করোনার ভুয়া রিপোর্ট : সাবরিনা-আরিফসহ আটজনের মামলার রায় ১৯ জুলাই

আগের সংবাদ

মসলার বাজারে ঈদের আঁচ : খুচরা বাজারে দামের উল্লম্ফন, ডলার সংকট ও এলসি জটিলতার অজুহাত

পরের সংবাদ

মোহাম্মদ মামদুদুর রশীদের আনন্দযাত্রা

প্রকাশিত: জুলাই ১, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জুলাই ১, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

মোহাম্মদ মামদুদুর রশীদের প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থ ‘পথ চলাতেই আনন্দ’। ১৪৩ পৃষ্ঠার বইটি পড়ে আবিষ্কার করলাম মামদুদুর রশীদ ক্যাডেট কলেজে পড়ার সময় সাহিত্যচর্চায় উৎসাহিত হন। গ্রন্থের ভেতর বাংলা এবং বিশ্বসাহিত্যের অসংখ্য গ্রন্থের উল্লেখ আছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে কবিতা কিংবা উপন্যাসের অংশবিশেষের উদ্ধৃতি আছে। এমনকি বিখ্যাত সব চলচ্চিত্রের প্রসঙ্গও এসেছে নিজের অনুভূতি কিংবা বিশ্লেষণ উপস্থাপন করার জন্য। লেখকের নানা অনুভূতির মালায় সজ্জিত হয়েছে গ্রন্থটির সূচি। মোট ৫টি পর্বের পরিচয় এ রকম-
ভ্রমণ অংশে আছে- কোয়ারেন্টিনের প্রহরগুলো, সাফারিরর রোজনামচা : মাসাই মারা, কেনিয়া, অপূর্ব এক ভ্রমণের সুখস্মৃতি, বার্লিনে একটি সন্ধ্যা ও একটি সকাল, উড়োজাহাজের নববর্ষ। পরিবার ও বন্ধু পর্বে রয়েছে- প্রৌঢ়ত্বের বিক্ষিপ্ত ভাবনাগুলো, তাঁর বয়স বাড়েনি, তাঁর বয়স বাড়ে না, খুঁজে ফেরা এবং তারপর…, শুধুই একটি ছবির খোঁজে, রিইউনিয়নের উপরি প্রাপ্তি, অরকা হোম ও হোসেনপুর, মুসলিম একাডেমিতে একটি মনোজ্ঞ সন্ধ্যা। স্মৃতিকথা অংশে রোমন্থিত হয়েছে- স্মৃতিতে আম-দুধ, আহ্, চলে আমার সাইকেল, হাওয়ার বেগে উইড়া উইড়া, ছুটির দিন মানেই একটু বেশি, সেই একশ কিলোমিটার। ব্যক্তিগত অনুভূতির তিনটি নিবন্ধ যথাক্রমে- কিছু নেই, তবু আছে, হর্ষের বর্ষা, বর্ষার হর্ষ, অলস বিকেল। সমাজ ভাবনা অংশে সংকলিত হয়েছে- পাগলটা কোথায়- একটি অভিজ্ঞতা এবং অনুভূতি, জীবনের স্বপ্ন ও গল্প : উদীয়মান তারুণ্যের পাথেয় ও প্রেরণা, পাশবিক, নাকি অমানবিক। গ্রন্থের ফ্ল্যাপে লেখক সম্পর্কে বলা হয়েছে- ‘স্বভাবগতভাবে কিছুটা অন্তর্মুখী চরিত্রের হলেও পেশাগত কারণে তা ঝেড়ে ফেলে তাকে হতে হয়েছে আপাত বহির্মুখী। লেখকের নিজের ভাষায়-বৈপরীত্যের। সীমার মাঝে সরল দোলকের মতোই দোদুল্যমান তিনি। ভ্রমণ পছন্দ করেন বরাবর। তাই মাঝে মাঝেই বেরিয়ে পড়েন অজানার উদ্দেশ্যে। তারই কিছু কিছু লিখে রাখেন। বই পড়েন অনেক। মানুষ এবং সমাজ নিয়ে ভাবেন। তার ভাবনার কিছু কিছু প্রকাশ পেয়েছে তার লেখায়।’
