলো। সেই আলো প্রবেশ করছে ক্যাম্পের বারান্দায়।
ছোট্ট পরিসরের খড়ের ছাউনি আর বেড়া দিয়ে গড়া ক্যাম্প। সামনে বারান্দা। তার আশপাশে বিক্ষিপ্ত হয়ে রয়েছে পাহাড়, কোথাও হালকা জনবসতি, নিবিড় গাছপালা, আবার মাঝে মাঝে শূন্য প্রান্তর। এমন প্রান্তরে নিছক সুন্দরের মাঝে হারিয়ে যায় বাঙালির মন। কিন্তু হারিয়ে যায় না হানাদারের নিষ্ঠুর মন। এখানে পাক-হানাদার দস্যুদের বসতিও খুব বেশি।
বারান্দায় ছোট্ট একটা বেঞ্চি। বেঞ্চিতে মসুর ডালের মতো চেপ্টা হয়ে বসে আছে কমান্ডার মতিন। তার চেহারা খুব চিন্তিত। সহযোদ্ধা কাজল এসে জিজ্ঞাসা করল, কি ব্যাপার? এত সাজ-সকালে মুখ ভার করে বসে আছিস কেন? তোর কি হয়েছে- দোস্ত?
বাঁকা চোখ করে ফিরে তাকায় মতিন।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে। গলাটা লম্বা করে বলে, তোদের সাথে তো বিষয়টা শেয়ার করা উচিত, না হয় এমন দুর্দান্ত কাজে হাত রাখা আমার একার দ্বারা অসম্ভব।
এত লম্বা বাক্যটা শুনে কপালে উঠেছে চোখ। নিচুস্বরে কাজল বলল, বল। শুনে দেখি।
নূর হোসেন এসে হাবাগোবা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার বুকেও এক ধরনের উত্তেজনা। চঞ্চল স্বরে বলল, দুর্দান্ত কি কাজ ভাই?
হাত দুটি ঝাঁকানি দিয়ে, আলস্য দূর করে মতিন বলিল, পুরো চা বাগানসহ এই অরণ্য অঞ্চল এখন হানাদার বাহিনীর দখলে। ধীরে ধীরে ওরা আরো এগুচ্ছে। অচিরে আমাদের এই ক্যাম্প ছেড়ে পালাতে হবে।
নূর হোসেন আতঙ্কের চোখে বলল, হ ভাই। মাঝে মাঝে রাজাকার কাদিরে আর তার সাঙ্গোপাঙ্গ নিয়ে বীরের মতো ঘুরতে দেখি।
কাজল বলল, তাদের ক্যাম্পে অনেক সদস্য এবং দূর-দূরান্ত থেকে এসে আরো বৃদ্ধি পাচ্ছে। বড় বিষয় হলো- অত্যাধুনিক অস্ত্র, গোলা-বারুদসহ নানা অস্ত্র তাদের কাজে মজুত।
ভাবনা মিশ্রিত কণ্ঠে মতিন বলল, ঘাঁটিটি খুব শক্ত।
কাজল মাথার চুল কুঁচকায়। -হ ভাই!
গতকাল রাতের অন্ধকারে হাসিম এসেছে। এসে একটা বার্তা দিয়ে গেছে। বার্তাটা সামসু উদ্দিনের হাতে আছে। সে অশিক্ষিত লোক। পড়তে-লিখতে জানে না। ক্যাম্পে কেউ উপস্থিত ছিল না বলে সামসু উদ্দিন বার্তাটা লুকিয়ে রেখেছে।
লুকানো বার্তাটা নিয়ে এসে সামসু উদ্দিন বলল, এই দেখ -একটা চিঠি এসেছে। কালুরঘাট থেকে হাসিম নিয়ে এসেছিল।
বার্তাটা লিখেছে ঢাকা থেকে ক্যাপ্টেন জামিল সাহেব। তারপর কালুরঘাট ক্যাম্প হয়ে এই চা-বাগানে। সামসু উদ্দিন বার্তাটা নিয়ে কমান্ডার মতিনকে বললেন, এই নিন। রাতে দিতে ভুলে গেছি।
মতিন টুকরো সেই কাগজে চোখ বুলাচ্ছে। পাঠ পূর্বক কপালে উঠেছে চোখ। নূর হোসেন বলল, কি হয়েছে? সমস্যা কি?
