এসপি হলেন পুলিশের ৪৭ কর্মকর্তা

আগের সংবাদ

সাশ্রয়ের নামে নিম্নমানের বই! : ছাপানো শুরু হয়নি, বছরের প্রথমদিন সব শিক্ষার্থীর বই পাওয়া অনিশ্চিত

পরের সংবাদ

অতিমারির দিনকাল

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ২৩, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: সেপ্টেম্বর ২৩, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

সেদিন সকাল সাড়ে দশটায় বেশ জড়সড়ো ব্যস্ততা ঘিরে ধরে রাস্তাটিকে। রাকিব সবেমাত্র মালামাল সাজিয়ে নিতে শুরু করেছে। এই সাহস হতো না, কথায় বলে নির্বোধ আর দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া মানুষের ভয়-ডর নেই, থাকে না; তার ভয় অনেক, যদিও অনেক সময় কোনো অবলম্বন খুঁজে পায় না। গত দু-দিন ধরে দেখে আসছে, কঠোর এই সময়ের মধ্যেও দোকান খুলছে কেউ কেউ। কোথাও সম্পূর্ণ শাটার উন্মুক্ত কোথাও হাফডাউন। প্রচণ্ড রোদের মধ্যে একটুকরো ছায়ার মতো। রাকিবের স্থায়ী দোকান নেই। একটি ভ্যানগাড়ি হাতে ঠেলে ঠেলে এগোতে হয়। আজো সেভাবে এসে সবকিছু সাজিয়ে নিয়েছে। তখনই ফিসফাস শোরগোল, –
‘গাড়ি আসছে… গাড়ি আসছে।’
‘কার গাড়ি? কে আসছে?’
রাকিবের এটা-ওটা ঠিকমতো বুঝতে সময় লাগে। বোকা মানুষ। দেরিতে বোঝে। বিবিধ ঝুটঝামেলা থেকে দূরে থাকতে পছন্দ করে। তাই সাধারণত টাউন হলের দেবদারু গাছের ছায়াতে দাঁড়ায়। আজ দক্ষিণে আরো একটু দূর, ওষুধ দোকানের পাশে ফাঁকা একচিলতে পরিসর, সেখানে দাঁড়িয়েছে; এখানে দুপুরে হালকা ছায়া পাওয়া যায়। হাতের বাঁ-পাশে গ্রিলের সীমানায় চকচকে অ্যানামেল পাইপের বাহারি জল-ফোয়ারা। গ্রিলের প্রত্যেক খুঁটিতে হাই-ওয়াট বালব। শহরের সকল রাস্তা ভাঙাচোরা, খানাখন্দক আর আবর্জনায় পরিপূর্ণ হলেও এটিই বড় সৌন্দর্য। মনলোভানো আরো আছে হাসপাতাল মোড়ে। সন্ধে হলে সাতরং বাতির আলোয় মনেই হয় না যে, এ দেশে লক্ষ লক্ষ শিশু রাতের খাবার না খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। কেউ কেউ নতুন সকালের প্রত্যাশা নিয়ে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে ভরপেট খাবারের স্বপ্ন দেখে। রাকিব কখনো এইসব হাবিজাবি ভাবে। ভেবে কোনো সমাধান পায় না। তার ভ্যানের উপর গেঞ্জি-ক্যাপ-শার্টপিস-লুঙ্গি। সারাদিন দাঁড়িয়ে বেচাবিক্রি। কখনো আবদাল্লাহর লোকজন আসে। পৌরসভার নতুন কাউন্সিলর। অনেক টাকা এধার-উধার করে তবেই নির্বাচিত। তাকে তো খরচ ওঠাতে হবে। রাকিব ফুটপাতে দাঁড়ায়। মানুষজনের হাজারও অসুবিধা। সুতরাং চাঁদা দিতে হবে। সে প্রায়শ পঞ্চাশ বা একশত টাকার নোট হাতে তুলে অসহায় চেহারা ধরে রাখে। রাজ্যের বিষাদ দৃষ্টি।
‘আজ এর বেশি হবে না মামা। বেচাবিক্রি নাই।’
‘দূর ব্যাটা! বিশ হাজার টাকার মাল নিয়া বইছস, আর কথা কস ট্যাহা নাই। যা রেট দুইশ, ওটাই দিতে হইব।’