সর্বমোট ২০টি প্রবন্ধ-নিবন্ধ মিলে ‘পথ চলাতেই আনন্দ’ গ্রন্থে মোহাম্মদ মামদুদুর রশীদ পাঠককে নিবিড় মমতায় আঁকড়ে ধরেছেন। লেখকের জীবনে ‘পথ’ একটি তাৎপর্যপূর্ণ বিষয়। কারণ তাকে অতিক্রম করতে হয়েছে দীর্ঘ ও বন্ধুর সরণি। আমরা জানি মানুষ তার জীবদ্দশায় বিচিত্র পথে বিচরণ করে। রবীন্দ্রনাথের ‘লিপিকা’র ‘পায়ে চলার পথ’ রচনার কথা মনে পড়ছে। সেখানে তিনি লিখেছেন- ‘এই পথে কত মানুষ কেউবা আমার পাশ দিয়ে চলে গেছে, কেউবা সঙ্গ নিয়েচে, কাউকে বা দূর থেকে দেখা গেল; কারো বা ঘোম্?টা আছে, কারো বা নেই; কেউবা জল র্ভতে চলেছে, কে,বা জল নিয়ে ফিরে এল।… একদিন এই পথকে মনে হয়েছিল আমারই পথ, একান্তই আমার; এখন দেখ্চি কেবল একটিবার মাত্র এই পথ দিয়ে চল্বার হুকুম নিয়ে এসেচি, আর নয়।’ কেবল পায়ে চলার পথ নয় মোহাম্মদ মামদুদুর রশীদ আনন্দ খুঁজে পেয়েছেন পরিবারে পিতা-মাতা, স্ত্রী-সন্তানের কাছে, আত্মীয়-স্বজনের মাঝে, বন্ধুদের আস্তানায়। জীবনের অন্তবিহীন পথচলায় অনেক দেশ ভ্রমণ করেছেন। সেখানে পরিচয় ঘটেছে নতুন ভূগোলের বাসিন্দাদের সঙ্গে। মেঠোপথ কিংবা বনবীথির আঙিনায় অথবা উড়োজাহাজে লেখকের গতিময় জীবনের চমৎকার সব বর্ণনায় পূর্ণ রয়েছে গ্রন্থটি। রাজপথ আর অলিগলি ঘুরে নিজেকে খুঁজে ফেরা আর মানুষ, দেশ ও সমাজ সম্পর্কে নিজের উপলব্ধি লিপিবদ্ধ করার প্রয়াসে কখনো বাস্তবতা প্রাধান্য পেয়েছে আবার কখনো বা তিনি কল্পনার ডানায় ভর দিয়ে উড়াল দিয়েছেন। বলাবাহুল্য, লেখকের জীবনের অভিজ্ঞতা বিপুল। এই অভিজ্ঞতা সঞ্চিত হয়েছে তার দেখার দৃষ্টি প্রসারিত বলেই। তিনি ভ্রমণ করেছেন বিশ্বের ২৩টি দেশ। তার কর্মজীবনের অনেকটা সময় কেটেছে ভারত ও অস্ট্রেলিয়াতে। বর্তমানে তিনি বাংলাদেশের অন্যতম ব্যাংক এনসিসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা।
‘পথ চলাতেই আনন্দ’ পাঠ করলে পাঠক দেখতে পাবেন, অফিসের কাজে অথবা ব্যক্তিগত প্রয়োজনে তিনি ঘুরে বেড়িয়েছেন কেনিয়ার মাসাই মারার বুনো প্রান্তরে, কখনো জার্মানিতে অবস্থানের সময় পরিপাটি জাদুঘরে ঘুরেছেন, কখনো বা ছাত্রজীবনে ভারত ভূখণ্ডের অলিতে গলিতে ঘোরার স্মৃতি রোমন্থন করেছেন ‘অপূর্ব এক ভ্রমণের সুখস্মৃতি’তে। আবার সিডনির হোটেলে কোয়ারেন্টিনে বসে তিনি ছুটে চলেছেন ‘মানসভ্রমণে’। ২০২০ সালে করোনা ভাইরাস মহামারি শুরু হলে লেখককে নভেম্বর মাসে কার্যব্যাপদেশে যেতে হয়েছে সিডনিতে। সেখানে ১৪ দিন হোটেলে একাকী অবস্থানের বিবরণ আছে ‘কোয়ারেন্টিনের প্রহরগুলো’ রচনায়। এই প্রবন্ধটি বাংলা সাহিত্যের অনন্য সংযোজন। কারণ কোভিড ১৯-এর অভিজ্ঞতা নিয়ে কিছু গল্প-উপন্যাস-প্রবন্ধের মধ্যে নিঃসন্দেহে মোহাম্মদ মামদুদুর রশীদ স্মরণীয় হয়ে থাকবেন ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে। এক একটি দিন-রাতের বর্ননায় ‘নিউ-নরম্যাল’ জীবনের আস্বাদ পাবেন পাঠক।
‘পথ চলাতেই আনন্দ’ গ্রন্থে জীবনে চলার পথে সঙ্গী হিসেবে পাওয়া পরিবারের সদস্যসহ বন্ধুদের প্রতি লেখকের অসীম ভালোবাসার কথা ফুটে উঠেছে ‘পরিবার ও বন্ধু’ পর্বের ৫টি নিবন্ধে। পিতা-মাতা, খালা-খালুর স্মৃতির পাশে অকালপ্রয়াত ক্যাডেট কলেজের বন্ধুর স্মৃতিকাতরতার বর্ণনা উন্মোচন করেছে লেখকের ভেতরের গোপন কষ্টকে ‘শুধুই একটি ছবির খোঁজে’ রচনায়। জীবনে মৃত্যু যে অনিবার্য তা লেখক জানেন কিন্তু অকাল প্রয়াত খালা কিংবা বন্ধুর বিদায় তার কাছে দুঃসহ বেদনার। কষ্ট ছাড়া যে জীবনে আনন্দ পাওয়া যায় না- এই দর্শনের প্রকাশ ঘটেছে এই পর্বের লেখাগুলোতে।
