করোনার ভুয়া রিপোর্ট : সাবরিনা-আরিফসহ আটজনের মামলার রায় ১৯ জুলাই

আগের সংবাদ

মসলার বাজারে ঈদের আঁচ : খুচরা বাজারে দামের উল্লম্ফন, ডলার সংকট ও এলসি জটিলতার অজুহাত

পরের সংবাদ

‘দরবার-ই-জহুর’ পাঠ করতাম নিয়মিত লেখাগুলো এখনো প্রাসঙ্গিক

প্রকাশিত: জুলাই ১, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জুলাই ১, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

জহুর হোসেন চৌধুরী ছিলেন বহুগুণে গুণান্বিত অসাধারণ এক ব্যক্তিত্ব। বাংলাদেশের সাংবাদিকতা জগৎ শুধু নয়, রাজনীতি, সমাজচিন্তন, প্রগতিশীল আন্দোলন-সংগ্রামে লড়াকু এক অগ্রসেনানী। তিনি এমনই এক সম্মোহক ও শরীফ ব্যক্তিত্ব ছিলেন, যেখানে থাকতেন সবার মধ্যমণি হয়ে থাকতেন। সবাই মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনতেন তার বয়ান বিশ্লেষণ। অনন্য বাকভঙ্গির মতোই তার লেখাও ছিল শাণিত, শ্লেষে কটাক্ষে উপভোগ্য, রঙ্গরসে ভরপুর এবং শিক্ষণীয়। বিশ্ব ইতিহাস ও রাজনীতির ব্যাপক পঠন-পাঠকের সুস্পষ্ট প্রতিফলন থাকত সব লেখায়। তার তুলনা তিনিই। সমকালীন বিশ্ব রাজনীতির ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ, পর্যালোচনা এবং তাৎপর্য অনুধাবনে তার তীক্ষè মেধা ও দূরদর্শিতার পরিচয় আমরা বারবারই পেয়েছি। এখনো আমরা সবাই আগ্রহ নিয়ে তার লেখা পড়ি। রেফারেন্স হিসেবে উল্লিখিত আদৃত হয়। আমাদের তাহজীব তমদ্দুন ও স্বাতন্ত্র্যের উজ্জ্বল প্রতীক তার রচনাসমূহ।
মনে পড়ে, ১৯৫৭ বা ৫৮ সালে তিনি একবার লন্ডন গিয়েছিলেন। তখনকার নিয়ম অনুযায়ী বিমানবন্দর নয়, শহরেই বহির্গামী যাত্রীদের চেক ইন করা হতো। লন্ডনের সাউথ কেনসিংটনে ছিল সেই চেক ইনের অফিস। শ্রদ্ধেয় জহুর ভাই দেশে ফিরবেন- তাকে বিদায় জানাতে আমি ও তাসাদ্দুক আহমদ সেখানে উপস্থিত ছিলাম। জহুর ভাই প্রচুর পরিমাণে বইপত্র কিনেছেন। লাগেজ সেইসবে ঠাসা, তার হাতে ও বগলে একগাদা বই। কাউন্টারের ভদ্রমহিলা বললেন, ‘আপনার মালপত্রের ওজন তো অনেক বেশি, এ জন্য এক্সট্রা চার্জ দিতে হবে।’ জহুর ভাই এ কথা শুনে বিস্মিত ও হতবাক। বললেন, ‘আমি তো শুধু বই-ই কিনেছি। অন্য কিছু আমার সঙ্গে নেই। আমার কাছে অত টাকা-পয়সা নেই, কীভাবে দেব।’
মহিলা বলছেন, ‘এটা তো আইন। চার্জ না দিলে তো এসব লাগেজ আপনি নিতে পারবেন না।’ জহুর ভাই পাঁচটি পাউন্ড টেবিলের ওপর সশব্দে রেখে বললেন, ‘ইভেন ইফ ইউ বাগার মি, আই ক্যান্ট পে ইউ মোর।’
ভদ্রমহিলা ভীষণ লজ্জা পেলেন। কোনো কথা না বলে মাথা নিচু করে রইলেন। পরক্ষণেই বললেন, ‘হ্যাঁ স্যার, ঠিক আছে। হেয়ার ইজ ইউর বোর্ডিং পাস।’ অতিরিক্ত ওজনের বইপত্রের জন্য অতিরিক্ত কোনো মাশুল আর গুণতে হলো না সে যাত্রায়।
