শিনজো আবের প্রতি বিএনপির শ্রদ্ধা

আগের সংবাদ

ভোট ঘিরে তৎপর কূটনীতিকরা

পরের সংবাদ

যুদ্ধকন্যা

প্রকাশিত: জুলাই ১৫, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জুলাই ১৫, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

তেরো-চৌদ্দ বছরের নীলিমা মুক্তিযুদ্ধ শুরুর মাত্র ২ দিন আগে বিয়ে হওয়ার পর শ্বশুরবাড়ি এসেছে। এর মধ্যে যুদ্ধের দামামা বেজে উঠল। নীলিমা তেমন কিছুই বোঝে না বা বোঝার সুযোগ তেমন হয়নি। কারণ মেয়ে বলতে যা হয় নীলিমাও তার ব্যতিক্রম নয়। লেখাপড়া তেমন একটা হয়নি। বুদ্ধি হতে না হতেই বুঝেছে তাকে বিয়ে করে শ্বশুরবাড়ি যেতে হবে।
বিয়ের দুদিন পরই চারদিকে আয়োজন চলতে লাগলো কে কোথায় পালাবে। বাড়ি ছেড়ে, কোন দিকে গেলে সুবিধা হবে। এর মধ্যে নীলিমার বর অর্থাৎ সদ্য বিবাহিত পুরুষটি যুদ্ধে যাওয়ার প্রস্তুতি নিয়ে বিদায় নিল। যাওয়ার সময় মায়ের হাতটি ধরে বলল, মা যেন বউকে দেখে রাখে। সামনে এসে দাঁড়াতেই তার স্বামী নির্বাকচিত্তে তাকিয়ে আছে নিলীমার দিকে। কী বলবে সে বুঝতে পারছে না। যে মেয়েটা তার জীবনের একটা অংশ হয়ে দাঁড়াল, তাকেই রেখে অনিশ্চিত পথে যাত্রা। জানেনা ফিরবে কিনা। শুধু বুকের মধ্যে শক্ত করে চেপে ধরে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। কপালে চুম্বন দিয়ে মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলল, সাবধানে থেকো। দুজনই চোখের জল আড়াল করে সামনে থেকে সরে গেল।
বিয়ের মাত্র দুদিন পর যে মেয়ে স্বপ্নে বিভোর হয়ে নতুন জীবন শুরু করার কথা, সে কিনা প্রস্তুতি নিচ্ছে তার স্বামীকে বিদায় জানাতে। মাথার ওপর শূন্য আকাশ ছাড়া কিছুই নীলিমার চোখে পড়ে না। এখনো তার পায়ে আলতার দাগ, গায়ে ফুলের গন্ধ। ভোরে ফুটে ওঠা সূর্যটাও আজ খুব অচেনা মনে হচ্ছে।
স্বামীকে বিদায় দিয়ে সে নিজেও তৈরি হচ্ছে মাত্র দুদিনের নতুন সংসার থেকে নিরুদ্দেশের যাত্রায় পাড়ি দিতে। শাশুড়ির কথামতো যা যা সাথে নিতে বলল। তা-ই সঙ্গে নিয়ে রওনা হয়ে গেল দূর পাহাড়ের উদ্দেশে। জানে না সে কোথায় যাচ্ছে। বারবার জানতে চাওয়াতে শাশুড়ি হাত দিয়ে যেদিকে ইশারা করে তা শুধুই পাহাড়ের ছায়া। প্রথমে নদী তারপর পাহাড় আবার নদী আবার পাহাড়। এবার শুধুই পাহাড় বেয়ে বেয়ে উঠতে হচ্ছে। এর মধ্যে নীলিমার শাড়ি বেশ ক’বার খুলে যাওয়ার উপক্রম। শাশুড়ি একটা কাপড়ের পাড় দিয়ে নীলিমার কোমরে শক্ত করে বেঁধে দিল।
