কাগজ প্রতিবেদক : চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের দুই মাসে রিজার্ভ থেকে ২৫৬ কোটি ৯০ লাখ (২ দশমিক ৫৭ বিলিয়ন) ডলার বিক্রি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক, যা অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে রেকর্ড। মূলত স্থিতিশীলতা ফেরাতে রিজার্ভ থেকে ধারাবাহিকভাবে ডলার বিক্রি করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। গত সপ্তাহের শেষ দিন গত বৃহস্পতিবারও কয়েকটি ব্যাংকের কাছে ৭ কোটি ৬০ লাখ ডলার বিক্রি করা হয়েছে।
ডলার বিক্রির বর্তমান হার অব্যহত থাকলে অর্থবছর শেষে দাঁড়াবে ১৫ বিলিয়ন ডলার। গত ২০২১-২২ অর্থবছরে যা ছিল এর অর্ধেক। গত অর্থবছরে রিজার্ভ থেকে ৭ দশমিক ৬৭ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করা হয়।
অবশ্য ২০২০-২১ অর্থবছরে ছিল উল্টো চিত্র। ওই বছর বাজারে ডলারের সরবরাহ বাড়ায় দর ধরে রাখতে রেকর্ড প্রায় ৮ বিলিয়ন (৮০০ কোটি) ডলার কিনেছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
এদিকে ডলার বিক্রির চাপে আরো কমেছে রিজার্ভ। রিজার্ভের অন্যতম প্রধান উৎস প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স বাড়ার পরও গত বৃহস্পতিবার দিন শেষে বাংলাদেশের রিজার্ভ ৩৯ দশমিক ০৫ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে।
আগামী সপ্তাহে এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) জুলাই-আগস্ট মেয়াদের আমদানি বিল পরিশোধের পর অর্থনীতির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর এই সূচক আরো কমে ৩৮ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে আসবে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা।
গত ১২ জুলাই আকুর প্রায় ২ বিলিয়ন ডলার আমদানি বিল পরিশোধের পর রিজার্ভ ৪০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে আসে। এরপর ২০ জুলাই পর্যন্ত রিজার্ভ ৩৯ দশমিক ৮০-৪০ বিলিয়ন ডলারের মধ্যে ওঠানামা করে। জুলাইয়ের শেষে তা কমে ৩৯ দশমিক ৫০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে আসে। রেমিট্যান্স বাড়ায় জুলাইয়ের শেষের দিকে রিজার্ভ বেড়ে ৩৯ দশমিক ৭০ বিলিয়ন ডলারে ওঠে। ডলার বিক্রির কারণে তা ফের নিম্নমুখী হয়। অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গত বছরের আগস্টে রিজার্ভ ৪৮ বিলিয়ন ডলারের যে মাইলফলক অতিক্রম করেছিল, তাতে বাজার থেকে ডলার কেনার অবদান ছিল বলে জানান অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংকাররা।
আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি ও প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্স কমায় গত অর্থবছরের আগস্টের পর থেকে দেশে ডলারের সংকট দেখা দেয়া দেয়। রপ্তানি আয় বাড়লেও ডলারের সংকট কাটছিল না। ফলে প্রতিনিয়ত বেড়েছে ডলারের দাম। এজন্য রিজার্ভ থেকে ডলার ছেড়ে বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। প্রতিনিয়ত দামও বাড়িয়েছে। এরপরও নিয়ন্ত্রণে আসছে না ডলারের তেজিভাব।
দুই সপ্তাহ ধরে বাংলাদেশ ব্যাংক ৯৫ টাকা দরে ব্যাংকগুলোর কাছে ডলার বিক্রি করলেও ব্যাংকগুলো এখনো ১০৪-১০৬ টাকা দরে নগদ ডলার বিক্রি করছে। রেমিট্যান্স সংগ্রহ করছে ১০৫-১০৫ টাকায়। আর এলসি (ঋণপত্র) খুলতে আমদানিকারকদের কাছ থেকে প্রতি ডলারের জন্য ১১০ টাকার বেশি নিচ্ছে।