‘বিশ হাজার টাকার মালামাল? মামা যে কী বলেন! তিন হাজার টাকারই হবে কি না! আজ সত্যই বিক্রিবাট্টা নাই মামা। পকেট দেখেন। এই মাত্র দুশ টাকা, চাল-ডাল-আলু কিনতে হবে।’
‘একদিন না খাইলে কী হয়! শ্শালা!’
আসলাম তার থুতনিতে টোকা মেরে সামনে এগিয়ে যায়। এই হলো ফুটপাতের ব্যবসা। কোনোদিন পুলিশ আসে। তাকে দশ-বিশ যা থাকে দিতে হয়। অথবা টাউন হলের গা-ঘেঁষে দাঁড়ানো চা-স্টল থেকে নানখাতাই বিস্কুট আর চা। লাল চা নয়, দুধ চা; মানুষ জমিয়ে খায়। রাকিব পানি খেয়ে গলা ভেজায়… পেট ভরে। কখনো চায়ের কাপে চুমুকও চলে। এখন সেই দোকানগুলো চালু হয়নি। কয়েক বছর আগে জেলা কারাগারের পুব সীমানায় কাঁটাতারের বেড়া উঠিয়ে বিশাল মার্কেট হয়েছে। সেগুলোর বেশিরভাগই গার্মেন্টেসের দোকান, কয়েকটি স্যান্ডেল-জুতো; তারই কয়েকটি খোলা- আধখোলা আর মালিকের সূ² সতর্ক চোখ-কান। এর মধ্যেই মানুষ হেঁটে গেলে হাঁক দেয়।
‘ও আপা আসেন আসেন কী লাগব কন?’
‘ভাই ভালো স্যান্ডেল আছে।’
এরা বেশিরভাগই অন্য জেলার মানুষ। এখন এখানে স্থায়ী বসতি গড়েছে। আগের জায়গায় কে কী করত, চুরি-ডাকাতি-ছিনতাই কিংবা বানবাসি মানুষ, জানে না কেউ, জানার কথাও নয়; এ হলো ইট-পাথরের শহর। শহরের রাস্তা ফুটপাত হলো ভাসমান বাজার। কেউ গাড়ি আসার কথায় লাফিয়ে রাস্তায় নামে। দোকানের শাটার ফটাফট বন্ধ হয়। রাকিবের তখন রাখাল বালকের গল্প মনে আসে। সাঈমা পড়ে। এক রাখাল গরু চরাতে চরাতে ‘বাঘ এসেছে… বাঘ এসেছে’ বলে চিৎকার দেয়। কৃষকেরা জঙ্গলের পাশে ক্ষেতের পাকা ধান কাটে। তারা দৌড়ে রাখালের কাছে যায়। ‘কোথায় বাঘ… বাঘ কোথায়?’ রাখাল হি হি হি করে হাসে। একদিন সত্যি সত্যি বাঘ এলো। রাখাল তুমুল চিৎকার করে। কৃষকেরা আর গেল না। বাতাসে শুকনো পাতার মর্মর আর্তনাদ ভেসে যায়। যেমন কর্ম তেমন ফল।
রাকিবের হাসি আসে না। বাবা আকস্মিক অসুস্থ হয়ে পড়ে আছে তিন মাসের ওপর। ডান কাঁধের জয়েন্টে ব্যথা। ডান হাত ঠিকমতো নাড়াতে পারে না। হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিল। অনেক অপেক্ষার পর ছয় টাকা দিয়ে টিকেট কেটে ডাক্তার দেখায়। ডাক্তার ঠিকমতো না দেখে না শুনেই খস খস করে কী লিখে দেয়। কাউন্টারে গিয়ে কয়েক পাতা এটা-ওটা ট্যাবলেট মেলে, যার মধ্যে অমিপ্রাজল গ্রপের আর বি-প্লেক্স ভিটামিন। অন্য ক্যাপসুলের দাম বেশি, সেগুলো বাইরে থেকে কিনতে হবে। কেনা হয়। তেমন কাজ হয় না। তারপর মুনশিপাড়ার সুবল কবিরাজের বাড়ি। কবিরাজের ছেলে এমবিবিএস ডাক্তার। চেম্বারের দিকে হেঁটে যায়, উজ্জ্বল চোখ-মুখ, কারো মলিন বিষাদ চেহারা বুঝি কাছে টানে, মানুষের মায়া অথবা কী ভেবে এগিয়ে এসে শুনে বলে, –
‘ফ্রোজেন সোলডার। ফিজিক্যাল থেরাপি হলো আসল চিকিৎসা।’