শাশুড়ি তার খুব ভালো। দুর্দিনে নীলিমাকে নিজের মেয়ের মতো করে আগলে রেখেছেন। নীলিমা বিয়ের আগে থেকেই শাশুড়িকে চিনত। দূরসম্পর্কে আত্মীয় তারা। এ কারণে নীলিমার মধ্যে নতুন বউ হলেও জড়তা কিছুটা কম। তাই সে শাশুড়ির পায়ে পায়ে তাল মিলিয়ে হাঁটতে চেষ্টা করে। কিন্তু কিছু দূর যাওয়ার পরই বসে পড়ে। শাশুড়ি একটু পরপর নীলিমাকে শুকনো খাবার ও পানি দেন। তাদের সাথে কিছু খাবার কিছু কাপড় আর একটা বড় গয়নার বাক্স। সাথে একটি নারকেলের মালাতে কিছু কয়লা ও ছাইনিয়েছেন। যা নিরাপত্তার উপকরণ বলা যায়।
এভাবে কিছু দূর যাওয়ার পরে নীলিমার শাশুড়ি নীলিমাকে মুখে হাতে পায়ে ঐ নারকেলের মালা থেকে কিছু কালি মাখিয়ে দিলেন। যাতে নীলমার সৌন্দর্য কারো চোখে না পড়ে। নীলিমার শাশুড়ি বেশ বুদ্ধিমতি মহিলা। পথে তাদের সঙ্গীও অনেক। সবার সাথে কথা বলতে বলতে তিনি বুঝতে পারতেন কে কোন উদ্দেশ্য নিয়ে কথা বলেছে। এভাবে অবশেষে তারা এক পাহাড়ের মাথায় আশ্রয় নিয়েছে।
পাহাড়ের কোল ঘেঁষে নদী। অঞ্চলটা সাঙ্গু নদী বেয়ে বান্দরবান যাওয়ার পথ। এই পথে রয়েছে সারি সারি পাহাড়। এই পাহাড়ে দিন সাতেক থাকার পর একদিন নীলিমার শাশুড়ি নীলিমাকে নদীতে স্নান করাতে নিয়ে যান। হঠাৎ দেখেন দুজন লোক নীলিমার দিকে হাত দেখিয়ে কী যেন বলছে। নীলিমার শাশুড়ির বুঝতে দেরি হলো না এরা হানাদার বাহিনীর চামচা। নীলিমার সারা শরীরে কালি মাখিয়ে দেন তিনি। ঐ দিন সন্ধ্যায় নীলিমাকে নিয়ে তিনি ঐ পাহাড় ছেড়ে আরকটি পাহাড়ে চলে যান। রাত হওয়ার আগে পৌঁছে যান তাদের দ্বিতীয় ঠিকানায়। নীলিমা জানে না এখানে তাদের ক’দিন ঠাঁই হবে। প্রতিরাতেই এক একটি বীভৎস চিত্র সে দেখেছে। কখনো কারো বউ কখনো বা কারো পুত্র। রাজাকারের লোক এসে ডেকে বা জোর করে নিয়ে গেছে। তারা আর ফিরে আসেনি। নীলিমা ভাবে এভাবে তারা কি আর ঘরে ফিরতে পারবে না কি কোন এক রাতই তাদের শেষ রাত হবে। স্বামীর জন্য মনটা আকুলি-বিকুলি করে তার। মাত্র দুদিন স্বামীকে দেখেছিল। জানে না এখন কেমন আছে, কোথায় আছে। শাশুড়ির কাছে জানতে চায় কিন্তু কোনো উত্তর পায় না। রাত হলেই অজানা ভয় চেপে বসে নিলীমার বুকে। অনিদ্রায়, আতঙ্কে কাটে প্রতিটি রাত।
এভাবেই কয়েকদিন চলে গেল। নীলিমার শাশুড়ি প্রতিদিন ভোরে অন্ধকারে নীলিমাকে নদীতে স্নান করিয়ে কালি মাখিয়ে দেন। নীলিমার অপূর্ব সৌন্দর্য সেই কালিমাখা চেহারার নিচে চাপা পড়ে প্রতিদিন। বয়স ও সৌন্দর্য মিলে নীলিমাকে নিয়ে শাশুড়ির দুশ্চিন্তার শেষ ছিল না। নীলিমার প্রতি সেবাযতœও কমতি ছিল না। এরকম দুঃসময়ে শাশুড়ি সারাক্ষণ আগলে রাখেন। যেন কোনো