সোহেল চৌধুরী হত্যা : শেষ দিনেও দাখিল হয়নি কেস ডকেট

আগের সংবাদ

ভয়াবহ বন্যায় দিশাহারা মানুষ

পরের সংবাদ

কবি-সাংবাদিক শ্যামল দত্ত : সোনার হাতে সোনার কাঁকন

প্রকাশিত: জুন ১৭, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জুন ১৭, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

প্রত্যাশা পূরণের লক্ষ্যেই কথা বলা; সংগঠিত প্রতিটি কথার পেছনে থাকে প্রত্যাশার স্বপ্ন। সাংবাদিক, সংগঠক ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব শ্যামল দত্ত’র ‘করোনা কাহিনি’ পড়তে পড়তে মনে হলো তিনি মেধা-মনীষায় যতটাই সাংবাদিক-সংগঠক ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব; মননে ততটাই কবি। করোনাকালীন তথ্যনির্ভর গ্রন্থে তিনি সংবেদনশীল মনীষার যে পরিচয় দিয়েছেন, তা পড়ে বারবার মনে হচ্ছিল শ্যামল দত্ত যদি কবিতায় মনোযোগী হতেন, তাহলে তার কাছ থেকে বাংলা কবিতার পাঠক ভিন্ন কিছু পেতেও পারত। বিশেষ করে তার করোনা কাহিনি গ্রন্থের- ‘অবরুদ্ধ দেশে নজিরবিহীন স্বাধীনতা দিবস’, ‘বরিস জনসনের জন্য শুভকামনা ও এক ব্রিটিশ বাংলাদেশি ডাক্তারের মৃত্যু’, ‘এমন বিষণ্ন পহেলা বৈশাখ যেন আর কখনো না আসে’, ‘৫ করোনা রোগী পুড়ে কয়লা, দায় কার?’ এবং ‘চলুন, ইচ্ছেমতোই বাঁচি!’ শিরোনামের গদ্যগুলো পড়ে আমার মনে এ প্রতীতি জন্মেছে। অথবা গ্রন্থের ভূমিকায় যখন তিনি লিখেন- ‘…ছোট্ট একটি ভাইরাস। পৃথিবীজুড়ে কত ক্ষমতার দম্ভ, শক্তির মহড়া, অস্ত্রের ভাণ্ডার। কিছুই কাজে লাগছে না এখন। বাঁচার আকুতি সবার। কান্নার রোল-আহাজারির শব্দ সবই একই। এখানে কোনো সীমান্ত নেই। কোনো কাঁটাতার নেই। আকাশ উঁচু করে রাখা কোনো দেয়াল নেই। সবই তুচ্ছ, তুচ্ছ ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র এক বিন্দুর কাছে।
মানুষ কি বুঝতে পারছে তার অর্জনের নামে এতদিনের যে অহংকার তা কতটা ঠুনকো। বিজ্ঞানের আবিষ্কারের নামে যে দম্ভ, তা কতটা অতিশয়োক্তি। এই বোধের পুনর্জাগরণ কতখানি দরকার বা সময়োপযোগী সেই বিশ্লেষণে না হয় নাই-বা গেলাম, উপলব্ধিটা যে দরকার ছিল, দর্পচূর্ণ হওয়া কতখানি প্রয়োজনীয় ছিল, তা অনেকেই টের পাচ্ছেন। এই উপলব্ধি যতক্ষণ পূর্ণ হচ্ছে না, ততদিন সম্ভবত মহামারিও যাবে না।’ তখন তার সংবেদনশীল মননের সন্ধান পাই সহসাই। করোনা কাহিনি যখন পড়া শেষ, হঠাৎ দৃষ্টি পড়ল বইটির শেষ প্রচ্ছদের ফ্ল্যাপে। সাধারণত এমনটি হয় না; যে কোনো বই পড়ার আগে তার ফ্ল্যাপ আর ভূমিকা পড়া আমার অভ্যাস, কিন্তু করোনা কাহিনির ফ্ল্যাপ পড়লাম বিলম্বে; সেখানেই জানা হলো ১৯৮৮-তে শ্যামল দত্ত’র কবিতার বই ‘অগ্নিবর্ণ সাতটি ঘোড়া’ প্রকাশিত হয়েছে চট্টগ্রাম থেকে। এছাড়া তিনি সম্পাদনা করেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান : পোয়েট অব পলিটিক্স (২০১৮), সাহিত্য ভাবনা : আমাদের রবীন্দ্রনাথ থেকে আমাদের হুমায়ূন (২০১৯), বাংলাদেশের সেরা গল্প (২০১৯), সাহিত্য ও সংগ্রাম : জাহানারা ইমাম থেকে শেখ হাসিনা (২০২১), সেরা ১০ উপন্যাস (২০২১) ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ। তাৎক্ষণিকভাবে সিদ্ধান্ত নিলাম তার কবিতা নিয়েই লিখব। করোনা কাহিনি আমাকে কবি শ্যামল দত্তকে খুঁজতে প্রাণিত করল; করোনা কাহিনি বইটি সময়ের দলিল, এ দলিল একদিন ইতিহাস হবে; কিন্তু কবিতা চিরকালের অনুষঙ্গ; তাই কবিতা নিয়ে আলোচনায় আমার আগ্রহ। ‘অগ্নিবর্ণ সাতটি ঘোড়া’ যখন হাতে এলো, দেখলাম, এটি চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত প্রথম সংস্করণ নয়, বরং বত্রিশ বছর পর ঢাকার আবিষ্কার প্রকাশন থেকে প্রকাশিত দ্বিতীয় সংস্করণ। কাব্য গ্রন্থটি হাতে নিয়ে চমকিত হওয়ার পালা। যিনি অনুসন্ধিৎসু মনীষায় রচনা করেন ‘করোনা কাহিনি’ তার মননে ঘুমায় ‘অগ্নিবর্ণ সাতটি ঘোড়া’ কাব্যের কবি শ্যামল দত্ত। যিনি সংবেদনশীল সাংবাদিক, তিনিই কবি; এ যেন ‘সোনার হাতে সোনার কাঁকন কে কার অলংকার!’

