শিনজো আবের প্রতি বিএনপির শ্রদ্ধা

আগের সংবাদ

ভোট ঘিরে তৎপর কূটনীতিকরা

পরের সংবাদ

রবীন্দ্র-নজরুল সাহিত্য সম্মেলন ও কবি মজিদ মাহমুদ

প্রকাশিত: জুলাই ১৫, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জুলাই ১৫, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

‘সভায় যেতে আমার বুক কাঁপে, পার্টির নামে দৌড়ে পালাই, কিন্তু আড্ডা। ও না-হ’লে আমি বাঁচি না। বলতে গেলে ওরই হাতে আমি মানুষ। বই প’ড়ে যা শিখেছি তার চেয়ে বেশি শিখেছি আড্ডা দিয়ে’-এভাবেই উত্তরতিরিশ (১৯৪৫) প্রবন্ধগ্রন্থের ‘আড্ডা’ নিবন্ধে কবি বুদ্ধদেব বসু (১৯০৮-১৯৭৪) তাঁর মানুষ হওয়ার কথা আমাদেরকে জানিয়েছেন, জানিয়েছেন শেখার কথা। পাবনায় ‘রবীন্দ্র-নজরুল সাহিত্য সম্মেলনে’ কবি মজিদ মাহমুদের কথা শুনে আমার উপলব্ধি হলো- বক্তব্য শুনেও অনেক কিছু শেখার আছে। তবে সবার বক্তব্য নয়, সব সময় নয়। জীবনাভিজ্ঞতায় বলতে পারি, বক্তব্য শুনে সিংহভাগ সময় বিরক্ত হলেও কবি মজিদ মাহমুদের বক্তব্য বাস্তবিকই মুগ্ধ করেছিল, মুগ্ধ হয়েছিলেন উপস্থিত দর্শক-শ্রোতাও।

দুই.
মজিদ মাহমুদের প্রায় বাইশ মিনিটের বক্তব্যে সহস্রবর্ষের সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসের সারসংক্ষেপ লক্ষ্য করা যায়। মজিদ মাহমুদের বক্তব্যের সারভাগে ছিল রবীন্দ্র-নজরুল ও বঙ্গবন্ধুর সাংস্কৃতিক সাযুজ্য। রবীন্দ্রমানসে মুসলিম সমাজ উপেক্ষিত বলে অনেকের অভিযোগ থাকলেও মজিদ মাহমুদের বক্তব্যে বরং রবীন্দ্রমানসে মুসলিম সাংস্কৃতিক প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। পিতা ঊনত্রিশ দিন পূর্বে মুসলিম সমাজ নিয়ে রবীন্দ্রনাথের ‘মুসলমানির গল্প’, একেশ্বরবাদ ভাবনা (ব্রহ্মবাদ), পিতামহ প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের (১৭৯৪-১৮৪৬) সৎকার-পদ্ধতি নিয়ে পারিবারিক মতভেদ ইত্যাকার নানা ঘটনার মধ্য দিয়ে মজিদ মাহমুদ রবীন্দ্রমানসে মুসলিম সাংস্কৃতিক প্রভাবের কথা স্মরণ করিয়ে দেন; স্মরণ করিয়ে দেন ষাটোর্ধ্ব বয়সের নোবেল বিজয়ী কবি হয়েও বাইশ-তেইশ বছরের তরুণ কবি নজরুলকে স্বীকৃতি দেয়ার কথা।
জমিদার-নন্দন হলেও পারিবারিক জীবনে একে একে আপনজনের বিয়োগবেদনায় রবীন্দ্রনাথের জীবনে নেমে এসেছিল মৃত্যুর মিছিল। এই দিক থেকে মজিদ মাহমুদ রবীন্দ্র-নজরুল-জীবনের সাযুজ্য দেখিয়ে দেন। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে সঙ্গে নজরুলের নাম উচ্চারিত হওয়া, নিম্নবিত্ত থেকে বাংলা সাহিত্যে বাঙালি মুসলমানের অংশীদারিত্বের বিষয়টি তিনি দেখিয়ে দেন। দেখিয়ে দেন রবীন্দ্রনাথের দুঃখ, কিভাবে নজরুলে আরো তীব্রতর হয়ে উঠেছিল, আর এই দুই মহাপুরুষের সকল দুঃখের সমন্বয় ছাড়িয়ে গিয়েছিল বঙ্গবন্ধুর জীবনের বিয়োগান্তক ঘটনা।

