কেন্দ্রীয় ব্যাংক : ব্যাংকগুলোতে জনগণের আমানত সম্পূর্ণ নিরাপদ রয়েছে

আগের সংবাদ

মাদকের টাকায় অস্ত্রের মজুত : মিয়ানমার সীমান্তে বেপরোয়া আরসা, আল ইয়াকিন > রোহিঙ্গা শিবিরে অস্থিরতার পেছনেও এরাই

পরের সংবাদ

এলসি-এনডোর্সমেন্টে বিড়ম্বনা : ডলার সংকটে মূলধনি যন্ত্রপাতি-কাঁচামাল আমদানি ব্যাহত > বিদেশ যাত্রায় বিপাকে সাধারণ মানুষ

প্রকাশিত: নভেম্বর ১৫, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: নভেম্বর ১৫, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

মরিয়ম সেঁজুতি : দেশে ডলার সংকট আরো গভীর হচ্ছে। সহসা পরিস্থিতি উন্নয়নের সম্ভাবনাও দেখছেন না সংশ্লিষ্টরা। রিজার্ভ কমছে দ্রুতগতিতে। বাড়ছে না রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয়। ডলার সংকটের কারণে অপারগতার কথা জানিয়ে বড় ব্যবসায়ী ছাড়া ঋণপত্র (এলসি) খুলছে না ব্যাংকগুলো। ফলে বিপাকে পড়েছেন মাঝারি ও ছোট ব্যবসায়ীরা। খরচ বাড়ায় অনেক ব্যবসায়ী তাদের ব্যবসা সংকুচিত করে ফেলছেন। প্রবাসী আয়ে ডলারের সর্বোচ্চ দাম বেঁধে দেয়া হয়েছে। এতে কমেছে প্রবাসী আয়, রপ্তানিও নি¤œমুখী। বিদেশি ঋণ ছাড়ও কমে গেছে। পাশাপাশি বিদেশি ব্যাংকগুলো ঋণসীমা কমিয়ে এনেছে। ফলে ডলার সংগ্রহের উৎসগুলো কমে যাচ্ছে। গত এপ্রিলে ৮৬ টাকার ডলার এখন বেড়ে ১০৭ টাকায় উঠেছে।
সূত্র বলছে, ঋণপত্র বা এলসি খুলতে না পারায় শিল্পকারখানায় মূলধনি যন্ত্রপাতি ও কাঁচামাল সংকট দেখা দিয়েছে। আবার গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংকটে শিল্পকারখানায় উৎপাদন অনেকাংশে কমে গেছে। ব্যবসা-বাণিজ্যে দেখা দিয়েছে স্থবিরতা। এতে ব্যবসায়ীদের ঋণখেলাপি হওয়ার ঝুঁকি বাড়ছে। আবার চিকিৎসার জন্য বা বিভিন্ন প্রয়োজনে বিদেশ যেতেও বাধার সৃষ্টি করছে এ বৈদেশিক মুদ্রা। ব্যাংকগুলো থেকে ডলার এনডোর্সমেন্ট করতে পারছেন না সাধারণ মানুষ।
একটি বাণিজ্যিক ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে ভোরের কাগজকে বলেন, প্রবাসী আয়ে ডলারের দামের সীমা তুলে দিলে এ সংকট কিছুটা হলেও কমতে পারে। তিনি বলেন, ব্যাংকগুলোর সঙ্গে কার্ব মার্কেটের ডলারের দামে এখনো অনেক ব্যবধান রয়েছে। ফলে ব্যাংকগুলোতে কেউ ডলার বিক্রি করতে চায় না। এছাড়া এখন ব্যাংকগুলো জোটবদ্ধ হয়ে প্রবাসী আয়ে ডলারের সর্বোচ্চ দাম দিচ্ছে ১০৭ টাকা। আর রপ্তানি আয় নগদায়নে প্রতি ডলারের দাম ধরা হচ্ছে ১০০ টাকা। বর্তমানে ব্যাংকের যে পরিমাণ ডলার আয় হচ্ছে, তার বেশি কেউ ঋণপত্র খুলছে না।
ডলার-সংকট কাটাতে বাংলাদেশ ব্যাংক নানাভাবে আমদানি নিয়ন্ত্রণ করছে। পাশাপাশি সরকারি

