জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তির সর্বশেষ রিলিজ স্লিপের মেধা তালিকা ২ অক্টোবর

আগের সংবাদ

ইউক্রেনের ৪ অঞ্চল রাশিয়ায় যুক্ত : প্রেসিডেন্ট পুতিনের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা, অবৈধ বলছেন ন্যাটো নেতারা

পরের সংবাদ

মুহম্মদ নূরুল হুদার কবিতা ও চিন্তা

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ৩০, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: সেপ্টেম্বর ৩০, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

তিনি কবি, তিনি সময়-মানুষ, সময়ের ভেতর দিয়ে সময়কে নির্মাণ করে চলেছেন। জীবনকে দেখেছেন কবি হিসেবে, মহাকালের ইতিহাসের চেতনালোকের ভেতর দিয়ে। তিনি করতে চেয়েছেন ভাষা-জাতির ইতিহাসের কাব্যিক নির্মাণ। ধরতে চেয়েছেন চির-বর্তমানকে, শুনতে চেয়েছেন অতীত মানুষের কণ্ঠস্বর। জানাতে চেয়েছেন কীভাবে বাঙালি বাঙালি হয়ে উঠল। চর্যার কাল থেকে হাজার বছরের অভিযাত্রায় কীভাবে এক বাঙালির মধ্যে পেল পূর্ণতার আহ্বান। এই সবই তিনি তার কবিতায় তুলে এনেছেন। কীভাবে অস্ট্রিক, মঙ্গলয়েড, দ্রাবিড়-ভেড্ডি জাতের মানুষেরা, কীভাবে সাগরবাহিত অন্য নৃগোষ্ঠীর মানুষেরা মিশে গেল এই রক্ত¯্রােতের ধারায়। কীভাবে ইরান তুরাণ আরব থেকে আসা, ইউরোপ থেকে আসা পর্তুগিজ, ইংরেজ সাহেব-হার্মাদ রয়ে গেল রক্তে ও চিন্তার মিথস্ক্রিয়ায়। শ্রম ও ঘামে ধারণ করল তামাটে বর্ণ, আর বলল, ‘রোদ্দুরে নেয়েছি আর বৃষ্টিতে বেড়েছি/ সহ¯্র শতাব্দী দিয়ে নিজেকে গড়েছি/ আমরা তামাটে জাতি, আমরা এসেছি।’ এসবই তিনি তার কাব্যে করেছেন ধারণ, তুলে এনেছেন তার সাহিত্যকর্মে। আর সেই কবি তিনি নিশ্চয় মুহম্মদ নূরুল হুদা, যিনি জাতিসত্তার কবির অভিধার সঙ্গে যুক্ত হয়ে গেছেন, অবিচ্ছেদ্য।
তার কবিতা আদিম পৃথিবীর গল্প; সেই গল্প শোনাতে শোনাতে তার কবিতা আজকের মানুষ পর্যন্ত প্রলম্বিত হয়ে পড়ে; যে মানুষ আগামী দিনে হয়ে যাবে প্রাচীন; তাই তার কবিতায় খ্যাতনামা পুরাণের ব্যবহার এবং সাম্প্রতিক বিষয়কে পুরাণ করে তোলার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। মুহম্মদ নূরুল হুদার কাব্যমানসের বৈশিষ্ট্য অন্যত্র, সমকালীন কাব্যসতীর্থ থেকে পৃথক; আধুনিক কবির রোমান্টিক গীতিধর্মিতার চেয়ে মহাকবির ক্লাসিক স্থৈর্য তাঁর মানসগঠনে বিশিষ্টতা দিয়েছে। তাই প্রতিটি গ্রন্থের জন্য একটি পৃথক এবং সামগ্রিক চেতনা ধারণে তিনি তৎপর। একটা কাব্যগ্রন্থের জন্য সামগ্রিক চেতনা রূপায়ণ আধুনিক বাংলাকাব্য পরিত্যাগ করেছিল, তিনি তার পুনর্বিবেচনা করেছেন। মুহম্মদ নূরুল হুদার কবিতায় মৌল প্রবণতা তার ইতিহাসচেতনা; মহাকালের ইশারা থেকে উৎসারিত যে সময়চেতনা, সেই সময়ের মধ্যে সংস্থাপিত মানুষের জৈবিক অস্তিত্ব এবং পরিণতি লিপিবদ্ধ করা।
