শিনজো আবের প্রতি বিএনপির শ্রদ্ধা

আগের সংবাদ

ভোট ঘিরে তৎপর কূটনীতিকরা

পরের সংবাদ

হারিয়ে যাওয়া চিঠি

প্রকাশিত: জুলাই ১৫, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জুলাই ১৫, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

সব মানুষের জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল চিঠি। সব প্রকার যোগাযোগ-কুশলাদি জানার, ভাব বিনিময়সহ সার্বিক প্রয়োজনে চিঠির গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। চিঠির কোনো বিকল্প ছিল না। মনের কথা, প্রাণের কথা, ভাব-চিন্তার কথা প্রকাশের একমাত্র অবলম্বন ছিল চিঠি। চিঠিতে প্রকাশ পেত মানুষের তাবৎ মনের নানা কথা। পরিবার-পরিজনের সাথে সব যোগাযোগ-প্রয়োজন মেটাত চিঠি। আমাদের সাহিত্যের সব শাখায় চিঠিকে কেন্দ্র করে রচিত হয়েছে প্রচুর রচনা সম্ভার। আমাদের খ্যাতিমান প্রচুর কবি-সাহিত্যিকদের রচনায় চিঠিকে কেন্দ্র করে রচিত হয়েছে অনেক সাহিত্যকর্ম। বাস্তবে চিঠি ছিল আমাদের জীবনেরই অপরিহার্য অংশ। চিঠির ব্যাপক ব্যবহার ছিল প্রায় প্রত্যেকের ক্ষেত্রে। আজকের বাস্তবতায় সেই চিরচেনা চিঠি কেবল উপেক্ষিত নয়; প্রায় বিলুপ্তির পথে। চিঠির আবেদন-গুরুত্ব সবই ফুরিয়েছে। চিঠি আর কেউ লিখে সময় অপচয় করে না। অথচ চিঠি লেখার দক্ষতা ও পারদর্শিতার জন্য অনেকে চিঠি-সাহিত্যিকের মর্যাদা পর্যন্ত পেতেন। তার কাছে ছুটে যেত কত মানুষ কেবল চিঠি লেখানোর জন্য।
চিঠি লেখার জন্য বিশেষ ধরনের নীল কাগজের প্যাড পাওয়া যেত। সেই প্যাডের উপরে পাখির ঠোঁটে চিঠির খাম মুদ্রিত এবং পাশে ছাপার অক্ষরে লেখা থাকত-‘ভুলনা আমায়’, ‘মনে রেখো’, ‘যাও পাখি বল তারে-সে যেন ভোলে না মোরে’ ইত্যাদি নানা কথা। যাদের সঙ্গতি ছিল তারা সেসকল নীল প্যাডের কাগজে চিঠি লিখে পাঠাত প্রিয়জনকে। এ যেন এক হারানো পৃথিবীর হারানো সময়ের স্মৃতি। অনেকের কাছে বিশ্বাস করাও কঠিন। চিঠির ভাষা ও শব্দ প্রয়োগে সৃজনশীলতা নিয়ে একরকম প্রতিযোগিতা পর্যন্ত ছিল। আত্মীয়-পরিজন ছাড়াও পত্রবন্ধুদের সাথে পত্রালাপের সংস্কৃতি ছিল। যা কালের গর্ভে আজ বিলীন হয়েছে। চিঠি লেখার মধ্য দিয়ে ভাষাজ্ঞান ঋদ্ধ ও সমৃদ্ধ করার সুযোগ ছিল। ভাষাজ্ঞান, শব্দ গঠন ও প্রয়োগে চিঠির ভূমিকাকে অস্বীকারের উপায় নেই। একটি চিঠিকে অনেকবার খসড়া করে তবেই চূড়ান্ত করে প্রাপকের কাছে পাঠানো হতো। চিঠির সর্বজনীন ব্যবহার যেমন ছিল, তেমনি ছিল চিঠির রোমান্টিক আবেদন। চিঠিকে কেন্দ্র করে কত হৃদয়বিদারক ঘটনাও ঘটত। মানুষের হাসি-কান্না, আনন্দ, দুঃখ, বিরহ-বেদনা, শোক বার্তা সবই বয়ে আনত চিঠি। চিঠির সেই ব্যাপক আবেদন-গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা আজ আর নেই। চিঠির স্থানটি বেদখল হয়ে গেছে। হাল আমলের মোবাইল ফোন পুরোপুরি দখলে নিয়েছে চিঠির সংস্কৃতি। তাই চিঠি হয়েছে অপ্রয়োজনীয় কালক্ষেপণের এক মাধ্যম মাত্র। সেকেলে এবং পশ্চাৎপদ সংস্কৃতির অপবাদ নিয়ে বিলুপ্তির প্রান্তে।