দুই.
‘অগ্নিবর্ণ সাতটি ঘোড়া’ কাব্যের কিছু বৈশিষ্ট্য আছে, যা অন্য পাঁচটি কাব্যের সঙ্গে মেলে না। ৪৮ পৃষ্ঠার বইটিতে মোট ২৪টি কবিতা আছে, কোনো কবিতাই দীর্ঘ নয়। সংকলিত ২৪টি কবিতার মধ্যে ১৬টি কবিতার ৩ বা ৪ পঙ্ক্তি আবার আলাদা একটি পৃষ্ঠায় উদ্ধৃতির মতো করে উপস্থাপিত হয়েছে। বাকি ৮টি কবিতা থেকে কোনো নির্বাচিত পঙ্ক্তি উপস্থাপিত হয়নি। কিন্তু কেন? পাঠকের মনে প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক। প্রথম সংস্করণ কেমন ছিল আমার জানা নেই; সেখানেও কি এভাবেই উপস্থাপিত হয়েছিল; না-কি কাব্যটিকে পূর্ণতা দিতে এ কৌশল অবলম্বন করেছেন প্রকাশক? যদি তাই হয়, তাহলে ৮টি কবিতা থেকে কেন কোনো পঙ্ক্তি উদ্ধৃত করে আরো ৮ পৃষ্ঠা বাড়ানো হলো না? এসব প্রশ্নের মীমাংসার আগে আসুন আমরা কবির কাব্য সম্ভাবনা এবং সংবেদনশীল মননের পরিচয় খুঁজতে কবির কবিতার পাঠ গ্রহণ করি-
প্রত্যেক মানুষের নিজস্ব জন্মদিন থাকে।
বুকে তিনশ পঁয়ষট্টি মোমবাতি জ্বালিয়ে রেখেছি
যে কোনটা নিভলেই তোমার আশ্চর্য জন্মদিন হয়ে যাবে।
তাবৎ ক্ষুধার্ত মানুষের আহারের তৈরি সুশোভন কেক
নিহত পাখির রক্তাক্ত ছুরির আঘাতে
ক্ষতবিক্ষত হওয়ার অপেক্ষায় বিমর্ষ।

