করোনার ভুয়া রিপোর্ট : সাবরিনা-আরিফসহ আটজনের মামলার রায় ১৯ জুলাই

আগের সংবাদ

মসলার বাজারে ঈদের আঁচ : খুচরা বাজারে দামের উল্লম্ফন, ডলার সংকট ও এলসি জটিলতার অজুহাত

পরের সংবাদ

দাগ

প্রকাশিত: জুলাই ১, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জুলাই ১, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

এই বছর শীতটা কিছুতেই কমছিল না দেখে অনামিকাকে নিয়ে মিরপুর দশের ‘সারা’ আউটলেটে চলে এলাম। সস্তায় শীতের পোশাক কেনার জন্য বেস্ট এই দোকান। পোশাক কিংবা যেকোনো ব্যবহারযোগ্য দ্রব্যের ক্ষেত্রে রঙিন বর্ণ আমার সবচেয়ে পছন্দ। আমি তাই ঘুরে ফিরে কালারফুল জ্যাকেটগুলোর দিকেই দেখছি। দামে কম, ডিজাইনগুলোও ইউনিক- তাই পছন্দের সবগুলোই কিনে নিতে ইচ্ছে হচ্ছিল আমার। অথচ বড়ো জোর আর মাসখানেক থাকবে এমন শীত। আর তাই এই বয়সেও বহু কষ্টে নিজের লোভ সংবরণ করলাম।
‘এটা পছন্দ হয়েছে আমার। কেমন লাগছে বলো তো? মানিয়েছে না?’ ধবধবে সাদা রঙের হুডিওয়ালা হাফ হাতা জ্যাকেট পরে ট্রায়াল রুম থেকে বেরিয়ে আমার সামনে এসে দাঁড়ালো অনামিকা। সত্যি বলতে, আমার বউটা দেখতে এত সুন্দরী যে, ও যা-ই পরুক না কেন, তাতেই ওকে মানাবে। সাদা পোশাকে আরো উজ্জ্বল লাগছে তাকে।
‘মানিয়েছে। কিন্তু তাই বলে এরকম সাদা জ্যাকেট কেউ কেনে? এটা তো কয়েক দিন পরলেই ময়লা হয়ে যাবে। এই তো এখানে পার্পেল কালারের ঠিক এরকম ডিজাইনেরই একটা জ্যাকেট আছে। এটা নিতে পারো’। আমি আমার ডান পাশের হ্যাংগারে ঝোলানো পার্পেল স্টকের দিকে আল তুলে দেখালাম।
‘না, না। এটাই নেব আমি। ময়লা হলে হবে। এই রঙের শীতের পোশাক আমার নেই। আর তাছাড়া আমার এটাই ভালো লাগছে।’
‘জি ম্যাডাম, আপনাকে এই জ্যাকেটে ভীষণ ভালো দেখাচ্ছে।’
পেছন থেকে সেলস গার্লের কথা শুনে আমার কিছুটা রাগও হলো।
এবার আর ফেরানো গেল না। কী আর করার? আমার জন্য দুটো সোয়েটার আর অনামিকার জন্য সাদা হুডি-জ্যাকেট নিয়ে বেরিয়ে এলাম। সাদা রঙের প্রতি এত আগ্রহ কেন মানুষের, কে জানে! কথা বাড়ালাম না। আজ নাইট ডিউটি আছে। বাসায় ফিরেই তৈরি হতে হবে হাসপাতালের উদ্দেশে।