তিনি যে কারণে আলাদা সেটি হলো, এই জনপদের আদিম রূপটি কবিতার সাহায্যে ফুটিয়ে তুলেছেন, সেই জনপদের ভয়াল শ্বাপদ রূপের পাশাপাশি সম্ভাবনাও তিনি আবিষ্কার করেছেন। চিত্রে যে দিকটি আবিষ্কার করেছিলেন এস এম সুলতান, তিনি কবিতায় সেই কাজটি করেছেন। সুলতানের চিত্রকলায় আমরা পাই, কৃষিনির্ভর সমাজের পেশিবহুল মানুষ এবং সেই মানুষের সংগ্রামশীলতা। অবশেষে একটি প্যান্টিসোক্রেসিরও ধারণা আবিষ্কার করা যেতে পারে। সেই সঙ্গে আধুনিক মানুষের বিবিক্ত, ক্লান্তি, সংশয়, বিতৃষ্ণা ও নৈরাশ্যিক নেতিবাচকতার তিনি একটি ইতিবাচ্য নির্মাণে সক্রিয় থেকেছেন। করেছেন সদাশয় সদাচারের সাধনা।
তার কবিতায় পড়–য়ার পাঠ অভিজ্ঞতাকে মাঝে মাঝে অতিক্রম করে যেতে চায়। তিনি বৈচিত্র্যপিয়াসী, তার একটি গ্রন্থ থেকে আরেকটি গ্রন্থ দৃষ্টিগ্রাহ্যভাবে আলাদা হয়ে যায়; যদিও পরিণামে একই লক্ষ্যে তার অভিযাত্রা; তার কাব্যগ্রন্থে নাম বিবেচনায় সে সত্য ধরা পড়ে- ‘শোভাযাত্রা দ্রাবিড়ার প্রতি’, ‘অগ্নিময়ী হে মৃন্ময়ী’, ‘আমার তামাটে জাতি’, ‘শুক্লা শকুন্তলা’; তবে কবির ক্ষেত্রে কোনো বিবেচনা চূড়ান্ত নয়। মানবমনের বিচিত্রমুখী চেতনার যতটুকু সে ধারণা করতে চায়। একই দর্শনে স্থিতি থাকা কবির ধর্ম নয়। তিনি মুজিববাড়ি থেকে যিশাস মুজিবকে গড়ে তোলেন বাংলার বিষণ্ন ও সংগ্রামী ভাবমূর্তি রূপে, মৃদুস্বরে গাইতে থাকেন ‘জলের গজল’। মূলত তার কাব্যচর্চা মৌলিক মানুষ হওয়ার চর্চা, চণ্ডীদাস-নজরুলীয় চেতনার নব-রূপকার ‘ ধর্মাধর্ম, জাতি ও বেজাতি, আর/মৌলিক মানুষ হয়ে বাঁচবার আদি অধিকার।’

দুই.
এখন তার যথেষ্ট বয়স হয়েছে, অভিজ্ঞতা ও প্রজ্ঞায় হয়েছেন ঋদ্ধ। আজ থেকে ২৫ বছর আগে কয়েকজন নবীন-প্রবীণ কবি-সাহিত্যিক চিন্তক তার ৫০তম জন্মদিনে তার সম্মুখীন হয়েছিলেন, বাধ্য করেছিলেন তার চিন্তাকে তার ভাষ্যে উন্মোচন করতে। ১৯৯৮ সালের সেপ্টেম্বর মাস, শারদ সন্ধ্যায়, সাক্ষাৎকার শিকারিরা জানতে চেয়েছিলেন- ৫০ বছরের জীবনটাকে কীভাবে দেখলেন, ঋদ্ধ না রিক্ত। বললেন, ‘দাঁড়াতে দাঁড়াতে হাঁটা, হাঁটার আগে দৌড়ানো আর দৌড়ানোর আগে উড়াল দেয়া- এরকম হন্তদন্ত আর প্রস্তুতিবিহীন কেটে গেল ৫০ বছর। এখনো তো মনে হয় না, ঊরু সোজা করে দাঁড়াতে পারি। দুপুরের রোদ-ভরা মাঠে এখনো যেন আমি ডাঙ্গুলি হাতে এক উপকূলীয় কিশোর।