ব্যক্তিগত কথামালায় মোহাম্মদ মামদুদুর রশীদ নিজের অনুভূতি প্রকাশ করেছেন কাব্যিক ভাষায়। সেখানে বৃষ্টি-বর্ষা আর অলস বিকেলের রোদ লেগে আছে। তবে জীবনের সঙ্গে প্রকৃতি, জীবনের সঙ্গে স্বাস্থ্য এবং একান্ত সময়ের ভেতর নিজেকে খুঁজে ফেরা বাস্তবতা বিচ্যুত নয়। সেখানে বর্ষার বর্ণনা শেষে বন্যার কথা এসেছে। মানুষের দুর্ভোগ নিয়ে চিন্তিত লেখকের বক্তব্য প্রকাশ পেয়েছে। তবে সমাজ ও দেশ নিয়ে তার ভাবনা এবং দায়িত্ববোধের কথা তিনি ব্যক্ত করেছেন গ্রন্থের পঞ্চম পর্বে। তিনি অত্যন্ত সহজভাবে কিন্তু নাটকীয়ভঙ্গিতে নিজের ভাষ্য উপস্থাপন করেছেন। প্রতিবন্ধী জীবন ও তাদের জন্য করণীয় সম্পর্কে সুপারিশ যেমন গুরুত্বপূর্ণ তেমনি সমাজের ব্যাধি হিসেবে ধর্ষণের কথা লিখেছেন দরদ দিয়ে। তার মতে, সমাজকে প্রতিবন্ধীবান্ধব হতে হবে তেমনি অন্যায়, অনৈতিক কাজে লিপ্ত মানুষকে প্রতিহত করতে হবে পশুর সঙ্গে তুলনা করে নয় বরং তারা যে পশুর চেয়েও অধম সেই পরিচয়ে চিহ্নিত করতে হবে।
‘পথ চলাতেই আনন্দ’ গ্রন্থে লেখক মোহাম্মদ মামদুদুর রশীদের দীর্ঘদিনের সাহিত্যচর্চার ছাপ রয়েছে। দেশের বিভিন্ন পত্রিকায় তিনি তার অভিজ্ঞতা ও অনুভূতির কথা লিখেছেন। দেশের খ্যাতনামা লেখকরাও তাকে উৎসাহ জুগিয়েছেন। এজন্য গ্রন্থটির আঙ্গিকে রয়েছে সচেতন শিল্পীমনের অভিব্যক্তি, যা পাঠককে আন্দোলিত করার জন্য যথেষ্ট। তার এই পথযাত্রার ভিন্ন ভিন্ন গল্পগুলোকে এমনভাবে একত্রে মালা গাঁথা হয়েছে যা একে অপরের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। লেখকের গদ্য সরল ও সাবলীল। তার পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা এবং সরস বুদ্ধিদীপ্ত মন্তব্য ও নাটকীয় বর্ণনা সত্যিই অভিনব। যেমন, তিনি ‘বার্লিনে একটি সন্ধ্যা ও একটি সকাল’ প্রবন্ধের সূচনায় নাটকীয় ভঙ্গিতে লিখেছেন- ‘খ্রিষ্টপূর্ব সপ্তম শতক থেকে শুরু করে খ্রিষ্টাব্দ তৃতীয় শতক পর্যন্ত প্রায় এক হাজার বছর সময়ের ধাতব মুদ্রাগুলো দেখতে দেখতে অতীতের শিল্পী এবং কারিগরদের সম্পর্কে গভীর এক শ্রদ্ধাবোধ জাগলো।’ (পৃ. ৭৪)
মূলত গ্রন্থভুক্ত প্রবন্ধগুলোতে লেখকের মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি অসাধারণ। এছাড়া লেখক যেসব বিষয় এ গ্রন্থে একটির পর একটি প্রবন্ধে বর্ণনা করেছেন তা হয়ে উঠেছে সামষ্টিক জীবনের কথা। পাঠক তার নিজের জীবনকে সেখানে খুঁজে পাবেন। আর যে সমস্যাগুলো সম্পর্কে লেখকের নিজস্ব বক্তব্য প্রকাশ পেয়েছে তাকে মনে হবে যথার্থ। জীবনের ভিন্ন ভিন্ন চিত্রের মধ্যে নিজেকে খুঁজে পাওয়ার আবেদন শাশ্বত। গ্রন্থটির বহুল প্রচার কাম্য।

(পথ চলাতেই আনন্দ- মোহাম্মদ মামদুদুর রশীদ, রুটস, ঢাকা, ২০২১, প্রচ্ছদ : মাকসুদুর রহমান, মূল্য : ৪৫০ টাকা।)

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়