এসপি হলেন পুলিশের ৪৭ কর্মকর্তা

আগের সংবাদ

সাশ্রয়ের নামে নিম্নমানের বই! : ছাপানো শুরু হয়নি, বছরের প্রথমদিন সব শিক্ষার্থীর বই পাওয়া অনিশ্চিত

পরের সংবাদ

সৈয়দ শামসুল হক বর্তমান প্রজন্মের কাছে গুরুত্বপূর্ণ

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ২৩, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: সেপ্টেম্বর ২৩, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

কথাটা সুনীল’দার কাছে শোনা। কলকাতা বা পশ্চিমবঙ্গকে আলাদা গুরুত্ব দেননি সৈয়দ শামসুল হক। এই উপেক্ষা কিন্তু তার স্পর্ধার প্রকাশ নয়। এটাও সত্যি নয় যে, তিনি এপার বাংলায় লেখার জন্য আমন্ত্রণ পাননি। কিন্তু বাস্তবে তার লেখা পশ্চিমবঙ্গে খুব একটা প্রকাশিত হয়নি। কারণ? বানান বিভ্রাট। বাংলা ১৩৮২-এর ফাল্গুন সংখ্যার কৃত্তিবাস পত্রিকায় প্রকাশিত হলো তার কবিতা ‘সেই ব্যর্থতার দৃশ্য’, তবে লেখকের নাম সামসুল হক। সৈয়দ শামসুল হক নয়। এই নাম বিকৃতি তাকে ক্ষুব্ধ করেছিল ভয়ংকরভাবে। এরপর থেকে সৈয়দ শামসুল হক পশ্চিমবঙ্গের পত্রপত্রিকায় বড় একটা কবিতা বা গদ্য প্রকাশের জন্য দেননি। কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী বিশেষভাবে পছন্দ করতেন সৈয়দ শামসুল হকের কবিতা। তিনি ছিলেন ‘দেশ’ পত্রিকার কবিতা সম্পাদক। তিনি বছর দুয়েক আগে তাঁর মৃত্যুর পরে এক ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণে বলেছিলেন ‘সৈয়দ শামসুল হক বড় অভিমানী কবি ছিলেন। তখন পশ্চিমবঙ্গে একজন কবিতা লিখতেন নাম সামসুল হক। তার সাথে গুলিয়ে ফেলে একবার নামের বিভ্রাট হওয়ায় কিছুতেই কবিতা দিতেন না এপার বাংলায়’।
কিন্তু এ অভিমান তো আমরা টের পাইনি। আমি অন্তত নই। তখন আমরা দুই দেশের বাঙালি কবি-সাহিত্যিকদের নিয়ে একটা সংস্থা করেছি। পত্রিকা প্রকাশ করব। কলকাতার নামি কবিদের কবিতা জোগাড় করেছি। বাংলাদেশের যারা আমাদের সংস্থার যারা সভ্য তারা বিস্তর খেটে প্রায় সব নামি প্রতিষ্ঠিত কবি ও অনামি নবীনদের কবিতা জোগাড় করেছে। কিন্তু সৈয়দ শামসুল হককে কবিতা দেয়ার কথা বলার সাহস করা হয়নি। অথচ কিছু মাস আগে আমার সঙ্গে তার পরিচয় হয়েছে জাতীয় কবিতা উৎসবের সান্ধ্য পার্টিতে ঢাকা ক্লাবে। তিনি আমাকে ও আমার কবিবন্ধু শ্রীজাতকে আলাদা করে নিয়ে বসিয়ে কবিতা সংক্রান্ত কত গল্প করলেন। মানুষ হিসেবে তাকে আমার অসাধারণ মনে হয়েছিল।
কথাসাহিত্য, কবিতা, নাটক, গান- কোথায় নেই তার প্রাণবন্ত বিচরণ? যেখানে হাত দিতেন সেখানেই সোনা ফলিয়েছেন।
