আইনমন্ত্রী : মানবাধিকারের উন্নতি হওয়ায় র‌্যাব নতুন নিষেধাজ্ঞায় পড়েনি

আগের সংবাদ

পাহাড়ে সন্ত্রাসী-জঙ্গি একাকার : স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসীগোষ্ঠীর যোগসাজস, দুর্গম হওয়ায় অভিযান চালানো কঠিন

পরের সংবাদ

জ্যোৎস্নার জল

প্রকাশিত: জানুয়ারি ২০, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জানুয়ারি ২০, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

সন্ধ্যায় কারওয়ানবাজার বেশ জমজমাট হয়ে ওঠে। কাঁচাবাজার পেরিয়ে দু’পা এগুলে যাত্রীছাউনি। সকাল থেকে কম-বেশি যাত্রী অপেক্ষমাণ থাকলেও সন্ধ্যায় থাকে গার্মেন্টকর্মীদের দখলে। আর কেউ দাঁড়াতে পারে না। কারণ, তখন গার্মেন্টস কারখানা ছুটি হয়। তাও আবার বেশিক্ষণের জন্য নয়, গাড়ি এলেই মুহূর্তে হাওয়া।
যাত্রীছাউনি থেকে ১০ হাত দূরে একটু ঘন ছায়া। জমিদার বাড়ির দেয়াল টপকে আতা ফলের গাছ বাঁকা হয়ে পড়েছে। ফলে ওখানে বেশ অন্ধকার হয়ে আসে সন্ধ্যার সময়।
রাধা তার সহকর্মীদের চেঁচামেছি সহ্য করতে পারে না। নিজেকে সব সময় আলাদা রাখার চেষ্টা করে। তাই যাত্রীছাউনির নিচে দাঁড়ায়নি। দাঁড়াতে গেছে গাছটার নিচে। সহকর্মী কাজলী টান টান গলার স্বরে বলল- কিরে মাগী, অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আছিস ক্যান? কোনো খদ্দর আসবে নাকি?
বাক্যটা কিন্তু খুব বিশ্রী। শুনে গা জ্বলে উঠেছে, কিন্তু সেই আগুন দেখা যাচ্ছে না। মন খারাপ করে তবু দাঁড়িয়ে আছে রাধা। একটু পরে সজল আসবে গাড়ি নিয়ে। এটা তার অপেক্ষা।
মায়মুনা বেগম নাকি স্বরে সপক্ষ গাইতে থাকলো কাজলীর। বলল, মাগীটা সব সময় আলাদা থাকার চেষ্টা করে। এত অহংকার কীসের!
কাজলী শক্তি খুঁজে পেয়েছে। কোমড় থেকে বল তুলে বলল- এত অহংকার ভাব থাকলে গার্মেন্টস কারখানায় আসলি ক্যান? বনানী, গুলশানে বাসা নিয়ে রাজ-রানীর মতো হয়ে থাক।
রাধা কিছুই বলল না। না শোনার মতো ভান করে বিপরীত মুখে দাঁড়িয়ে রইল। অতিষ্ঠ হয়ে আপনা মনে বলে গেল, সজল এত দেরি করছে কেন? খুব অস্থির লাগছে।
গার্মেন্টসের গাড়ি এসে গেছে। পা পা করে সবাই গাড়িতে উঠে গেছে। যাত্রীছাউনি মুহূর্তে খালি। মধুবালা একবার ডাক দিল- কিরে রাধা, আমাদের সঙ্গে যাবি না?
-না। তোরা যা।
-কারো জন্য অপেক্ষা করছিস?
তিক্ত গলায় রাধা বলল- হ!
ঢাকা শহরে অন্ধকার ঘনিয়ে আসতে না আসতে কৃত্রিম আলো ছড়িয়ে পড়ে। ফলে আঁধারের সাম্রাজ্য খুব বেশি বিরাজ করতে পারে না।
যাত্রীছাউনির সামনে এসে কার ব্রেক করেছে সজল। কালো গøাসখানা খুলে আঙুলের ইশারায় ডাকে। -এসো রাধা।
অতিষ্ঠ হয়ে রাধা নিজে নিজে বলল, এত দেরি!
আঁধার পেরিয়ে রাধা আলোতে এসেছে। যদিও সস্তা দামের স্কার্ট তার গায়ে তারপরও অপূর্ব লাগছে। পথের পথিকের চোখ থেমে যায়।
সজলের মুখে বেনসন সিগারেট জ¦লছে। ধোঁয়া দেখা না গেলেও গন্ধ্য ম-ম করছে। মাঝে মাঝে আগুনের ফুলকি উঠানামা করতে দেখা যাচ্ছে।
রাধা গাড়িতে বসতে বসতে বলল- সিগারেট ফেলে দাও, না হয় আমি নেমে যাচ্ছি।
আগুনের ফুলকিটা ছুঁয়ে ফেলে দিয়েছে সজল। যেভাবে ফুলকিটা গেছে অনেকটা ধনুকের মতো বাঁকা হয়ে গেছে। ফুলকিটা একটু একটু জ¦লছে।
রাধা নিচুস্বরে বলল- আমরা এখন কোথায় যাচ্ছি?
নেশার মাত্রা কেটে গেছে সজলের। অনেকটা স্বাভাবিক। নিথর ভাব-ভঙ্গিমায় বলল- দেখি, কোথায় উঠতে পারি।
-কোনো হোটেলে বা …….
-দেখা যাক।
-যেখানে যাও বা থাক কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু ছোট্ট একটি শর্ত আছে।
-কি?
-আজ থেকে আর নেশা করা চলবে না।
কথাটা শুনে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকায় সজল। তার দেখার ভাবটা এভাবে- বহুকাল পর প্রিয় মানুষটির মুখ একবার দেখেছে।

