ঢাকায় সিপিবির সমাবেশ কাল

আগের সংবাদ

টার্গেট এবার রাজপথ দখল : পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নামছে আওয়ামী লীগ ও প্রধান প্রতিপক্ষ বিএনপি

পরের সংবাদ

‘দিগলি টাঁড়ের বৃত্তান্তে’র কিছু কথা

প্রকাশিত: জুন ৩, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জুন ৩, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

মায়া মৃদঙ্গ, রাণীরঘাটের বৃত্তান্ত, নিলয় না জানি, জনপদ জনপথ, জানমারি, স্বর্ণচাপার উপাখ্যান, তৃণভূমি, অলীক মানুষের মতো রচনার প্রকৃতিবাদী কথাশিল্পী সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ, তার এই বিপুল পরিমাণ গল্প-উপন্যাস লিখতে গিয়ে তাকে শত-সহস্র চরিত্র নির্মাণ করতে হয়েছে, উদ্ভাবন করতে হয়েছে অজস্র আখ্যান, পটভূমি ও পরিবেশ প্রয়োগে আনতে হয়েছে অভিনব বৈচিত্র্য, এবং সংলাপ অথবা বর্ণনা অংকন করতে যুক্ত হয়েছে নতুন-নতুন মাত্রা, সুবিপুল উদ্ভাবনী ক্ষমতার অধিকারী না হলে তা অবশ্য কখনো সম্ভব হতো না, অগাধ কল্পনাশক্তি এবং সৃষ্টির অভিপ্রায় নিয়েই সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ এসেছিলেন পৃথিবীতে, নিরবচ্ছিন্নভাবে কলম চালিয়েছেন জীবনভর, সৃজনশীলতার চর্চা রেখেছেন অব্যাহত বেগবান।
সিরাজ তার প্রথম যৌবনের অনবদ্য দিনগুলো ‘আলকাপ’ দলের ‘ওস্তাদ’ হয়ে রাঢ়-বরেন্দ্র অঞ্চলের বিভিন্ন গ্রামে-গ্রামে ঘুরে বেড়িয়েছেন, তখন তিনি আলকাপের সঙ্গে এতোখানিই সম্পৃক্ত যে প্রায় পরিচিতজনরাই তাকে ওই দলের সঙ্গে ঘুরে বেড়াতে দেখে বিস্মিত প্রকাশ করে বলতো, ‘এসব হাড়-হাভাতেদের দলে আপনি জুটলেন কেনো’? এমন প্রশ্নের কোনো উত্তর তিনি কখনো দিতেন না, পরবর্তী সময়ে আমরা দেখি এই আলকাপ জীবনের অভিজ্ঞতা নিয়ে লেখা অসামান্য সৃষ্টি ‘মায়া মৃদঙ্গ’, তারপর ওইসব অঞ্চলের আউল-বাউল, পীর-দরবেশ, ফকির-ফাকরাদের মেলা এবং দরগায় ঘুরতে লাগলেন, আমরা দেখি সেই অভিজ্ঞতায় পুষ্ট ‘নিলয় না জানি’ উপন্যাসে তার বিস্তৃত বর্ণনা আছে। জীবন-জীবিকার কারণে কলিকাতায় মতো ইট-লোহ-সিমেন্টের কংক্রিটে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে গেলেও মন তার বাঁধনহীন ‘উড়ালপঙ্খী’ হয়ে উড়ে গেছে রাঢ় বা বরেন্দ্রের খটখটে জনপদে। ভ্রমণবিলাসী এই মানুষটা নিজেকে বারংবার ভেঙেচুরে দেখেছেন গল্পের আখ্যানের প্রয়োজনে, তার ছোটগল্পগুলো বিরল সৃষ্টি। ‘দিগলি টাঁড়ের বৃত্তান্ত’ গল্পটি নিয়ে আলোচনা করতে চাই, মোটা দাগে বলতে হলে অবশ্য বলতেই হয়, গল্পটির শিল্পরূপ অসাধারণ, চরিত্র প্রকৃতিবিন্যাস মনে দাগ কাটবার মতো, সুতরাং ‘দিগলি টাঁড়ের বৃত্তান্ত’ উভয় বাংলার মানুষেরই উপাখ্যান।