রাজাকারের চোখে না পড়ে। কিন্তু নীলিমার চোখ কোনো কিছুই এড়িয়ে যায় না। রাজাকারের লোকগুলো ঘুরে বেড়ায়। নিজেকে খুব সাবধানে আড়াল করে রাখে সে। কিছু দিন যেতে না যেতেই, নীলিমার শাশুড়ি জানতে পারলেন, রাজাকাররা তাদের অবস্থান ও নীলিমার সৌন্দর্যের কথা জেনে গেছে। এদিকে খবর পেয়েছে নীলিমার স্বামী যুদ্ধে গিয়ে কলেরায় আক্রান্ত হয়েছে। শাশুড়ি নীলিমাকে কিছু জানাননি। খবরটি সত্য না মিথ্যা যাচাই করার সুযোগ নীলিমার নেই। শুধু নীরব প্রার্থনা ঘুরে বেড়ায় নীলিমার নিশ্বাসে-বিশ্বাসে।
নীলিমার শাশুড়ি নিয়মিত লোক মারফত গ্রামের খবর রাখেন। ছেলের খবরও তিনি লোক মারফত পেতেন। জানেন না সত্য মিথ্যা তারপরও দুশ্চিন্তার শেষ নেই। পরদিন তারা আবার আগের পাহাড়ে ফিরে গেল। সেখানে এই গ্রামের অনেকজন আছে। অনেকে গরুর বাছুরও সাথে এনেছে। পোষা প্রাণীটাকেও ছেড়ে আসতে পারেনি। আবার অনেকে কোনো কিছুই সাথে আনতে পারেনি। শুধু পরনের কাপড় আর কিছু খাবার। এখানে থাকলে নীলিমার শাশুড়ি একটু স্বস্তি পান। কিন্তু নীলিমার মন অস্থির হয়ে ওঠে। কারণ এই চেনা মুখগুলো তার কাছে অচেনা। তবে এখানেও বেশি দিন থাকতে পারল না। পালাক্রমে চলতে লাগল এই পাহাড় ওই পাহাড়। এর মধ্যে অনেকদিন ছেলের কোনো খবর পাননি নীলিমার শাশুড়ি। তাই নিজেই নদীপথে গ্রামের কাছাকাছি এক জায়গায় খবর নিতে যান। নীলিমা কোনো কিছুই বুঝতে পারে না কী করবে সে। যুদ্ধের বিভিন্ন চিত্রে তার মধ্যে আতঙ্ক গ্রাস করেছে। এভাবে সারাদিন যায়। শাশুড়ি ফিরে এসে তাকে জানান চিন্তার কোনো কারণ নাই। তার স্বামী ভালো আছে। তবুও নীলিমার মনে কেমন যেন লাগে। দেশের এই ভয়ানক অবস্থায় বাবা মা কেউ কাছে নাই। জানে না তারা কেমন আছে। প্রতিটা রাত ভয়ে বুক ভারি হয়ে যায় নীলিমার। চাপা কান্নায় সূর্য উঠার অপেক্ষা করে।
রাত হলেই আতঙ্ক আর দিন হলে পালিয়ে বেড়ানো হানাদারের ভয়ে। এভাবে চলতে চলতে প্রায় নয় মাস কেটে গেল। শুনেছে এখন অনেকটা শান্ত হয়েছে পরিবেশ। গ্রামে ফিরতে পারবে। নীলিমা নদীর জলে সেই কালিমাখা শরীরটা দেখে আর ভাবে এই রকম কালি মেখে থাকতে থাকতে হয়তো সে এই রকম কালোই হয়ে যাবে।
যুদ্ধ শেষ খবর পেয়ে ফিরছে বাড়ি। নৌকায় নীলিমা ও তার শাশুড়ি সঙ্গে বড় গয়নার বাক্সটি। নৌকায় আরো তিনজন যাত্রী। সামনের ঘাটে দুজন নেমে যায়। এখন তাদের নৌকায় তার দুজন ছাড়া এক ভদ্রলোক আছেন। কথা প্রসঙ্গে জানতে পারে ভদ্রলোক একজন স্কুল শিক্ষক। সামনের ঘাটে ভদ্রলোক নেমে যাবেন। তারা আগেই দূর থেকে ঘাটের পারে কয়েকজন লোক সবার জিনিস চেক করে মূল্যবান জিনিস নিয়ে নিচ্ছে। এই অবস্থায় নীলিমার শাশুড়ি চিন্তা করে তার গয়নার বাক্সটি ভদ্রলোকটিকে নিয়ে যেতে বললেন। লোকটি অবাক হয়ে রইল। তখন নীলিমার শাশুড়ি বললেন, তিনি এতদিন কষ্ট করে যে গয়নার বাক্সটি রক্ষা করেছেন তা হানাদারদের ভোগ করতে দেবেন না। তার চেয়ে দেশের মানুষ খাওয়া অনেক ভালো।