তিন.
মজিদ মাহমুদের বক্তব্য সংক্ষিপ্ত হলেও পূর্বকালের সঙ্গে বর্তমানের একটা সমন্বয় লক্ষ্য করা যায়। যুগ যুগ ধরে, কালকাল ধরে ধর্ম-বর্ণ-সম্প্রদায় ও সাংস্কৃতিক কারণে বাঙালি জাতি বিচ্ছিন্নতার বেড়াজালে বিপন্ন ছিল। এই বিপন্ন বাঙালি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯-১৯৭৬) বাঙালির জয় কামনা করেছিলেন। ‘বাঙলার জয় হোক, বাঙালির জয় হোক’-স্লোগানের মধ্য দিয়ে নজরুল ইসলাম মূলত বাঙালির স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখেছিলেন।
দেশভাগে (১৯৪৭) নজরুলের স্বপ্ন বিপন্ন হলেও বছর কয়েকের মধ্যে ভাষার ভিত্তিতে বাঙালি ঐক্যবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে যায় এবং সিকি শতাব্দীর মধ্যে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাংলাদেশ স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। বক্তব্যে মজিদ মাহমুদ বাংলাদেশকে প্রধানত বাঙালির সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ফসল বলে উল্লেখ করেন।

চার.
মজিদ মাহমুদের বক্তব্যের পুরোভাগে ছিল রবীন্দ্র-নজরুল ও বঙ্গবন্ধু এবং এই তিন মহান ব্যক্তিত্বের সাংস্কৃতিক সম্পর্ক ও সাযুজ্য। সেই সঙ্গে ‘জয়বাংলা’ শব্দের উৎপত্তি ও নজরুলের স্বাধীনতার স্বপ্ন কীভাবে বঙ্গবন্ধুর নেতুত্বে বাস্তবায়িত হয় সেই পূর্বাপর ইতিহাস। স্বাধীন বাংলাদেশে স্বাধীনতার প্রথম জয়ন্তী উদযাপন এবং কবির তিয়াত্তরতম জন্মদিন উপলক্ষে স্বাধীনতার কবি কাজী নজরুল ইসলামকে বঙ্গবন্ধু কীভাবে বাংলাদেশে নিয়ে এসেছিলেন, অর্থ ও বাড়ি বরাদ্দ করেছিলেন- ইতিহাসের এসব অনুপঙ্খু ঘটনা মজিদ মাহমুদের বক্তব্যে দারুণভাবে উঠে আসে। সেই সঙ্গে মজিদ মাহমুদ আরো একটি প্রশ্ন উত্থাপন করেন।
বাংলাদেশ স্বাধীন না হলে পাকিস্তানে কত শতাংশ মানুষ রবীন্দ্র-নজরুল চর্চা করত? প্রশ্নের সঙ্গে সঙ্গে তিনি পাকিস্তান আমলে এ অঞ্চলে রবীন্দ্রসংগীতের বিরোধিতা এবং নজরুল সাহিত্য সংশোধনের কিছু ষড়যন্ত্রের কথাও তুলে ধরেন। অর্থাৎ মজিদ মাহমুদ খানিকটা এ কথাও বলেন যে, স্বাধীন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু রবীন্দ্র-নজরুল চর্চার পথ কিছুটা হলেও প্রশস্ত করে দিয়েছেন।
বিষয়টি মজিদ মাহমুদ সাহিত্যে বঙ্গবন্ধু মহাজীবনের মহাকাব্য (২০২১) গবেষণাগ্রন্থে বেশ বিস্তারিতভাবে পর্যালোচনা করেছেন। এপ্রসঙ্গে ‘তিনি কেন সেরা বাঙালি’ ও ‘শ্রীনীরোদ চৌধুরীর শ্রেষ্ঠ বাঙালি প্রকল্প ও বঙ্গবন্ধু’ প্রবন্ধটি দুটি পাঠ করা যেতে পারে।

