আইনমন্ত্রী : মানবাধিকারের উন্নতি হওয়ায় র‌্যাব নতুন নিষেধাজ্ঞায় পড়েনি

আগের সংবাদ

পাহাড়ে সন্ত্রাসী-জঙ্গি একাকার : স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসীগোষ্ঠীর যোগসাজস, দুর্গম হওয়ায় অভিযান চালানো কঠিন

পরের সংবাদ

স্মরণ : আ হ্যাঙ্গিং

প্রকাশিত: জানুয়ারি ২০, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জানুয়ারি ২০, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

মূল : জর্জ অরওয়েল
অনুবাদ : মধুসূদন মিহির চক্রবর্তী

বার্মায় বৃষ্টিভেজা একটি স্যাঁতসেঁতে সকাল। হলুদ রাংতা কাগজের মতো ফ্যাকাশে এক তির্যক আলো জেলখানার উঁচু প্রাচীরে এসে পড়েছে। আমরা মৃত্যুদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত কয়েদিদের কারাকক্ষগুলোর বাইরে অপেক্ষা করছি। সামনের দিকে দ্বিগুণ গরাদ দেয়া ছোট পশুর খোয়াড়ের মতো এক সারি ছাউনি। ১০ বর্গফুট আয়তনের প্রতিটি কারাকক্ষে একটি তক্তপোশ এবং জলপানের পাত্রই একমাত্র সম্বল। সেলগুলোর কয়েকটিতে কতিপয় পিঙ্গল-বর্ণ নির্বাক পুরুষ গরাদের ভেতরের দিকে কম্বল মুড়ি দিয়ে উবু হয়ে বসে আছে। বিচারে দোষী সাব্যস্ত এই লোকদের আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে ফাঁসি দেওয়া হবে।
এক কয়েদিকে তার সেল থেকে বের করে আনা হয়েছে। লোকটি ন্যাড়ামাথা, খুবই দুর্বল ও ক্ষুদ্রাকৃতির এক হিন্দু পুরুষ। আবছা ধরনের শীতল চাউনির লোকটির শরীরের তুলনায় অযৌক্তিকভাবে ফুলে ওঠা বেশ বড়সড় একটি পুরুষ্টু গোঁফ ছিল। গোঁফটি বরং সিনেমার কোনো কৌতুক অভিনেতার মতোই ছিল। দীর্ঘদেহী ছয়জন ভারতীয় কারারক্ষী তাকে পাহারা দিচ্ছিল। তারা তাকে ফাঁসির মঞ্চের জন্য প্রস্তুত করছে। এদের মধ্যে দুজন প্রহরী বেয়নেটযুক্ত রাইফেল নিয়ে দাঁড়িয়ে। অন্যরা তাকে হাতকড়া পরিয়ে দিল। তার হাতকড়ার মধ্য দিয়ে পেঁচিয়ে একটি করে শিকল প্রহরীদের কোমরবন্ধে লাগানো হলো। কয়েদির বাহু দুটো পিঠমোড়া দিয়ে শক্ত করে বাঁধা ছিল। প্রহরীরা তার খুব কাছাকাছি ঘেঁষে সবসময় যতœশীল, স্নেহপূর্ণভাবে তাকে আঁকড়ে ধরেছে। যেন সব সময় তার উপস্থিতি অনুভব করতে পারে। এ যেন মানুষের মুঠোয় থাকা একটি মাছ, যেটা এখনো জীবিত এবং জলে ঝাঁপ দিতেও সক্ষম। কিন্তু কোনো রকমের প্রতিরোধ না করে লোকটি দড়ির কাছে তার দুর্বল বাহু দুটোকে সমর্পণ করে দাঁড়িয়ে আছে। কী ঘটতে চলেছে তিনি যেন তা বুঝতেই পারছিলেন না।
ঘড়িতে ৮টা বাজল, তখনি ভেজা বাতাসকে ভর করে দূরের ব্যারাক থেকে ভেসে এলো বিউগলের হালকা করুণ এক সুর। আমাদের সবার থেকে কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে জেল সুপারিনটেন্ডেন্ট অস্থির চিত্তে লাঠি দিয়ে কাঁকর মাটি খোঁচাচ্ছেন। বিউগলের শব্দে তিনি মাথা তুললেন। ধূসর টুথব্রাশের ন্যায় গোঁফধারী এবং কর্কশ কণ্ঠস্বরের লোকটি ছিলেন সেনাবাহিনীর একজন ডাক্তার। বিরক্তির সুরে তিনি বলে উঠলেন, “ঈশ্বরের দোহাই লাগে, তাড়াতাড়ি করো ফ্রান্সিস। লোকটির এতক্ষণে মারা যাওয়া উচিত ছিল। তুমি এখনো প্রস্তুত হওনি?’
