হাছান মাহমুদ : সেই নৈরাজ্যের পথেই হাঁটছে বিএনপি

আগের সংবাদ

ভূরাজনীতির ফাঁদে প্রত্যাবাসন! রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে এডিটরস গিল্ডের গোলটেবিল বৈঠক : ৫ বছরে সংকট আরো বেড়েছে

পরের সংবাদ

সাশ্রয়ের নামে নিম্নমানের বই! : ছাপানো শুরু হয়নি, বছরের প্রথমদিন সব শিক্ষার্থীর বই পাওয়া অনিশ্চিত

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ২৪, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: সেপ্টেম্বর ২৪, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

অভিজিৎ ভট্টাচার্য্য : নতুন শিক্ষাবর্ষ শুরু হতে আজ থেকে ৯৮ দিন বাকি। কিন্তু আনুষঙ্গিক কাজ শেষ করে এখন পর্যন্ত প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের পাঠ্যবই ছাপানোর কার্যাদেশই দিতে পারেনি জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। চলতি সপ্তাহ থেকে কার্যাদেশ দেয়া শুরু হবে। এরকম পরিস্থিতিতে প্রশ্ন উঠেছে, এত কম সময়ের মধ্যে প্রায় ৩৫ কোটি বই কীভাবে ছাপানো সম্ভব। এর ফলে ২০২৩ সালে ১ জানুয়ারি কোমলমতি শিশু শিক্ষার্থীদের হাতে পাঠ্যবই পৌঁছাবে তো? পাশাপাশি ছাপাখানার মালিকরা এবার কম দামে বই ছাপিয়ে দেয়ার দায়িত্ব নিয়েছেন। এতে হয়তো সরকারের টাকা সাশ্রয় হবে, কিন্তু মানসম্মত পাঠ্যবই পাওয়া যাবে কিনা তা নিয়ে তর্ক শুরু হয়েছে।
প্রসঙ্গত, চলতি শিক্ষাবর্ষে বছরের প্রথমদিন সব শিক্ষার্থীর হাতে সব পাঠ্যবই তুলে দিতে পারেনি এনসিটিবি। ফেব্রুয়ারি-মার্চেও কোনো কোনো মুদ্রণকারী বই দিয়েছিল। বইয়ের কাগজের মান নিয়েও অভিযোগ উঠেছিল। এবারের পরিস্থিতি আরো খারাপ হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শিক্ষার্থীদের পাঠ্যপুস্তকের সংকট কমাতে ২০০৯ সাল থেকে বাংলাদেশ সরকার বিনামূল্যে বই বিতরণের সিদ্ধান্ত নেয়। শিক্ষাবর্ষের শুরুর দিনে বই উৎসব করে শিক্ষার্থীদের হাতে বই পৌঁছানো হলে শিক্ষার্থীদের যেমন আনন্দের সীমা থাকে না, তেমনি পড়াশোনায়ও আগ্রহ তৈরি হয়। কিন্তু গত বছরে যে সংকট দেখা গিয়েছিল এবারো সে সংকটের আশঙ্কা করা হচ্ছে। বই ছাপানোর কার্যাদেশ দিতে দেরি করাসহ তিনটি কারণে এবারো সময়মতো শিক্ষার্থীদের হাতে মানসম্মত সব বই তুলে দেয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে।
জানতে চাইলে এনসিটিবির চেয়ারম্যান অধ্যাপক মো. ফরহাদুল ইসলাম ভোরের কাগজকে বলেন, সময়ের চেয়ে পিছিয়ে থাকলেও সময়মতো মানসম্মত বই দেয়া নিয়ে এনসিটিবি সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। মুদ্রণকারীরাও সহায়তার আশ্বাস দিয়েছেন। বই ছাপাতে ছাপাখানাওয়ালাদের কম দর প্রস্তাবের কারণ ব্যাখা করে তিনি বলেন, তারা জানে এবার সবকিছুর দাম বাড়তি তবু কম দামে বই ছাপিয়ে দেবে বলেছে। কেন এটা করেছে তিনি জানেন না উল্লেখ করে

