রাজপথ বিএনপির বাপ-দাদার সম্পত্তি নয় : কাদের

আগের সংবাদ

সাফ জয়ীদের লাগেজ ভাঙল কে

পরের সংবাদ

প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশের ৩ বছর পরও হয়নি মেডিকেল ইউনিট : কারা চিকিৎসায় ভরসা ‘ডেপুটেশন’!

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ২২, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: সেপ্টেম্বর ২২, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

কামরুজ্জামান খান : কারাগারে বন্দিদের চিকিৎসাসেবা নিয়ে ভোগান্তি ও অভিযোগের কমতি নেই। কারা হাসপাতাল ও চিকিৎসা কেন্দ্রে নামমাত্র সেবার সুবিধা থাকায় দীর্ঘদিন অসুস্থ এমন বন্দিরা গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। কারা হাসপাতাল ও চিকিৎসাকেন্দ্রে বছরের পর বছর ধরে চিকিৎসক ও জনবল সংকট থাকলেও তা নিরসন হচ্ছে না। এই সুযোগে অসুস্থ ও সুচিকিৎসার কথা বলে অনেক বন্দি কারাগারের বাইরের হাসপাতালে চিকিৎসার সুযোগ পাচ্ছেন। পরে তারা অসুস্থ বিবেচনায় আদালতে আবেদন করে জামিনও পাচ্ছেন। অনেক বন্দি হাসপাতালের প্রিজন সেলে পরিবার-স্বজনদের সঙ্গে নিয়মিত সাক্ষাৎ, বৈঠক এমনকি জুম মিটিংয়েও অংশ নিচ্ছেন। কারাগারের বাইরে হাসপাতালে বন্দির চিকিৎসার ব্যবস্থা করিয়ে দেয়ার জন্য ডেপুটেশনে থাকা অনেক চিকিৎসকের বিরুদ্ধে বাড়তি সুবিধা নেয়ার অভিযোগ আছে। আবার কারাগারে পদায়ন করা হলেও অনেক চিকিৎসক যোগ দিতে চান না- এমন অভিযোগও রয়েছে।
এ প্রসঙ্গে কারা মহাপরিদর্শক (আইজি-প্রিজন) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এ এস এম আনিসুল হক ভোরের কাগজকে বলেন, মেডিকেল ইউনিট চালু করার জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে একটি বিশেষ ইউনিট গঠন করা হয়েছে। তারা মেডিকেল ইউনিটের জন্য কাজ করছেন।
তিনি বলেন, কোভিডের সময় অনেক চিকিৎসককে সংযুক্ত করা হয়েছিল। তাদের অনেকে এখনো সেবা দিচ্ছেন। এছাড়া প্রেষণে পদায়ন করা পাঁচজন চিকিৎসক রয়েছেন। সংকটের মধ্যে সহকারী সার্জন, নার্স, ডিপ্লোমা অ্যাসিসটেন্ট ও ফার্মাসিস্টের সমন্বয়ে সাধ্যমতো সেবা দেয়া হচ্ছে বলেও জানান তিনি।
আনিসুল হক বলেন, কেন্দ্রীয় কারাগারগুলোতে হাসপাতাল রয়েছে। অন্যসব কারাগারে চিকিৎসা কেন্দ্র রয়েছে। সেখানে প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়া হয়।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অতিরিক্ত সচিব (কারা অনুবিভাগ) সৈয়দ বেলাল হোসেন জানান, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (অতিরিক্ত দায়িত্ব: মেডিকেল অনুবিভাগ) রুহী রহমানের নেতৃত্বে এই মেডিকেল ইউনিট গঠনের কাজ চলছে। মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করলে রুহী রহমান এ প্রসঙ্গে কথা বলতে রাজি হননি।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কারা অনু বিভাগের (সুরক্ষা সেবা) উপসচিব পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ করে ভোরের কাগজকে জানান, কারাগারে চিকিৎসায় সংকট দীর্ঘদিনের। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে ডেপুটেশনে চিকিৎসক নিয়ে কার্যক্রম চালানো হয়। সিভিল সার্জন অফিস থেকে সব সময় চাহিদা মেটানো হয়। পুলিশ ও কারাগারের জন্য পৃথক মেডিকেল ইউনিট গঠনের কাজ চলছে। কারা অধিদপ্তরের এআইজি

