সোহেল চৌধুরী হত্যা : শেষ দিনেও দাখিল হয়নি কেস ডকেট

আগের সংবাদ

ভয়াবহ বন্যায় দিশাহারা মানুষ

পরের সংবাদ

জ্ঞান ছাড়া তো প্রকৃত অগ্রগতি সম্ভব নয়

প্রকাশিত: জুন ১৭, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জুন ১৭, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

** জ্ঞান ক্রমাগত মূল্য হারাচ্ছে। সেই জ্ঞানের চর্চা দরকার, যা মানবিক উন্নয়নে কাজ দেবে **

ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক। প্রায় ১০০ গ্রন্থের রচয়িতা তিনি। গত ১৫ বছর ধরে সাহিত্য-সংস্কৃতির ত্রৈমাসিক নতুন দিগন্ত পত্রিকা সম্পাদনা করে যাচ্ছেন। এছাড়া তিনি বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় উল্লেখযোগ্য প্রবন্ধ লিখছেন। ভোরের কাগজেও তিনি নিয়মিত লিখছেন। প্রফেসর চৌধুরী একজন সফল ও সম্মানিত শিক্ষক। তার কাজের ওপর এমফিল পর্যায়ে গবেষণা হয়েছে, পত্র-পত্রিকায় লেখা হয়েছে। তার পরিচালনায় নয়জন গবেষক পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে তার রচনা পড়ানো হয়। সাংস্কৃতিক ও সামাজিক আন্দোলনে তার অংশগ্রহণ উল্লেখযোগ্য। ১৯৭১ সালে পাক-সামরিক বাহিনীর জেনারেল টিক্কা খান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যে ছয়জন শিক্ষককে আনুষ্ঠানিকভাবে সতর্ক করে দেয় তিনি তাদের অন্যতম। ওসমানী উদ্যান রক্ষা আন্দোলন ও লালন ফকিরের আখড়া রক্ষার আন্দোলনে তিনি নেতৃত্ব দেন। আড়িয়াল বিল রক্ষা আন্দোলনে তিনি যুক্ত ছিলেন। দেশের সব গণতান্ত্রিক ও সামাজিক আন্দোলনে তিনি সবসময় সামনের কাতারে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন। আগামী ২৩ জুন ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর জন্মদিন। জন্মদিনকে সামনে রেখে
ভোরের কাগজের সঙ্গে কথোপকথন। কথা বলেছেন : সালেক নাছির উদ্দিন

প্রশ্ন : আমরা বিজয়ের ৫০ বছর উদযাপন করছি। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী অতিক্রমে আমরা কি কাক্সিক্ষত বাংলাদেশের লক্ষ্যকেন্দ্রে পৌঁছাতে পেরেছি?
উত্তর : না, কাক্সিক্ষত বাংলাদেশের লক্ষ্যকেন্দ্রে পৌঁছাতে পারিনি। আর পানিনি যে সেটা সবাই বলবেন। কাক্সিক্ষত বাংলাদেশ ছিল একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও সমাজের, গণতান্ত্রিক পরিপূর্ণ অর্থে। অর্থাৎ যেখানে মানুষের সঙ্গে মানুষের শ্রেণিগত, ধর্মগত লৈঙ্গিক, বা বর্ণগত কোনো বৈষম্য থাকবে না। নাগরিকদের সবার থাকবে আহার, বাসস্থান, স্বাস্থ্য, শিক্ষাসহ মৌলিক অধিকারগুলোর নিশ্চয়তা। থাকবে মতপ্রকাশের পূর্ণ স্বাধীনতা। ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ ঘটবে। সর্বক্ষেত্রে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা পাবে। সর্বোপরি থাকবে অধিকার ও সুযোগের সাম্য। ওই লক্ষ্যে পৌঁছানো সম্ভব হয়নি।
প্রশ্ন : যদি পৌঁছাতে না পেরে থাকি তাহলে এই ব্যর্থতার দায় কার বা কাদের বলে আপনি মনে করেন?