অবশেষে ‘দিগলি টাঁড়ের বৃত্তান্ত’ গল্পে দেখা যায় সাহাবাবুদের মোটর সার্ভিসের মেকানিক নির্মলের সঙ্গে আকাশমনির পালিয়ে যাওয়া। ঘটনাটি আকস্মিক হলেও এটাই যে স্বাভাবিক, এ কথাটি মানতেও কষ্ট। হাজার পাঁচেক টাকার নোট ছিলো, নির্মলকে দিয়ে ভাঙিয়ে শূন্য বাকসো রেখে ভেগেছে তারই মেয়ে, সাধুচরণ আর কিছু ভাবতে পারে না। তারপরও ভাবনা তার হারিয়ে যায়, যেন এমনই হবে ভেবেছিলো, শুধুই নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে দেখে, এমনকি খাঁচার টিয়াপাখিটিও নেই, শূন্য খাঁচা। একজন পিতার দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে, কেউই থাকে না দিগলি টাঁড়ে, এখানে যতোই টাকা উড়–ক না কেনো, কেউই মাথা উঁচু রেখে থাকতে পারে না মেয়েদের টাঁড়ে। এটা-ই হয়তো একটা বড় রকমের প্রশ্ন হতে পারে, কিন্তু আকাশমনি দিগলি টাঁড় ছেড়ে, তার পিতাকে ছেড়ে, তার ঠাকুমার সাম্রাজ্য ছেড়ে সত্যিসত্যিই চলে যেতে চায়নি। কিন্তু তারপরও চলে যেতে হয়েছে, কারণ লোকমুখে প্রচার, তার পিতা সাধুচরণ আবার বিয়ে করবে বলে ঘটক লাগিয়ে পাত্রী খুঁজছে, খবরটা সত্য-মিথ্যা না বুঝেই আকাশমনি ভুল বোঝে, এখানেই একটা রহস্য লুকিয়ে আছে। সৎ মা কী জিনিস আকাশমনি সত্যিই জানে না, কেনো তার জন্য নির্মলকে কালিঝুলি মেখে ট্রাকের তলায় চিৎ হয়ে শুয়ে থাকতে হয়, কিংবা কেনো তার বিএ পাস গ্র্যাজুয়েট হওয়া হলো না, চটকা-কটকটি-পটলি ধাবার ফাইফরমাশখাটা এসব ছেলেমেয়ের মা আছে এবং সেই মাগুলোকে খুঁটিয়ে দেখে তার অনেক সময় ইচ্ছে করেছে একজন মা থাকলে কতো না ভালো হতো, কিন্তু তাই বলে তার বাবা আবার বিয়ে করে নতুন একটা মেয়েমানুষ আনবে তাও মেনে নিতে পারেনি। সৎ মায়ের ছোঁয়া এবং ছায়া কে বা চায় সংসারে, আকাশমনি তার মায়ের আসনে অন্য কোনো মানুষকে দেখতে চায়নি, তার জাগ্রত চেতনায় মা যেন অন্য এক প্রতীক, সেই মায়ের শূন্যস্থান পূরণ হোক তা কোনোভাবেই মেয়ে হয়ে আকাশ মানতে পারেনি এবং সেই কারণেই বাপের ভিটা ছেড়ে অর্থাৎ ঠাকমা কালিদাসীর সাম্রাজ্য থেকে চিরবিদায় হয়।