তারপর দু-চার কথা। রাকিব শোনে, এই রোগ নাকি আপনিই সেরে যায়। সময় লাগে। সুবল কবিরাজ তবু এক শিশি তেল দেয়। কুজ্বপ্রসারণী তৈল। ছোট্ট শিশি অনেক দাম। সাঈমা সেই তেল কুসুম কুসুম গরম করে বাবার কাঁধ আর হাতে হালকা মালিশ দেয়। কাজ হয় কিনা বোঝা যায় না। এর মধ্যে আবার প্রস্রাবের সংক্রমণ। আধঘণ্টা পরপর বাইরের ড্রেনে যেতে হয়। প্রস্রাব ধরে রাখতে পারে না। এই অভাবিত কষ্ট খারাপ লাগে। কখনো চোখ-মুখ কুঁচকে বলে ওঠে, –
‘বড় যন্ত্রণা বাবা। জ্বলে যাচ্ছে যেন।’
‘বেশি করে পানি খাও তো। দেখি সন্ধেয় কিছু ওষুধ কেনা যায় কি না। ডাব খেলে মনে হয় ভালো হতো, কিন্তু যে দাম!’
‘দোকানপাট বন্ধ কোথা থেকে টাকা আসবে?’
বাবা নিজেই সন্ধেয় মডার্ন মোড়ের ওষুধ দোকানে গিয়ে ট্যাবলেট কিনে নিয়ে আসে। রাকিব একসময় দেখে বাবার বিছানায় লাল রঙের পকেট ট্রানজিস্টারটা নাই। প্রায় সময় হারানো দিনের গান শুনত। জীবন থেকে গান হারিয়ে গেলে সুর আর থাকে না। রাকিবের বুকে উদাস বাতাসের ঢেউ একপলক জেগে মিলিয়ে যায়। কী করতে পারে? সে কিছু বলে না। অভাবি মানুষকে অনেক কিছু ছেড়ে দিতে হয়। আজকাল ব্যবসা নাই। কয়েক সপ্তাহ হলো পুনরায় লকডাউন শুরু হয়েছে। দোকানপাট-অফিস-আদালত-স্কুল-কলেজ সব বন্ধ। এক সপ্তাহ পর আবার পরের চৌদ্দ দিন। সবকিছুতে তালা। পৃথিবীজুড়ে কী অদ্ভুত ব্যামো ছড়িয়ে গেছে, মানুষজনের বের হওয়ায় শত বিধিনিষেধ; বাবা কেন বাইরে যায়? বয়সি মানুষের ঝুঁকি বেশি। সে পরদিন ওষুধের কার্যকারিতার খোঁজ নিয়ে মন্তব্য করে, –
‘তুমার বাইরে যাওয়া নিষেধ। আমারে কইবা আইন্যা দিমুনে। মা থাকলে পহরায় বসাইতাম। সাঈমা শোন, বাপে রে খেয়াল রাখবি। বাইরে য্যান না যায়।’
‘তুই তো যাস ব্যাটা। আমি বুইড়া মানুষ, জীবনে অনেক দেখছি, তুই যোয়ান পোলা, তোর বাঁইচ্যা থাহন বেশি দরকার বাপ, বোনডার বিয়া দিতে হইব, তুই বাইরে যাবি না।’
‘আমি না গেলে খাইবা কী?’
‘আমি দোকান লইয়া যাই?
‘একবার তো হাজার টাকার জালনোট পাইছিলা। মানুষজন খারাপ… তোমার মতো সাদাসিধা না।’
বাবা নিশ্চুপ থাকে। এই তো কয়েক মাস আগেও ভ্যানগাড়ি দোকান নিয়ে বাপ-ব্যাটা দুজনই টাউন হল আর লিলি মোড় থাকত। এখন সব বন্ধ। মানুষজন নাই। যে দু-চারজনের হাঁটাচলা, তাদের মুখে মুখোশ, চোখে-মুখে সেই প্রাণোচ্ছলতা নাই; কোথায় বুঝি সব হারিয়ে গেছে। পৃথিবী স্থবির হয়ে নিশ্চিত কোনো ধ্বংসের অপেক্ষায়। দেশে দেশে প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ মারা যাচ্ছে। সেই মৃতদেহ স্পর্শ করতেও নিকটজনের মনে দ্বিধা আর আতঙ্ক। সামান্য সর্দি-কাশি-মাথাব্যথা-জ্বর এত ভয়ানক! মানুষ বাতাসের মধ্যে ডুবে থেকে নিশ্বাস নিতে পারে না। শ্বাস নিতে নিতে দম ফুরিয়ে কাহিল। কোথা থেকে এলো এই দুর্যোগ? মানুষজন নানা কথা বলে। কেউ বলে ভাইরাস, মানুষ হত্যার জীবাণু অস্ত্র, কেউ জানায় চীনারা নাকি বাদুড় খেয়ে অসুখ তৈরি করেছে, সেটাই একজনের কাছে থেকে আরেকজন, এক দেশ থেকে আরেক দেশ; এভাবেই ছড়িয়ে গেছে সারা পৃথিবী। কোভিড উনিশ নাকি করোনা তার নাম।