আমদানির জন্য বৈদেশিক মুদ্রার মজুত থেকে ডলার বিক্রি করছে। ফলে বৈদেশিক মুদ্রার মজুত বা রিজার্ভ ৪৮ বিলিয়ন ডলার থেকে কমে ৩৪ বিলিয়নের (এক বিলিয়নে ১০০ কোটি) ঘরে নেমে এসেছে। যদিও আগামী বছরের জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি নাগাদ দেশে বৈদেশিক মুদ্রা বাজারের সরবরাহ ও চাহিদায় ভারসাম্য ফেরার আশা করা হচ্ছে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্র আবুল কালাম আজাদ সোমবার এক প্রেস ব্রিফিংয়ে একথা বলেন। এ সময় তিনি বলেন, গণমাধ্যমে প্রকাশিত এলসি (ঋণপত্র) বাতিল করা হচ্ছে- এ ধরনের তথ্য সঠিক নয়। নভেম্বরের প্রথম ১০ দিনে ১ হাজার ২৬৩ মিলিয়ন ডলারের এলসি খোলা হয়েছে, যা গত অক্টোবরে ছিল ৪ হাজার ৭৪৩ মিলিয়ন।
তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, গত বছরের নভেম্বরে দেশে ডলারের দাম ছিল ৮৫ টাকা ৭০ পয়সা। বর্তমানে আমদানিতে দাম বেড়ে হয়েছে গড়ে ১০৫ টাকা। একবছরে প্রতি ডলারের দাম বেড়েছে প্রায় ২০ টাকা। এর ফলে সব ধরনের আমদানি পণ্যের দাম বেড়ে গেছে। মানুষকে আগের চেয়ে অনেক বেশি দামে পণ্য কিনতে হচ্ছে। পিআরআই নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, আমদানিতে এখনো যে গতি রয়েছে, সেটা যদি অব্যাহত থাকে, রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্স যেভাবে কমছে, সেভাবে কমলে রিজার্ভ আরো নিচে নেমে আসবে। এবারো ব্যালান্স অব পেমেন্ট এবং পণ্য বাণিজ্যে বড় ঘাটতি নিয়ে অর্থবছর শেষ হবে। তাতে অর্থনীতিতে চাপ আরো বাড়বে।
এদিকে ব্যবসায়ী-শিল্পোদ্যোক্তাদের চাহিদা অনুযায়ী ঋণপত্র (এলসি) খুলতে পারছে না ব্যাংকগুলো। শুধু যাদের রপ্তানি আয় আছে ও যারা বড় ব্যবসায়ী, ব্যাংক শুধু তাদের ঋণপত্রই খুলছে। তবে অক্টোবরে এসে ঋণপত্র খোলা একেবারেই কমিয়ে দিয়েছে। বিকেএমইএ নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ব্যবসায়ীরা কাপড়ের এলসি খুলতে পারছেন না। রপ্তানি বাড়াতে মূলধনি যন্ত্রপাতি আনা জরুরি। কিন্তু এজন্যও ঋণপত্র খোলা যাচ্ছে না। বস্ত্র শিল্পের জন্য দেশের বাইরে থেকে তুলা আমদানি করতে হয়। তুলা আমদানি করা না গেলে সুতা তৈরি হবে না। সুতা তৈরি না হলে কাপড় শিল্পের অগ্রগতি ব্যাহত হবে। কিন্তু তুলা আমদানিতেও এলসি খোলা যাচ্ছে না। এদিকে বিভিন্ন গুজবে অনেকেই ব্যাংকে আমানত রাখতে ভয় পাচ্ছেন। যদিও বাংলাদেশ ব্যাংক সম্প্রতি এ বিষয়ে একটি বিজ্ঞপ্তি প্রাকশ করেছে। পাশাপাশি গতকাল সোমবার এক সংবাদ সম্মেলনেও এমন আশঙ্কার কথা উড়িয়ে দেয়া হয়। তবে একাধিক এক্সচেঞ্জ হাউসের কর্মকর্তারা মনে করেন, অনেকেই ডলার কিনে মজুত করছেন। কারণ শেয়ারবাজারে আস্থা নেই। তাই এখানে বিনিয়োগের পরিবর্তে ডলার কিনছেন। পরে দাম বাড়লে বা কৃত্রিম সংকট তৈরি হলে বেচে দেবেন তারা।
অব্যাহত ডলার সংকটের কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। ডলারের বাজার নিয়ন্ত্রণে রিজার্ভ ভেঙে বাজারে ডলার ছাড়া হচ্ছে। তবু দাম কমছে না। সংকটও কাটছে না। ফলে ব্যাংকগুলো সময়মতো এলসি খুলতে পারছে না। এতে ব্যাহত হচ্ছে আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম। ডলার সংকটের সবচেয়ে বেশি প্রভাব এখন জ্বালানি খাতে। জ্বালানির দাম বাড়ার কারণে সব ধরনের জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে অনিয়ন্ত্রিতভাবে। এতে মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়ছে হু হু করে। আয়-ব্যয়ের হিসাব মেলাতে হিমশিম খাচ্ছে সাধারণ মানুষ। বিবিএসের হিসাবে, আগস্ট মাসে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৯ দশমিক ৫২ শতাংশ। সেপ্টেম্বরে তা কিছুটা কমে ৯ দশমিক ১০ শতাংশ হয়েছে। আগস্ট মাসে ১১ বছর তিন মাসের (১৩৫ মাস) মধ্যে সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতি হয়েছে। এর আগে ২০১১ সালের মে মাসে সর্বোচ্চ ১০ দশমিক ২০ শতাংশ মূল্যস্ফীতি হয়েছে। ২০১১ সালের মে মাসের পর মূল্যস্ফীতি আর কখনোই ৯ শতাংশের বেশি হয়নি। বেসরকারি গবেষণা সংস্থগুলো বলছে, মূল্যস্ফীতির প্রকৃত চাপ আরো বেশি।