সাদা ড্রিল স্যুট এবং সোনালি চশমা পরিহিত প্রধান কারাধ্যক্ষ দক্ষিণ ভারতীয় ফ্রান্সিস তার কালো হাতটি নাড়লেন। তিনি খুশিতে টগবগিয়ে উঠে বললেন, ‘আজ্ঞে হ্যাঁ স্যার, হ্যাঁ স্যার, সবকিছুই সন্তোষজনকভাবে প্রস্তুত হইছে। জল্লাদ অপেক্ষা করতেছে। আমরা এগিয়ে যাইতে পারি।’
‘আচ্ছা, জলদি মার্চ করো তাহলে। এই কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত কয়েদিরা তাদের সকালের জলখাবার খেতে পারবে না।’
আমরা ফাঁসির মঞ্চের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। রাইফেল কাঁধে দুজন কারাপ্রহরী কয়েদির দুপাশ বরাবর এগিয়ে চলল। আরও দুজন প্রহরী তার হাত এবং কাঁধ শক্ত করে আঁকড়ে ধরে গা ঘেঁষে এগিয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছিল তারা যেন যুগপৎভাবে তার শরীরটাকে আলতো ধাক্কা দিয়ে বয়ে নিয়ে যাচ্ছে। অবশিষ্ট আমরা অর্থাৎ ম্যাজিস্ট্রেট এবং সমমর্যাদার কর্মকর্তারা তাদের অনুসরণ করে এগিয়ে গেলাম। আমরা ১০ গজের মতো এগিয়ে যাওয়ার পর বিনা নির্দেশে বা কোনো সতর্ক সংকেত ছাড়াই শোভাযাত্রাটি থেমে গেল। একটি ভয়ানক কাণ্ড ঘটে গেল। কোত্থেকে কীভাবে জানি না, সংরক্ষিত স্থানটিতে হঠাৎ এসে একটি কুকুর উদয় হলো। কুকুরটি লাফ দিয়ে আমাদের মাঝখানে এসে পড়ল এবং তীব্র স্বরে ঘেউঘেউ শুরু করল। এতগুলো মানুষকে একসঙ্গে দেখে বন্য আনন্দে আমাদের চারপাশে লাফিয়ে লাফিয়ে তার সমস্ত শরীরটাকে ঝাঁকাতে লাগল। বিশাল আকারের একটি আধা টেরিয়ার দো-আঁশলা পশমী কুকুর। এক মুহূর্তের জন্য এটি সামনের দুই পা তুলে আমাদের চারপাশে উদ্ধতভাবে লাফাল। এরপর কেউ থামানোর আগেই কুকুরটি দ্রুতগতিতে কয়েদির কাছে পৌঁছে গিয়ে লাফ দিয়ে তার গাল চাটতে চেষ্টা করল। সবাই চমকে গিয়ে থ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল, এমনকি কুকুরটিকে পাকড়াও করতেও ভুলে গেল।
‘এই জঘন্য কুত্তাটাকে এখানে কে ঢুকতে দিয়েছে? কেউ একজন এটাকে আটকাও!’- ক্রুদ্ধস্বরে হাঁক ছাড়লেন জেল সুপারিন্টেন্ডেন্ট।
রক্ষীদল থেকে বিচ্ছিন্ন জনৈক কারাপ্রহরী কুকুরটির ওপর কদাকারভাবে চড়াও হলো। কিন্তু কুকুরটি সবকিছুকে খেলার অংশ হিসেবে নিয়ে নাগালের বাইরে গিয়ে তিড়িংবিড়িং নৃত্য আরম্ভ করল। এক তরুণ ইউরেশীয় কারারক্ষক এক মুঠো কাঁকর তুলে কুকুরটিকে পাথর ছুড়ে মারার চেষ্টা করল, কিন্তু এটা পাথরগুলোকে পাশ কাটিয়ে আবার আমাদের পিছু নিল। কুকুরটির অবিরত চিৎকার কারাগারের মধ্যে হাহাকারের