উত্তর : না-পৌঁছানোর সব দায় নেতৃত্বের। লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য প্রয়োজন ছিল একটি সামজিক বিপ্লবের, যে-বিপ্লব ঘটেনি। রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা এসেছে, কিন্তু সমাজে মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের ক্ষেত্রে মৌলিক কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। সেই যে ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত’ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ঔপনিবেশিক শাসনামলে তার ভেতরকার জমিদার ও প্রজার সম্পর্কই নানাভাবে ও চেহারায় পুনঃ পুনঃ উৎপাদিত হয়ে চলেছে। শাসক শাসিতের সম্পর্ক বদলায়নি। বাংলাদেশের মানুষ অপেক্ষা করছিল, এখনো করছে, সামাজিক ক্ষেত্রে মৌলিক পরিবর্তনের জন্য। মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে জাতীয়তাবাদী নেতৃত্বে। যুদ্ধে সমাজতন্ত্রীরাও ছিল, কিন্তু তারা নেতৃত্ব দিতে পারেনি। যারা নেতৃত্ব দিয়েছে তারাই রাষ্ট্রক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। জাতীয়তাবাদীরা একাধিক দলে বিভক্ত হয়ে রাষ্ট্রশাসন করেছে।
সামাজিক বিপ্লব সম্পন্ন করার দায়িত্ব ছিল সমাজতন্ত্রীদের। স্বাধীনতার পরে সমাজ ও রাষ্ট্রকে সমাজতান্ত্রিক বৈপ্লবিক পরিবর্তনের অভিমুখে নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল তাদেরই। তারা সে দায়িত্ব পালন করতে পারেনি। প্রথমত, তারা বিভক্ত হয়ে গিয়েছিল নানা দলে ও উপদলে। দ্বিতীয়ত, তাদের ওপর নির্মম রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন চলেছে। তৃতীয়ত, মিডিয়া ছিল তাদের বিরুদ্ধে। ওদিকে বিশ্বরাজনৈতিক পরিস্থিতিও সমাজতন্ত্রের পক্ষে ছিল না। একাধিপত্য ও দৌরাত্ম্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল পুঁজিবাদের।
আমার ধারণা মূল ব্যর্থতা বামপন্থিদেরই। জাতীয়তাবাদী নেতৃত্বের তো অঙ্গীকার ছিল না সামাজিক বিপ্লবের। যে জন্য দেখা যায় সংবিধানের স্বীকৃত রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতি থেকে সমাজতন্ত্র বিদায় নিয়েছে।
প্রশ্ন : বিগত পঞ্চাশ বছরে আমাদের অর্জনের বিষয়গুলো কীভাবে দেখছেন? দেশে-বিদেশে আমাদের সার্বিক অবস্থান কি আগের চেয়ে তুলনামূলকভাবে ভালো নয়?
উত্তর : স্বাধীনতা লাভের পরে প্রশ্ন দেখা দিয়েছিল অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশ কীভাবে উঠে দাঁড়াবে। যুদ্ধে অর্থনীতিকে বিপর্যস্ত করেছে; উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে। তার পরে বন্যা হয়েছে। দুর্ভিক্ষও দেখা দিয়েছে। তাতে লোকও মারা গেছে। সেসব বিপর্যয় কাটিয়ে বাংলাদেশ এগিয়েছে, স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্বে সে স্থান করে নিয়েছে। অর্থনৈতিক ও অবকাঠামোগত উন্নতি ঘটেছে। এসবের পেছনে আছে শ্রম। মেহনতি মানুষ শ্রম দিয়েছে- যেমন দেশের ভেতরে থেকে তেমনি বাইরে গিয়ে। তাদের শ্রমে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা এসেছে; বৈদেশিক ঋণগ্রহণ কমেছে; বিদেশ থেকে রপ্তানির টাকা এসেছে, রেমিট্যান্স এসেছে। বাংলাদেশের মানুষ বিদেশে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সুনাম অর্জন করেছে। নারী শিক্ষার ক্ষেত্রে, এবং অর্থনীতিতে মেয়েদের অংশ গ্রহণ বিশেষভাবে লক্ষণীয় হয়ে উঠেছে। আমরা ছিলাম অত্যন্ত দরিদ্র এবং পশ্চাৎপদ একটি দেশ, সেখান থেকে বেরিয়ে এসেছি। অর্জনগুলো সামান্য নয়।
প্রশ্ন : বাহাত্তরের সংবিধানের মূল স্তম্ভগুলোতে আঘাত করা হয়েছে। সেই সংবিধানে ফিরে যাওয়ার দাবি প্রগতিশীলদের দীর্ঘদিনের। কিন্তু এখন সেই প্রেক্ষাপট থাকা সত্ত্বেও কেন বাহাত্তরের সংবিধানে প্রত্যাবর্তন সম্ভব হচ্ছে না?