চারপাশে কিছু কৌতুক, লজ্জাহীন খল্খল্ হাসি,
কিছু সুযোগসন্ধানী বেড়াল আজ চতুরতার নীল ধুম জ্বলবে।
প্রত্যেক মৃত মানুষের একটা জন্মদিন ছিল।
সকল উজ্জ্বলতা ঘুমিয়ে পড়লে
জানালার এইটুকু ফাঁক গলে
ঢুকে যায় তিন লক্ষ বরফের কুচি।

শূন্য বেলুনের মাঝে নিজেকে রেখে, ভাবি বড়ো সুখে আছি
পরিচ্ছন্ন হাড় চিবুতে চিবুতে
খুনি বেড়ালটা পিছনে ফ্যাঃ ফ্যাঃ করে হেসে ওঠে।
(জন্মদিন \ অগ্নিবর্ণ সাতটি ঘোড়া \ পৃষ্ঠা-৯)
কবিতাটি থেকে প্রথম তিন পঙ্ক্তি আলাদা করে ১০ম পৃষ্ঠায় উপস্থাপিত-
‘প্রত্যেক মানুষের নিজস্ব জন্মদিন থাকে।
বুকে তিনশ পঁয়ষট্টি মোমবাতি জ্বালিয়ে রেখেছি
যে কোনটা নিভলেই তোমার আশ্চর্য জন্মদিন হয়ে যাবে।’
‘জন্মদিন’ কবিতা থেকে এই যে তিনটি পঙ্ক্তি আলাদা করে উপস্থাপিত হলো, সে নির্বাচন কার জানি না; স্বাভাবিকভাবেই আমরা ধরে নেবো এ নির্বাচন কবির নিজের। আমরা যদি ১৫ পঙ্ক্তির কবিতার দিকে মনোযোগী হই, দেখবো; কবিতার অন্য পঙ্ক্তিগুলো কিছুতেই অনুজ্জ্বল নয়; বরং নানান বিবেচনায় শেষ তিন পঙ্ক্তির গভীরতা অনেক বেশি। অথবা মাঝের তিনটি পঙ্ক্তি-
‘চারপাশে কিছু কৌতুক, লজ্জাহীন খল্খল্ হাসি,
কিছু সুযোগসন্ধানী বেড়াল আজ চতুরতার নীল ধুম জ্বলবে।
প্রত্যেক মৃত মানুষের একটা জন্মদিন ছিল।’
এ পঙ্ক্তি তিনটি কি অনেক বেশি ব্যঞ্জনাময় নয়? শ্যামল দত্ত’র কবিতার সৌন্দর্য আবিষ্কারের সঙ্গে সঙ্গে প্রশ্নটি অনেক বেশি তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
আমরা ‘অগ্নিবর্ণ সাতটি ঘোড়া’ কাব্যের নাম কবিতাটির দিকে দৃষ্টি দিতে চাই-

সেই পারে,
নীল দিগন্তে হালকা মেঘের পালক ওড়াতে,
সতেজ বাগানে কাগজের মতো ধবধবে সাদা ফুল ফোটায়।

চোখে আগুন জ্বালিয়ে,
নদীর জল শুকিয়ে ফেলল কে?
অনায়াসে, দৃষ্টির করাতে কাটে তেজীয়ান গাছ
চমকে দেওয়ার মত দ্রুত সাইকেল,
পিঠে প্রজাপতি নিয়ে সেই ছুটে যায়,
রক্তে তার অগ্নিবর্ণ ছুটন্ত সাতটি ঘোড়ার নিজ।