… শৈশবের জোছনা রাত আর মধ্য বয়সের নিয়নের আলোয় জীবনের অনেক কিছুই দেখেছি। আমার সমাজের ৯০ শতাংশ মানুষই তো আমার চেয়ে খারাপ অবস্থনে আছে। কবির কোনো তৃপ্তি নেই। প্রার্থিত আলোক-পঙ্ক্তিটি এখনো তার ধরাছোঁয়ার বাইরে। কবি জোছনা রাতে চিৎকার করে পাড়া মাতায়, ‘হে চাঁদমামা, কবির কপালে টিপ দিয়ে যা।’
আদিম মানুষের আচরণ ও তাদের পেশার প্রতি রয়েছে তার সহজাত পক্ষপাতিত্ব, আধুনিক সভ্যতার মধ্যে প্রাকৃতিক বর্বরতার এই পুনঃস্থাপনের দার্শনিক পটভূমিই বা কী। বললেন, ‘আমার জাতির প্রথম মানুষকে আমি দেখতে চাই। তার চলাফেরা, ধুলোমাখা নগ্নদেহ। পেশল বাহু, তার হাতে গাছের ডাল দিয়ে তৈরি শিকারের অস্ত্র। কিংবা পলিময় এই গঙ্গাভূমির আঁঠাল মাটিতে দাঁড়িয়ে সে ছড়িয়ে যাচ্ছে শস্যবীজ। কিংবা ক্ষুধানিবৃত্তির জন্যে তার সদ্য শিকার করা পশুর কাঁচা মাংস। না, একে বর্বরতা বলব না। এ হচ্ছে জীবন স্বভাবের প্রাকৃতিকতা। বর্বর হলাম একালের আমরা, যার হাতে ধাতব সভ্যতার হননপ্রবণ ছুরি। আধুনিক সভ্যতার সন্ত্রাসী আচরণকে যদি আদিম মানুষের প্রাকৃতিক উর্বরতা দিয়ে ঢেকে দেয়া যেত, তাহলে মানুষ প্রকৃতই আলোক মানুষে পরিণত হতো। এই আমার মধ্যেই আমি এক মুহূর্তে দেখে ফেলি আমার কোটি কোটি পূর্বপুরুষের ছায়া ও শরীর। ওরা ছিল বলেই আমি আছি। আমার স্মরণের মধ্যে ওরা পুনর্জন্মপ্রাপ্ত।’
কেউ একজন জানতে চাইলেন ‘যে কোনো ব্রিজের পাশেই শুরু হয় আমাদের শৈশবের খেলা’- কি ছিল এর সৃজন রসায়ন।
বললেন, ‘১৯৭১ সালের পরে ১৯৭২ সালের দিকে হবে। আমার স্পষ্ট মনে পড়ে, এখন যে গ্রিন রোড- সে গ্রিন রোড দিয়ে আমি হাঁটছিলাম, হেঁটে হেঁটে আমারই কবিবন্ধু শাহনূর খানের বাসার দিকে যাচ্ছিলাম, তখন বেশ কিছুকাল ধরে শাহনূর খানের বাসায় আমি এবং আহমদ ছফা থাকতাম। যেতে যেতে বিকেলবেলা হঠাৎ খুব বিষণ্ন মনে হচ্ছিল নিজেকে- একটি শব্দ এসে গেল আমার মাথার ভেতর, ‘দ্রাবিড়া’। মনে হচ্ছিল আমি হেঁটে যাচ্ছি কারো উদ্দেশে এবং সে-অন্বিষ্ট দ্রাবিড়া’, মনে হচ্ছিল তখন প্রতি পদক্ষেপে অসংখ্য ‘আমি’ তৈরি হয়ে যাচ্ছি। মনে হচ্ছিল দ্রাবিড়ার দিকে অসংখ্য ‘আমি’র শোভাযাত্রা তৈরি হয়ে যাচ্ছে।’
জানতে চাইলেন- ‘বিশেষ নারীর কথা’ মনে পড়ে না!
‘অনেক নারীর কথা মনে পড়ে। অনেক নারীই আছেন, যারা আমাকে প্রভাবিত করেছেন।.. দীর্ঘকাল আমি যার বক্ষলগ্ন ছিলাম- সেই রমণীর কাছে। তিনি আমার পিতামহী।’ তারপর বললেন, ‘তুমি আমাকে দেখিয়েছিলে, তুমি আমাকে দেখতে বলেছিলে তাই আমি দেখেছি; আমি হাঁটিনি, তুমি আমাকে হাঁটতে বলেছিলে তাই আমি হেঁটেছি এবং একটা বিশাল মাঠের কথা বলা আছে, মাঠের ভেতর গিয়ে একজন শ্যামাঙ্গী কিশোরী আমাকে ডাকছে।’
‘কবিতার সেই রমণী কি বাংলাদেশ।’
তিনি বললেন, ‘সেই রমণীর রূপ পাল্টেছে, সেই রমণীকে আমি দ্রাবিড়া বলেছি, মৃন্ময়ী বলেছি, অনেকটা বলা যায় শেক্সপিয়ারের ডার্কলেডির মতো একটা এনিগমেটিক কারেক্টার।’
জানতে চাইলেন, ‘আপনি যখন কোনো রমণীর সংস্পর্শে আসেন..’
‘আমি যদি তেমন কোনো রমণীর কাছে যাই যিনি আমাকে সবকিছু দিয়ে আশ্রয় দিতে পারেন, আমার মাথার ওপর হাত রাখতে পারেন- তাহলে আমি তাকে করি শ্রদ্ধা।..
‘আমি আমার আশপাশে যারা আছেন, তাদের সবাইকে নিয়ে গর্বিত। আমাদের সময়ে আমি, রফিক আজাদ, আবদুল মান্নান সৈয়দ, সিকদার আমিনুল হক, মোহাম্মদ রফিক প্রমুখের কথা বলব। এরা প্রত্যেকেই নিজের একটা ডিকশন খুঁজে পেয়েছেন, এদের নিজস্ব কাব্যভাষা আছে এবং এদের শনাক্ত করার মতো বিষয়বস্তু এদের কবিতায় আছে। এছাড়া আছেন- নির্মলেন্দু গুণ, আবুল হাসান, হুমায়ুন কবির প্রমুখ।’
‘আমি মনে করি, আমার কোনো রচনা যদি কারও ভালো লাগে, তাহলে পড়া উচিত আর যদি ভালো না লাগে, তাহলে পড়া উচিত নয়। একজন পাঠক তার যেটা পছন্দের জিনিস, সেটাই বেছে নেবেন। বিশ্বসাহিত্যের অনেক বড় বড় লেখক আছেন, যাদের পাঠ করার সুযোগ আমি নিজেও পাইনি এবং আমার পড়তেও ইচ্ছা করে না।’
আপনার জাতিসত্তার কথা বলুন। ‘আমার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘শোণিতে সমুদ্রপাত’, দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘আমার সশস্ত্র শব্দবাহিনী’ এবং তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘শোভাযাত্রা দ্রাবিড়ার প্রতি’- অনেকেই বলে থাকেন আমার যে জাতিসত্তার দিকে যাত্রা, সেটি এ তিনটি কাব্যগ্রন্থ থেকে স্পষ্ট। ‘শোভাযাত্রা দ্রাবিড়ার প্রতি’ কাব্যগ্রন্থের প্রায় প্রতিটি কবিতাতেই বাংলাদেশের বাস্তবতা, জাতিসত্তার বাস্তবতা, দ্রাবিড় নৃতাত্ত্বিক বিষয় এসেছে। কাজেই এই সচেতনতা আমি বেশ আগে থেকেই শুরু করেছিলাম বলে আমার ধারণা। ১৯৭২ সালে ডাকসুর সাহিত্য সম্মেলনে আমি জাতিসত্তার প্রশ্নটা উত্থাপন করি। আমি কারো সঙ্গে তুলনার কথা বলব না- এই বিষয়টা আমার ভেতর আগাগোড়া সুপ্ত ছিল। ’৬৯- এর গণআন্দোলনে আমি অংশগ্রহণ করেছি। আমার পাশেই আসাদ গুলি খেয়েছেন। আমি একটি কবিতা লিখেছিলাম উৎসবের বিভিন্ন প্রেক্ষিত’, আমি আমার ডিকশন অনুযায়ী বিষয়গুলোকে উপস্থাপন করেছি- আমার সমসাময়িক কবিরাও বিষয়গুলো উপস্থাপন করেছেন তাদের মতো করে আমার মনে হয়।’