গয়নার বাক্সটি নিয়ে ভদ্রলোক নেমে গেলেন। মুহূর্তেই যেন দুঃস্বপ্ন এসে ভর করে। পরের ঘাটে হানাদার বাহিনীর কিছু লোক নৌকায় ওঠে সব তছনছ করে দেয়। হামলে পড়ে নীলিমার শরীরের ওপর। কী বীভৎস গন্ধ-মুখভর্তি পান। শিউরে ওঠে নীলিমার শরীর। এত দিন যে সম্ভ্রম রক্ষা করার যুদ্ধ সে করেছে আজ বুঝি সব শেষ। চঞ্চল হয়ে ওঠে রক্তের নদী। ধাক্কা মেরে মুক্ত হয় নীলিমা। তার শরীরে হাত বুলিয়ে দানবটা নিজের আক্রোশের কিঞ্চিৎতৃষ্ণা মিঠানোর চেষ্টা করে। বলে উঠে (কুচ নেহি হে) তখনো নীলিমার শরীর কাঁপছে। মুহূর্তেই যেন কিছু না পেয়ে নীলিমার কোমরে একটি বিশেষ গোটা (বিচি জাতীয়) যা নজর না লাগার জন্য দেয়া হয়। সেটিকে মূল্যবান কিছু মনে করে নিয়ে নেয়। তারপর দেখে ফেলে দেয়। দানবগুলো চলে যাওয়ার পর শাশুড়ি নীলিমাকে জড়িয়ে ধরে বলল- আমি আছি, কিছু হয়নি তোর। যা হয়েছে সমস্ত কিছুই এখন নদীর জলে ভাসিয়ে দে।
অবশেষে তারা বাড়ি ফিরল। বাড়ির ক্ষয়ক্ষতি তেমন হয়নি। নীলিমার মন অস্থির, স্বামী ও বাবা মা সবার জন্য। দিন যায় এভাবে হঠাৎ একদিন নীলিমার স্বামী ফিরে আসে। শরীর, চেহারা, আগের মতো কিছুই নেই। মৃত-প্রায় স্বামীকে দেখে অচেনা কোন পুরুষ মনে হচ্ছে নীলিমার। কাছে যেতে ভয় ও জড়তা কাজ করছে। মাত্র নয় মাসের ব্যবধানে যেন কোন দীর্ঘপ্রাচীর তাদের দুজনের মাঝে দাঁড়িয়ে আছে।
যুদ্ধে গিয়ে কলেরায় আক্রান্ত হয়ে প্রায় মৃত্যুশয্যায় ছিল। চৌদ্দ বছরের নীলিমা নয় মাসের জীবনযুদ্ধে যেন জয়ী হওয়া এক সৈনিক।
বছরখানেক পর তাদের বাড়িতে সেই ভদ্রলোকটি এসে হাজির। যার হাতে নীলিমার শাশুড়ি তার সমস্ত গয়না রাখা বাক্সটি তুলে দিয়েছিলেন। সবাই অবাক লোকটিকে দেখে। লোকটি নীলিমার শাশুড়িকে বাক্সটি দিয়ে জানান পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার অপেক্ষায় ছিলেন তিনি। এরপর খবর পেয়ে নিশ্চিত হয়ে তাদের আমানত তাদের ফিরিয়ে দিতে এসেছেন।
নীলিমাও একজন যোদ্ধা। যুদ্ধ করেছে নিজের সাথে। নিজের সুন্দর শরীরটা কালি মেখে আড়াল করে রেখেছে হায়েনাদের চোখ থেকে। নারীসত্তার অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়