নিঃশ্বাসে ভয়ঙ্করী ঝড়ের বিপর্যয়-
একমাত্র সেই আনে,
ভিতরে যার শূন্যতার মতো বিশাল নিঃশব্দতা।
(অগ্নিবর্ণ সাতটি ঘোড়া \ পৃষ্ঠা-২১)
উপরের কবিতার শেষ তিন পঙ্ক্তি পরবর্তী পৃষ্ঠায় উদ্ধৃতি হিসেবে উপস্থাপিত হয়েছে। এ পঙ্ক্তি তিনটি উজ্জ্বল- সন্দেহ নেই; কিন্তু কবিতাটির দ্বিতীয় চরণে যে পাঁচটি পঙ্ক্তি, তাকে তো আমার কাছে কম গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়নি! পাঠক সামান্য মনোযোগী হলেই দেখবেন, উদ্ধৃত দুটি কবিতাই শুরু হয়েছে রোমান্টিক আবহে; কিন্তু দুটি কবিতাই শেষপর্যন্ত ভিন্ন দিকে মোড় নিয়েছে। এ মুন্সিয়ানা সবার থাকে না; যা শ্যামল দত্ত’র কবিতায় স্পষ্ট। অথচ ১৬টি কবিতা থেকে কতিপয় পঙ্ক্তি উদ্ধৃতি দিয়ে কবির সম্ভাবনাকে ক্ষুণ্ন করা হয়েছে। যা হোক, বইটিকে প্রশ্নবিদ্ধ করা আমার কাজ নয়; প্রশ্নগুলো উত্থাপনের ভিন্ন উদ্দেশ্য আছে, যা আমি রচনার শেষ দিকে আলোচনা করব; তার আগে যে ৮টি কবিতা থেকে কোনো পঙ্ক্তি উদ্ধৃত হয়নি; আমি এবার সেই ৮টি কবিতা থেকে অন্তত ৪টি কবিতা নিয়ে সামান্য আলোকপাত করতে চাই।

তিন.
আমার বিশ্বাস অবহেলিত ৮টি কবিতার ৪টির ওপর আলোকপাত করা হলেই কবি শ্যামল দত্ত’র কাব্যশক্তির দ্যুতি অনুসন্ধান সহজ হয়ে যাবে। এবার আসুন পাঠ করা যাক ৪টি কবিতার প্রথমটি-
পাত্র থেকে রংটা ছুড়ে দিতেই
আকাশ লাল হয়ে উঠল-

এখন উজ্জ্বল তারা আর কেউই চায় না।
চোখ জুড়ানো এই রঙ মিলিয়ে গেলে,
মানুষের অহঙ্কার কমে যায়।

আমি সেই নম্র তারার আলোয়-
অসংখ্য পায়ের শব্দ পৃথক করেছি,
এতো অল্পে চিহ্নগুলো অর্থহীন হতে দেওয়া যায় না।
একটু দাঁড়াও,
আপাতত সুস্থ থাকার কথাটা ভেবে নিই।
(অহঙ্কার \ পৃষ্ঠা-২৫)
‘অহঙ্কার’ কবিতার তৃতীয় চরণের তিনটি পঙ্ক্তি নানান কারণে তাৎপর্যপূর্ণ; আমার বিবেচনায় পঙ্ক্তি তিনটি কবির অনন্য সৃষ্টি; কিন্তু পঙ্ক্তি তিনটিকে উদ্ধৃত করা হয়নি। আবার নিচের কবিতাটি যদি পড়ি-

যদি সবকিছু এত সহজে ছেড়ে দেওয়া যায়;
তবে যাও, যেদিকে পাহাড় দেখো, অবাক চূড়ায় উঠে
আবিরের মতো লাল আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্ন দেখো।

এখন বাতাস তোমাকে বৃষ্টির গান শোনাবে,
কিংবা পাহাড়ের আকাশ ছোঁয়ার শীতল কবিতা
কিন্তু কারো গান অবিকল কান্নার মতন-
ভোরের নদীর কাছে,