করোনা মহামারির কারণে ২০২০-২১ অর্থবছরজুড়ে আমদানি বেশ কমে গিয়েছিল। কিন্তু প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয়ে উল্লম্ফন দেখা যায়। সে কারণে বাজারে ডলারের সরবরাহ বেড়ে যায়। সে পরিস্থিতিতে ডলারের দর ধরে রাখতে ওই অর্থবছরে প্রায় ৮ বিলিয়ন ডলার কিনেছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
কিন্তু আগস্ট থেকে দেখা যায় উল্টো চিত্র। করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে শুরু করায় লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে থাকে আমদানি ব্যয়। রপ্তানি বাড়লেও কমতে থাকে রেমিট্যান্স। বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভও কমতে থাকে। বাজারে ডলারের চাহিদা বেড়ে যায়, বাড়তে থাকে দাম। বাজার স্থিতিশীল রাখতে আগস্ট থেকে ডলার বিক্রি শুরু করে বাংলাদেশ ব্যাংক, চলে পুরো অর্থবছর। সেই ধারাবাহিকতায় চাহিদা মেটাতে নতুন অর্থবছরেও (২০২২-২৩) ডলার বিক্রি অব্যাহত রেখেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য মতে, গত বছরের ৫ আগস্ট আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারে প্রতি ডলার ৮৪ টাকা ৮০ পয়সায় বিক্রি হয়। এক বছরেরও বেশি সময় ধরে ওই একই জায়গায় স্থির ছিল ডলার। এর পর থেকেই বাড়তে থাকে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিধর অর্থনীতির দেশ যুক্তরাষ্ট্রের মুদ্রার দর। এ হিসাবে আন্তব্যাংক মুদ্রাবাজারে এক বছরে টাকার বিপরীতে ডলারের দাম বেড়েছে ১২ শতাংশের বেশি।
এদিকে রিজার্ভ কমার কারণ হিসেবে অর্থনীতির গবেষক পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ও ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান আহসান এইচ মনসুর বলেন, রিজার্ভ কমার প্রধান কারণ হচ্ছে, আমদানি ব্যয় অস্বাভাবিক বৃদ্ধি। এই ব্যয় বাড়ার অবশ্য কারণ ছিল, জ্বালানি তেল, খাদ্যপণ্যসহ বিশ্ববাজারে সব ধরনের পণ্যের দাম বেড়েছে। জাহাজ ভাড়া বেড়েছে দুই গুণ-তিন গুণের মতো।
তবে মনে রাখতে হবে, গত বছরের আগস্টে আমাদের রিজার্ভ যে ৪৮ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছিল, তাতে কিন্তু দর ধরে রাখতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাজার থেকে ৮ বিলিয়ন ডলারের মতো কিনেছিল তার একটা অবদান ছিল।
আর এখন গত অর্থবছর এবং নতুন অর্থবছরের দুই মাসে মোট ১০ বিলিয়ন ডলারের বেশি বিক্রি করেছে, সে কারণেই কিন্তু রিজার্ভ ৩৯ বিলিয়ন ডলারে নেমে নেমেছে। আকুর জুলাই-আগস্টের বিল শোধের পর ৩৮ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে আসবে।
তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার বলেছেন, সর্বোচ্চ দুই মাসের মধ্যে ডলারের বাজার স্বাভাবিক হয়ে আসবে। গত ২৭ আগস্ট বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অফ ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট (বিআইবিএম) আয়োজিত ‘নবম বার্ষিক ব্যাংকিং কনফারেন্স’-এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে গভর্নর বলেন, মহামারি করোনার পর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে চ্যালেঞ্জিং সময় পার করছে বাংলাদেশ। গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার পর পরই আমি সব ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের সঙ্গে কথা বলেছি। তাদের সমস্যা ও সম্ভাবনা জানার চেষ্টা করেছি। এখন যে সমস্যা (ডলার সংকট) দেশে বিরাজ করছে এটি বেশি দিন থাকবে না। সর্বোচ্চ দুই মাসের মধ্যেই সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে।