গ্রেপ্তার ৪ ডাকাত : বন্যার কারণে বেড়ে যেতে পারে ডাকাতি আশঙ্কা পুলিশের

আগের সংবাদ

আ.লীগের ৭৩তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালিত

পরের সংবাদ

বাড়ছে কোটিপতি বাড়ছে বৈষম্য

প্রকাশিত: জুন ২৩, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জুন ২৩, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

মরিয়ম সেঁজুতি : ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ ও বৈশ্বিক পরিস্থিতির কারণে সব পণ্যের দাম অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে। উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে সাধারণ মানুষকে ভোগব্যয় কমাতে হচ্ছে অনেক ক্ষেত্রেই। এদিকে সাধারণ মানুষ কষ্টে থাকলেও দেশে ধনীর অনুপাত বাড়ছে। বর্তমানে দেশে কোটিপতির সংখ্যা লাখ ছাড়িয়েছে। চলতি বছরের মার্চ মাস শেষে গত বছরের ডিসেম্বরের তুলনায় কোটি টাকার বেশি আমানত জমা আছে এমন ব্যাংক একাউন্টের সংখ্যা বেড়েছে ১ হাজার ৬২১টি। মোট কোটিপতি একাউন্ট সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৩ হাজার ৫৯৭টি। এসব একাউন্টে আমানতের পরিমাণ মার্চ শেষে ৬ লাখ ৬৩ হাজার ৫০৫ কোটি টাকা। ডিসেম্বরে জমার পরিমাণ ছিল ৬ লাখ ৫৩ হাজার ৮৫৮ কোটি টাকা। অর্থাৎ তিন মাসে কোটিপতিদের আমানত বেড়েছে ৯ হাজার ৬৪৭ কোটি টাকা।
উন্নয়নের বিভিন্ন প্রকল্প যেভাবে নেয়া হচ্ছে, আর্থিক প্রতিষ্ঠান যেভাবে পরিচালিত হচ্ছে, সরকারি বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা যেভাবে বণ্টন হচ্ছে, তাতে জিডিপি বাড়লেও একই সঙ্গে ধনী-গরিবের বৈষম্যও বাড়ছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা না থাকায় কিছু লোকের হাতে অনেক সম্পদ চলে গেছে। ব্যাংক ঋণ নিয়ে তা পরিশোধ না করে, উন্নয়ন প্রকল্পের ব্যয় বাড়িয়ে অনেকে টাকা বাড়াচ্ছে। ফলে তারা ধনী হচ্ছে। করোনার মধ্যে এটা আরো বেড়েছে। আর কর্মসংস্থান কমে যাওয়ায় গরিব আরো নাজুক অবস্থায় পড়ছে। অসমতা বৃদ্ধির ফলে দেশে ও সমাজে অস্থিরতা তৈরি হচ্ছে বলে মনে করেন তারা। এ সংখ্যা একদিকে যেমন দেশের উন্নয়ন ও আয় বাড়ার প্রমাণ দিচ্ছে, অন্যদিকে এটি বৈষম্য বৃদ্ধিরও প্রমাণ বলে অভিমত তাদের।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব মতে, গত ২০২০ সালের মার্চ মাসে দেশে করোনা ভাইরাস প্রকোপ শুরুর সময় দেশের ব্যাংকগুলোতে এক কোটি টাকার বেশি থাকা হিসাবধারীর সংখ্যা ছিল ৮২ হাজার ৬২৫টি। ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে সে সংখ্যা এক লাখ ছাড়িয়ে যায়। ২০২২ সালের মার্চ প্রান্তিক শেষে দেশে কোটিপতি হিসাবধারীর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে এক লাখ ৩ হাজার ৫৯৭টিতে। এর আগে ২০২১ সালের ডিসেম্বরের শেষে কোটিপতি হিসাবধারীর সংখ্যা ছিল এক লাখ এক হাজার ৯৭৬টি। সে হিসাবে তিন মাসের ব্যবধানে কোটিপতি হিসাবধারীর (ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠান) সংখ্যা বেড়েছে এক হাজার ৬২১টি।