(প্রশাসন) মাইন উদ্দীন জানিয়েছেন, সবকটি কারাগারে সবমিলিয়ে ৬৯টি হাসপাতাল বা চিকিৎসা কেন্দ্র রয়েছে। প্রতিটি কারাগারে হাসপাতাল ভবন আছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ১০ শয্যার চিকিৎসা কেন্দ্র রয়েছে এমন কারাগারও আছে। ১৪১ জনের স্থলে পাঁচজন চিকিৎসক আছে। এছাড়া সিভিল সার্জন অফিস থেকে সংযুক্ত আছেন ৯০ জন চিকিৎসক।
ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. মাহমুদুল হাসান বলেন, ৮ কেন্দ্রীয় কারাগারসহ অনেক কারাগারে হাসপাতাল রয়েছে। এছাড়া আছে চিকিৎসা কেন্দ্র। বগুড়া, কক্সবাজার, সিরাজগঞ্জসহ যেসব জেলার কারাগারে সহ¯্রাধিক বন্দি রাখার ব্যবস্থা আছে সেসব কারাগারে হাসপাতাল আছে।
মুন্সীগঞ্জ কারাগারে আউটডোরে চিকিৎসা দেয়া হয় জানিয়ে তিনি বলেন, কুড়িগ্রাম ও গাইবান্ধা কারাগারে চিকিৎসা কেন্দ্র নেই। আরএমও চিকিৎসা দেন সেখানে। মাহমুদুল হাসানের মতে, ৬৮ কারাগারের অর্ধেকে হাসপাতাল বা চিকিৎসা কেন্দ্র আছে। ঝামেলা এড়াতে চিকিৎসকরা কারাগারে চাকরি করতে চান না বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, ২০১৯ সালের ২০ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পরিদর্শনে গেলে জানানো হয়, দেশের কারাগারগুলোতে ধারণক্ষমতার চেয়ে কয়েক গুণ বন্দির চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে প্রেষণে আসা অল্পসংখ্যক চিকিৎসক দিয়ে। কারা কর্তৃপক্ষ গুরুতর রোগীদের অনেকটা বাধ্য হয়ে অন্যত্র চিকিৎসা করাচ্ছে। পরে প্রধানমন্ত্রী স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে আলাদা মেডিকেল ইউনিট গঠনের নির্দেশ দেন। তবে, তিন বছর পার হলেও এর কার্যক্রম শেষ হয়নি। নিয়োগবিধি চূড়ান্ত করাসহ নানা জটিলতায় সেই প্রক্রিয়া চলছে ধীর গতিতে।
কারা সদর দপ্তরের তথ্যমতে, কারাগারে চিকিৎসার জন্য দুই হাজার ২১০ শয্যা রয়েছে। কাশিমপুর-২ কারাগারে ২০০ শয্যা, ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ১৭২ শয্যা হাসপাতাল রয়েছে। ৬৮টি কারাগারের ধারণ ক্ষমতা ৪২ হাজার ৬২৬। সবসময় ৮০ হাজারের বেশি বন্দি থাকে। যা ধারণ ক্ষমতার দ্বিগুণ। ২১ আগস্ট পর্যন্ত সারাদেশে বন্দি ছিল ৮৫ হাজার ৬৭৭ জন। বন্দিদের চিকিৎসায় স্থায়ী চিকিৎসকের পদ ১৪১টি। