ঐক্য পরিষদের বিবৃতি : ধর্ম মন্ত্রণালয়ে বাজেট বরাদ্দে ধর্মীয় বৈষম্য অবসান দাবি

আগের সংবাদ

নিছক দুর্ঘটনা নাকি নাশকতা : সীতাকুণ্ড ট্র্যাজেডি

পরের সংবাদ

রপ্তানি জটিলতায় হুমকির মুখে উপকূলের কাঁকড়া শিল্প

প্রকাশিত: জুন ৭, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জুন ৭, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

শেখ সিরাজউদ্দৌলা লিংকন, কয়রা (খুলনা) থেকে : কাঁকড়া হতে পারে উপকূলীয় অঞ্চল কয়রার অপার সম্ভাবনাময় শিল্প। তবে দেশ-বিদেশে কাঁকড়ার প্রচুর চাহিদা থাকলেও রপ্তানি ব্যবস্থাপনাসহ নানা প্রতিকূলতায় সম্ভাবনাময় খাতটি হুমকির মুখে পড়েছে। করোনা মহামারির আগে উপকূলের বড় একটি অংশ এই পেশার সঙ্গে জড়িত থাকলেও বর্তমানে মূল্য ও নানা অব্যবস্থাপনার কারণে অধিকাংশ মানুষ পেশা পরিবর্তন করছে, অনেকে বেকারত্বের অভিশাপে পুড়ছে। বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের অতি সম্ভাবনাময় খাতটি বাঁচাতে কর্তৃপক্ষের আশু হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন উপকূলবাসী।
জানা যায়, দেশের জীবন্ত কাঁকড়া দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করা হতো। করোনার আগে আন্তর্জাতিক বাজারে এর চাহিদা ও মূল্য বাড়ায় উপকূলের বেশির ভাগ মানুষ ঝুঁকে পড়ে কাঁকড়া চাষে।
মহামারির আগের বছরগুলোতে হাজার হাজার টন কাঁকড়া চীন, তাইওয়ান, কোরিয়া, হংকংসহ বিশ্বের অন্তত ২০-২৫টি দেশে রপ্তানি করা হতো। এর মধ্যে বড় একটি অংশ কয়রার সুন্দরবনের প্রাকৃতিক কাঁকড়া ও কয়রা উপকূলের চাষ করা কাঁকড়া। উপজেলা মৎস্য অফিস সূত্রে জানা যায়, করোনার আগে সুন্দরবন বাদে শুধুমাত্র উপকূলে ১৩০টি খামারে উৎপাদন হতো ২১৫ টন থেকে ২৫০ টন পর্যন্ত কাঁকড়া। বর্তমানে কাঁকড়া খামার কমে দাঁড়িয়েছে ৬৫টি আর তাতে উৎপাদন হচ্ছে মাত্র ১১২ থেকে ১২০ টন।
কয়রার মোকামগুলোতে ব্যাপক পরিমাণে কাঁকড়া দেখা গেলেও ৯০ শতাংশ কাঁকড়াই সুন্দরবনসহ প্রাকৃতিক উৎসের। কিন্তু সুন্দরবনের নদনদী অবৈধ ব্যবসায়ীরা বিষ প্রয়োগে মাছ ধরায় কাঁকড়াসহ বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য হুমকিতে পড়েছে। তাছাড়া বিষ দিয়ে মাছ ধরার কারণে বিষ খেয়ে অধিকাংশ কাঁকড়া মারা যাচ্ছে, জীবিতগুলো দুর্বল হয়ে যাচ্ছে, ফলে বিদেশীরা বিষাক্ত দুর্বল কাঁকড়া নিতে চাচ্ছেন না।
