হাতিরঝিল লেক থেকে যুবকের লাশ উদ্ধার

আগের সংবাদ

এলসি-এনডোর্সমেন্টে বিড়ম্বনা : ডলার সংকটে মূলধনি যন্ত্রপাতি-কাঁচামাল আমদানি ব্যাহত > বিদেশ যাত্রায় বিপাকে সাধারণ মানুষ

পরের সংবাদ

ক্ষয়

প্রকাশিত: নভেম্বর ১৪, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: নভেম্বর ১৪, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

আমার যেদিন ফাইনাল পরীক্ষা শেষ হলো, হল থেকে বেরুতেই দেখি কলেজের আঙিনার পাশে আধা মরা যে কৃষ্ণচূড়া গাছটি, তার তলে মলিন মুখে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে ছোট চাচা। আমার বুক ধক করে উঠল। চাচা কোনো অশুভ সংবাদ নিয়ে আসেনি তো বাড়ি থেকে! আশিকের কিছু হয়ে গেছে নাকি! ছোট চাচার কাছে ছুটে এসে উৎকণ্ঠে বললাম- ‘কী হইছে চাচা? আশিকের কিছু হইছে?’ কোনো কথা না বলে চাচা কাঁদতে লাগল।
বাড়িতে এসে দেখি পরিবেশ সম্পূর্ণ ভিন্ন। মা আর বাবার বিলাপি কান্না দেখে চোখের জল বার বার মুছছে আশপাশের দশ গেরামের উৎসাহী আগন্তুকেরা।
আশিককে খাটিয়ায় রাখা হয়েছে সারা গায়ে সাদা কাপড় জড়িয়ে। আমি লাশের দিকে তাকাতে পারি না। চাচাকে জড়িয়ে ধরতেই আমার ভারি কান্না ক্রমশ বাড়তে লাগল। আশিকটা এভাবে আমাদের ছেড়ে চলে গেল! কী এমন বয়স হয়েছে ভাইটির? মাত্র সতেরো কেবল। থেলাসেমিয়া রোগে শয্যাশায়ী হতে হতে আজ সে আকাশের তারা হয়ে গেছে। আমার একমাত্র ভাইয়ের মরণ শোক আমাকে ঘিরে ধরতে থাকল।
আসরের পরই লাশ দাফন করে আমরা ফিরে এলাম আমাদের তাজা শোক মাখানো বেদনাময় ঘরে। দ্বিতীয়বারের মতো কাঁদতে কাঁদতে অজ্ঞান হলেন মা। বাবা আশিকের ঘরে গিয়ে তার ব্যবহৃত জিনিস নাড়াচাড়া করছেন ভেজা দুটি চোখে।
মৃত্যুর ক’দিন পরই সব কিছু স্বাভাবিক হতে লাগল। আশিকের যে জামাগুলোতে তাকে রাজপুতের মতো লাগল বলে মায়ের ধারণা, মা সেগুলো ভাঁজ করে আলমারিতে লুকিয়ে রাখলেন।
ক’দিন পর আলমারি খুলে মা চিৎকার দিলেন। সর্বনাশা ইঁদুর আশিকের জামাগুলো ধাঁরালো দাঁতে কেটে কুচি কুচি করে ফেলেছে। আবার কাঁদতে লাগলেন মা।

২.
আশিকের মৃত্যুর পর তার পোষা কুকুর টমিও দিন দিন কেমন যেন হয়ে গেল। যে টমির সঙ্গে আশিকের ছিল দারুণ সখ্য, মুনিবের শোকে টমিও দিন দিন নিস্তেজ হতে হতে আমরা এক ভোরে আবিষ্কার করলাম টমির নিথর দেহ। এভাবে টমিটা মরে যাবে, আমরা ভাবতেই পারিনি।

৩.
ছড়া লেখার হাত দারুণ ছিল আশিকের। তার লেখা ২শটি ছড়ার পাণ্ডুলিপি সে পড়ার টেবিলে রেখে দিয়েছে কোনো এক বইমেলায় ছড়ার সংকলন বের করবে বলে।
এক রাতে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামল। সকালে আমরা দেখলাম আমাদের ঘরের পুরনো টিনের ফুটো দিয়ে কাল রাতের বৃষ্টি এসে টেবিলসুদ্ধ আশিকের সমস্ত বইপত্র ভিজিয়ে দিয়েছে। শত চেষ্টা করেও আশিকের ছড়ার পাণ্ডুলিপি স্বাভাবিক পাওয়া গেল না। নিউজপ্রিন্ট কাগজে লেখা ছড়াগুলো স্যাঁতসেঁতে জলে ভিজে পড়ার অযোগ্য হয়ে গেছে।