হতাশ হয়ে মতিন বলল, এত বড় দায়িত্ব পালন করা আমার দ্বারা সম্ভব হবে না। প্রথমত আমাদের যোদ্ধাও স্বল্প সংখ্যক, ইহা ছাড়া ভালো অস্ত্রশস্ত্রও নেই। গত অপারেশনে তিনজন হারিয়েছি। আমরা কোনোমতে বেঁচে গেছি। অস্ত্র ছাড়া কি যুদ্ধ করা সম্ভব।
নূর হোসেন বার্তাটি শেষ করে রেগে উঠে। আপনা-আপনি বলে, ফেলে দাও সেই বার্তা! অস্ত্রশস্ত্র কিছুই নেই, লাঠি দিয়ে কি হানাদার দৌড়া সম্ভব নাকি? ক্যাম্পে আছে শুধু দুটা রাইফেল। অস্ত্র ছাড়া যুদ্ধ করতে গিয়ে গত ক’দিন আগে নান্টু, মনজু ও নোমানকে হারিয়েছি। এটা অসম্ভব!
মতিন বলল, সম্ভব না। হানাদার ক্যাম্পে এত আধুনিক আর ভারি অস্ত্র রয়েছে- আমাদের মতো ক্যাম্প ক’টা উড়িয়ে দিতে দু’এক মিনিট সময় লাগবে।
কাজল বলল, ঠিক।
ক্যাম্পে সবচেয়ে কনিষ্ঠ যোদ্ধা শফিক। বয়স কম। তবে ভালো বুদ্ধি রাখতে পারে। কৌশল বুঝে। সে এসে কমান্ডার মতিনকে ফিশ ফিশ করে বললেন, অহল্যা আমাদের সাথে যুদ্ধে যেতে চায়।
-অহল্যা কে?
-চা-বাগানের পাশে ছোট্ট একটা গ্রাম রয়েছে। মাত্র দু’চার ঘর। অহল্যা ঐ গ্রামের মেয়ে।
ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে মতিন বলল, নারী?
-হ স্যার।
-কিন্তু কেন?
-পুরোপুরি জানি না। তবে আমাকে খুব আগ্রহ করে যুদ্ধে যাবার জন্য ভাব প্রকাশ করেছে। অনেক বার মনের কথাগুলো প্রকাশ করতে চেয়েছিল, কিন্তু নানা কারণে হয়নি।
-তাকে এখানে নিয়ে আসতে পারবে?
-পারব স্যার।
কমান্ডার মতিন সাহেবের কানে ফিশ ফিশ করে আবারও শফিক বললেন, স্যার, অহল্যাকে আমাদের বড়ই প্রয়োজন। হানাদার বাহিনীর গোপন তথ্য সব তার কাছে জানা।
-তাই?
-হ-স্যার।
গভীর রাত।
আকাশে চাঁদের আলো নেই। ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাকে কানে ঝালাফালা। তবে জোনাকী পোকাগুলো তারার মতো ঝলমল ঝলমল করছে। এত অন্ধকার যে- নিজের হাত দুটি নিজেই দেখার মতো নয়।
অহল্যার যুদ্ধ যাবার নেশা। যুদ্ধ করবে, প্রতিশোধ নিবে। দেশ জয় করবে। সেই প্রত্যাশা নিয়ে এমন আঁধারে ঘর ছেড়েছে। ফেলে এসেছে বুকের মাসুম বাচ্চাটি। যাবার সময় চোখে জল আসলেও ফিরে নিয়েছে নিজেকে।
-শফিক! -থর থর করে কাঁপছে অহল্যা।
-হুঁ!