এ ব্যাপারে কয়রা উপজেলা কাঁকড়া ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক, ভাই ভাই কাঁকড়া ডিপোর মালিক আলমগীর হোসেন বলেন, আমাদের এখানকার প্রায় ৯০ শতাংশ কাঁকড়া চীনে যেত। কিন্তু করোনার প্রাদুর্ভাব হলে চীন সম্পূর্ণরূপে কাঁকড়া নেয়া বন্ধ করে দেয়, করোনা পরবর্তীতে ব্যবসায়ীদের নিজস্ব উদ্যোগে চীন স্বল্প পরিসরে মাল কিনতে রাজি হলেও ব্যবসায়িক কাগজপত্র যোগাযোগ ব্যবস্থা ও বিমান সমস্যার কারণে সম্ভাবনাময় খাতটি হুমকিতে পড়েছে।
তিনি বলেন, যেখানে ২০১৯ সালে ১০ পায়ের ডাবল এফ ওয়ান (ডিম কাঁকড়া) এক কেজির মূল্য ছিল ২২শ টাকা, বর্তমানে তার মূল্য ৮০০-৯০০ টাকা। মূল্য কমার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, চীন দাম কম দিচ্ছে না কবে রপ্তানি কাগজপত্রে জটিলতার কারণে ব্যবসায়িদের মাল পাঠাতে না পারা ও বিমান সমস্যার কারণে বাজারদর নেমে গেছে। যেহেতু কাঁকড়া জীবন্ত পণ্য হিসেবে রপ্তানি হয়।
কাঁকড়া পানি থেকে তোলার ৭ থেকে ১০ দিন জীবিত থাকে যদি এই সময়ের মধ্যে বিদেশে পাঠানো না হয় তাহলে বিক্রির অযোগ্য হয়ে পড়ে।
তাছাড়া চীন ভাইরাসমুক্ত শক্তিশালী কাঁকড়া পছন্দ করে। বর্তমানে কয়রা উপকূলে কাঁকড়ার চাষাবাদ নেই বললেই চলে। এখানকার প্রায় ৯০ শতাংশ কাঁকড়াই সুন্দরবনসহ প্রাকৃতিক উৎসের।
বর্ষা মৌসুমে প্রাকৃতিক উৎসের কাঁকড়া থাকে ভাইরাসমুক্ত ও শক্তিশালী। বিদেশীরা এই কাঁকড়া বেশি পছন্দ করে, কিন্তু অসাধু ব্যবসায়ীরা বেশি মুনাফার আশায় সুন্দরবনে নির্বিচারে বিষ প্রয়োগে মাছ ধরায় রেনু ও ছোট কাঁকড়া মারা যাচ্ছে আর বড় কাঁকড়া বেঁচে গেলেও দুর্বল হয়ে পড়ছে।
কয়রা দিব্য এন্টারপ্রাইজের মালিক মিজানুর রহমান মিলন বলেন, করোনার আগে প্রতি গোন মুখে আমার ঘরে (৭ দিনে একগোন) ২ হাজার থেকে ২৫শ কেজি মাল (কাঁকড়া) হত, এখন গোনে ১২ থেকে ১৪শ কেজির বেশি হচ্ছে না।
আগে যেখানে ৫০০ গ্রাম পুরুষ কাকড়ার কেজি ছিল ১৫০০-১৬০০ টাকা পর্যন্ত, বর্তমানে দাম ৮০০-৯০০ টাকা। ডিম কাকড়ার আগে দাম ছিল ২২০০-২৫০০ টাকা পর্যন্ত, বর্তমানে দাম ৮০০-১০০০ টাকা। তিনি বলেন, আগের মত চায়নার বাজার ফিরে পেলে উপকূলের কাঁকড়াই হবে দেশের প্রধান রপ্তানি আয়। তাছাড়া সরাসরি চায়নার লাইসেন্স পেলে উপকূলে কাঁকড়া চাষ বৃদ্ধি পাবে।
কয়রা উপজেলা কাঁকড়া ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির কোষাধ্যক্ষ আবু মুসা গাইন বলেন, শুনেছি চায়না মালের সঠিক দাম দিলেও ঢাকায় একটি ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট বিভিন্ন অব্যবস্থাপনা সৃষ্টি করে প্রতিযোগী ব্যবসায়ীদের ব্যবসা থেকে সরিয়ে রেখেছে। ফলে হাতেগোনা ২-৩ জন ব্যবসায়ী বেশি লাভের আশায় ইচ্ছমতো দাম হাঁকিয়ে কম মূল্যে মাল কিনছে।