তিনি একবার ঘোষণা দিয়ে ছিলেন, আর লিখবেন না কবিতা। কি এমন হয়েছিল। বললেন কবিতা লিখে কি হয়। মানুষের নিরাময়ে কাজ করা অনেক ভালো। এই লেখালেখির কাজ না করে বরং ভালো, যদি হোমিওপ্যাথিও করা যায়। ‘হোমিওপ্যাথি করার সঙ্গে সঙ্গে একজন ব্যক্তিকে আমি প্রত্যক্ষভাবে সাহায্য করতে পারছি,- আর কবিতা লিখে অন্যকে তো নয়ই, আমি আমাকেও সাহায্য করতে পারছি না। এই না-লেখা আমাকে অনেক দিন দীর্ঘ করতে হয়েছিল- আমি লিখিনি।’ পরে তিনি কবিতাও লিখেছেন, হোমিওপ্যাথিও করেছেন, দুটিকে দারুণ মিলিয়েছেন- ‘পোয়েমোপ্যাথি’ রূপে।
‘আসলে মানুষের সমস্ত জ্ঞান মানে নিজের ভেতর যে প্রতিমা, সে প্রতিমাকে গড়ে তোলা, যে প্রতিমা হলো জ্ঞানপ্রতিমা, বলা যেতে পারে আবেগপ্রতিমা, বলা যেতে পারে বোধপ্রতিমা। আসলে সুতনুকা তনুনির্ভর কোনো কিছুকে মানুষ সৃষ্টি করতে চায়, যাতে সেই তনুর গায়ে হাত বুলিয়ে বুঝতে পারে এটাই তো আমার সৃষ্টি।’ তরুণ কবিরা জানতে চেয়েছিলেন, আপনার সুতনুকা, দ্রাবিড়া, সিকোরাক্স কি নারীবাদের পক্ষে যায়। বললেন, ‘আদম কেবল পুরুষ নন, নারীও, কেননা সে হাওয়া না¤œী রমণীকে তার ইচ্ছে দ্বারা তৈরি করেছেন।.. মেক্সিকান লোককাহিনীতে যেখানে একটা আদি মাকড়সার কথা বলা আছে, সেই মাকড়সা থেকে এই সৃষ্টির সূত্রপাত ঘটেছিল, এই মাকড়সাই তৈরি করেছিল প্রথম পুরুষ এবং রমণী। তাহলে ওই মাকড়সাকে কী আমরা পুরুষ বলব? না রমণী বলব? আমরা বলব উৎস। আমি বলতে চাই উৎস-জননেন্দ্রীয়।.. সিকোরাক্সের একটা সন্তান ছিল ক্যালিবান। সে ক্যালিবানের জন্মের ইতিহাস আমাদের জানা নেই। ক্যালিবানকে জন্ম দেয়ার আগে সিকোরাক্স এক ধরনের স্বেচ্ছাসঙ্গমে লিপ্ত হয়েছে।’
কিছুটা সন্দেহ নিয়ে জানতে চাইলেন একজন, ‘বাঙালি হচ্ছে শংকর জনগোষ্ঠী, এক মিশ্র জাতি। কিন্তু আপনি বাঙালিকে বলছেন তামাটে জাতি।’ তামাটে জাতিকে এর কনোটেশন দিয়েই গ্রহণ করতে হবে- আমি সেভাবেই ব্যবহার করেছি। তা না হলে একটা বর্ণবাদের ব্যাপার চলে আসতে পারে। কালো-সাদা-তামাটে। আমি এই কবিতাতে যে এসেন্সটা তৈরি করেছি, সেটা হচ্ছে কর্মী মানুষের এসেন্স। আমাদের এই ভূখণ্ডের মানুষ অর্থাৎ মঙ্গোলয়েড ধারার যে মানুষ, তার চেয়ে বেশি হচ্ছে শ্রীলঙ্কা থেকে আসা ভেড্ডি গোত্রীয় মানুষ।’
জানতে চাইলেন তিনি, ‘যেটা মনে হয় আমার কাছে, আপনি একসঙ্গে সৃষ্টিশীল এবং অন্য দিকে কিছুটা অস্থির। আপনার ‘শোণিতে সমুদ্রপাত’ কিংবা ‘প্রতীকমানুষ’ কিংবা প্রথম দিকের কবিতাগ্রন্থগুলো আপনার মধ্যে এক ধরনের পরিমার্জিত এবং অত্যন্ত অভিনিবেশী একজন লেখককে খুঁজে পাই।’ আপনি বলেছেন, ‘আমার জামানার ফিরোজ সাঁই, তারও যেমন এক সেকেন্ডের বিশ্বাস নাই।’