রাকিব আজ মুখোশ পরেছে। যে উদ্দেশ্যে মুখে-নাকে সেঁটে নেয়া তার চেয়ে অন্য লাভও কম নয়। হাজার চিন্তায় শুকিয়ে যাওয়া চেহারা লুকোনো যায়। বাড়িতে চাল-ডালের টান। সকালে নাশতা হয়নি। বেচাবিক্রি না হলে দুপুরে রান্না হবে না। সাঈমা বরাবর যেমন আশপাশের কারো বাড়ি থেকে কিছু চাল-ডাল কিংবা দু-চারটে আলু বা সবজি নিয়ে আসে, হয়তো তেমন চেষ্টা করবে। রাকিবের এসব ভালো লাগে না। কার সহ্য হয়? কত দিন কত মাস চলবে লকডাউন? অতিমারির দিনকাল? এই বছরও কি এমনভাবে পেরিয়ে যাবে? মানুষ যেমন যুগে যুগে বসন্ত-কলেরা-ফ্লু-প্লেগ হাজারও রোগের টিকা বা ওষুধ আবিষ্কার করে মানব সভ্যতাকে বাঁচিয়ে রেখেছে, এবারো নিশ্চয়ই তেমন সাফল্য আসবে, জীবনের সুস্থ জয়গান পুনরায় শুরু হবে; কিন্তু কবে? এমন সব এলোমেলো ভাবনা-দুর্ভাবনার ছকবাঁধা ছবির মধ্যে সেই প্রশ্ন ধোঁয়াশার মতো জেগে ওঠে। কবে মিলবে মুক্তি?
আকাশে সূর্য তার সকল উত্তাপ ঢেলে দিয়েছে। রাস্তায় হেঁটে চলা বিস্রস্ত মানুষজনের চেহারায় বেচাবিক্রির সম্ভাবনা খুঁজে পাওয়া অনেক কঠিন। তখন কেউ শাটার তোলা অর্ধেক দোকান থেকে বাইরে বেরিয়ে আসে। দোকানদার উঁচু বারান্দায় দাঁড়িয়ে দূরে সতর্ক তাকাতে থাকে।
‘আ বে গাড়ি আসছে… গাড়ি। বন্ধ কর… বন্ধ কর।’
দোকানের শাটার দুদ্দাড় বন্ধ হতে থাকে। এর অর্থ ম্যাজিস্ট্রেট আসছে। লকডাউন সময়। মানুষজনের ঘর থেকে বাইরে বেরোনো নিষেধ। তারপর নাক-মুখ মাস্কে ঢেকে রাখতে হবে। মোবাইল কোর্টের জরিমানা গুনতে হবে। আজকাল প্রাথমিক শাস্তি হিসেবে কান ধরে ওঠবস করতে হয়। রাকিব কোথায় লুকোয়? সে খুব দ্রুত পুবের রাস্তা ধরে হেমায়েত আলি লাইব্রেরি মসজিদের দিকে ভ্যান ঠেলে নিয়ে যেতে থাকে। আসলে সে কোথায় পালায় কোথায় আশ্রয় খোঁজ জানে না। জীবনের সকল অস্তিত্ব বুঝি আজ দিগভ্রান্ত পাখির মতো নিরাপদ জায়গা অনুসন্ধানে দিশাহারা। রাকিব জানে না কবে আসবে স্বস্তির দিনকাল। এমন সময়েও পেট মোচড় দিয়ে ওঠে। ক্ষুধা কিছু বোঝে না। ক্ষুধা সব খেতে চায়।

তখন আচমকা কোনো জিপের মৃদুমন্দ শব্দ খুব দ্রুত কাছে এসে থমকে দাঁড়ায়।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়