এসব হিসাবে (মার্চ প্রান্তিক শেষে) আমানতের পরিমাণ ছয় লাখ ৬৩ হাজার ৫০৫ কোটি টাকা। যা গত ডিসেম্বর শেষে আমানতের পরিমাণ ছিল ছয় লাখ ৫৩ হাজার ৮৫৮ কোটি টাকা। সে হিসাবে তিন মাসে এসব হিসাবে আমানত বেড়েছে নয় হাজার ৬৪৭ কোটি টাকা। চলতি বছরের মার্চ মাস শেষে ব্যাংকিং খাতে মোট হিসাবধারীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১২ কোটি ৭৩ লাখ। এসব হিসাবে আমানতের পরিমাণ ১৫ লাখ ১৪ হাজার ৮৯৫ কোটি টাকা। তথ্যে দেখা যায়, মোট ব্যাংক একাউন্টের তুলনায় কোটিপতিদের একাউন্ট সংখ্যা ১ শতাংশও নয়। কিন্তু এসব একাউন্টে মোট আমানতের প্রায় ৪৪ শতাংশ টাকা জমা আছে।
এ প্রসঙ্গে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, দেশের প্রবৃদ্ধি ভালো আছে। নতুন নতুন কলকারখানা হচ্ছে। আমদানি-রপ্তানি বাড়ছে। এতে মুনাফা বাড়ছে। তাই কোটিপতির সংখ্যাও বাড়ছে। কিন্তু অন্যদিকে দরিদ্র মানুষের সংখ্যাও বাড়ছে। এটি প্রমাণ করে যে দেশে বৈষম্যও বেড়ে চলেছে। তিনি বলেন, দেশে কোটিপতিদের সংখ্যা বাড়ার খবর অবশ্যই ভালো। কিন্তু আমাদের দেখতে হবে মধ্যবিত্তের ব্যাংকের আমানত, যারা মহামারিতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল, তা বেড়েছে কিনা। মধ্যবিত্তের অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয়। করোনা চলাকালীন ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করার ফলে অনেকের ব্যবসা দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছে। কেউ কেউ অবৈধভাবে তাদের ব্যবসা চালানোর দায়ে কারাগারে রয়েছেন, কিন্তু তার ব্যাংক হিসাব এখনো চলছে।
এ বিষয়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর কাছে সম্পদ কুক্ষিগত হয়ে দেশে বৈষম্য বাড়ছে- এ সংখ্যাগুলো তাই প্রমাণ করে। এছাড়া বৈশ্বিক কিছু প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, অতি ধনী বৃদ্ধির তালিকায় বাংলাদেশ সবচেয়ে এগিয়ে কোটিপতি একাউন্ট সংখ্যা। সেই তথ্যের সত্যতা রিফ্লেক্ট করছে। ২০১০ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত গত ১০ বছরে দেশে ধনকুবেরের (৫০ লাখ ডলারের বেশি সম্পদের অধিকারী) সংখ্যা বেড়েছে গড়ে ১৪ দশমিক ৩ শতাংশ হারে। যা এ সময়ে সারা বিশ্বে সবচেয়ে বেশি। বহুজাতিক আর্থিক পরামর্শ দানকারী প্রতিষ্ঠান ওয়েলথ এক্স এর প্রতিবেদনে এই তথ্য ওঠে এসেছিল।