বিকেল রোদের মতো শীর্ণকায় মানুষের কাছে,
শুধু রাত গভীর হলে, অলক্ষ্য একটি তারা
যা স্মৃতির মতো, কিংবা স্বপ্নের মতো
নিঃশ্বাস আর অসীম শূন্যতায় নিষ্ঠুর হয়ে ওঠে।
মনে হয় কারো চোখের শ্যামল পাতায়
করুণা, অসীম করুণার মতো ছায়া লেগে থাকে।

যদি সবকিছু ছেড়ে যেতে চাও, যাও
ভুলে থাকার ঘুমের ভিতর মুক্তির গান শুনবো।
(ভুলে থাকা \ পৃষ্ঠা-৩৭)

উপরের কবিতায়-
‘বিকেল রোদের মতো শীর্ণকায় মানুষের কাছে,
শুধু রাত গভীর হলে, অলক্ষ্য একটি তারা
যা স্মৃতির মতো, কিংবা স্বপ্নের মতো
নিঃশ্বাস আর অসীম শূন্যতায় নিষ্ঠুর হয়ে ওঠে।’
পঙ্ক্তি চারটি কবি শ্যামল দত্তের অসাধারণ সৃষ্টি বলে আমার বিশ্বাস; কিন্তু এ পঙ্ক্তিগুলো উদ্ধৃত হয়নি কাব্যে। কাব্যের ২৪টি কবিতা থেকে যে ১৬টি কবিতার কিছু পঙ্ক্তি বইটিতে উদ্ধৃত করা হয়েছে, তাদের পাশে ‘ভুলে থাকা’ কবিতার উপরের চারটি পঙ্ক্তি উপস্থাপিত হওয়ার যোগ্যতা রাখে। এবার যদি তৃতীয় কবিতাটি পাঠ করি-
রাত, চলে গেছে বহু দূর পথে,
মাটি তার নূপুরের ঘ্রাণ বুকে নেয়,
বাঁশির নির্দয় আঘাত দূরে, তিমিরে
ফের কখনো নির্জন চুল হাতের অসুখ পাবে না।

কার স্মৃতির অসুখ জমছে দেহে,
কেউ কি কাউকে মূলত ভালোবাসে?
কী বাতাস নষ্ট করেছিল হিরণ্য প্রেম
কার কথা ভরে উঠে বিকেলের যন্ত্র কলরব?

শীতল, শীর্ণ নদী শব্দহীন চলে গেছে সর্বস্ব সম্পর্কে,
তপ্ত লোহার পাতে,
ঠাণ্ডা ধূলো জমে, পরতে পরতে,

তবু মাটি তার ফেলে দেওয়া ঘাম,
বড়ো যতেœ ধরে রাখে,
কবে ফুল হয়ে ফোটে।
নির্জন প্রভাতে কিছু তো ঘটে।
(নিজস্ব \ পৃষ্ঠা-৪১)

কবিতাটির আদ্যোপান্ত চমৎকার হলেও প্রথম চারটি পঙ্ক্তি কি চমকে দেয়ার মতো নয়? কিন্তু এ কবিতা থেকেও কোনো পঙ্ক্তি উদ্ধৃতির তালিকায় আসেনি। এভাবেই বইটি আমাকে বঞ্চিত করেছে বারবার। এবারে বঞ্চিত ৮ কবিতার চতুর্থটিকে আলোচনায় এনে কবি শ্যামল দত্ত’র কাব্যদ্যুতি বিষয়ক এ রচনার ইতি টানতে চাই।

জলের অতল থেকে উঠে আসে নির্মম ঘুম।
চারদিকে থৈ থৈ, সমুদ্র প্রবল

নিশিকান্ত, পথ কোথায়?
চমৎকার বৃষ্টি আর বাতাসে মাটি ভিজে ওঠে।
নিশিকান্ত অন্ধ ইঁদুর
স্তব্ধ বিস্ময়ে,
ভেজা মাটি কামড়ে কামড়ে পথ খোঁজে।
হাঁটু অব্দি জল ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে, নিশিকান্ত
স্তব্ধ বিস্ময়ে,
চারজন বালকের হাততালির ক্ষুব্ধ গর্জন শোনে।
(পথ কোথায়? \ পৃষ্ঠা-৪৭)