প্রিয়জন বা নিকটজনের সংবাদ জানতে চিঠির জন্য ব্যাকুল হয়ে ধৈর্যের পরীক্ষা আর দিতে হয় না। প্রেরক এবং প্রাপক কাউকে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় প্রহর গুনতে হয় না। প্রয়োজন হয় না সময়ক্ষেপণের ক্লান্তিকর প্রতীক্ষার। তাৎক্ষণিকভাবে কাক্সিক্ষত যে কারো সাথে মুহূর্তে যোগাযোগ স্থাপন করা যায়। পরস্পরের সঙ্গে বলা যায় কথাও। বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রার এই যান্ত্রিক যুগে সবকিছুই তাৎক্ষণিকভাবেই মানুষের নাগালে এখন। আমাদের চিরচেনা চিঠির সংস্কৃতি এখন সোনালি অতীত। আমাদের অনেক খ্যাতিমান সাহিত্যিকের রচনার হাতে খড়ি ছিল চিঠি লেখা, যা তারা অনেকে স্বীকারও করে গেছেন। আজকের প্রজন্মের কাছে চিঠির প্রয়োজন-গুরুত্ব কোনোটিই নেই। থাকার কথাও নয়। তারা অনায়াসে মুহূর্তে যেখানে ইচ্ছে নাম্বার টিপে কথা বলতে পারছে। দেশে-বিদেশে সর্বত্র। সেখানে কেন অকারণে সময় অপচয় করবে! বিজ্ঞানের এই অগ্রযাত্রায় ইতির পাশাপাশি নেতির দিকটি যে নেই, তা কিন্তু নয়। নেতির দিকটি কি আমরা বিবেচনা করছি? আজকের প্রজন্ম মোবাইল, ওয়েভ, ইমেইল, কম্পিউটার, স্যাটেলাইট সংস্কৃতিতে নিমজ্জিত। তাদের মেধা ও মনন বিকাশে যান্ত্রিকতার বিরূপ প্রভাব অস্বীকার করি কীভাবে? চিঠি লেখার অনভ্যস্ততায় কর্মজীবনে প্রাতিষ্ঠানিক কাজে চিঠি লিখতে তাদের যে বিড়ম্বনায় পড়তে হবে না এই সত্যটি কি অস্বীকার করা যাবে? যান্ত্রিকতার ভিড়ে তাদের মধ্যে সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চা ও জ্ঞান অর্জনের পাঠাভ্যাস গড়ে ওঠার উপায় আছে? সেটা কি ভাবনার কারণ নয়? আমাদের চিরচেনা সংস্কৃতি মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানে হয়েছে অচেনা এবং অপাংক্তেয়। আজকের তরুণদের কাছে আমাদের সেই চিরচেনা সংস্কৃতি হাস্যকর এবং উপেক্ষিত। আমাদের ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি, দর্শন ও ইতিহাস ভিত্তিক রচনা আজকের প্রজন্মকে তেমন আকর্ষণ করে না। এটা কি ভাবনার বিষয় নয়? সমষ্টির বাইরে এসে তারা ব্যক্তিগত প্রতিষ্ঠার জন্য রীতিমতো প্রতিযোগিতায় শামিল হয়েছে। পাস-টাস করে ঠাস্-ঠাস্ উপরে উঠে যাবার প্রবণতায় ব্যস্ত। সেই সিঁড়িটির খোঁজেই তারা অধীর ব্যস্ত, যে সিঁড়িটি তাদের ব্যক্তিগত উন্নতির চূড়ান্ত শিখরে পৌঁছে দেবে। সমষ্টিগত চিন্তা তাদের চিন্তাজগতে সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। একটি জাতির সমষ্টিগত উন্নতির বিপরীতে চলছে ব্যক্তিগত উন্নতির প্রতিযোগিতা। এতে ব্যক্তির উন্নতি সাধন হলেও সমষ্টি রয়ে যাচ্ছে আলোহীন অন্ধকারে। সমষ্টিগতভাবে আমরা হয়ে পড়েছি অনগ্রসর। এতে সমষ্টিগত মানুষের প্রাপ্তি কোথায়?