পাঁচ.
একটি বিষয় লক্ষণীয়, পাবনার এই সাহিত্য সম্মেলনের শিরোনাম ছিল ‘রবীন্দ্র-নজরুল জয়ন্তী উপলক্ষে সাংস্কৃতিক উৎসব-২০২২’। আলোচনার পরিপূর্ণতার জন্য মজিদ মাহমুদ বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে এসেছেন। তবে নজরুলকে একটু বেশি প্রাধান্য দিতে দেখা যায়। এর কারণও আছে।
মজিদ মাহমুদ সুদীর্ঘ প্রায় চারদশক নজরুল চর্চা করছেন। নজরুল তৃতীয় বিশ্বের মুখপাত্র (১৯৯৭), নজরুলের মানুষধর্মসহ (২০০৩) বেশকিছু গবেষণাগ্রন্থ তিনি ইতোমধ্যে লিখেছেন। সম্প্রতি ‘তুমি শুনিতে চেয়ো না’ শিরোনামে মজিদ মাহমুদ নজরুলের জীবন ভিত্তিক একটি উপন্যাস রচনা করেছেন। এটি গ্রন্থাকারে প্রকাশিত না হলেও কবি সোহেল হাসান গালিব সম্পাদিত অনলাইন পত্রিকা ‘পরস্পর’এ পড়ার সৌভাগ্য হয়েছে। বিদ্রোহী রণক্লান্ত (২০১৮) রচনার পর গুণি-গবেষক গোলাম মুরশিদ (জ. ১৯৪০) ‘প্রথম আলো’য় কলাম লিখে অনেকটা ঘোষণা দিয়ে জানিয়েছিলেন যে, নজরুল নিয়ে নতুন কিছু আবিষ্কারের খুব একটা সম্ভাবনা নেই। আমাদেরও অনেকটা তা-ই মনে হয়েছিল।
কিন্তু মজিদ মাহমুদের ‘তুমি শুনিতে চেয়ো না’ গ্রন্থটির মধ্য দিয়ে নজরুলকে নিয়ে নতুন করে ভাবার সুযোগ ও সম্ভাবনার ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে। নজরুলকে নিয়ে নজরুল গবেষক ও পাঠককে নতুন করে ভাবতে হবে।

ছয়.
কবি মজিদ মাহমুদের বক্তব্যের আদ্যান্ত লক্ষ্য করলে দেখা যায়, উপস্থাপনাশৈলীতে প্রাবন্ধিকসুলভ আচরণ বেশি লক্ষ্য করা গেছে অর্থাৎ তত্ত্ব ও তথ্য উপস্থাপনে ছিল বেশ যৌক্তিক দৃঢ়তা। মাত্র একুশ-বাইশ মিনিটের মধ্যে সহস্রবর্ষের বাঙালির সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসের সারবত্তা তিনি উপস্থাপন করেছেন।
বলতে চাই, সহস্র পাতা পাঠের মতো উপযোগিতা এই ছোট্ট বক্তব্যটির মধ্যে সন্নিহিত ছিল। অনুষ্ঠানে সাহিত্যচর্চায় বিশেষ অবদানের জন্য মাননীয় সংসদ সদস্য (পাবনা-৫) গোলাম ফারুক প্রিন্স কবি মজিদ মাহমুদের হাতে ‘রবীন্দ্র-নজরুল সাহিত্য পদক’ তুলে দেন। শিক্ষা ও সংস্কৃতিতে বিশেষ অবদানের জন্য পাবনার প্রবীণ শিক্ষাবিদ ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব প্রফেসর মোহাম্মদ কামরুজ্জামান এবং প্রফেসর শিবজিত নাগকে ‘রবীন্দ্র-নজরুল সাহিত্য পদক’ প্রদান করা হয়।
পদকপ্রাপ্ত তিন গুণী ব্যক্তিত্ব, ‘স্বাধীনতা ও বিজয় দিবস উদযাপন পরিষদ’সহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে অভিনন্দন; অভিনন্দন কবি মজিদ মাহমুদকে। সভাপতির বক্তব্যে মাননীয় সংসদ সদস্য গোলাম ফারুক প্রিন্স বলেন, মানুষের মনে আলো ছড়াতে, সাম্প্রদায়িক অন্ধকার দূর করতে কবি মজিদ মাহমুদদের মতো মানুষদের কথা আমাদের শুনতে হবে এবং তাদের কথা বলার সুযোগ করে দিতে হবে।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়