ঋণ নিয়ে ব্যবসা শুরু করেছিলাম, ব্যবসা হারিয়ে দেউলিয়া হয়ে ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে বাড়ি বাড়ি গিয়ে কাঁকড়া কিনছি, তাতে যা হচ্ছে তাই দিয়েই কোনো রকম সংসার চলছে।
কাঁকড়া চাষি অনিল ঘরামি বলেন, বসতবাড়ির আঙিনায় ছোট পুকুরের এক কোণে নেট ও বাঁশের পাটা দিয়ে কাঁকড়া চাষ করে বাড়িতে টিনের নতুন ঘর তুলেছি। পরিবারের ৪ সদস্যের ভরণ পোষণসহ ছেলেদের উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়ার খরচ জুগিয়েছি, কিন্তু দাম পড়ে যাওয়ায় কাঁকড়া চাষ বাদ দিয়ে গত দুই বছর শহরে দিন মজুরি খেটে কোনোরকমে সংসার চলছে।
উপজেলা সদরের বাসিন্দা দিদারুল ইসলাম সানা বলেন, করোনার এক বছর আগে উপজেলা পরিষদের একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্প থেকে ৭০ হাজার টাকা ঋণ ও নিজের আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে ৯০ হাজার টাকা ধারদেনা করে বসতবাড়ির আঙিনার পুকুরসহ ছয় কাঠা জায়গায় কাঁকড়া চাষ শুরু করি। কিছুদিন ভালো গেলেও করোনার কারণে চাষাবাদ বন্ধ করতে বাধ্য হই।
তিন বছর ধরে অনেক কষ্ট করে দিনমজুরের কাজ করে ঋণের টাকা পরিশোধ করতে পারলেও আত্মীয়দের ঋণ আজো শোধ করতে পারিনি।
এ ব্যাপারে উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা মো. আমিনুল হক ভোরের কাগজকে বলেন, সুন্দরবন উপকূলে কাঁকড়া চাষ পুরোপুরিভাবে প্রাকৃতিক উৎস থেকে আহরণের ওপর নির্ভরশীল। বেশি মুনাফার আশায় প্রাকৃতিক উৎস থেকে নির্বিচারে মা কাঁকড়া পোনা এবং অপরিপক্ব ছোট কাঁকড়া আহরণের প্রবণতা কমিয়ে প্রচলিত প্রাকৃতিক উৎস থেকে নির্বিচারে অপরিপক্ব ছোট কাঁকড়া ধরার প্রবণতা রোধ করার জন্য পোনা উৎপাদন এবং চাষ সম্প্রসারণ করা দরকার। অপরিপক্ব ও ছোট কাঁকড়া আহরণের ওপর নিয়ন্ত্রণ না থাকলে এ শিল্প হুমকিতে পড়বে। তিনি বলেন, উন্নত চাষ পদ্ধতি চালু হলে প্রাকৃতিক উৎসের কাঁকড়া আহরণের নির্ভরশীলতা কমবে।
এছাড়া চাষিদের সহজ শর্তে ঋণ ও প্রণোদনা, প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা স্থাপন, প্রশিক্ষণ উপকরণ ও সহায়তা, পরিবহন সুবিধা এবং বাজারজাতকরণে মধ্যস্থভোগী মহাজনসহ বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা দূর করতে পারলে উপকূলীয় অঞ্চলে কাঁকড়া সম্ভাবনাময় শিল্প হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হবে।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়