রাত তখন ১২টা।
বস্তিবাসী গভীর ঘুমে আছন্ন। এই বস্তির সবাই খেটে খাওয়া মানুষ। ফলে গভীর রাত পর্যন্ত জেগে থাকার ভাবটা নেই। বিছানায় শয্যাসায়ী হওয়ার পরক্ষণে নাক ডাকতে শুরু করছে।
রাধার হাতে বেশ কিছু কেনাকাটা। পাউরুটি, মাখন, বিস্কুটসহ অনেক কিছু। বস্তির দীর্ঘ পথ ধরে হাঁটার সময় মাঝ বয়সি এক মহিলা বলল- এত রাতে মাগীটা আসে কোথা থেকে?
অন্য এক মহিলা বলল- আইজ ভালোই কামাই হইছে মনে হয়। মাগীর হাতে কত কিছু কেনাকাটা দেখ।
কোনো কথা বা উক্তির প্রতি খেয়াল নেই রাধার। দ্রুত পায়ে হেঁটে যায়। কারণ- বাসায় না খেয়ে ঘুমাচ্ছে ছোট্ট দুটি ভাইবোন। দুপুরে অনাহারে ছিল। না জানি এখন বেঁচে আছে কিনা।
খড়-কুঠো ছাউনিওয়ালা বাসা। যেখানে বস্তিবাসী থাকে। দিনে মাছির ভন ভন শব্দ আর রাতে মশা। অস্বস্তিকর একটা পরিবেশ। তারপরও হত-দরিদ্র মানুষের ঠিকানা।
রাধা দরজা খুলে প্রবেশ করেছে। ছোট্ট বাতিটার আলো যখন জ¦লে উঠেছে দেখা মিলেছে ছোট্ট ছোট্ট বাচ্চ দুটি আড়াআড়ি হয়ে ঘুমাচ্ছে। বুকের হাড্ডিগুলো হার মোনিয়াম যন্ত্রের মতো উল্লেখযোগ্য। সারা গায়ে মশা কামড়ে ধরেছে।
রাধা নিজের চোখের জল ধরে রাখতে পারেনি। ফোটা ফোটা ঝরছে। একবার যখন ডাক দিয়েছে- হুড়মুড় করে উঠে বসেছে। অনাবিল হাসি রাতুল আর পার্বতীর মুখে। কিন্তু সেই হাসি রাধাকে আরো মর্মাহত করে যায়। কারণ দু’জনের মুখ আর শরীরে মশা এত বেশি কামড়ে গেছে অনেকটা গুটি বসন্ত রোগের মতো করে ফেলেছে।
পার্বতী চোখ মুছে নিতে নিতে বলিল- আফু, রাতুল খুব কান্না করেছিল।
-কেন রে?
-তার নাকি প্রচণ্ড ক্ষুধা পেয়েছিল।
রাধা বুকের খুব কাছে জড়িয়ে ধরে বলে- এই নে ভাই, পেট ভরে খা। তোদের জন্য অনেক খাবার নিয়ে এসেছি।
রাধার চোখে জল দেখে রাতু আলাবোলা স্বরে বলল- আফু, তুমি কাঁদছো কেন?
-না ভাই। কাঁদছি না।
রাধা আড়াল করে চোখে মুছে। তিক্ত গলায় নিজে নিজে বলে- বিধাতা এমন করুণ পরিণতি দিয়ে কী সাধটা মেটাচ্ছে? কে জানে?