উত্তর : আমাদের সংবিধানে দুর্বলতা ছিল; কিন্তু সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ছিল রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতি। ওই মূলনীতিগুলোর তাৎপর্য ছিল এটা যে আমরা ওই লক্ষ্যগুলো অর্জন করতে পারব। লক্ষ্যগুলো অর্জিত হয়নি। বরং আমরা সেখান থেকে পিছিয়েই গেছি, যার প্রতিফলন ঘটেছে রাষ্ট্রীয় মূলনীতিগুলোর ওপরের আঘাতে। প্রেক্ষাপট আসলে বদলায়নি।
প্রশ্ন : একদিকে আমরা শুনছি উন্নয়ন-অগ্রগতির কথা, অন্যদিকে নানা ক্ষেত্রে বৈষম্যচিত্র এখনো দৃশ্যমান। আপনি বিষয়টি কীভাবে দেখছেন?
উত্তর : উন্নয়ন হয়েছে। কিন্তু ওই উন্নয়ন হচ্ছে পুঁজিবাদী ধরনের। পুঁজিবাদী উন্নয়ন বৈষম্য বাড়ায়। তাই বাংলাদেশে যত উন্নতি হয়েছে তত বেড়েছে বৈষম্য। তদুপরি এ উন্নয়ন কর্মসংস্থান বাড়ায়নি। বিপরীত দিকে দেখা যাচ্ছে সম্পদ পাচার হয়ে যাচ্ছে। উন্নয়নের এই নীতি বদলানো চাই। উন্নয়ন হওয়া দরকার সর্বজনীন ও দেশপ্রেমিক।
প্রশ্ন : ধর্মান্ধ-প্রতিক্রিয়াশীলদের বাড়বাড়ন্ত নিয়ে আপনি বরাবরই উচ্চকণ্ঠ। এসবই আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিপরীত। এ ব্যাপারে আপনার বক্তব্য কী?
উত্তর : ধর্মান্ধরা আছে, আছে ধর্মব্যবসায়ীরাও। ধর্মব্যবসায়ীরা রাজনীতিতে ধর্মকে ব্যবহার করে। মূল সমস্যাটা হচ্ছে আমরা ধর্মনিরপেক্ষতার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য থেকে সরে গেছি। ‘ধর্ম যার যার রাষ্ট্র সবার’ এটা হওয়া উচিত ছিল নীতি; সেটা হয়নি।
প্রশ্ন : গণতন্ত্র, নির্বাচন, নির্বাচনী ব্যবস্থার সংকট নিয়েও আপনার উদ্বেগ সংবাদমাধ্যমেই প্রকাশিত হয়েছে। এ থেকে উত্তরণের পথ কী?
উত্তর : উত্তরণের উপায় হচ্ছে একটি গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি গড়ে তোলা। ওই সংস্কৃতির বৈশিষ্ট্য হয়ে পরমতসহিষ্ণুতা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণ। এটি সহজ কাজ নয়, এবং অবশ্যই অত্যন্ত সময়সাপেক্ষ। নির্বাচন গণতন্ত্রের অংশ; তাই সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের ব্যবস্থা করাটা অপরিহার্য। এর জন্য নির্বাচন কমিশনের স্বাধীনতা তো অবশ্যই প্রয়োজন; তারও আগে প্রয়োজন সরকারের নিরপেক্ষতা। কিন্তু আসল কাজটা হলো গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির প্রতিষ্ঠা, যেটা বাংলাদেশে এখন নেই।
প্রশ্ন : আমাদের রাজনীতি বহুলাংশে দুর্বৃত্তায়িত হয়ে পড়েছে- এ অভিযোগ অনেকেরই। আপনি কী মনে করেন? আমাদের রাজনীতির অর্জন নিয়ে আপনার মূল্যায়ন কী?