মতো প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল। প্রহরীদ্বয়ের মুঠোয় থাকা কয়েদি নিরাসক্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে যেন এটি মৃত্যুদণ্ডেরই অন্য কোনো আনুষ্ঠানিকতা। কয়েক মিনিটের মধ্যে কেউ একজন কুকুরটিকে আটকাতে সক্ষম হয়। তারপরে আমার রুমাল তার গলা বন্ধনীতে বেঁধে চাপাস্বরে কাতরাতে থাকা কুকুরটিকে নিয়ে আরও একবার সরে গেলাম।
ফাঁসির মঞ্চ তখনো প্রায় ৪০ গজ দূরে। আমি কয়েদির নগ্ন বাদামি পিঠটি আমার সামনে দিয়ে এগিয়ে যেতে দেখলাম। তিনি তার হাত বাঁধা অবস্থায় অপটু অথচ বেশ দৃঢ় পদক্ষেপে হেঁটে চলেছেন। সেইসব ভারতীয়ের মতো নতজানু হয়ে যারা কখনই হাঁটু সোজা করে না। প্রতিটি পদক্ষেপে তার পেশিগুলো সুন্দরভাবে টানটান হয়ে উঠছিল। তার মাথার টিকির গিট্টুটি উপরে নিচে দুলতে থাকল। তার পা দুটো ভেজা নুড়িতে ছাপ তৈরি করে এগিয়ে চলল। প্রহরীরা কাঁধ আঁকড়ে ধরে থাকা সত্ত্বেও তিনি পথে একটি জলাবদ্ধ ডোবা এড়াতে কিছুটা দূরে সরে গিয়েছিলেন।
অদ্ভুত বিষয়! অথচ সেই মুহূর্তের আগ পর্যন্ত আমি বুঝতাম না যে একজন সুস্থ, সচেতন মানুষকে শেষ করে দেয়ার কি মানে হতে পারে! কয়েদিকে জলাবদ্ধ গর্ত এড়িয়ে একপাশে সরে যেতে দেখেই অনুধাবন করলাম গোপন রহস্যটি। জানতে পারলাম তাজা একটি জীবনকে শেষ করে দেয়ার অবর্ণনীয় অবিচারের বিষয়টি। মানুষটির মরার বয়স হয়নি। তিনি আমাদের মতোই প্রাণবন্ত ছিলেন। তার শরীরের সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কাজ করছিল- অন্ত্রগুলো খাদ্য পরিপাক করছিল, ত্বক নতুন করে তৈরি হচ্ছিল, নখ গজাচ্ছিল, শরীরে নতুন কোষ তৈরি হচ্ছিল। তাবৎ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ অহেতুক পরিশ্রম করে যাচ্ছিল। যখন তিনি পাটাতনের ওপর থেকে সেকেন্ডের এক-দশমাংশ সময়ে শূন্যে ঝুলে পড়লেন, তার নখ তখনো বেড়ে চলেছিল। হলুদ কাঁকর এবং ধূসর দেয়াল দেখার স্মৃতি তার মস্তিষ্ক তখনো মনে রেখেছে, পূর্বাভাস দিয়েছে, যুক্তি দিয়েছে- এমনকি জলাবদ্ধ গর্ত সম্পর্কেও সতর্ক করেছে। তিনিসহ আমরা সমভিব্যহারে ছিলাম। একসঙ্গে চলাফেরা, দেখা, শ্রবণ, অনুভব, একই জগতকে বোঝা। অথচ মিনিট দুইয়ের ব্যবধানে হঠাৎ টুপ করে আমাদের মধ্য থেকে একজন চলে যাবে- মনহীন, পৃথিবীহীন হয়ে যাবে।