রূপকের আশ্রয়ে সময়ের স্থবিরতাকে যতটা নিপুণ শৈলীতে উপস্থাপন করা হয়েছে এ কবিতায়, তা-কি অনিন্দ্যসুন্দর নয়? চাইলে বঞ্চিত ৮ কবিতার বাকি ৪টি থেকে উদ্ধৃতিযোগ্য পঙ্ক্তি আবিষ্কার কঠিন হবে না; কিন্তু রচনার পরিসর বিবেচনা করে তা থেকে বিরত থাকলাম।
করোনা কাহিনি গ্রন্থে যে স্থবিরতা, যে সংশয়ের কথা উচ্চারিত হয়েছে আজকের এই অতিমারির প্রেক্ষাপটে ‘পথ কোথায়?’ কবিতায় নিশিকান্ত কি একই স্থবিরতার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে নয়? ৩৩ বছর আগে কবি শ্যামল দত্ত নিশিকান্তকে যে স্থবিরতার সমুখে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছিলেন; ৩৩ বছর পর সাংবাদিক শ্যামল দত্ত নিজে যেন একই স্থবিরতার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছেন। যে সংবেদনশীল মন নিয়ে একজন মানবতাবাদী কবি ৩৩ বছর আগে রুগ্ন সমাজের দুর্দশা প্রত্যক্ষ করেছিলেন; সেই দুর্দশার বেদনাটিই ৩৩ বছর পর মানবদরদী একজন সাংবাদিক প্রত্যক্ষ করলেন তার মনীষার আলোয়।

চার.
কবিতার তিন/চার পঙ্ক্তি উদ্ধৃতির মতো উপস্থাপন করে পৃষ্ঠা বাড়ানোর উদ্যোগের বিপক্ষে যে কথা আমি পরে বলব বলেছিলাম, সে কথাটি উচ্চারণের মাধ্যমে এ রচনার আজ ইতি টানতে চাই। আমি মনে করি উদ্ধৃতির পুনরুচ্চারণ না করে যদি বইটিতে আমরা আরো ১৬টি পূর্ণাঙ্গ কবিতা পাঠের সুযোগ পেতাম, সেটি হতো সবদিক থেকে গ্রহণীয়। একজন নিষ্ঠ পাঠক হিসেবে কবি শ্যামল দত্ত’র কবিতাযাত্রার প্রবহমানতা দাবি করে বলব, ‘আপনার সামাজিক ও মানবিক দায় মোচনে সাংবাদিকতায় অবশ্যই ক্রিয়াশীল থাকুন; কিন্তু কবিতার মতো শ্যামল অমোঘাস্ত্রটিকে অকার্যকর হতে দেবেন না!’
আমি জানি না সাংবাদিক শ্যামল দত্ত’র অলংকার কবি শ্যামল দত্ত, না-কি কবি শ্যামল দত্ত’র অহংকার সাংবাদিক শ্যামল দত্ত? আমি বিশ্বাস করি করোনা কাহিনির লেখক শ্যামল দত্ত’র বুকে যে কাব্যস্রোত প্রবহমান, তাকে উজ্জীবিত রাখা জরুরি। কবি শ্যামল দত্তকে হরিয়ে আমাদের কাব্যাঙ্গনের ক্ষতি হোক, তা যেমন প্রত্যাশিত নয়; সমাজপ্রগতির যুদ্ধে সংবেদনশীল সাহসী সাংবাদিক শ্যামল দত্ত পরাস্ত হোন, তা-ও কখনো কাক্সিক্ষত নয়; দুজন দুজনের অলংকার হয়ে দুঃসহ সময়ে আলোকবর্তিকা হাতে সুন্দর আগামীর পথে হেঁটে যান; এই শুভ কামনা জানাই।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়