চিঠির ব্যাপক আদান-প্রদানে একমাত্র গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ডাক বিভাগের। কর্মব্যস্ত ডাক বিভাগও আজ আর অতীতের ন্যায় কর্মমুখর নেই। চিঠি লেখার প্রয়োজন ফুরিয়ে যাবার সাথে সাথে ডাক বিভাগের কর্মপরিধিও সংকুচিত হয়েছে। ডাক বিভাগ এখন কর্মমুখর সচল কোনো প্রতিষ্ঠান নয়। অচল এবং অলস এক রাষ্ট্রীয় ভর্তুকির প্রতিষ্ঠানে পরিণত। যা ইতোমধ্যে রাষ্ট্রের বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কর্মব্যস্ত ডাক বিভাগের নানা অনিয়ম-অসঙ্গতি ছিল সাধারণ বিষয়। যথা সময়ে বা নির্দিষ্ট প্রাপকের হাতে চিঠি পৌঁছানোও ছিল অনেক ক্ষেত্রে দুর্লভ ব্যাপার। চিঠি খোয়া যাবার ঘটনাও অতি সাধারণ বিষয় ছিল। এজন্য প্রতিষ্ঠানটির কোনো জবাবদিহিতা ছিল না। প্রাপকের চিঠি বেহাত হবার মূলে ছিল চিঠি বিলি-বণ্টনে নিয়োজিত ডাক পিওনদের অনৈতিক অপকীর্তি। একান্ত ব্যক্তিগত চিঠির ক্ষেত্রে ডাক পিওনদের উপঢৌকন দিয়ে হাতে রাখতে হত। চিঠি যেন খোয়া না যায় কিংবা বেহাত না হয় সেজন্য ডাক পিওনদের মাসোহারা পর্যন্ত দিতে হত। ডাক পিওনদের অপকীর্তির মাশুল গুনে কত চিঠির প্রাপককে অভিভাবকদের দ্বারা তিরস্কারের শিকার হতে হয়েছে। চিঠির প্রেরক বা প্রাপক নারী হলে চিঠির গোপনীয়তা ফাঁসে পারিবারিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে রীতিমতো অসম্মানজনক অবস্থার মুখোমুখি হতে হতো। কত সুন্দর সম্পর্ক মুকুলে বিনষ্ট পর্যন্ত হয়েছে ডাক পিওনদের অনৈতিক দায়িত্বহীন অপকর্মে।
সঙ্গত কারণেই ডাক বিভাগের ওপর মানুষের আস্থা না রেখে উপায় ছিল না। বিকল্প ব্যবস্থার অভাবে ইচ্ছের বিরুদ্ধে হলেও ডাক বিভাগের ওপরই বাধ্য হয়ে নির্ভর করতে হতো। আজকে আধুনিক প্রযুক্তির আগমনে ই-মেইল, ফ্যাক্সে চিঠি যেমন প্রেরিত হয়, পাশাপাশি হয় বেসরকারি কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমেও। বেসরকারি কুরিয়ার ডাক বিভাগের বিকল্পরূপে রাষ্ট্রীয় ডাক বিভাগের অস্তিত্বকে বিপন্ন করে তুলেছে। ডাক বিভাগের শক্ত প্রতিপক্ষ এবং বিকল্পরূপে মানুষের আস্থাও অর্জন করেছে। চিঠি, ডকুমেন্ট, পার্সেল, অর্থ প্রেরণসহ ডাক বিভাগের তাবৎ কর্মের বিকল্প রূপে বেসরকারি কুরিয়ার সার্ভিসগুলো