-আমার হাত ধর। আমার বুকটা খুব কাঁপছে।
-কেন?
-আমার বুকের মাসুম বাচ্চাটির জন্য।
ক্যাম্পে উঠে আসতে আসতে তখন শেষ রাত। দূরে কোথাও মোরগের ডাক শোনা যাচ্ছে। আগে কোন এক সময় আযানের ডাক শোনা যেত, যুদ্ধ বাধার পর থেকে এই গ্রামে আর শোনা যায়নি।
অহল্যা বেঞ্চিতে বসে আছে। কমান্ডার মতিন আর সহযোদ্ধা কাজল এসে জিজ্ঞেসা করল, তোমার স্বামীর নাম কি?
-রসিদ। সে এখন পাকিস্তানের পক্ষ হয়ে যুদ্ধ করছে।
হতভম্ব হয়ে যায় কমান্ডার মতিন। -বল কি?
-সত্যি বলছি স্যার। সে এখন ফেনী অঞ্চলের কোন এক হানাদার ক্যাম্পে আছে।
-তোমার সাথে যোগাযোগ নেই?
-না। মত পার্থক্যে সংসার ভেঙে গেছে। আমি বাংলাদেশের পক্ষে। ‘ও’ মানতে পারেনি। শেষে সেই আমাকে ফেলে চলে গেছে। তার একটি ছোট্ট বাচ্চা আছে।
-বাচ্চাটি কোথায়?
-আমার মায়ের হাতে দিয়ে এসেছি।
-যুদ্ধে যেতে চাও কেন?
-অত্যাচার আর সহ্য করতে পারছি না। পাক-হানাদার বাহিনীরা প্রতিদিন অত্যাচার করে।
কাজল চেয়ার ছেড়ে দাঁড়ায়। -বল কি?
সত্যি বলছি। তারা শর্ত দিয়েছে প্রতিদিন আমাকে তাদের ক্যাম্পে যেতে হবে। না হয় ধরে নিয়ে যায়। সারা শরীরে পাতিলের কাল কালি মেখেও ঘরে থাকতে পারি না। তারা আমার উপর ইচ্ছে মত যৌবনের তৃপ্তি মেটায়।
বাকি কথাগুলো বলতে পারেনি অহল্যা। চোখ দিয়ে বৃষ্টির মতো জল এসে ভরে গেছে। কাঁদছে অজোড়ে। কান্নার স্বরে বললেন, আর পারছি না। আমার হাতে অস্ত্র দাও, আমি যুদ্ধ করব।
মতিন বলল, কোনো চিন্তা কর না। তোমাকে আমরা ট্রেনিং দেব। তারপর যুদ্ধ করতে যাবে।
অহল্যার মন একটু শান্ত হয়েছে। কমান্ডার মতিনের কাছে গিয়ে বললেন, হানাদার বাহিনীর বিশাল একটা অস্ত্রের গোডাউন আমি দেখেছি। ও’টা ডাকাতি করতে পারলে অনেক অস্ত্র আমাদের হাতে এসে যাবে।
-কোথায় এটা?
-হানাদার ক্যাম্পের পশ্চিমে বিশাল একটা পাহাড়, তার ঢালুতে ছোট্ট একটা গর্ত। উপরি ভাগে নিথর হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সেগুন, কড়াইসহ নানা গাছ। চারিদিক ঘন অরণ্য। লতা-পাতা, ঝোপ-ঝাপে ভরা। ওখানে গেলেই ভয় ভয় লাগে। গর্তের মুখ চেনার মতো উপায় নেই। লতা-পাতায় ভরা। তার ভেতরে বিরাট একটা গুহায় পাক বাহিনীর বিপুল অস্ত্রের ভান্ডার। একবার লুট করতে পারলে আর আমাদের অস্ত্রের অভাব থাকবে না।
কাজল বলল, কাজটা কি তত সহজ?
-আমি পারব। গর্তের মুখের অনতি দূরে দু’জন পাক-সেনাবাহিনীর গার্ড থাকে। তাদের আমি ধরে রাখব।
-তুমি কি পারবে? নাকি জীবন দিতে হবে?
-জীবনের ঝুঁকি না নিলে বিজয় আসবে না স্যার, আমার উপর একবার ভরসা রাখুন।
-ঠিক আছে, দেখা যাক।
তখন পরন্ত বিকেল। সবুজ বনানীর ওপর দিয়ে বয়ে বয়ে বেড়াচ্ছে পিন-পিনে বাতাস। মুহূর্তটা ভালোই। গোলা-বারুদের গন্ধ্যে পাখিরা বন ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিল। মাঝে মধ্যে দু’একটার ডাক শোনা যায়।
অহল্যা অপূর্ব সুন্দরের মাঝেও নিজেকে আবার সাজিয়ে নিয়েছে। কমান্ডার মতিনকে বললেন, আমি আগেবাগে যাত্রা করছি। আঁধার নেমে আসার সাথে সাথে আপনারা রওনা দিবেন।
-আমরা বুঝব কি করে?
-আমি পথে পথে সংকেত রেখে যাব।
কথাগুলো বলে বনের ভেতরে অহল্যা প্রবেশ করেছে। আর আঁকানো ছকের মাঝে অপেক্ষা করছিল মুক্তিযোদ্ধার একটি দল। আঁধার বয়ে আসলে রওনা হবে।
অন্ধকার ঘনিয়ে আসার পর পর যোদ্ধারা তাদের অপারেশন সাকসেস করে ফেলেছে। অহল্যা সফল।

দুই.
মুক্তিযোদ্ধারা একের পর এক হানাদার ক্যাম্প উড়িয়ে দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। এর পেছনে বড় ভূমিকা অহল্যার। তাই হানাদার বাহিনীরা হন্য হয়ে খুঁজতেছে অহল্যাকে। পেলে টুকরো টুকরো করে ভাগ বসাবে।
এদিকে অহল্যা চ্যালেঞ্জ জুড়িয়ে দিয়েছে। তার সাথে কোনো শত্রæ মোকাবিলা করা সম্ভব নয়। বীরের মতো ছুটছে অহল্যা।
শফিকের ডাকে ফিরে তাকায় অহল্যা। তখন বেলা শেষ। রাতে আরো একটা অপারেশন আছে, রাইফেলের স্টিকারে তেল-মুবিল দিচ্ছে। -কি-রে শফিক! কিছু বলবি নাকি?
দীর্ঘশ্বাস ফেলে শফিক বলল, এখন কি আর তোর সাথে পারি?
পিক করে হাসি দিয়ে অহল্যা বলে, এমন করে বলিস কেন? এভাবে বলিস না-রে! তোকে বড় ভালোবাসি!
-দুত্তরী তোর ভালোবাসা!
অহল্যা রাইফেলের স্টিকারে তেল-মুবিল দেওয়া বন্ধ করে মলিন স্বরে বলে, তোকে বড় ভালোবাসি। কিন্তু এখন নেশা পেয়েছে দেশ জয় করার। এটা-তো অনেক বড় ভালোবাসা। দেশকে বড় ভালোবাসি, তোকেও…
এর মধ্যে মুক্তিসেনারা এগিয়ে চলেছে। বহু আগে চা-বাগানের হানাদার বাহিনীর শক্ত ঘাঁটি উড়িয়ে দিয়েছে। এখন কিছু মাত্র হানাদার বাহিনীর সদস্যরা ওৎ পেতে আছে জঙ্গলের ভেতরে। কমান্ডার মতিন বলল, অহল্যা, তোমাকে খুব সাবধানে থাকতে হবে।
-ভয় করি না স্যার। প্রথম প্রথম ভয় পেতাম। মাঝে মাঝে লাশ দেখে কেঁদেও ফেলতাম। আস্তে আস্তে সব ঠিক হয়ে গেছে। এখন হানাদার বাহিনীদের গুলি করতে হাত কাঁপে না বরং আনন্দ বোধ করি।
অবাক হয়ে গেছে মতিন সাহেব। -তোমার তুলনা হয় না। আর ক’জন যদি তোমার মতো এই বাংলায় থাকত…
কাজল বলল, বহু আগে এই দেশ স্বাধীন হয়ে যেত। এত লম্বা সময় নিতে হতো না।
ক্যাম্পে সর্বশেষ একটা বার্তা আসল। বার্তাটা পাঠ পূর্বক আগের মতো কেউ আর আতঙ্কে উঠেনি। বরং মুহূর্তে মুক্তিযোদ্ধারা প্রস্তুত। মতিন বলল, পাকিস্তানি মিলিটারি পালিয়ে গেছে। ফেনীতে গত রাত তুমুল যুদ্ধ চলেছে। কিছু পাক সেনা পালিয়ে আমাদের সীমানায় প্রবেশ করেছে।
কাজল বলল, ওদের তাড়াতে হবে। বসে থাকার সময় নেই। মনে হয় এবারই আমাদের সর্বশেষ যুদ্ধ।
অহল্যা টান টান চোখে তাকায়। -আমরা কি বিজয় আশা করতে পারি?