বললেন, ‘এখানে ফিরোজ সাঁইয়ের কথা বলা আছে, তেমনিভাবে ক্লিনটনের কথা বলা আছে, আল গোরের কথা বলা আছে, ইয়াসমিনের কথা বলা আছে, মার্টিন লুথার কিংয়ের কথা বলা আছে। তারপর নিগ্রোরা যে নির্মাতা হচ্ছে, তার কথা বলা আছে, আবার নিগ্রোরা যে আমেরিকাকে রসাতলে পাঠিয়ে দিচ্ছে, তার কথাও বলা আছে। তারপর বলা আছে, বাংলাদেশের কথা। বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে দেরিদার কথা বলা আছে। দেরিদাকে নিয়ে এই কবিতার শুরু এবং দেরিদাকে নিয়ে এই কবিতার শেষ।’ জানতে চাইলেন, ‘একপর্যায়ে আপনি বলেছেন আপনি যাই দেখেন, সেটাই লেখেন। সে দেখা আমার মনে হয় এত ক্ষুদ্র অর্থে নয়। ‘বীক্ষণ’-এ শব্দটি আমি ব্যবহার করতে চাই। দান্তে ফ্লোরেন্সের সার্কাসের বাঘ দেখেছিলেন। পরবর্তীকালে তিনি যখন ডিভাইন কমেডি লেখেন, তাতে নরকের একটা জায়গায় তিনি সেরকম একটি বাঘকে স্থাপন করলেন। আপনার একটি কবিতার নাম ‘জালো’।
বললেন, ‘আমি যখন ‘জালো’ লিখি তখন আমি প্রত্যক্ষভাবে কিছুই দেখছি না। আমি তখন ঢাকা শহরে। আর ‘জালো’ যে বিষয়ে লিখিত হয়েছে, যে পরিবেশের কথা বর্ণনা করা হয়েছে, যে সমুদ্রের কথা বলেছি, সেটি আমার আজন্ম দেখা। এই মুহূর্তে আমি তা দেখতে পাচ্ছি না। একসময়ে আমার দেখার ব্যাপার ছিল, তাকে আমি যখন পুনর্নির্মাণ করছি, তখন তাকে আমি সম্পূর্ণ আমার নিজের মতো করে পুনর্নির্মাণ করছি। জালো কিংবদন্তির চরিত্র। মালো এবং জালো দুই ভাই।’
অনুবাদ নিয়েও জানার ছিল, ‘অনুবাদের ক্ষেত্রে আপনি নির্দিষ্ট একটি আদর্শকে কখনো অবলম্বন করেননি। যেমন ধরা যাক, ইউনুস এমরের ক্ষেত্রে অনুবাদের যে কৌশল বা আদর্শ আপনি গ্রহণ করেছেন এবং প্রয়োগ করেছেন ভিনদেশি প্রেমের কবিতার ক্ষেত্রে সেটা একেবারেই ভিন্ন। আবার আগামেমনন আর একটু ভিন্ন রকম। যেমন আগামেমনন ও ভিনদেশি প্রেমের কবিতা খানিকটা কাছাকাছি।’
বললেন, ‘আমি প্রথমে অনুবাদ করলাম মিখাইল ইজাকোভস্কির একটি কবিতা।.. এটাই প্রথম সচেতনতা এবং তারপর আমি যে অনুবাদগুলো পরে করতে শুরু করি, তখন প্রতিটি রচনা পাঠ করার পর ওই রচনার ধরন শৈল্পিক যে বিন্যাস কাঠামো, সেটাকে চেনার চেষ্টা করেছি। এমন যদি হতো আমি মিখাইল ইজাকোভস্কির কবিতা অনুবাদ করলাম কিংবা তার কবিতাই শুধু অনুবাদ করেছি, তাহলে তার অন্য কবিতার যে কাঠামোটা, সেটা তার মতো হতো। কিন্তু আমি তার কবিতাই অনুবাদ করছি, তার ডিকশন, তার শব্দরাজি এবং তার স্টাইলস্টিকস আমাকে মেনে চলতে হতো।’