মানুষের কাছে আস্থাশীল হয়ে উঠেছে। এতে ডাক বিভাগের কর্মপরিধি সংকুচিত এবং হুমকির মুখে এখন। স্বেচ্ছাচারিতার মাশুল এখন গুনতে হচ্ছে খোদ ডাক বিভাগকেই। রাষ্ট্রীয় ডাক বিভাগের দ্বিগুণ খরচে মানুষ বেসরকারি কুরিয়ার সার্ভিসে আস্থাবান হয়ে পড়েছে। বেসরকারি কুরিয়ার সার্ভিসের সাথে পাল্লা দিতে না পেরে বিশাল ডাক বিভাগ এখন অন্তিম প্রহর গুনছে। ডাক বিভাগের সেবার মান অতি নিম্নমানের এবং বিড়ম্বনাময় বলেই মানুষের আস্থা-ভরসা তারা হারিয়েছে। পাঁচ টাকা খরচে একটি চিঠি নির্দিষ্ট সময়ে প্রাপকের হাতে পৌঁছুবে কিংবা আদৌ পৌঁছুবে কিনা-তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। অথচ দ্বিগুণ দশ টাকা খরচে বেসরকারি কুরিয়ার পরদিনই নির্দিষ্ট প্রাপকের হাতে ডাক পৌঁছে দেবার নিশ্চয়তা দিয়ে থাকে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই কুরিয়ার সার্ভিসের ডাক বিলি-বণ্টনের সাফল্য প্রমাণিত। আর রাষ্ট্রীয় ডাক বিভাগ স্বীয় ব্যর্থতার দায় নিয়ে রাষ্ট্রের লোকসানি প্রতিষ্ঠানে পরিণত। সেবার স্থলে দুর্ভোগ দিয়ে দিয়ে মানুষের আস্থা হারিয়ে নিজেরাই অন্তিম দুর্ভোগে পতিত।
আমাদের দেশের কোনো সরকারই ডাক বিভাগের আধুনিকায়নসহ সংস্কার করেনি। সেকেলে ব্যবস্থাপনার কারণে প্রতিষ্ঠানটি যুগোপযোগী হয়নি, হয়নি আধুনিকও। তাই যুগের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এগোতে পারেনি। ক্রমেই পিছিয়ে পড়েছে। প্রতিষ্ঠানটির সর্বস্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা মাস শেষে বেতন নিয়মিতই পেয়েছে। নিশ্চিত বেতন প্রাপ্তিতে বর্তমান দুরবস্থায় তাদের হয়নি সামান্য সচেতনতা এবং দায়িত্বশীলতাও। তাদের দায়িত্বহীন বেপরোয়া আচরণ অতীতের ন্যায় অটুটু রয়েছে। প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার ক্ষেত্রে তাদের বোধ বিবেচনার সামান্য পরিবর্তন হয়নি। তারা অতীতমুখী এবং অতীতের পথেই হাঁটছে। ডাক বিভাগ কেবল অলাভজনকই নয়; রাষ্ট্রের আর্থিক ভর্তুকির এক নজরকাড়া প্রতিষ্ঠান। যা রাষ্ট্রের জন্য অনভিপ্রেত বোঝা। এই বোঝা সরকার কতদিন বইবে তা নিকট ভবিষ্যৎই বলে দেবে।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়