ফাঁসির মঞ্চটি ছিল কারাগারের মূল মাঠ থেকে আলাদা একটি ছোট উঠানের ওপারে। স্থানটি কাঁটাযুক্ত লম্বা আগাছায় পরিপূর্ণ। একটি চালার নিচে, তিন দিকে খাড়া ইটের গাঁথুনির ওপর পাটাতন আচ্ছাদিত ছিল ফাঁসির মঞ্চটি। পাটাতনের উপরে দুটি আনুলম্বিক কড়িকাঠকে সংযোগকারী একটি খুঁটিতে ফাঁসির রজ্জুটি দুলছিল। জেলের সাদা পোশাকধারী পক্ককেশ দণ্ডিত আসামি জল্লাদ তার যন্ত্রের পাশে অপেক্ষা করছিল। আমরা প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গে সে আমাদেরকে অবনত মস্তকে অভ্যর্থনা জানাল। ফ্রান্সিসের একটি নির্দেশে দুজন কারারক্ষী কয়েদিকে আগের চেয়ে আরো ঘনিষ্ঠভাবে আঁকড়ে ধরল। কিছুটা টানতে টানতে এবং কিছুটা ঠেলতে ঠেলতে ফাঁসির মঞ্চের কাছে নিয়ে তাকে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে সাহায্য করল। এরপর জল্লাদ হাত উঁচিয়ে বন্দির গলায় দড়ি বেঁধে দিল।
পাঁচ গজ দূরে আমরা অপেক্ষা করছিলাম। কারারক্ষীরা ফাঁসির মঞ্চের চারপাশে একটি খসড়া বৃত্ত তৈরি করল। তারপর যখন ফাঁসির দড়িটার গেরো এঁটে দেয়া হলো, কয়েদি তার দেবতার উদ্দেশ্যে চিৎকার করতে লাগল। তিনি তখন একটি উচ্চকিত চিৎকারে ‘রাম! রাম! রাম! রাম!’- বলে প্রার্থনা বা সাহায্যের জন্য চিৎকার করছিলেন। আবেদনটি ছিল সংকটকালীন কিন্তু সেটি ভয়ঙ্কর নয়। চিৎকারটি ছিল অবিচল ছন্দময়, প্রায় ঘণ্টা ধ্বনির মতো। কুকুরটি ঘেউ ঘেউ শব্দে তার উত্তর দিল। ফাঁসির মঞ্চে দায়িত্বরত জল্লাদ ময়দার থলের মতো একটি ছোট সুতিকাপড়ের ব্যাগ এনে বন্দির মাথাটি ঢেকে দিল। সেই কাপড়টি ভেদ করে বিরামহীন আর্তনাদ তবুও বহাল রইল- ‘রাম! রাম! রাম! রাম! রাম! রাম!’
জল্লাদ ফাঁসির মঞ্চের উত্তোলক দণ্ডটির কাছে এসে প্রস্তুত হয়ে দাঁড়াল। মনে হয় মিনিটখানেক কেটে গেল। কয়েদির কাছ থেকে স্থির, একাগ্র চিৎকার ভেসে আসছে, ‘রাম! রাম! রাম!’ এক মুহূর্তের জন্যও কখনো ছন্দপতন হলো না। জেল সুপারিনটেনডেন্ট তার বুকে থুতনি গুঁজে দাঁড়িয়ে নিবিষ্টমনে লাঠি দিয়ে মন্থরগতিতে মাটি খোঁচাচ্ছিলেন। সম্ভবত তিনি কয়েদির চিৎকার গুনছিলেন, একটি নির্দিষ্ট সংখ্যা পর্যন্ত- ৫০ বার অথবা সম্ভবত ১০০ পর্যন্ত। সবারই মুখের রং পাল্টে গেছে। ভারতীয়রা বাজে কফির মতো ধূসর হয়ে গিয়েছিল, আর দু-একটা বেয়নেট দুলছিল। পাটাতনের ওপর দড়ি এঁটে বাঁধা, মাথায় যমটুপি পরানো লোকটির দিকে তাকিয়ে থেকে আমরা তার আর্তনাদ শুনলাম- প্রতিটি আর্তনাদই যেন জীবনের বাড়তি এক একটি সেকেন্ড! আমাদের সবার মনে একই ভাবনা ছিল : উফ্! মানুষটিকে তাড়াতাড়ি ঝুলিয়ে দাও, এর সমাপ্তি হোক, এই বীভৎস শব্দ থেমে যাক!