কমান্ডার মতিন পিক করে হাসি দিয়ে বলে, হয়তো।

তিন.
উত্তর ফটিকছড়ির ভারতের সীমান্তবর্তী এলাকা। পশ্চিমে ফেনী। মাঝখানে গভীর জঙ্গল। ওখানে অপারেশন চলবে। মুক্তিযোদ্ধারা চা-বাগান পেরিয়ে ওখানে পৌঁছে গেছে। কমান্ডার বলল, গভীর রাতে যুদ্ধ হবে।
-সারারাত কি জঙ্গলে অবস্থান করব?
-হ।
-অহল্যা না গেলে হয় না? শফিকের দাবি।
শফিকের দরদ দেখে কাজল বলল, কি-রে? অহল্যার জন্য তোর দেখি অনেক দরদ!
-অহল্যার একটা মাসুম বাচ্চা আছে। তাকে ফেলে এত দূরে যাওয়াটা ঠিক হবে না। এটা বড় অপারেশন নয়। ছোট্টখাটো। আমরা সামাল দিতে পারব।
প্রথমে অহল্যা যাবার জন্য প্রস্তুতি নিয়েছিল। পরে মতিনের বাধা পেয়ে আর যায়নি। অহল্যা বলল, আজ আমি মাসুম বাচ্চাটি নিয়ে আমার মায়ের কাছেই থাকব। ওরা অপেক্ষা করছে শুধু আমার জন্য।
-তোমার ইচ্ছে। যেটা ভালো মনে কর।
অহল্যা তার মায়ের কাছে ফিরে গেছে। বহুদিন মা-ছেলে এক সাথে থাকা হয়নি, মাসুম বাচ্চাটিও তার মায়ের আদর পায়নি। -আহা! আজ কি মজা!
মুক্তিসেনারা সীমান্ত এলাকায় পৌঁছে গেছে। তখন সূর্য পশ্চিমের আকাশে শেষবারের মতো আকুতি-মিনতি করছে। ভারতীয় সেনাপ্রধান সীমানার কাছে মহড়া দিচ্ছে।
মতিনকে কাছে পেয়ে সেনাপ্রধান শোভন লাল জিজ্ঞেস করিল, বীরাঙ্গনা কোথায়? সে আসেনি?
চাপা উত্তেজনা নিয়ে জিজ্ঞেস করিল, বীরাঙ্গনা কে?
-কেন? অহল্যা!
-আশ্চর্য-তো!