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে হাসপাতালে চিকিৎসক মাত্র দুজন। ১৪১ পদের মধ্যে ঢাকা বিভাগে ২৭টি, ময়মনসিংহে ছয়টি, রাজশাহীতে ১১টি, রংপুরে ৯টি, চট্টগ্রামে ১৭টি, সিলেটে ছয়টি, খুলনায় ১৫টি ও বরিশালে সাতটি চিকিৎসকের পদ রয়েছে। চিকিৎসক পদ রয়েছে ১৪১টি। এছাড়া সিভিল সার্জন কার্যালয়ের ৯৩ জন চিকিৎসক সংযুক্ত রয়েছেন, যাদের প্রয়োজন হলে ডেকে আনতে হয়। তারা সপ্তাহে দু-এক দিন কারাগারে গিয়ে চিকিৎসা দেন। তবুও সংকট ৪৩ জন চিকিৎসকের। অনুমোদিত ১৪১ পদের বিপরীতে চিকিৎসক শূন্য ১৩৬টি।
কারাবন্দিদের চিকিৎসাসেবা দেয়ার জন্য ৬৮টি কারা হাসপাতালে সহকারী সার্জনের ৭০টি, মহিলা সহকারী সার্জনের ১২টি, প্যাথলজিস্ট ১২টিসহ মোট ১৪১ পদ সৃষ্টি করা হয়েছে। এসব পদের বিপরীতে মাত্র পাঁচজন কর্মরত আছেন। অধিকাংশ কারাগারে শুধু ইসিজি পরীক্ষার সুযোগ রয়েছে। আর কয়েকটি কারাগারে এক্স-রে করা যায়।
ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ইসিজি মেশিন থাকলেও এক বছর ধরে নতুন এক্স-রে মেশিন পড়ে আছে। ফরিদপুর কারাগারে চিকিৎসক নেই, কাজ চালাচ্ছেন ফার্মাসিস্ট। বন্দিদের চিকিৎসাসেবা দিতে কারা হাসপাতালে সহকারী সার্জনের ৭০টি, মহিলা সহকারী সার্জনের ১২টি, প্যাথলজিস্ট ১২টিসহ মোট ১৪১ পদ তৈরি করা হয়েছে। কিন্তু শূন্য পদ রয়েছে ১৩৬টি। অর্ধেকের বেশি বন্দি চল্লিশোর্ধ্ব। তাদের বেশির ভাগই একাধিক জটিল রোগে আক্রান্ত। পরিস্থিতি সামাল দিতে সিভিল সার্জন কার্যালয়ের ৯০ জন চিকিৎসককে অস্থায়ীভাবে সংযুক্ত করা হয়েছে। তবু সংকট ৪৩ জন চিকিৎসকের। কারা হাসপাতালে যেকোনো রোগে প্যারাসিটামল, হিসটাসিন ও স্যালাইন ছাড়া অন্য ওষধ মিলে না বলে বন্দিদের অভিযোগ রয়েছে।
ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ১১ সেপ্টেম্বর রবিবার প্রাপ্ত তথ্য মতে, সেখানকার বন্দি ৯ হাজার ১৪৫ জন। সেখানকার বন্দিদের মধ্যে রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ১৯ জন। কক্সবাজারের জেলার গোলাম মোস্তফা জানিয়েছেন, সেখানে দুইজন চিকিৎসক রয়েছেন।
এদিকে মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্য মতে, ২০১৮ সালের জানুয়ারি থেকে গত জুলাই পর্যন্ত কারাগারে ৩২৮ জন বন্দির মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে সাজাপ্রাপ্ত বন্দির সংখ্যা ১২৩ ও আটক ২০৫ জন। বছর হিসেবে ২০১৮ সালে ৭৪ জন, ২০১৯ সালে ৫৮ জন, ২০২০ সালে ৭৫ জন, ২০২১ সালে ৮১ জন ও ২০২২ সালের জুলাই পর্যন্ত ৪০ জন বন্দির মৃত্যু হয়েছে। গত ছয় বছরে জেলখানায় মারা গিয়েছেন কমপক্ষে ৪১৯ জন বন্দি।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়