বলেন, আইন অনুযায়ী পাঠ্যবই মানসম্মতভাবে ছাপা না হলে সে বই এনসিটিবি গ্রহণ করবে না।
এনসিটির তথ্যমতে, গত ২০১০ সাল থেকে উৎসব করে বছরের প্রথম দিন শিক্ষার্থীদের হাতে পাঠ্যবই তুলে দেয়ার যে রেওয়াজ শুরু হয়েছিল করোনার কারণে গত কয়েক বছর তাতে ভাটা পড়েছে। গত শিক্ষাবর্ষের শুরুতে বই বিতরণ শুরু হলেও সব শিক্ষার্থীর হাতে সব বই দেয়ার ধারাবাহিকতা রক্ষা করা যায়নি।
এদিকে নতুন বছরের জন্য প্রায় ৩৫ কোটি বই ছাপানো হচ্ছে। এর মধ্যে মাত্র ২ লাখ ৪০ হাজার (ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মাতৃভাষায় রচিত বই) ছাপানোর কার্যাদেশ দেয়া হয়েছে। আবার বই ছাপার কাজ পেতে প্রাক্কলিত দরের চেয়ে গড়ে ২২ থেকে ২৫ শতাংশ কম দাম দিয়েছে মুদ্রণকারীরা। যদিও কাগজ ও কালির দাম বাড়তির দিকে। এ দুটি কারণেও মানসম্মত বই ছাপানো নিয়ে শঙ্কা দেখা দিয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এনসিটিবির ঊর্ধ্বতন একজন কর্মকর্তা বলেন, কার্যাদেশ দিতে বিলম্বসহ তিন কারণে সময়মতো মানসম্মত বই ছাপিয়ে আগামী শিক্ষাবর্ষে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের হাতে বিতরণ করা খুবই কঠিন হয়ে পড়বে। অর্থাৎ গত বছরে যে সংকট সৃষ্টি হয়েছিল তা থেকে জাতীয় শিক্ষা শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) কোনো শিক্ষাই নেয়নি। যে কারণে এবারো একই সংকট তৈরি হয়েছে। তিনি এনসিটিবির পাশাপাশি এর ব্যর্থতার দায় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ওপর চাপিয়েছেন। কারণ শিক্ষা মন্ত্রণালয় সময়মতো সিদ্ধান্ত দিতে পারেনি।
আরেকজন কর্মকর্তা বলেন, সাধারণত বছরের মে মাস থেকেই দরপত্রের প্রক্রিয়া শুরু হয়। কিন্তু এ বছর এনসিটিবির চেয়ারম্যান পদ শূন্য থাকা, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির নতুন শিক্ষাক্রমের অনুমোদন সংক্রান্ত জটিলতার জেরে এ দরপত্রের প্রক্রিয়াটিই শুরু হয় অন্তত তিন মাস পর। এরপর আবার মূল্যায়নসহ আনুষঙ্গিক কাজগুলো শেষ করতেও দেরি হচ্ছে। বিলম্বে কার্যাদেশ ও চুক্তি হলে শেষ সময়ে নি¤œমানের কাগজে বই দেয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
দামে ছাড় মানে ফাঁকি : অনুসন্ধানে জানা গেছে, বই ছাপানোর জন্য সরকার যে দর দিয়েছে, ঠিকাদার দিয়েছেন তার চেয়ে ২৪ শতাংশ কম। ঠিকাদারের দেয়া দরের চেয়ে সরকারের দর কম হওয়ায় অনেক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। অনেকেই বলছেন, ঠিকাদাররা দামে ছাড় দিলেও লাভের জন্য সরবরাহ করবেন নি¤œমানের বই। যে বই দিয়ে এক বছরও পড়াশোনা করা যাবে না। এরপর শিক্ষার্থীদের বাধ্য হয়েই বাজার থেকে বই কিনতে হবে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শত শত কোটি টাকার এই কাজ বাগিয়ে নিতে এবং বিদেশি প্রকাশনা সংস্থাগুলো ঠেকাতে মুদ্রাকরদের একটি সংঘবদ্ধ চক্র পরিকল্পিতভাবে অস্বাভাবিক কম দরে টেন্ডার দিয়েছে। এই অস্বাভাবিক দরের বিষয়টি জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) হয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির অনুমোদনও পেয়েছে। শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপুমনি এ নিয়ে একবার প্রশ্ন তুললেও পরে তিনি নীরব হয়ে যান।
জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মো. ফরহাদুল ইসলাম আশঙ্কা প্রকাশ করে ভোরের কাগজকে বলেন, এবারও প্রাক্কলিত দরের চেয়ে কম দরে টেন্ডার জমা দিয়েছেন মুদ্রাকরেরা। এতে মান নিয়ে সংশয় সৃষ্টি হওয়া অমূলক নয়। তবে শিক্ষার্থীরা যাতে মানসম্মত বই পায়, সেজন্য কঠোর নজরদারি করা হবে। তবে অনেকেই বলছেন, চেয়ারম্যান যা-ই বলুন না কেন, ঊর্ধ্বমুখী এই বাজারে প্রাক্কলিত দরের চেয়ে কম দরে কোনো অবস্থাতেই মানসম্মত বই সরবরাহ করা সম্ভব নয়। জানতে চাইলে অগ্রণী প্রিন্টিং প্রেসের মালিক কাওসারউজ্জামান রুবেল ভোরের কাগজকে বলেন, আমরা যখন টেন্ডার জমা দেই তখন পরিস্থিতি এত খারাপ ছিল না। এখন এসে সবকিছু দাম বেড়ে যাওয়ায় ঠিকাদাররা যে দর দিয়েছেন তাতে হয়ত বেশি লাভ হবে না। তবু কম লাভে সরকারকে আমরা কাজটি চূড়ান্ত করে দেব।
এনসিটিবি থেকে জানা গেছে, আগামী বছরের জন্য প্রায় ৩৪ কোটি ৬১ লাখ ৬৩ হাজার কপি পাঠ্যবই ছাপানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এগুলোর মধ্যে প্রাক-প্রাথমিক থেকে প্রাথমিক স্তরের ৯ কোটি ৯৮ লাখ ৫৩ হাজার কপি এবং মাধ্যমিক স্তরের জন্য মোট ২৪ কোটি ৬৩ লাখ ১০ হাজার কপি পাঠ্যবই ছাপানো হবে।
সূত্র জানায়, প্রাথমিক স্তরের বই ছাপতে ৯৮টি লটে দরপত্র আহ্বান করা হয়। প্রাক্কলিত দরের চেয়ে কম দর দেয়ার ঘটনা প্রথম ঘটে ২০১৬ সালে। শিক্ষার্থীরা যখন ২০১৭ সালের জানুয়ারি মাসে বই হাতে পায়, তখন দেখা যায় অধিকাংশ বই নি¤œমানের। পরে এ নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হয়। এরপর কয়েক বছর ধরে একই কৌশলে বই ছাপার কাজ নিচ্ছে সংঘবদ্ধ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান। প্রতিবারই এসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে নি¤œমানের বই সরবরাহের অভিযোগ ওঠে। কিন্তু এ ধরনের ঘটনায় অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠানকে বাদ দিয়ে নামমাত্র সাজা দেয়া হয় অন্য কয়েকটি প্রতিষ্ঠানকে।
এনসিটিবি থেকে জানা যায়, এবার প্রাথমিকের বই প্রতি ফর্মা (৮ পৃষ্ঠা) ২ টাকা ৯০ পয়সা। এর বিপরীতে ঠিকাদাররা বলেছে ২ টাকা ২০ পয়সার কাজটি করে দেবে। মাধ্যমিকের ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির বই প্রতি ফর্মা (৮ পৃষ্ঠা) প্রাক্কলন করা হয় ২ টাকা ৮৫ পয়সা। ঠিকাদাররা বলেছে ২ টাকা ১০ পয়সা। অষ্টম ও নবম শ্রেণির বই প্রতি ফর্মা (৮ পৃষ্ঠা) প্রাক্কলন করা হয় ২ টাকা ৬৮ পয়সা। ঠিকাদাররা বলেছে ১ টাকা ৯৮ পয়সা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এনসিটিবির দায়িত্বশীল কয়েকজন কর্মকর্তা বলেন, দুই স্তর মিলিয়ে প্রাক্কলিত দরের চেয়ে প্রায় ২৪ শতাংশ কম দরে কাজ পেতে যাচ্ছেন মুদ্রাকররা। এতে সরকারের খরচ কমবে ২৮০ কোটি টাকা।
দরপত্রের শর্তানুযায়ী, প্রাথমিক স্তর ও ইবতেদায়ীর বই ৮০ জিএসএমের (গ্রাম/স্কয়ার মিটার) কাগজে ৮৫ শতাংশ উজ্জ্বলতা বা পাল্প থাকতে হয়। নবম-দশম শ্রেণির বিজ্ঞানের বই চার রঙা মুদ্রণে ৭০ জিএসএম কাগজে এবং অন্য শ্রেণির বই ৬০ জিএসএম কাগজে ছাপতে হয়। আর বইয়ের কভারে ২৩০ জিএসএমের আর্ট কার্ড (মোটা কাগজ) ব্যবহার করতে হয়। কিন্তু বর্তমানে কাগজ ও কালির দাম যেভাবে বাড়ছে, তাতে এই দরে (প্রাক্কলিত দরের চেয়ে কম দর) কোনোভাবেই মানসম্মত বই ছাপানো সম্ভব নয় বলে জানান একাধিক মুদ্রাকর।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক প্রেস মালিক বলেন, এর আগে যখন মুদ্রাকরেরা কম দামে কাজ নিয়েছিলেন, তখন তারা ডিসেম্বর মাসের জন্য অপেক্ষা করেছিলেন। কেননা ১ জানুয়ারি যেহেতু বই দিতে হবে, তাই ডিসেম্বর এলে এনসিটিবি আর মানের দিকে তাকায় না। তখন যে বই-ই দেয়া হয়, এনসিটিবি তা-ই নেয়। এবারের পরিস্থিতিও সেদিকে যাচ্ছে। তবে এনসিটিবি চেয়ারম্যান অধ্যাপক মো. ফরহাদুল ইসলাম বলেন, আইন অনুযায়ী বই ছাপিয়ে দিতে হবে। অন্যায় করলে কোথাও না কোথাও ধরা পড়বে। তখন জরিমানাসহ শাস্তির মুখে পড়তে হবে তাদের।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়