দুই. সকাল ১০টা।
কনকনে শীতের দিন। বস্তির উপর পড়েছে সোনালি আলো। সামনে ধু-ধু বালুময় মাঠ। মাঠটা রেলওয়ের। কারো একা গ্রাস করার সুযোগ নেই। বস্তিবাসীর ছেলেরা খেলাধুলা করে।
সজল গাড়িটা রাস্তায় রেখে বস্তিতে ছুটে এসেছে। তখন পুরো বস্তি খালি। একটা-দুটা মানুষ দেখা যাচ্ছে। অথচ কত মানুষের বসতি এই বস্তিতে।
দিবসের আলো ধরনা দেয়ার মুহূর্তে জীবনজীবিকার জন্য ছুটে গেছে। ফিরে আসবে তখন সূর্য পৃথিবীকে আড়ালে করে যাবে।
পার্বতী আর রাতুল মাঠে খেলছিল। তাদের গায়ে আলো মেখেছে, পাশে পড়ে থাকা একটা বর্ণমালার বই। প্লাস্টিকে মোড়ানো। সোনালি আলো যখন বইটার উপর পড়েছে, ঝলমল ঝলমল করছিল।
সজল বইটা হাতে নিয়েছে। বালুমাখা বই। ফুঁ দিতে দিতে পরিষ্কার করছে। রাতুল বলল- হেইটা আমার বই, আপনি নিছেন ক্যান?
ফ্যাফ ফ্যাল করে তাকায় শিশুটির দিকে সজল। নিচু স্বরে বলে- তুমি কি স্কুলে যাও?
কোনো কথা বলতে পারছিল না রাতুল। পার্বতী আনমন হয়ে বলে- দু’বেলা খেতে পারি না, স্কুলে কেমনে যাব। জামাকাপড় বলতে কিচ্ছু নেই।
-তোমাদের বাসা কোথায়?
-ওই যে সামনে।
-তোমাদের কে আছে?
-আফু ছাড়া আর কেউ নেই।
-তোমার আফু কোথায়? নাম কী?
-রাধা। চাকরিতে গেছে।
সজলের চোখ কপালে উঠেছে। -রাধা তোমাদের আফু? আমি তার খোঁজে এসেছি।
-হ।
পার্বতী ভালো কথা বলতে পারে। বুদ্ধি হয়েছে। নিচুস্বরে বলল- আমাদের খোঁজ নেয়ার মানুষ নেই, আপনি কে?
রাতুল বইটার জন্য কাঁদছিল। আলাবোলা কণ্ঠে বারবার বলছিল- এটা আমার বই, আমাকে দেন।
পার্বতী আবার বলল- আমরা রাতের অন্ধকারে গ্রাম ছেড়ে পালানোর সময় রাতুল বইটা হাতে নিয়েছিল। সেই ভেবেছিল এটাই তার শেষ সম্ভল।
সজল বলল- বাড়ি থেকে পালালে কেন?
প্রশ্নটার উত্তর দিতে গিয়ে শঙ্কিত বোধ করছিল পার্বতী। ইতস্তত নয়নে ভ্রæ-কুঁচকে বলল- গভীর রাতে আমাদের ঘুম ভেঙে যায়। পাশের কক্ষে বাবা-মা ঘুমিয়েছিল। ওখানে থেকে বয়ে আসছে ভিন্ন ধরনের স্বর। আফু চিৎকার না করে জানালার ফাঁকে দেখছিল। আমিও চোখ দিয়েছি। রাতুল নিদ্রা যাচ্ছে। জানালার ফাঁকে দেখলাম বাবা আর মার গলা কাটা লাশ। সেই স্বর মুহূর্তে নিস্তব্ধ। আশপাশে দাঁড়ানো আছে অনেকেই। যাদের আমরা একটু-আধটু চিনি। মাতব্বর, চেয়ারম্যানসহ অনেকে।
কথাটা বলতে গিয়ে পার্বতী থেমে গেছে। সজল তার হাত ধরে বলল- তারপর?
-ঘাতকরা বাবা-মায়ের মৃত্যু নিশ্চিত করে খোঁজা শুরু করলেন আমাদের। আফু আমাদের নিয়ে এই নিশি রাতে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছে।
-এভাবে হত্যা করার কারণ?
-আমার জানা নেই। তবে যতটুকু জেনেছি- বাবার জমিদারি ছিল। অনেক অনেক সম্পদ। এই সম্পদের কারণে …।
-তোমাদের স্বজনদের সঙ্গে যোগাযোগ করেনি?
-আফু কাউকে বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। কারণ, ঘাতক এই দলটির ভেতরে আমাদের খুব কাছের একজন স্বজনের মুখ দেখেছি।
শুনে সজল হাবাগোবা হয়ে গেছে। কী বলে গল্পটার ইতি টানবে, সেই ভাষা খুঁজে পাচ্ছে না সজল।