আগেই বললাম আমার সঙ্গে তার প্রথম পরিচয়ের কথা। ঢাকা ক্লাবে সেদিন আমাকে নাসিরুদ্দিন ইউসুফ আলাপ করিয়ে দিতেই তিনি আন্তরিকভাবে জিজ্ঞাসা করলেন ‘আমার কোনো কবিতা তুমি পড়েছ?’ বললাম ‘পড়েছি।’ ৩টি কাব্যগ্রন্থ ‘একদা এক রাজ্যে’, ‘বৈশাখে রচিত পঙ্ক্তিমালা’, ‘পরাণের গহীন ভিতর’ পড়েছি আর উপন্যাস ২টি ‘নিষিদ্ধ লোবান’, ‘সীমানা ছাড়িয়ে’ পড়েছি। খুশি হলেন। কথা এগোল। কবিতা নিয়ে কথা এগিয়ে চলল। খোঁজ নিলেন কলকাতায় কে কে এখন লিখছেন। সুনীলদার স্মৃতিচারণ হলো। হঠাৎ জিজ্ঞাসা করলাম ‘আচ্ছা, আমি যদি কলকাতায় থেকে এই দেশে কবিতাচর্চা করতে চাই আমি কি সুযোগ পাব?’ প্রথমে হেসে ফেললেন, তার পরে বললেন ‘এই আইডিয়া কি সুনীল মাথায় ঢুকিয়েছে?’ আমি বললাম ‘ঠিক তা নয়, তবে তার প্রভাব কিছুটা তো আছেই।’ হক সাহেব পিঠে হাত রেখে বললেন, ‘কবিতা যদি লিখতে পারো তাহলে এ দেশ তোমায় ফেরাবে না’। কথাটা সেদিন মাথায় বীজমন্ত্র হয়ে ঢুকে গেল।
এই কবির জীবনের অন্তিম পর্বের কিছুদিনের ধারাবিবরণী আমি পেয়ে বড্ড বিমর্ষ ছিলাম। সৈয়দ শামসুল হক চাননি তার অসুস্থতার কথা সবাই জেনে যাক। হক সাহেব তখন ইংল্যান্ডে। চিকিৎসা চলছে। একই সময় নাসিরুদ্দিন ইউসুফ ইংল্যান্ডে একটি ছবির কাজের জন্য গেছেন। প্রথম খবর তার কাছে পাই। আর শেষ সময়ে আমার কবিবন্ধু ডাক্তার আশরাফ জুয়েলের তত্ত্বাবধানে ছিলেন। তখন প্রায় প্রতিদিনের খবর পেতাম। রবীন্দ্রনাথ মৃত্যুর আগে রোগ যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে মুখে মুখে দুটি কবিতা রচনা করেছিলাম। ডাক্তার আশরাফকে বলেছিলাম যে কথা বলছেন, গল্প করছেন যখন তোদের সঙ্গে, প্রস্তাবটা দে। কর্কট রোগজনিত যন্ত্রণা থেকে মন তো কিছুটা ঘুরবে। নাহ, সেটা হয়নি। সম্ভবত প্রস্তাবটা দেয়াই হয়নি। ডাক্তাররা কবিসুলভ পাগলামিকে প্রশ্রয় দেননি। শুধু মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে খবরটা ফোনে দিয়েছিলেন।
তার মৃত্যুর দিন দুয়েক পরে কবি শঙ্খ ঘোষের বাড়িতে গিয়েছি। একেবারে বিনা নোটিসে। তাকে বাসায় প্রত্যাশাও করিনি। একটি কাগজ দেয়ার ছিল। দেখলাম স্যার বাসায়। কথাপ্রসঙ্গে জানালেন কবি সৈয়দ শামসুল হককে শ্রদ্ধাজ্ঞাপক কবিতা লিখছেন। পরে সে কবিতা পড়লাম বাংলাদেশের একটি সাহিত্য পত্রিকায়।
‘আরো একবার ঠিকই কলকাতায় যাব, কথা হবে।’
দূর-দূরান্তর থেকে সাগর পেরিয়ে ভেসে আসে
শমনশয়ান থেকে যাপনের দিকে ভেসে আসে
সেই একই স্বচ্ছ আর মর্মছোঁয়া স্বর
মুহূর্তে যে স্বর
উষ্ণতায় করতল স্পর্শ হয়ে যায়।
গুঞ্জন, গুঞ্জন শুনি : কথা হবে, কথা হবে
আরো কিছু কিছু স্বপ্নকথা হবে কোনোদিন পাশাপাশি।
‘কে একা নিঃসঙ্গ বসে অশ্রæপাত করে?’
তোমার সৃষ্টিরই মতো আজ মনে পড়ে
তোমারও অপেক্ষা ছিল দেখবে কখনো
মানুষ মানুষ বলে মানুষের কাছে এসে যায়
কলকাতা-ঢাকায়
নিত্য সেতুপথ বেয়ে এপার-ওপার
এক নূরলদীন গেলে হাজার হাজার নূরলদীন
জেগে ওঠে এ মাটিতে, কথা হয়, কথা
তোমার আনন্দ শুধু ভাষার আনন্দে ভেসে ওঠা
নূরলদীনের গলা হয় ফের হয়
সাগরের ঢেউ ভেঙে তোমার আনন্দ শুধু জীবন-আনন্দে জেগে ওঠা
সারা জীবনের নূরলদীন।
কথা হবে- শঙ্খ ঘোষ