অকস্মাৎ সুপারিনটেনডেন্ট মনস্থির করে ফেললেন। মাথা উঁচু করে হাতের লাঠিটি দ্রুতগতিতে ঘোরালেন এবং কিছুটা তীব্রভাবে গর্জন করে উঠলেন, ‘চলো!’
একটা ঝনঝন আওয়াজ, তারপর শুনশান নীরবতা। কয়েদির অন্তর্ধান হলো এবং দড়িটি নিজেই মোচড় খাচ্ছিল। আমি কুকুরটিকে ছেড়ে দিলাম। এটি ছুটে ফাঁসির মঞ্চের পেছনে গেল কিন্তু সেখানে পৌঁছেই এটি দ্রুত থেমে গেল। ঘেউ ঘেউ শব্দ করে পিছু হটল। এরপর কুকুরটি চত্বরের এক কোণে আগাছার মধ্যে আগের জায়গায় দাঁড়িয়ে ভয়ে আমাদের পানে তাকিয়ে রইল। আমরা ফাঁসির মঞ্চে গিয়ে কয়েদির শবদেহ সযতেœ নিরীক্ষণ করলাম। আনতশির শবদেহটি তার পায়ের আঙ্গুলশুদ্ধ সোজা নিচের দিকে ঝুলছিল। পাথরসম মৃতদেহটি তখনো অতি মন্থরগতিতে ঘূর্ণায়মান।
সুপারিনটেনডেন্ট তার লাঠি হাতে অকুস্থলে পৌঁছে নগ্ন শবদেহের গায়ে খোঁচা দিলেন, এটা সামান্য একটু নড়ে উঠল। সুপারিনটেনডেন্ট বললেন, ‘সব ঠিক আছে’। একটি দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে তিনি ফাঁসির মঞ্চের নিচ থেকে সরে এলেন। তার মুখমণ্ডলের মেজাজী ভাবটি আচমকা তিরোহিত হলো। তিনি তার কব্জিতে বাঁধা ঘড়ির দিকে তাকালেন। ‘আটটা বেজে আট মিনিট। ঠিক আছে, আজকের সকালের জন্য এতটুকুই। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ!’
কারারক্ষীরা বেয়নেট খুলে ফেলে দূরে সরে গেল। কুকুরটি নিজের বাজে আচরণের বিষয়ে সচেতন হয়ে প্রশান্ত ভঙ্গিতে তাদের অনুসরণ করল। আমরা ফাঁসি চত্বর থেকে বেরিয়ে এলাম। দণ্ডাদেশ পাওয়া সেলগুলোতে অপেক্ষমাণ কয়েদিদের পার হয়ে কারাগারের বড় কেন্দ্রীয় চত্বরে চলে এলাম। লাঠি হাতে সজ্জিত কারারক্ষীদের অধীনে কয়েদিরা ইতোমধ্যে তাদের সকালের জলখাবার গ্রহণ করছিল। তারা প্রত্যেকে হাতে একটি করে টিনের থালা নিয়ে লম্বা সারিতে বসে আছে। তখন দুজন কারারক্ষী বালতিতে ভাত বয়ে নিয়ে হাতায় করে বিতরণ করতে করতে এগিয়ে যাচ্ছিল। ফাঁসি কার্যকর করার পরের এই দৃশ্যটি বেশ ঘরোয়া এবং আনন্দদায়ক বলে মনে হলো। কাজটি সম্পন্ন হওয়াতে আমাদের মনে একটি বিশাল স্বস্তি বয়ে আনল। কেউ কেউ গান গাইতে, দৌড় থেকে বিরতি নিতে চাপাহাসিতে প্রবৃত্ত হলো। আচমকা সবাই আনন্দে আগড়ম-বাগড়ম বকতে শুরু করে দিল।
ফিরে আসার সময় আমার পাশে পাশে হাঁটতে থাকা ইউরেশীয় তরুণটি মাথা নেড়ে তার সুপরিচিত হাসি দিয়ে বলল : ‘আপনি কি জানেন স্যার, (সে মৃত ব্যক্তির পানে ইঙ্গিত করল) আমাদের বন্ধুবর তার আপিল খারিজ হয়ে গেছে শুনেই ভীষণ আতঙ্কে সেলের মেঝেতে প্রস্রাব করে দিয়েছিল। অনুগ্রহ করে আমার একটা সিগারেট নিন স্যার। আপনি কি আমার নতুন কেনা রুপোর সিগারেট কেসটির প্রশংসা করবেন না স্যার? উৎকৃষ্ট ইউরোপীয় শৈলীতে নির্মিত সিগারেট কেসটি দুই টাকা আট আনা দিয়ে ভ্রাম্যমাণ ফেরিওয়ালা থেকে কিনেছি।’