তবে ব্যাংকারদের হিসেবে, কোটি টাকার ব্যাংক হিসাবের সবই ব্যক্তি একাউন্ট নয়। এখানে প্রাতিষ্ঠানিক একাউন্টও আছে। সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংস্থার কোটি টাকার একাউন্ট আছে। তবে এই সংখ্যা অবশ্যই কোটিপতিদের একটি ধারণা দিয়ে থাকে। ব্যাংকার্স এসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি আনিস এ খান বলেন, এখানে বিভিন্ন ধরনের একাউন্ট থাকলেও কোটিপতির বিষয়ে এখান থেকে আমরা ধারণা পেতে পারি। অর্থনীতি এগিয়ে যাচ্ছে, বাড়ছে ব্যবসাবাণিজ্য। ফলে কোটিপতিদের সংখ্যা বাড়ছে বলে মনে করেন তিনি।
দেশ স্বাধীনের পর ১৯৭২ সালে দেশে কোটিপতি আমানতকারীর সংখ্যা ছিল মাত্র পাঁচজন। ১৯৭৫ সালে এ সংখ্যা থেকে উন্নীত হয়ে দাঁড়ায় ৪৭-এ।
দেশে ১৯৮০ সালে কোটিপতি ছিলেন ৯৮ জন, ১৯৯০ সালে ৯৪৩ জন, ১৯৯৬ সালে দুই হাজার ৫৯৪ জন, ২০০১ সালে পাঁচ হাজার ১৬২ জন, ২০০৬ সালে আট হাজার ৮৮৭ জন এবং ২০০৮ সালে ১৯ হাজার ১৬৩ জন কোটিপতি গ্রাহক ছিলেন। দেশে আয় বৈষম্য বাড়ার কারণ সম্পর্কে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর কলেন, করোনা মহামারির মধ্যে ক্রমবর্ধমান বৈষম্য একটি বৈশ্বিক ঘটনা। বৈষম্য মোকাবিলায় যথাযথ ব্যবস্থা না নেয়াই এর অন্যতম প্রধান কারণ। করোনাকালীন সময়ে ধনী ব্যক্তিরা সরকার ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজ থেকে সমর্থন পেয়েছেন। এদের অনেকেই এ টাকা ব্যাংক অ্যাকাউন্টে জমা করেছেন। অপরদিকে, দরিদ্র লোকরা এ জাতীয় সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছেন।
আন্তর্জাতিক বেসরকারি সেবা সংস্থা অক্সফাম সম্প্রতি বলেছে, বর্তমানে বিশ্বে দুই হাজার ৬৬৮ জন শতকোটি ডলারের (বিলিয়নিয়ার) মালিক আছেন- যা ২০২০ সালের তুলনায় ৫৭৩ জন বেশি। অর্থাৎ করোনা মহামারির সময় বিশ্বে ৫৭৩ ব্যক্তি নতুন করে বিলিয়নিয়ার হয়েছেন। এসব বিলিয়নিয়ার মিলে ১২ দশমিক ৭ লাখ কোটি ডলারের মালিক। এ ছাড়া করোনাকালে বিশ্বে ৯৯ ভাগ লোকের প্রকৃত আয় কমেছে উল্লেখ করে অক্সফাম বলছে, চলতি বছর নতুন করে বিশ্বে ২৬ কোটি ৩০ লাখ মানুষ হতদরিদ্র হয়ে যাবে। এ হিসাবে, এ বছর প্রতি ৩৩ ঘণ্টায় ১০ লাখ মানুষ চরম দরিদ্র হচ্ছে। এ বিশ্বচিত্র বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও একই বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলেন, রাষ্ট্রের সঙ্গে ধনীদের একরৈখিক সম্পর্কের বিন্যাস, একে পুঁজি করেই তারা আরো ধনী হন। রাষ্ট্রই তাদের বিভিন্ন রকম ছাড় ও ভর্তুকি দেয়। এসব বন্ধ করলে অনেকেরই আর অত ধনী থাকার কথা নয়।
ধনী হতে সাহায্য করেছে সরকার এ অবস্থাকে বিপর্যয় বলে উল্লেখ করে অক্সফাম বলছে, করোনায় বিশ্বে প্রায় দেড় কোটি লোক মারা যাওয়া ছাড়াও বৈষম্য হয়ে গেছে আকাশচুম্বী। এখন ধনীরা শুধু সুরক্ষিতই নন, তারা এই সংকট থেকে মুনাফা লুটছেন। সরকারগুলো করোনাকালে খাবার, জ্বালানি, ওষুধ, স্বাস্থ্যপ্রযুক্তিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিপুল অঙ্কের টাকা ঢালায় ধনীরা সম্পদ বাড়িয়েছেন।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়