স্বপ্নজয়ের পদ্মা সেতুর নিরাপত্তায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনী

আগের সংবাদ

হাওর জনপদে স্বাস্থ্যসেবা ‘নেই’

পরের সংবাদ

সাম্প্রদায়িক উসকানির অভিযোগে নড়াইলে শিক্ষক-ছাত্র লাঞ্ছিত : নেপথ্যে অধ্যক্ষের চেয়ার দখলের তৎপরতা

প্রকাশিত: জুন ২৬, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জুন ২৬, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

কাগজ প্রতিবেদক : সাম্প্রদায়িক উসকানির অভিযোগ তুলে আবারো শিক্ষক লাঞ্ছনার ঘটনা ঘটেছে। নড়াইলের মির্জাপুর ইউনাইটেড ডিগ্রি কলেজে এমন পরিস্থিতিতে সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটেছে। আর ওই ঘটনার সূত্রপাত বিজেপির বহিষ্কৃত নেত্রী নূপুর শর্মাকে প্রণাম জানিয়ে ওই কলেজের ছাত্র রাহুল দেবের ফেসবুকে দেয়া এক পোস্টকে কেন্দ্র করে।
জানা যায়, রাহুল গত ১৭ জুন ফেসবুকে ভারতের নূপুর শর্মার ছবি দিয়ে ‘প্রণাম নিও বস নূপুর শর্মা, জয় শ্রী রাম’ ক্যাপশন দেয়। ১৮ জুন সকালে তাকে কলেজে দেখে সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়লে একপর্যায়ে তা নিয়ন্ত্রণের জন্য পুলিশের সহায়তা চান ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাস। কলেজে পুলিশ এসে রাহুলকে নিয়ে যেতে চাইলে ছাত্ররা বাধা দেয়। এরপর অতিরিক্ত পুলিশ আসে। স্থানীয় লোকজনের সংখ্যাও বাড়ে। সেই সঙ্গে ছড়িয়ে পড়ে উত্তেজনা। বিকালে পুলিশের সঙ্গে ছাত্র-জনতার সংঘর্ষ হয়। পুলিশ টিয়ারশেল নিক্ষেপ করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারের আশ্বাসেও পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়নি। এ সময় উত্তেজিত জনতার চাপে পরে পুলিশের পাহারায় জুতার মালা পরিয়ে রাহুল ও অধ্যক্ষকে পুলিশ হেফাজতে নিয়ে আসে। এই ঘটনার ভিডিওটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে শুরু হয় সমালোচনার ঝড়। পুলিশের উপস্থিতিতে এ ধরনের ঘৃণ্য কর্মকাণ্ডের তীব্র প্রতিবাদ জানাতে দেখা গেছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে।
গত ১৯ জুন নড়াইল-১ আসনের সংসদ সদস্য কবিরুল হক মুক্তি কলেজে গিয়ে শান্তি সভা করেন। সভায় কলেজের জিবির সভাপতি অচিন কুমার চক্রবর্তী অনাকাক্সিক্ষত ঘটনার জন্য দুঃখ প্রকাশ করে সকলকে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে থাকার অনুরোধ জানান। সেইসঙ্গে কলেজের শিক্ষকদের মোটরসাইকেল ভাঙচুর করা ও পোড়ানো, শিক্ষকদের লাঞ্ছিত করা ও মারপিটের ঘটনায় কোনো মামলা করবেন না বলে জানান।
এ বিষয়ে নড়াইল সদর থানার ওসি শওকত কবীর জানান, আমরা খবর শোনার সঙ্গে সঙ্গে ফোর্স নিয়ে ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করি এবং ছাত্র রাহুল ও অধ্যক্ষকে নিরাপদে রাখি। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসলে তাদের থানায় নিয়ে আসা হয়। রাহুলের নামে এলাকার মাদ্রাসার শিক্ষক মো. ফারুক বাদী হয়ে মামলা দায়ের করেন। রাহুল এখন কারাগারে। এলাকার পরিবেশও এখন শান্ত।
ওই ঘটনায় পুলিশি পাহারায় থাকা অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাস অনেকটাই বাকরুদ্ধ। তিনি ভোরের কাগজকে বলেন, শারীরিক ও মানসিকভাবে আমি অসুস্থ। নিরাপত্তাহীনতার মধ্যেও আছি। বাড়িতে আমার স্ত্রী-সন্তানরা রয়েছে। বাড়িতে পুলিশ পাহারা আছে। কিন্তু আমি বাইরে বাইরে থাকছি। আমি ষড়যন্ত্রের শিকার। যারা এই ধরনের ষড়যন্ত্রে জড়িত তাদের মুখোশ উন্মোচন হোক। প্রকৃত ঘটনা উদ্ঘাটন হোক। ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠিত হোক। এলাকায় শান্তি ফিরে আসুক। এলাকায় ধর্মীয় সম্প্রীতি ফিরে আসুক। কারোর বিরুদ্ধে আমার কোনো অভিযোগ নেই।