উত্তর : রাজনীতির দুর্বৃত্তায়নের পেছনে রয়েছে টাকার দৌরাত্ম্য। রাজনীতিতে ব্যবসা ঢুকে পড়েছে। যারা ব্যবসা করেন বা ব্যবসার সঙ্গে জড়িত তারা এবং তাদের প্রতিনিধিরাই সর্বস্তরে নির্বাচিত হচ্ছেন। রাজনীতিকে টাকার অধীনস্থতা থেকে মুক্ত করার ব্যাপারে রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকা থাকা চাই। আর থাকা চাই জনমতের চাপ। জনমত গঠনে মিডিয়া একটা বড় ভূমিকা পালন করতে পারে। এক্ষেত্রে মিডিয়ার মালিকদের তুলনায় মিডিয়ার কর্মীদের দায়িত্ব অধিক।
প্রশ্ন : আপনাকে যদি প্রশ্ন করা হয় আমাদের বড় কয়েকটি সমস্যা চিহ্নিত করুন। তাহলে আপনি কোন কোন বিষয়গুলো সামনে আনবেন?
উত্তর : এক নম্বরে সমস্যা বৈষম্য। বৈষম্য সব সময়েই ছিল; তার বিরুদ্ধে আমরা সংগ্রাম করেছি। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে উন্নতি ও বৈষম্য একে অপরের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। দ্বিতীয় সমস্যা জ্ঞানচর্চার অভাব। জ্ঞান ক্রমাগত মূল্য হারাচ্ছে। অথচ জ্ঞান ছাড়া তো প্রকৃত অগ্রগতি সম্ভব নয়। সেই জ্ঞানের চর্চা দরকার, যা মানবিক উন্নয়নে কাজ দেবে। তৃতীয় সমস্যা বেকারত্ব। উন্নয়ন হচ্ছে কিন্তু বেকারত্ব কমছে না। চতুর্থ সমস্যা সংস্কৃতিচর্চার অপ্রতুলতা। সংস্কৃতির চর্চা না থাকলে সামাজিকতা বাড়বে না, বিপরীতে বাড়ছে বিচ্ছিন্নতা। সংস্কৃতির চর্চা চাই সমাজ-পরিবর্তনের লক্ষ্যে সমস্যা আরও আছে। এই কয়টির কথাই আপাতত বললাম।
প্রশ্ন : বাংলাদেশের অভ্যুদ্বয় হয়েছিল পাকিস্তান রাষ্ট্রের অন্তর্গত ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাকে প্রত্যাখ্যান করে এবং ভাষাভিত্তিক বাঙালি জাতীয়তাবাদকে বিকশিত ও প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে। সেই লক্ষ্য কি পূরণ হয়েছে বলে মনে করেন?
উত্তর : না, হয়নি। বাঙালি জাতীয়তাবাদ যথার্থরূপে প্রতিষ্ঠিত হতে পারেনি। পেছনে অনেকগুলো কারণ আছে। একটা কারণ ধর্মনিরপেক্ষতার প্রতিষ্ঠা না হওয়া। এর ফলে সাম্প্রদায়িক বিভাজন রয়ে গেছে। আরো বড় বিভাজন অবশ্য শ্রেণিগত। শ্রেণিগত বৈষম্য অন্য যে কোনো সময়ের তুলনায় এখন প্রকট। এই বৈষম্যের ফলে সব বাঙালি এক হতে পারছে না। বৈষম্য প্রতিফলিত হয়েছে তিন ধারার শিক্ষায়। ইংরেজি, বাংলা ও মাদ্রাসা- এই তিন ধারাকে এক ধারায় আনার কথা ছিল, এবং এক ধারার মাধ্যম হওয়ায় কথা ছিল বাংলা ভাষায়, তা হয়নি। রাষ্ট্রভাষা বাংলা হয়েছে, কিন্তু রাষ্ট্রের ভাষা যে বাংলা হয়েছে তা বলা যাবে না। সংস্কৃতির চর্চার ঘাটতিও একটি কারণ। ঐক্যকে বাস্তবিক ও গভীর করার জন্য সংস্কৃতি ব্যাপক চর্চার প্রয়োজন ছিল; সেটা করা যায়নি।
প্রশ্ন : আইনের শাসন, ন্যায়বিচার, মানাবাধিকার, সুশাসনের ক্ষেত্রে আমরা বিগত পঞ্চাশ বছরে কতটুকু এগোলাম।