সেনাপ্রধান শোভন লাল নিচুস্বরে বলিলেন, মুক্তিযোদ্ধা, বীরাঙ্গনা ও তার সহযোগীদের তালিকা তৈরি করে যাচ্ছে ভারত সরকার। তৎমধ্যে বীরাঙ্গনা তালিকায় অহল্যার নাম প্রথমে উঠে এসেছে।
-বলেন কি স্যার? হৃষ্টচিত্তে জিজ্ঞেস করল কমান্ডার মতিন।
-হ। তাও আবার প্রথম সারিতে।
সারারাত যুদ্ধ চলেছে। যে ক’জন পাক-মিলিটারি সেনা ছিল সবাই আত্মসমúর্ণ করেছে। কেউ পালাতে পারেনি, তবে বেশ ক’জন হানাদার গুলি খেয়ে মারা গেছে। আহত ক’জনকে ক্যাম্পে নিয়ে এসে চিকিৎসা করছে।
ভোর হবার আগে যুদ্ধ শেষ হয়ে গেছে। বুঝা গেল কি- চট্টগ্রাম রাজাকার মুক্ত হয়ে এসেছে। আর কোন পাক-হানাদার নেই। কাজল আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল, ভোর হয়ে আসছে, অন্ধকার কোথায় যেন বিলীন হয়ে যাচ্ছে।
শফিক সবুজ ঘাসে বসেছিল। ঘাস কুঁয়াশায় ভেজা। ঠাণ্ডা লাগছে। হঠাৎ সে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠেছে। মতিন দ্রুত ছুটে গেছে। -কি-রে শফিক? কাঁদছিস কেন? কোথাও আঘাত লেগেছে?
-অজানা একটি কষ্ট আমার অন্তরে লেগেছে। মনে হলো- আমার কেউ একজন মরে গেছে।
মতিন চেঁচিয়ে বলল, তুই সব সময় আবোল-তাবোল ভাবিস। বেশি ভাবনা ভালো না।
শফিক চোখ মুছে নিয়ে ভোর হবার জন্য অপেক্ষা করছে। আকাশ পরিষ্কার হলে জিপটা ছেড়ে যাবে। সব যোদ্ধারা গাড়িতে ওঠে বসেছে, নানা গল্প গুজবে মেতেছে।
ভোর হবার আগে জিপটা ছেড়ে গেছে। কমান্ডার মতিন বলল, আমার মনে হয়- চট্টগ্রাম আর ফেনী এখন হানাদার মুক্ত।
কাজল বলল, আমার মনও তাই বলছে।
নূর হোসেনের মুখে এক খণ্ড আফসোসের আভা লেগে আছে। ভাবনা মিশ্রিত কণ্ঠে সে বলিল, সন্দেহজনক। আমার মনে হয় না।
গাড়ি চলছে। বন-জঙ্গলের ঝোপ-ঝাপে অন্ধকার কোথাও ঘন আবার কোথাও পরিষ্কার। যেখানে পরিষ্কার ওখানে আকাশটা স্পষ্ট দেখার মতো। তার গায়ে সারা রাত তারা ঝলমল ঝলমল করেছিল। শেষ রাতে মাসের শেষ তারিখের চাঁদটা আবারো একবার উঁকি মেরেছিল। দিবসের আগমন ঘটতে দেখে চাঁদ-তারা উভয়ে লুকিয়ে গেছে। আকাশে তারাও নেই, চাঁদটাও আর নেই।
ক্যাম্পে প্রবেশের আগে অহল্যার মৃত্যুর সংবাদ পেয়ে গেছে। রাতের অন্ধকারে অহল্যার স্বামী রসিদ এসে মা মেয়ে দুজনকে হত্যা করেছে।
কমান্ডার মতিন ড্রাইভারকে বলল, গাড়ি ঘুরাও। চা-বাগানের দিকে চালাও।
শফিক কাঁদছে। সে চোখের জল ধরে রাখতে পারছে না। চারিদিক আলো ছড়িয়ে পড়েছে। যার ফলে গাড়ির ভেতরে আলো। সেই আলোতে জল স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। শফিকের চোখের জল সবার মন কাতর করে যাচ্ছে। একজন যোদ্ধা বলল, যোদ্ধার চোখে জল মানায় না, যোদ্ধার ভালোবাসা হলো ঘাত-প্রতিঘাত।
কমান্ডার মতিন ফিরে তাকিয়েছে তার দিকে। বলল- তোমাকেই যোদ্ধা বলে!