দুই.
হ্যান্ডওভার বুঝে নিতে নিতেই জানতে পারলাম, ১০৪ নম্বর বেডে আবারো সেই রোগীটা ভর্তি হয়েছে- অনিল। আবারো বললাম কারণ ওর যখন মাত্র পাঁচ বছর বয়স, তখন থেকেই সে এই হাসপাতালের নিয়মিত রোগী। অতটুকু বয়সেই পায়ুপথকে বিশ্রামে রাখার জন্য কোলোস্টমি করে তার মলত্যাগের রাস্তা পেটের ডান পাশে করে দেয়া হয়। সে সময় ইন্টার্নশিপ শেষ করে মাত্র চাকরিতে জয়েন করেছি। অনিলকে ফলোআপ করতে গিয়ে দেখতে পেলাম; আকাশি রঙের শার্টের এক কোনায় হলদে রঙ লেগে আছে। খানিকটা ঘৃণাই লেগেছিল সেদিন। এখন অবশ্য ওসবে অভ্যেস হয়ে গিয়েছে।
অনিল ক্রোনস ডিজিজের রোগী ছিল প্রথমে। এরপর ধরা পড়ল এবডোমিনাল টিউবারকুলোসিস। শরীরে এলবুমিন কমে যাওয়ায়; গত সপ্তাহে আবার ভর্তি হয়েছে হাসপাতালে। ‘কেমন আছো, অনিল?’ ডান হাত দিয়ে কোঁকড়া চুলগুলো নেড়ে দিলাম। প্রতিবারই দিই।
বরাবরের মতোই ফিক করে হেসে দিল বারো বছরের কিশোর। ‘ভালোই তো আছিলাম স্যার’। হাসিটা এত নিষ্পাপ। আচ্ছা, এই নিষ্পাপ শিশুগুলোকেই কেন এত মারাত্মক সব শাস্তি দেয়া হয়?
‘তুমি স্কুলে ভর্তি হবে বলেছিলে?’
‘স্যার, আমি তো স্কুলে পড়ি এখন। ক্লাস থ্রিতে উঠসি। বলি নাই আপনেরে?’
আরে তাইতো। বছর দেড়েক আগে যখন টিবি নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল, তখনই তো বলেছিল এই কথা।
“হুম, মনে পড়েছে। তা পড়াশোনা কেমন হচ্ছে?’
‘পড়ালেখা তো ভালোই চলতেসিল স্যার। শুধু শার্টটা না ভিজলেই হইত। ক্লাস করতে করতে মাঝে মাঝেই সাদা শার্ট ভিজা হলুদ হইয়া যায়। সব্বাই তাকায় থাকে। ঘিন্নায় কেউ আমার ধারে-কাছে আসতে চায় না। তখন একটু কষ্ট লাগে, বুঝসেন?’
সত্যিই বিব্রতকর সিচুয়েশন। মাঝেমধ্যে আমিও ভাবি, পায়ুপথটা যদি জায়গামতো না থেকে পেটে হতো, তাহলে প্রতিটি মানুষেরই কতটা অদ্ভুত অসহায়ত্বের মধ্য দিয়ে যেতে হতো, তাই না? মলত্যাগ করব কি করব না, সেজন্য নার্ভের আলাদা সিগনাল কাজ করে শরীরে; পায়ুপথে আছে স্ফিংকটার বা দরজার মতো বস্তু। অথচ কলোস্টোমি করলে সেখানে কোনো স্ফিংকটার থাকে না। কাজ করে না নার্ভের সিগনাল। ছোট একটা ব্যাগে কলোস্টোমির রাস্তা দিয়ে স্টুল গড়িয়ে জমা হতে থাকে অনবরত। এখানে সেই মানুষটির হাতে বিন্দুমাত্র নিয়ন্ত্রণ থাকে না।
স্কুলের চার থেকে পাঁচ ঘণ্টা সময়ে কলোস্টোমি ব্যাগ পরিবর্তন করা হয় না বিধায় মাঝে মাঝে স্টুল উপচে ইউনিফর্মে লেগে যায়। সাদা শার্ট ভিজে উঠে হলুদ দাগে। অনিলের অভিযোগ তো এখানেই।
‘স্যার, আমার পায়খানার রাস্তা ঠিক কইরা দিবেন কবে?’
‘দেবো দেবো। আরেকটু সুস্থ হও,’ মিথ্যে আশ্বাস দিতে গিয়ে অনিলের চোখের দিকে তাকানোর সাহস পেলাম না। এবার সে ভর্তি হয়েছে সিভিয়ার এলবুমিন স্বল্পতা নিয়ে। প্রথম কয়েক দিন ওর পরিবার এলবুমিন কেনার খরচ বহন করলেও এখন আর সম্ভব হচ্ছে না। হাসপাতালের ডাক্তার আর নার্সরা মিলে চাঁদা তুলে আরো কিছুদিন হয়তো কাজ চালানো যাবে। কিন্তু এলবুমিন এভাবে ক্রমাগত লস হতে থাকলে বাইরে থেকে দিয়ে কুলানো যাবে না বেশিক্ষণ।
দরজার ঠিক পাশের বেডটাই অনিলের। অন্যান্য সব রোগী চেক করে ওয়ার্ড থেকে যখন রাত একটার দিকে বের হয়ে যাচ্ছি, ঐ মুহূর্তে পেছন থেকে আবারো ডেকে উঠল অনিল।
‘স্যার!’
ঘুরে তাকালাম। আসলে ওর দিকে তাকানোর মুখ আমার নেই। ডাক্তার হয়েও রোগীকে সুস্থ হতে না দেখার মতো লজ্জা আর অসহায়ত্বের আর কিছু কি আছে?
‘বলো, অনিল।’
‘স্যার, আমি কি আর কোনোদিন সাদা শার্ট পরতে পারুম না?’ কী নিদারুণ বিষাদ ছোট্ট কিশোরের কণ্ঠস্বরে।
‘কেন পারবে না? নিশ্চয়ই পারবে।’
‘আমার খুব শখ আছে, স্যার। যেইদিন আপনারা আমারে ছুটি দিবেন পুরোপুরি; ঐদিন বাড়িতে যাওয়ার আগে একখান সাদা শার্ট কিনমু। ওইটা পইরা ক্লাস থ্রি-এর বার্ষিক পরীক্ষায় বসমু।’
‘অবশ্যই বসবে। এখন তুমি ঘুমানোর চেষ্টা করো, অনিল।’ আর কিছু বলা সম্ভব না; তাই ফাইলগুলো নিয়ে ডক্টর’স রুমে এসে ঢুকলাম।