তিন. অভাব মেটানোর নেশায় দিন-রাত কোন দিকে ফুরায়- সেই খেয়াল নেই রাধার। তবু গার্মেন্টসের সেই মজুরিতে কিছুই আসে না। ওভারটাইম করে। নতুন কর্মীর আর কত মজুরি হতে পারে? মাঝে মাঝে বস্তির বাসা ভাড়া আটকা পড়ে। জমিদার অকথ্য ব্যবহার করে। অথচ এই জায়গাটা রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের।
রাত ১০টায় গার্মেন্টস থেকে বের হয় রাধা। প্রতিদিনের মতো পায়ে হেঁটে চলা। কাঁচাবাজার পার হয়ে একটু গেলে গাড়িটা এসে থামে। হরণ বেজে ওঠে। সুন্দর গ্রিবাটা বাঁকিয়ে রাধা ফিরে তাকাতে সজল ডাকে – এসো, গাড়িতে উঠ।
গাড়িটা চলছে।
রেললাইনের কাছাকাছি গেলে সিগন্যাল বাতি জ্বলে ওঠে। গাড়ি ব্রেক। সজল নিচুস্বরে বলে- আজ থেকে পার্বতী আর রাতুলের দায়িত্ব আমার।
হতভম্ব হয়ে উঠে রাধা। চোখ কপালে উঠেছে। ক্ষণিক নিস্তব্ধ থাকার পর বলল- তাদের পেলে কোথায়?
-বস্তির বাসায় গিয়েছিলাম।
-কবে?
-সকাল ১০টায়।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে যায় রাধা। গল্পটা পুনরায় বলতে গিয়ে অজোরে ভেসে যাচ্ছিল চোখের জলে। সবিশেষে বলল- এমন অবস্থা ঘাতকরা আমাদের যেখানে পাবে সেখানে খুন করবে।
-এত সহজ?
-ওদের হাত অনেক লম্বা।
-আচ্ছা দেখা যাক, আগে পার্বতী আর রাতুলকে নিজের কাছে নিয়ে আসি। তারপর মোকাবিলা হবে।