শিল্পমালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজের (বিসিআই) সভাপতি আনোয়ার উল আলম চৌধুরী পারভেজ জানান, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বাংলাদেশের পোশাকের প্রধান দুই বাজার যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের দেশগুলোয় মূল্যস্ফীতি অস্বাভাবিক বেড়েছে। তারা পোশাক কেনা কমিয়ে দিয়ে খাদ্যের জন্য খরচ করছে বেশি। এ অবস্থায় আগামী দিনে রপ্তানি আয়ে খুব ভালো খবর নেই।
এদিকে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধকে কেন্দ্র করে বিশ্বজুড়েই অর্থনীতির পরিস্থিতি টালমাটাল হয়ে পড়েছে। বিশ্বব্যাংক, আইএমএফসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো তাদের পর্যবেক্ষণ তুলে ধরে বৈশ্বিক অর্থনীতি সংকুচিত হওয়ার খবর দিয়েছে। বিশেষ করে আসন্ন বৈশ্বিক মন্দা ও দুর্ভিক্ষে উন্নয়নশীল দেশগুলো বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে মনে করা হচ্ছে। এতে আগামীতে অনেক দেশের মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) কমে যাবে। পাশাপাশি মন্দার ঝুঁকি বাড়বে। বিশ্বমন্দার আশঙ্কা করা হচ্ছে। এদিকে জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে প্রধান দুই দল ইতোমধ্যে নানা ধরনের কর্মসূচি দিচ্ছে। ফলে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে কোনো ধরনের অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি হলে দেশের সামষ্টিক অর্থনীতির ঝুঁকি আরো বাড়ার আশঙ্কা করছে আইএমএফ।
আগামী জুন পর্যন্ত ডলার সংকট : উন্নয়ন অংশীদারদের সহায়তার কারণে চলতি অর্থবছরের শেষের দিকে ব্যালেন্স অব পেমেন্টের ওপর চাপ কমবে বলে অনুমান করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। গত মাসে তৈরি করা বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের শেষে পরিশোধ ঘাটতির ভারসাম্য হবে ১৫০ মিলিয়ন ডলার, যা গত জুনের শেষে ছিল ৫ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলার।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, মেগাপ্রকল্প ও বাজেট সহায়তা, রেকর্ড রেমিট্যান্স প্রবাহ ও রপ্তানি আয়ের কারণেই এ পুনরুদ্ধার সম্ভব হবে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থবছরে রপ্তানি ৫৫ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছাবে, যা আগের বছরের তুলনায় ১১ দশমিক ৮ শতাংশ বেশি। রেমিট্যান্স প্রথমবারের মতো ২৫ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করবে। গত অর্থবছরে রেমিট্যান্স প্রবাহের পরিমাণ ছিল ২১ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার।
চলতি অর্থবছরে বাজেট ও নিয়মিত সহায়তা এবং সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে উন্নয়ন অংশীদারদের কাছ থেকে রেকর্ড ১৬ বিলিয়ন ডলার আসবে। গত অর্থবছরে এর পরিমাণ ছিল ১৩ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার ছিল। ওই তিন খাত থেকে এ পরিমাণ অর্থ এলে জুনের শেষে ঘাটতি কমে ১৫০ মিলিয়ন ডলারে দাঁড়াবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমান অনুযায়ী, আমদানি ৮২ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার থেকে চলতি অর্থবছরে ৯১ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হবে বলে আশা করা হচ্ছে।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়