উত্তর : এগিয়েছে, তবে তা যে সন্তোষজনক নয় সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। গণতন্ত্রের জন্য আইনের শাসন অবশ্যই প্রয়োজন; কিন্তু সেটা যথেষ্ট নয়। কারণ আইন তৈরি হয় সমাজের সুবিধাভোগী অংশের স্বার্থের দিকে চোখ রেখে। তাছাড়া বৈষম্যমূলক সমাজে আইনের সুরক্ষাও সবাই পায় না। টাকা খরচ করতে হয়। টাকা সবার থাকে না। যার টাকা বেশি বিচার তার দিকে ঝুঁকে পড়ে। আসলে প্রয়োজন হচ্ছে ন্যায়বিচার। ন্যায়বিচারের পথেও প্রধান অন্তরায় হচ্ছে বৈষম্য। আমরা একটি পুঁজিবাদী আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থার ভেতর রয়েছি; এই ব্যবস্থা মানুষের মৌলিক অধিকারগুলোর ব্যবস্থা করতে অক্ষম। সুশাসনের পথে বড় অন্তরায় হচ্ছে দুর্নীতি। ঘুষ ছাড়া কাজ হয় না। এটাও কিন্তু পুঁজিবাদী ব্যবস্থারই অন্তর্গত। ঔপনিবেশিক ব্যবস্থা আগে ছিল, সেটা এখনো রয়ে গেছে। একে বদলানো চাই।
প্রশ্ন : যে লক্ষ্য নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশের অভ্যুদ্বয় ঘটেছিল, সেই লক্ষ্যে সমাজ বিনির্মাণ আজো সম্ভব হয়নি বলেও অনেকেই মনে করেন। আপনি যদি এর সঙ্গে একমত পোষণ করেন তাহলে এর অন্তরায় কী মনে করেন?
উত্তর : প্রধান অন্তরায় হচ্ছে পুঁজিবাদী উন্নতির ধারা। এই ধারা ব্রিটিশ আমলে ছিল, পাকিস্তানি আমলে আরো বৃদ্ধি পেয়েছিল, এখন সর্বাত্মক হয়ে পড়েছে। আগে রোগকে চেনা দরকার; তার পরে চিকিৎসা। রোগটা হচ্ছে পুঁজিবাদী উন্নতি। উন্নতিকে সামাজিক করা চাই। ব্যক্তিমালিকানা বাদ দিয়ে আমাদেরকে এগুতে হবে সামাজিক মালিকানার দিকে। কাজটা কঠিন, কিন্তু এর কোনো বিকল্প নেই।
প্রশ্ন : বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ আপনি কেমন দেখছেন?
উত্তর : আমি আশাবাদী। আমার মতে পরিবর্তন প্রয়োজন এবং পরিবর্তন সম্ভব। এই পরিবর্তনের জন্য জ্ঞান প্রয়োজন হবে, প্রয়োজন হবে একটি সাংস্কৃতিক জাগরণের। বাংলাদেশে অনেক কিছু ঘটেছে, কিন্তু এ পর্যন্ত কোনো সাংস্কৃতিক জাগরণ ঘটেনি। ওই কাজটা খুবই জরুরি। এক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা থাকবে তরুণদের। ভূমিকা থাকবে তাদের যারা হৃদয়বান ও বুদ্ধিমান। দুটিই চাই, শিক্ষিত হৃদয় চাই, শাণিত বুদ্ধি চাই। সঙ্গে নিতে হবে মেহনতি মানুষকে। সমাজে মেহনতিদের সংখ্যা সর্বাধিক, এবং তাদের শ্রমের ওপর আমাদের রাষ্ট্র ও সমাজ নির্ভরশীল। মেহনতি মানুষকে সঙ্গে না পেলে পরিবর্তন ঘটবে না। স্মরণীয় যে একাত্তরের যুদ্ধে তো অবশ্যই, আমাদের সব অভ্যুত্থানই সম্ভব হয়েছে মেহনতিদের অংশ গ্রহণের দরুন। মূল কাজটা রাজনৈতিক, তবে রাজনৈতিক কাজ গভীর, পূর্ণাঙ্গ ও স্থায়ী হবে না সাংস্কৃতিক প্রস্তুতি না থাকলে।
প্রশ্ন : ধন্যবাদ সময় দেয়ার জন্য।
উত্তর : আপনাকেও আমার ধন্যবাদ।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়