রাজধানী ঢাকা শহরের প্রাণকেন্দ্রে পার্বতী আর রাতুলের বসবাস। একটি ক্যাডেট স্কুলের হোস্টেলে থাকে। হোস্টেলে থাকা, খাওয়াসহ লেখাপড়ার সমস্ত ব্যয়ভার সজলের হাতে।
মাদকের নেশা কেটে গেছে সজলের। নেশা আর ধরে না। বরং মাদকের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে। পার্বতী আর রাতুলকে মানুষ করবে নেশায় ধরেছে। এটাই এখন তার বড় নেশা।
মাঝে মাঝে হোস্টেলে রাধা ছুটে যায়। মূল ফটকে অপেক্ষা করে। সময় মতো ছুটে আসে রাতুল আর পার্বতী। বড় আফুকে দেখে আবেগে ভেঙে পড়ে। দুটি চোখ দিয়ে বের হয় জল। আঁচল দিয়ে চোখ মুছে দিয়ে বলে- কাঁদিস না পার্বতী।
আলাবোলা স্বরে রাতুল বলে- আমাদের দেখতে বাবা আর মা কোনোদিন ছুটে আসবে না আফু?
প্রশ্নটার উত্তর দিতে পারে না, তার আগেই নিজের চোখের জল থুথুনি গড়িয়ে পড়ছে। বুকে ঝড়িয়ে ধরে বলে- আসবে ভাই, আসবে।
-কবে?
-অপেক্ষা কর। যেই কোনো দিন আসবে।
পাশে দাঁড়িয়ে পার্বতী আফুর মিথ্যা সান্ত¡নার বাণী শুনে। সে জানে তার মা-বাবা কেউ নেই। দু’জনকে হত্যা করেছে। জায়গা-সম্পত্তি সব কেড়ে নিয়েছে। খুনিরা বরং হন্য হয়ে খুঁজতেছে তাদের। পালিয়ে এসেছে তারা।
রাধা সান্ত¡না দিয়ে ফিরে যায়। পার্বতী আর রাতুল নিজ নিজ হোস্টেলে চলে গেছে। যাওয়ার সময় পার্বতীর হাতে একখানা চিরকুট দিয়ে যায়।
-আফু, এটা কী করব?
-সজল ভাইয়া তোদের দেখতে এলে তার হাতে দিবি। মনে থাকে যেন।
-কিছু জিজ্ঞেস করলে কী বলব?
-কিছু বলতে হবে না।
পার্বতী চিরকুটখানা তার বইপত্রের মাঝে যতœ করে রাখে। সপ্তাহের পর সজল ভাইয়া আসবে। তার হাতে তুলে দেবে।