আমাদের অনেকেই হেসে উঠল- কিন্তু কেন? বিষয়টি সম্পর্কে কাউকেই নিশ্চিত বলে মনে হচ্ছিল না।
সুপারিনটেনডেন্টের পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় ফ্রান্সিস বাচালের ন্যায় আঞ্চলিক সুরে বকবক করছিলেন। ‘আইচ্ছা স্যার, সবই অত্যন্ত সন্তোষজনকভাবে শেষ হইয়া গেছে। কম সময়েই ঝামেলা পার হইল। ভালোই হইল। এমনটা সব সময় হয় না- কী বলব! আমি এমনও কিছু ঘটনা জানি যে, ডাক্তার ফাঁসির মঞ্চের নিচে গিয়া বন্দির পা টাইন্যা ধইরা জান কবজ করতে বাধ্য হইছিল। কী জঘন্য ব্যাপার!’
সুপারিনটেনডেন্ট বললেন ‘বিষয়টি অস্বস্তিকর, তাই না? খুবই খারাপ।’
‘হ্যাঁ স্যার, যখন তারা অবাধ্য হয়ে ওঠে তখন আরো খারাপ হয়! একজন কয়েদির কথা আমার মনে আছে। আমরা যখন তাকে বের করে আনতে গিয়েছিলাম তখন সে শক্ত করে খাঁচার গরাদ আঁকড়ে ধরেছিল। আপনি হয়তো এটাকে ব্যর্থতা বলবেন স্যার, তাকে ছাড়িয়ে আনতে ছয়জন কারারক্ষীর প্রয়োজন হয়েছে। এদের মধ্যে তিনজন মিলে কয়েদির পা ধরে টানছিল। আমরা তাকে বোঝাতে চেষ্টা করেছিলাম। আমরা বললাম, ‘প্রিয় সাথী, আপনি আমাদের জন্য যেসব যন্ত্রণা এবং সমস্যার সৃষ্টি করছেন তা একটু ভেবে দেখুন!’ কিন্তু না, সে কিছুই শুনতে নারাজ! ‘উফ্! তার জন্য প্রাণান্তকর কষ্ট করতে হয়েছিল!’
লক্ষ্য করে দেখলাম আমি বেশ জোরে হাসছি। সবাই হাসছিল। এমনকি সুপারিনটেনডেন্টও সহনশীল ভঙ্গিতে হাসছিলেন। তিনি বেশ উদারভাবে বললেন,
‘তোমরা সবাই বাইরে এসে মদ্যপান করলে ভালো হবে, আমি গাড়িতে একটি হুইস্কির বোতল পেয়েছি। এখন আমরা এটার সদ্ব্যবহার করতে পারি।’
আমরা জেলখানার বড় জোড়াতোরণ পেরিয়ে রাস্তায় এলাম। ‘তার পা ধরে টানছে! -একজন বর্মী ম্যাজিস্ট্রেট হঠাৎ চিৎকার করে বললেন এবং ঠাট্টার অট্টহাসিতে ফেটে পড়লেন। আমরা সবাই আবার হাসতে শুরু করলাম। সেই মুহূর্তে ফ্রান্সিসের উপাখ্যানটি যারপরনাই মজার বলে মনে হয়েছিল। এরপর স্থানীয় এবং ইউরোপীয়রা একসঙ্গে আমরা সবাই বেশ সৌহার্দপূর্ণভাবে মদ্যপান করলাম। মৃত লোকটি একশ গজ দূরে পড়ে ছিল।

(১৯৩১ সালের আগস্ট মাসে দ্য অ্যাডেলফি পত্রিকায় প্রথম প্রকাশিত। ১৯৪৬ সালে ‘দ্য নিউ স্যাভয়’-এ পুনর্মুদ্রিত)

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়