এই ভাবে কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা ধরা পড়েন সাক্ষাৎকার শিকারিদের প্রশ্ন ফাঁদে। তিনি ধীর এবং আস্থার সঙ্গে প্রশ্নগুলো উত্তর দিয়ে যান। সাক্ষাৎকার গ্রহীতারা প্রায় সবাই ছিল তার অনুজ ও প্রিয়, কেউ কেউ কবি ও সাংবাদিক, সবাই ছিল তার ঘনিষ্ঠ পাঠক ও ব্যাখ্যাকারী, তাদের কিছু প্রশ্নে ছিল, আরো কিছু জানার আকাক্সক্ষা। খুব বেশি আড়াল ছাড়াই তিনি উত্তর দিয়েছেন। বিশ ও একুশ শতকের যে সংকট, সাহিত্যতত্ত্ব, যান্ত্রিক বিবর্তন সবই প্রশ্নে অন্তর্ভুক্ত ছিল। ব্যক্তিগত প্রসঙ্গ তিনি এড়িয়ে যেতে চাননি, কারণ সাহিত্যের উৎসমূলে সেগুলো দারুণ কার্যকরী। প্রাচ্য ও প্রতীচ্য পুরাণের তিনি এক বিশেষজ্ঞ, সাহিত্যের ক্ষেত্রে, শ্রেণিকক্ষে পাঠগ্রহণ ও পাঠদানে যেহেতু তিনি সিদ্ধহস্ত ইংরেজি সাহিত্যে, অনুবাদ কর্মে যেহেতু তার রয়েছে অবাধ বিচরণ, সেহেতু এই সাক্ষাৎকারটি কেবল কবি মুহম্মদ নূরুল হুদাকে জানার জন্যই উপযোগী নয়, সাহিত্যের খুটিনাটি বিশ্লেষণ ও প্রয়োগে কাজে আসবে বলে আমার ধারণা। তার ঝোক ছিল শনাক্তকরণের প্রতি। বোদলেয়ারের আধুনিকতা বেশ পুরনো হলেও যতদিন না বুদ্ধদেব বসু বোদলেয়ারের অনুবাদ করলেন, ততদিন এই আধুনিকতা আমাদের সাহিত্যে ধরা দেয়নি। সময়ে শনাক্ত করতে না পারলে গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যও হারিয়ে যেতে পারে। অবলীলায় প্রকাশ করেন সত্য, ‘আমার বয়স বাড়ে, মূর্তজা বশীরের আঁকা প্রকৃতির বয়স বাড়ে না। আমি বয়সের বাঁকে বাঁকে লুকিয়ে ফেলি কত সহ¯্র আমাকে।’ তবু এত সব প্র্রশ্নের পরেও সহ¯্র নূরুল হুদা অপ্রকাশিতই থেকে যায়।
কবিতাই কবির জীবন, তার সময়ের ইতিহাস। বহির্জগত ও অন্তর্জগতের যেসব অভিঘাত কবিকে বিপন্ন করে, আনন্দিত করে, সেসবই তিনি লিখে যেতে চান ভাষার শব্দে, কিন্তু সেই শব্দ প্রাত্যহিক ব্যবহারে ক্লিষ্ট নয়, পরীক্ষিত কিন্তু সময়োত্তীর্ণ- তার সহজ কোনো মানে নেই, কিন্তু পরম সত্য আছে উপলব্ধি জাত, সাধারণের কাছে তা সহজবোধ্য নয়, ব্যাখ্যা দ্বারা তাকে অনুভব করতে হয়, যার নাম হতে পারে রহস্যময় দ্ব্যর্থক; তাই ব্যক্তি কবিকে জানার কৌতূহল পাঠকের প্রবল। সে কবির সঙ্গে কথা বলে, সলার্থে কথা শুনে তার নির্মিত রহস্যেও জাল উন্মোচন করতে চায়, তাই প্রয়োজন পড়ে কবির কথা শোনার; কিন্তু সব সময় তা সহজ নয়, যারা লেখকের মুখোমুখি হতে পারেন, তাদের ধারাভাষ্য পাঠকের অবলম্বন হয়ে ওঠে। আর এ কারণে এই সাক্ষাৎকার গ্রন্থটি প্রকাশের প্রয়োজন রয়েছে। কারণ, কবি মুহম্মদ নূরুল হুদার একটি পাঠক জনতা গড়ে উঠেছে। যারা তার আশ্রমবালিকা শকুন্তলার কাছে যেতে চায়, দ্রাবিড়ার সান্নিধ্য পেতে চায়, তামাটে জাতির মানুষের সঙ্গে পান্তা পুটি খেতে চায়।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়