আরেকটি ঘটনা মনে পড়ে। ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধের সময়কার ঘটনা। প্রেস ক্লাবে ঘটনাটি ঘটেছিল। প্রচুর পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছিল ক্লাব প্রাঙ্গণে। পুলিশ তাড়ানোর একটা কৌশল বের করলে তিনি সোজা টেলিফোন করলেন তৎকালীন চিফ সেক্রেটারিকে। আমরা যারা তার আশপাশে ছিলাম, তাদেরকে আগেই বলে রেখেছিলেন আমি ফোনে কথা বলার সময় তোমরা খুব জোরেশোরে চিৎকার চেঁচামেচি করবে। তাই হলো। মুহুর্মুহু চিৎকার সেøাগানের মাঝে তিনি চিফ সেক্রেটারিকে বললেন, ‘ডু ইউ হিয়ার মি? এখানকার পরিস্থিতি খুবই উত্তপ্ত। প্রচণ্ড বিক্ষোভ চলছে। পুলিশের ওপর যে কোনো সময় হামলা হতে পারে।’ ব্যস, কাজ হয়ে গেল। কিছুক্ষণের মধ্যেই ক্লাব চত্বর থেকে পুলিশ প্রত্যাহার করে নেয়া হলো। এই হলেন আমাদের জহুর ভাই।
তিনি বাম রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন আজীবন। আশরাফ আতরাফে প্রভেদ নেই এমন বৈষম্যহীন, গণতান্ত্রিক, মুক্ত সমাজের স্বপ্ন দেখতেন। সে লক্ষ্যেই তার লেখনি সর্বদা সচল ছিল।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাকে খুবই শ্রদ্ধা করতেন। সব সময় ‘জহুর ভাই’ বলে সম্বোধন করতেন। আমাদের অনেকেরই হয়তো এই তথ্যটি জানা নেই যে, তিনি মওলানা ভাসানীর একমাত্র ছেলের সর্বদা দেখভাল করতেন। নিজে ছিলেন নিঃসন্তান।
জহুর ভাইয়ের সঙ্গে পাকিস্তানের প্রচণ্ড ক্ষমতাধর আমলা আলতাফ গওহরের বেশ ভালো সম্পর্ক ছিল। একবার শহীদ মুনীর চৌধুরীর অনুরোধে তার পাসপোর্ট নবায়নের জন্য আলতাফ গওহরের কাছে তিনি তদবির করেছিলেন। একদিনের মধ্যেই সমাধান হয়ে গিয়েছিল সে সমস্যার।
অসাধারণ এক ক্যারেক্টার ছিলেন জহুর হোসেন চৌধুরী। ভিন্ন মতাবলম্বীদের সঙ্গেও তার সম্পর্ক ছিল মধুর। তাদের মধ্যকার পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের অনেক দৃষ্টান্ত কাছে থেকে দেখবার সুযোগ হয়েছে আমার। তার সঙ্গে পরিচয়ের পর এই গুণী মানুষটির লেখা বিশেষত জনআদৃত কলাম ‘দরবার-ই-জহুর’ আমরা গোগ্রাসে পাঠ করতাম। সেসব লেখা এখনো অনেকাংশে প্রাসঙ্গিক।
মৃত্যুর পরে যখন বনানী গোরস্তানে তাকে দাফন করা হয়, সে সময়কার কথাও মনে পড়ে। দৈনিক সংবাদে তার অভিন্ন হৃদয় বন্ধু সৈয়দ নূরুদ্দীন গোরস্তানে উপস্থিত ছিলেন। দীর্ঘশ্বাস ফেলে নূরুদ্দীন ভাই বলেছিলেন, আমারও যাওয়ার সময় হয়ে গেল। জহুরকে হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়েছি। আমরা সবিস্ময়ে প্রত্যক্ষ করলাম সত্যি সত্যিই সৈয়দ নূরুদ্দীন ভাইও আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন এক মাস পরেই। জহুর হোসেন চৌধুরী ইন্তেকাল করেন ১৯৮০ সালের ১১ ডিসেম্বর। তার অন্যতম সুহৃদ বন্ধু সৈয়দ নূরুদ্দীন মারা যান ১৯৮১ সালের ২৩ জানুয়ারি।
জন্মশতবর্ষে জহুর ভাইকে গভীর শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করি। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন শ্রদ্ধেয় জহুর হোসেন চৌধুরী ও সৈয়দ নূরুদ্দীনের রুহের মাগফেরাত দান করুন। আমিন।

লেখাটি ‘দরবার-ই-জহুর কলাম’ বই থেকে সংগৃহীত।
প্রকাশক : আবিষ্কার, প্রকাশ : জুন ২০২২

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়