৪.
পাঁচ নম্বর বিপদ সংকেতের খবর রেডিওতে শুনে আমাদের পুরো জেলাবাসী ভয়ে তটস্থ। না জানি ঝড়-তুফান কী হাল করে আমাদের। রাতভর সিগনালের শোঁ শোঁ শব্দে বাতাসের ঝলকানি শুনে আমরা আতঙ্কে নেতিয়ে পড়ি।
সকালে আমরা বড় বড় চোখে তাকিয়ে থাকি উঠোনের ডানপাশে ডালপালা ছড়িয়ে বেড়ে ওঠা উপড়ে পড়া ডালিম গাছটি। ছয় বছর আগে এ গাছ নিজ হাতে রোপণ করেছে আশিক। কাল রাতের দমকা বাতাসে সেটিরও পতন হলো।
বাবা ডালিম গাছটি কেটে কেটে জ্বালানি কাঠ বানালেন। শুকানোর পর সেগুলো রসই ঘরের চুলোয় ভরে রান্নার কাজে আগুন জ্বালাতে জ্বালাতে শেষ করলেন মা।

৫.
গত মাসে গভীর রাতে আমরা যখন ঘুমিয়ে, বিকট শব্দে ঠাস করে কী যেন পড়ে সবার ঘুম ভেঙে গেল। লাইট জ্বালিয়ে দেখি কোনো কারণ ছাড়াই বাঁশের বেড়ায় ঝুলন্ত আশিকের ৯ বছর বয়সের সাদা কালো ছবিটা কোন এক রহস্যময় কারণে পড়ে গিয়ে ফ্রেমের মোটা কাচগুলো ভেঙে খান খান হয়ে গেছে। এভাবে আশিকের সমস্ত স্মৃতি বিলীন হচ্ছে কেন বুঝলাম না। আশিকের সব চিহ্ন আমাদের কাছ থেকে হারাতে হারাতে ক্ষয় হবে কেন? আজ তার এই ছবিটাও পড়ে ভেঙে গেল!
না, আমি আশিকের ছবিটা হারাতে দেব না। নতুন করে নতুন ফ্রেমে বাঁধাই করে আনব। তারপর ঝুলিয়ে রাখব আগের জায়গায়। তখন মনে হবে আশিক আমাদের থেকে হারায়নি। সে এই ঘরেই আছে ছবি হয়ে। ছবির ভেতর মিষ্টি মুখের হাসি দিয়ে আমাদের রোজ দিন দেখছে।
সকালে ছবিটা নিয়ে গঞ্জের ঝুমকা ফটো স্টুডিওতে গেলাম নতুন ফ্রেমে বাঁধাই করাতে। স্টুডিও কর্মকর্তা রতন নাথ বিনয়ী গলায় বললেন ‘হাতে অনেক কাজ। এখন রেখে যান। বিকালে এসে নিয়ে গেলে হয় না?’ আমি রাজি হলাম। ক্যালেন্ডারের মোটা কাগজে মোড়ানো আশিকের ছবিটা রতন নাথের কাছে দিতেই তিনি তা ড্রয়ারে ভরে রাখলেন।
বিকালে ছবিখানা আনতে গিয়ে দেখি মহাসর্বনাশ। অসতর্কতার কারণে বৈদ্যুতিক আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে ঝুমকা স্টুডিও। সমস্ত মালামালের ছাই থেকে বের হয়ে আসছে পোড়া তাজা গন্ধ।
আমার ব্যথিত চোখ খুঁজছে একখানা সাদা কালো ছবি। আমি জানি এই ছবি আর কোনোদিন পাব না। আগুনে জ্বলে ছাই হয়েছে আশিকের শেষ স্মৃতিও। আমাদের কাছে আশিকের আর কোনো চিহ্ন নেই। ক্ষয় হতে হতে সব শেষ।
আমি টের পাচ্ছি আশিকের জন্য আমার বুকের অতলে চিনচিন করছে একখণ্ড নীল ব্যথা। ভিজে যাচ্ছে দুটো চোখও।
জোবায়ের রাজু
আমিশাপাড়া, নোয়াখালী

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়