চার.
খোলা আকাশ। চারিদিক সবুজ বনানী। ছোট্ট একটি মাঠ, মাঠের পুরাটাই সবুজ ঘাস। ঊষার দুয়ার খুলেছে, চাদরের ন্যায় সেই আলো বিছিয়েছে সবুজের মাঠে। বিচ্ছিন্ন জনবসতি, কোথাও নিবিড় গাছপালা, মাঝখানে শূন্য ভূমি। সবকিছু মিলে বীরহের মাঝে আলাদা একটা বীরহের সৃষ্টি করেছে। যা শিল্পীর তুলিতেও ধরা পরার মতো নয়।
মাঠের মাঝখানে নিথর হয়ে শুয়ে আছে দুটি লাশ। বীরাঙ্গনা অহল্যা ও তার মাসুম বাচ্চাটি। ঘাতকের বুলেটে ঝালাফালা করেছে তাদের বুক। গ্রামবাসীরা হতদরিদ্রতার মাঝেও এক টুকরো সাদা কাপড় দিয়ে ঢেকে দিয়েছে। মুখ দেখা যাচ্ছে।
শফিক হাউ-মাউ করে কেঁদে উঠেছে। তার কান্নায় আকাশ ভারি হয়ে যাচ্ছে। কমান্ডার মতিন পকেট থেকে রুমাল বের করে বারবার চোখ মুছে নিচ্ছে। নূর হোসেনের অশ্রæ জল মাঠে ঝড়ছে।
নির্বাক হয়ে আছে সকল যোদ্ধা। অহল্যা ও তার মাসুম বাচ্চাটির চোখ খোলা। খোলা চোখে তাকিয়ে আছে আকাশ। শফিক তার পাশে বসে গেছে। কাঁদছে অজোড়ে।
খুব শক্ত মনের যোদ্ধা ছিল কমান্ডার মতিন। কিন্তু লাশ দেখে তিনিও আঁখির জলে ভেসে গেছে। চোখ মুছে নিতে নিতে আবেগে বিভোর হয়ে বলে- অহল্যা, তুমি উঠে বসনা! উপমহাদেশ থেকে একমাত্র তোমার নামটি বীরাঙ্গনার তালিকায় এসেছে। পুরস্কারটি তোমার জন্য। তুমি নিবে না? প্লিজ, তুমি উঠে এসো…
ক্যাপ্টেন জামিল সাহেব এসে গেছে। হেলিকপ্টার যোগে ঢাকা থেকে। লাশ দেখতে দেখতে তিনি স্বাভাবিক হয়ে গেছে, ততমধ্যে অহল্যা ও আর মাসুম বাচ্চাটিকে দেখে তিনিও বারে বারে চোখ মুছে নিচ্ছে।
লাশের চোখ খোলা। জামিল সাহেব বললেন- চোখ বন্ধ করে দাও।
কমান্ডার মতিন সাহেব হাত বাড়িয়েছে। চোখগুলো বন্ধ করে দেয়ার জন্য। তার হাত কাঁপছে। খুব। কিছুতেই পারা হয়ে উঠছে না।
চোখগুলো বন্ধ করতে পারেনি যোদ্ধা। থেমে গেছে। চোখগুলো দেখে মনে হচ্ছে- বহুকাল আগেই তাদের চোখের ভেতরে জন্মেছিল নতুন একটি আশা।
এক খণ্ড বিশাল মেঘ এসে ঊষার দুয়ারে থেমেছে। আলো আর চোখে পড়ছে না। লাশের ওপর ছায়া পড়েছে। একটু একটু বাতাস বইছে। সেই বাতাসে নাড়া দিচ্ছে কাফনের কাপড়, নাড়া দিচ্ছে কপালে ঠেকানো চুলগুলো। মনে হচ্ছে- ওরা একটু পরে জেগে উঠবে।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়