বাংলা সাহিত্যের দুই দিকপাল কবি। কী অপরিসীম শ্রদ্ধা ছিল পরস্পরের প্রতি। তখন বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি এখনকার মতো নিশ্চিন্ত ছিল না। সব সময়ই উথাল-পাথাল। ফলে যাতায়াত করা কবিরাই ছিলেন এই সাংস্কৃতিক আদান প্রদানের মাধ্যম। সৈয়দ শামসুল হকের ব্যক্তিত্ব ও উদাসীনতা তাকে কলকাতার বইপাড়া থেকে সব সময়ই দূরে সরিয়ে রেখেছিল। কলকাতার বইপাড়া কলেজ স্ট্রিটে তার রচিত বই সে কারণেই খুব একটা পাওয়া যায় না। তাহলে এপারের পাঠকরা কি কেউ সৈয়দ শামসুল হকের লেখা পড়েননি? গদ্য? বা পদ্য? সত্যি কথা বলতে দ্বিধা নেই যে, অনেক কম। কিন্তু আরেকটা বড় সত্যি এই যে, এপার বাংলায় যারা কবিতা লেখেন তারা সৈয়দ শামসুল হকের কবিতার বই সংগ্রহে রাখেন। কলকাতা বইমেলায় একটি বাংলাদেশ প্রকাশনা সংস্থা বেশ কিছু কবিতা ও গদ্যের বই নিয়ে এসেছিলেন বিক্রির উদ্দেশ্যে। তার মধ্যে রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ও সৈয়দ শামসুল হক ছিলেন হটকেক। দুদিনের মধ্যে সব বই শেষ। বর্তমানে বিভিন্ন কবিতা সংক্রান্ত আলোচনায় সৈয়দ শামসুল হক সম্পর্কে একটা অদ্ভুত পরিবর্তন লক্ষ্য করেছি। বর্তমান প্রজন্ম এই সব্যসাচী কবির কবিতা অনেক বেশি গ্রহণ করছে। ‘পরাণের গহীন ভিতর’ বইটি প্রকাশিত হয়েছিল নব্বই দশকের শুরুতে। তখন কবিতার জগতে সবে পা দিয়েছি। সে বইয়ের কবিতা পড়া হয়েছিল বেশ কিছু আসরে। তবে সে সময়ে এপারের কবিরা বলেছেন যে ‘বাঙাল ভাষা’য় লেখা এই কবিতাগুলো ছিল একটু বেশি সরল। একই কবিতাগুলো এপারের বর্তমান প্রজন্ম যেভাবে গ্রহণ করেছে সেটা সত্যি বিস্ময়কর।
মৃত্যু হয়তো মানুষকে মহান করে। তাই এপারের কবিরা আজ তেড়েফুঁড়ে পড়ছেন সৈয়দ শামসুল হক। নাট্যদল নাটক করছে ‘নূরুলদীনের সারা জীবন’। এপারে তার সৃষ্টির চর্চা বাড়ছে এতদিনে। এটা অবশ্যই শুভ প্রবণতা। আমার তাই এখন কবি সৈয়দ শামসুল হকের কথাটাই একটু অন্যভাবে মনে হয় সব সময় তা হলো- স্বদেশে পুজ্যতে রাজা, বিদ্বান সর্বত পুজ্যতে।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়