চার.
রাধাকে কোথাও খুঁজে পাচ্ছে না। গার্মেন্টসের দু’য়ারে কয়েক দিন থেকে অপেক্ষা করেছে। না। কোন খোঁজ-খবর নেই।
-শ্যামলী, রাধাকে দেখছে?
সজলের প্রশ্নের জবাবে শ্যামলী বলে, না তো।
-গেল কোথায়?
-গত ক’দিন ধরে অনুপস্থিত রাধা।
-তুমি কি সিওর?
-হ। রাধাকে দেখছি না।
সজল ছুটে আসে বস্তিতে। প্রতিদিনের মতো বিলাসবহুল গাড়িটা রাস্তায় রেখে প্রবেশ করে। বস্তির অনেকের চোখ সজলের দিকে। কিন্তু কোনো দিকে তার মন নেই। সোজা পায়ে হেঁটে রাধার বাসায়। কিন্তু না, রাধার বাসায় তালা ঝোলানো।
মরিয়মকে জিজ্ঞেস করে- রাধা কোথায় গেল?
-জানি না।
-বল কি? কোথায় খোঁজ পাচ্ছি না কেন?
দীর্ঘশ্বাস ফেলে মরিয়ম বলল, কে রাখে ভাই কার খবর। জীবনে যেখানে দু’মুঠো ভাত পেটে ধরছে না, সেখানে কে রাখে কার খবর।
ফিরে যায় সজল। বিষণ্ন মন নিয়ে। বস্তিবাসী অনেকেই অনেক বর্ণনা দিয়েছে। কেউ ভালো, কেউ খারাপ। কিন্তু কোনো খবর রাধার নির্ধারিত গতিবিধি খোঁজ দিতে পারছে না। শুধু রাবেয়া নামের এক বস্তির বৃদ্ধ মহিলা বলেছে, রাধার ভাব-ভঙ্গিমা বা চেহারার ভাব থেকে বোঝা যাচ্ছিল কোনো দুর্ঘটনা করে যাবে। রাধা নিজের ভাগ্য বা জীবনের প্রতি খুব বিতৃষ্ণ ছিল।
সজল মাথা নেড়ে বলে, হতেও পারে।
সপ্তাহ শেষে হোস্টেলে যাওয়ার পালা সজলের। পার্বতী আর রাতুলের জন্য জামাকাপড়, আচার-চকলেটসহ নানা কিছু নিয়ে যথাসময়ে উপস্থিত। আর সেই সময়টাও জানা আছে রাতুল আর পার্বতীর।
পিওন মামুন এসে ডাকে। -রাতুল, পার্বতী!
ছুটে আসে দু’জন। -বল ভাইয়া।
-তোমাদের ডাকা হচ্ছে। তোমাদের অভিভাবক সজল ভাইয়া এসেছে।
মুহূর্তে লেজ তুলে দে-ছুট। পাগলের মতো ছুটে যায় ওয়েটিং রুমে। যেখানে অভিভাবকগণ এসে অপেক্ষা করে। কেউ ভাইয়ের জন্য, কেউ সন্তানের জন্য।
সজল বসে আছে রাতুল আর পার্বতীর জন্য। দেখা হলে আবেগে হেরে যায়। রাতুল কান্নাকাটি করে। আবার নানা প্রশ্নও করে। যা সজলের কিছুই জানা নেই।
পার্বতী নিচুস্বরে বলে- আফু এসেছিল।
-কবে?
-আজ থেকে চার দিন আগে।
রাধার কথা শুনে একটু আনন্দবোধ করছিল। চোখ কপালে ওঠে। ভ্রæ-কুঁচকে বলে, কিছু বলেছে?
-হ।
-কী?
পার্বতী চঞ্চল হইয়া ওঠে। বলে, আপনি এখানে বসুন। আমি হোস্টেলে যাই। চিটিখানা নিয়ে আসি।
সজল ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে বলে- চিঠি! কার চিঠি?
পার্বতী উত্তরটা দেয়নি, ছুটেছে হোস্টেলের দিকে। দৌড়াচ্ছে। মাঠ দিয়ে দৌড়াচ্ছে পার্বতী। জানালা ধরে হাবাগোবা হয়ে পথ পানে চেয়ে আছে রাতুল আর সজল।
পরক্ষণে ফিরে এসেছে পার্বতী। তার হাতে ছোট চিরকুটটা। ঘন ঘন নিঃশ্বাস নিতে নিতে বলল- এই নিন ভাইয়া। আফু পত্রখানা আপনাকে দিতে বলেছে।
সজল পত্রখানায় চোখ রেখেছে।
প্রিয় সজল,
আবেগ দিয়ে সংসার হয় না। ‘ভালোবাসা আর সংসার’ দুইটা বিষয় দুই মেরুর। সুতরাং আমি এই পৃথিবী ছেড়ে অন্য পৃথিবীতে চলে গেলাম। তুমি অবশ্যই জান- আমি আর আমরা ভাগ্য বিড়ম্বনা মানুষ। তাই রাতের আঁধারে তোমার দুয়ারে উপস্থিত হয়েছি। আমাদেরও গর্ব যোগ্যতা ছিল। কিন্তু বিধাতা সেই গর্ববোধ করতে দিল না। হয়তো সহ্য হয়নি বিধাতার। তাই মেনে নিয়েছি জীবন। বস্তিতে এসে বুঝতে পেরেছি, জীবন কত রঙের। সেই রঙে আমি রঙিন হয়ে গেলেও বিবেকের কাছে হয়ে গেছি প্রচণ্ড ঘেন্নার। আমাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখা মানে- বোকামি। কারণ তোমার কাছে আমার পরিচয় ঘন কালো ছায়ায়।
সেই অসম্মানের জায়গায় আমি গিয়েছি, একমাত্র অসহায় মা-বাবা হারানো দুটি শিশুর জন্য। তাদের তোমার হাতে গচ্ছিত রেখে আমি ছুটি নিলাম। পুনঃরায় আসব ফ্রেশ হয়ে। অপেক্ষায় রবে। শুধু একটি কথা শেষবার বলব- নেশার জগতে আর পা রাখিও না। সময়টুকু মানবতার পথে বিলিয়ে দিও। অবাধ্য হলে কখনো ক্ষমা পাবে না।
ইতি- রাধা।
পত্রখানা পড়ে বেহুশের মতো হয়ে গেছে সজল। মুখে আর কোনো সাড়া শব্দ নেই। দীর্ঘক্ষণ পর রাস্তা ধরে হেঁটে চলল। একাকী। রাস্তায় পড়ে আছে বিলাসবহুল গাড়িটা। গাড়িটার প্রতি আর খেয়াল নেই।
পেছনে ছুটেছে পার্বতী আর রাতুল। চিৎকার করছে। -ভাইয়া, দাঁড়াও। তুমি ফেলে গেলে এই শহরে আমাদের আর কেউ দেখার নেই। দাঁড়াও ভাইয়া!
সজল দাঁড়িয়েছে ঠিক, তবে একটি পাথরের মূর্তির মতো। মনে আর কোনো রং নেই।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়