এই ঘটনায় হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজল দেবনাথ ভোরের কাগজকে বলেন, পত্রিকায় আমি যতটুকু জেনেছি সেটি হলো- অভিযোগ মূলত ছাত্রটির বিরুদ্ধে। ছাত্রটি যদি অভিযুক্ত হয় এর জন্য অধ্যক্ষ কেন অভিযুক্ত হবেন? গণপিটুনি বা সংঘাত এড়াতে পুলিশও অভিযুক্তকে অনেক সময় আড়াল করে। তিনি প্রশ্ন রাখেন- তাই বলে কি সে দোষী? ছাত্রটি যদি অভিযুক্ত হয়েই থাকে অধ্যক্ষতো কিছু করেননি। যদি এমনটাই হয় তাহলে প্রত্যেকটি জায়গায় ছাত্র এবং সেই প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ ব্যক্তিকে অভিযুক্ত করব? যেহেতু ছাত্রটি একটি সম্প্রদায়ের এবং অধ্যক্ষও একই সম্প্রদায়ের সেহেতু বিষয়টিকে আমরা এক করে ফেলব? আর অন্য ধর্ম হলেই এক করব না? এটা তো হতে পারে না। দুর্ভাগ্যজনকভাবে ‘ধর্মীয় অনুভূতির’ আঘাতের কথাটা আসলেই একটি ধর্মের ব্যাপারে সমস্ত কিছুতে আমরা বিচার বিবেচনা হারিয়ে ওই ধর্মাবলম্বী কাউকে পেলে সব এক করে ফেলছি। কিন্তু ঠিক উল্টো দিকের ব্যাপারে আমরা একেবারেই নীরব। ‘ধর্মীয় অনুভূতি’ আসলে একমুখী। অনান্য ধর্মাবলম্বীদের ধর্মীয় অনুভূতি নাই। যদি থাকত তাহলে কিছু দিন পরপরই মন্দির ভাঙতো না। সম্প্রতি ভারত সফরে পররাষ্ট্রমন্ত্রী যে দুটি কথা বলেছেন সেগুলো অসত্য।
প্রসঙ্গত, সম্প্রতি দিল্লি সফরের সময় (গত ২০ জুন) ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভালকে ড. এ কে আব্দুল মোমেন জানিয়েছেন, বাংলাদেশে হিন্দুদের ওপর নির্যাতন এবং মন্দির ও পূজামণ্ডপে হামলা ভাঙচুর নিয়ে মিথ্যা প্রচারণা হয়। এছাড়া তিনি জানান, এ বছর সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় প্রায় ৩৩ হাজার পূজা মণ্ডপ তৈরি করা হয়েছে।
এদিকে কলেজের একটি সূত্র জানিয়েছে, অধ্যক্ষ স্বপন বিশ্বাসকে সরিয়ে নতুন ব্যক্তিকে তার স্থলে বসানোর তৎপরতার আভাস মিলছে। ঘটনায় রাহুলের বিচার দাবির থেকেও গুরুত্ব দেয়া হয়েছে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে অপপ্রচারকে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, একটি চক্র ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের চেয়ার দখল করে পাঁচজন কর্মচারী নিয়োগ দিয়ে মোটা অঙ্কের নিয়োগ বাণিজ্য করতে দীর্ঘদিন ধরে তৎপরতা চালিয়ে আসছে। তারা নিজেদের স্বার্থ হাসিলের জন্য রাহুলের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলে।
এরপর ঠিক সময়মতো মিথ্যা কাল্পনিক অপবাদ দিয়ে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের অপসারণ দাবি করে আন্দোলন শুরু করে। ইচ্ছাকৃতভাবে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে স্থানীয়দের ভুল বুঝিয়ে ঘটনার মোড় অন্যদিকে নিয়ে যায় তারা। মূলত তাদের উদ্দেশ্য ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের পদ থেকে স্বপন কুমার বিশ্বাসকে সরিয়ে দেয়া। নিয়োগ বাণিজ্যে তৎপর এই মহলটির বিষয়ে জানার পর স্থানীয়ভাবে অধিকাংশরা ধর্মীয় সম্প্রীতি বিনষ্টের জন্য রাহুলের বিচার দাবি করেন।
নড়াইলে শিক্ষক লাঞ্ছনাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়েছে বাসদ (মার্কসবাদী)। গতকাল শনিবার এক বিবৃতেতে সংগঠনের সমন্বয়ক মাসুদ রানা বলেন, একজন শিক্ষকের এমন লাঞ্ছনা আমাদের ক্ষুব্ধ ও ব্যথিত করেছে। কিন্তু পুলিশ ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধির উপস্থিতিতে এ ঘটনা সংঘটিত হওয়া আরো বেশি উদ্বেগজনক। সাম্প্রতিক সময়ে হৃদয় মণ্ডল, আমোদিনী পাল, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের দুজন শিক্ষকসহ অনেক শিক্ষককে কথিত ধর্ম অবমাননার দায়ে লাঞ্ছিত হতে হয়েছে। সুযোগ সন্ধানীরা সাম্প্রদায়িক রং চড়িয়ে নিজেদের স্বার্থ হাসিল করছে। এটা যেমন সত্য, তেমনি দেশে জনমনে সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গীর প্রসার ঘটছে এটাও অস্বীকার করার উপায় নেই।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়