তিন.
‘তুমি সাদা শার্ট কিনবে!’
‘আরে, আস্তে! এটা ইনফিনিটির শো রুম, আমাদের বাসা না!’ অনামিকা এমনভাবে চেঁচিয়ে উঠেছিল যে ঠোঁটে আঙ্গুল রাখতে বাধ্য হলাম।
‘কিন্তু তোমাকে তো গত চার বছরে স্যান্ডো গেঞ্জি বাদে আর কোনো সাদা রঙের পোশাক পরতে দেখলাম না। আমাকেও রঙিন ড্রেস পরতে উৎসাহ দাও সবসময়। সেই তুমি সাদার প্রতি আগ্রহী হলে কবে থেকে?’
‘আমার জন্য নিচ্ছি কে বলল? আমি এই সাইজের শার্ট পরি? এটা গিফটের জন্য নিচ্ছি।’
‘গিফট? কাকে দেবে?’
‘আমার এক রোগী- অনিলকে।’
‘রোগী? ওমা, কেন?’
সবকিছু অনামিকাকে খুলে বলতে গেলে আজ আর ডিউটি ধরা হবে না।
‘পরে বলব’, জানিয়ে অনামিকাকে হতভম্ব করে রেখেই সেই সন্ধ্যায় দোকান থেকে চলে এলাম।

চার.
নাইট ডিউটিতে এসে দেখি, একশো চার নম্বর বেডে কেউ নেই। চাদরটাও তুলে ফেলা হয়েছে। কোনো রোগী ডিসচার্জ হয়ে গেলেই কেবল বেডের এই হাল দেখা যায়। কিন্তু পরশু দিনও যে অবস্থায় রেখে গিয়েছি অনিলকে, তাতে দুইদিনে ছুটি পাওয়ার মতো অবস্থায় সে ছিল না। হয়তো বেশি অসুস্থ হয়ে যাওয়ায়; স্পেশালাইজড হাসপাতালে রেফার্ড করা হয়ে থাকতে পারে।
‘সিস্টার, অনিল কোথায়?’
‘আজ সকালে হঠাৎ করেই রেসপিরেটরি ডিসেট্রেস শুরু হওয়ায় আইসিইউতে শিফট করা হয়েছে, স্যার।’
যা ভেবেছিলাম। লিফটে করে সেভেন্থ ফ্লোরে এসে আইসিইউ ডিপার্টমেন্টে প্রবেশ করলাম। তবে রোগীদের খুব কাছে যাওয়া যাবে না এসেপ্টিক না হয়ে। দূর থেকেই দেখলাম, ভেন্টিলেটর দিয়ে প্রাণপণ চেষ্টা করে যাচ্ছে অনিল, এই পৃথিবীর সীমাহীন বাতাস থেকে নিজের দুটি ফুসফুসের জন্য বুকভর্তি করে একটুখানি টেনে নিতে। কিন্তু খুব একটা সহজ হচ্ছে না সেই চেষ্টা। হাপরের মতো তার বুক ওঠা-নামা করছে। চোখ দুটো বন্ধ।
আমার হাতে ইনফিনিটির একটা প্যাকেট। ঐ মুহূর্তে ঘুরে-ফিরে কেবল একটা কথাই মনে হচ্ছিল, অনিল যদি আরেকবার চোখ মেলে তাকায়, ধবধবে এই শার্টটি দেখিয়ে বলব, ‘উঠে পড়ো, অনিল। এখনো অনেক পথ চলা বাকি তোমার। দাগহীন সাদা শার্ট গায়ে দিয়ে ক্লাস থ্রি-এর ফাইনাল পরীক্ষায় বসতে হবে না, বলো?’

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়