কলকাতার ‘দেশ’-এর একটা সাধারণ সংখ্যায় ‘দিগলি টাঁড়ের বৃত্তান্ত’ গল্পটি প্রকাশিত হয়, গল্পটিতে এক ধরনের মানবতা ফুটে উঠে, জীবনের রূপ যে কতো রঙের হয়, কতো ঢঙের হয় তারই হদিস পাওয়া যায়। সিরাজ যে মা-মাটি এবং মানুষের কথা বলে, মানুষের ভেতরের উপলব্ধিকে টেনে-খুঁড়ে বের করে আনে, জীবনের কঠিন সময়কে সাহিত্যে অন্যরকম মাত্রা দেয়, তাই তার গল্পে জীবন বিস্তৃত রূপে ধরা দেয়। গদ্যের অসাধারণ লালিত্যের কারণে জীবন এবং জগৎ একাকার হয়ে যায়। তার নিজস্ব ভাষাশৈলী শিল্পবোধ বিষয় ও বর্ণনা আঙ্গিককৌশল মৃত্তিকা ও আকাশ পরস্পরকে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে রেখেছে, গ্রামীণ মানুষ ও পল্লীপ্রকৃতি তার শিল্পসত্ত্বায় জুড়ে আছে, গল্পের স্বাতন্ত্র্য ও আধুনিকতায় কাহিনী বা আখ্যান চরিত্র এবং ব্যক্তিত্বের সঙ্গে তার রচনার অনুপম সমন্বয় লক্ষ্য করা যায়।
সিরাজের গল্পে জীবন বিভিন্ন বাঁকে ধরা দেয়, চরিত্রগুলো সাবলীল ভাষায় কথা বলে ওঠে। মানিক-বিভূতি-তারাশঙ্করের হাতের ছোঁয়া যেন তার গল্পের শরীরে আলোছায়ার মতো লুটোপুটি খায়। সিরাজ অকারণে তার গল্প বা উপন্যাসে বর্ণনা দেয় না কখনো, তারপরও বলতে হয় তার ভাষা কবিত্বময়, কবিত্বময়তা কোনো সাহিত্যিকের দোষের কিছু নয়, বরং সাহিত্যকে আরো সমৃদ্ধ করে, সিরাজ তার জীবনের দীর্ঘ পথের যেটুকু প্রত্যক্ষ করেছেন তাই কদাচিৎ তুলে ধরেন, পাঠককে বিড়ম্বনায় ফেলার জন্য নয়, গল্পকে আরো শানিত করার অভিপ্রায়ে।
সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের একশত ১৫০টি উপন্যাস, ৩৬০টি ছোটগল্প ছাড়াও অসংখ্য গোয়েন্দা-রহস্য কাহিনী, প্রবন্ধ-নিবন্ধ বিবিধ রচনা করেছেন, তার দৃষ্টিভঙ্গি-সৃজনীক্ষমতা এবং গল্পের জাদুকরীর কারণে বাংলাসাহিত্যের একজন কিংবদন্তি সাহিত্যিক হয়ে থাকবেন। সিরাজের সাহিত্য মানুষের কথা বলে, মানুষ এবং মানুষের ভেতরের মানুষটাই তার সাহিত্যেকে করেছে সমৃদ্ধ-বেগবান এবং সাবলীল। গল্পটিতে এক আকাশমনিই যেন সমস্ত সাম্রাজ্যের অধিপতি হয়ে ধরা দিয়েছে, কারণ তাকে ঘিরেই গল্প এগিয়ে গেছে, সিরাজ এখানে গল্পই বলে যাচ্ছেন, তার গল্পের বর্ণনা যেন হৃদয় ছুঁয়ে যায়, সত্যিই তিনি কি গল্প বলেন, নাকি গল্প অংকন করেন ক্যানভাসে। তার প্রথমদিকের গল্পগুলো ‘ইন্তি পিসি ও ঘাটবাবু’, ‘ভালোবাসা ও ডাউনট্রেন’, ‘হিজল বিলের রাখালেরা’, ‘তরঙ্গিনীর চোখ’- গ্রামীণ জীবন ও মানুষ যেভাবে এসেছে পরবর্তীকালের গল্পেও গ্রামীণ জীবন এবং মানুষেরা এসেছে কিন্তু অনেকটা ভিন্ন ভাবে, তবে মাটি ও মানুষের গন্ধ ঠিক ওই রকমেরই। ‘রাণীরঘাটের বৃত্তান্ত’ গল্পগ্রন্থেও গ্রামীণ জীবন এবং মানুষ এসেছে, সে মানুষগুলো আরো যেন সজীব এবং অনেক বাস্তব, কোনো ভনিতা নেই কারো চরিত্রে, সবাই যেন মৃত্তিকা সংলগ্ন একেকজন মানুষ। গোঘœ, বাদশা, উড়োচিঠি, বসন্তের বিকালে ঘুমঘুমির মাঠে, সূর্যমুখী, বৃষ্টিতে দাবানল, বাগাল, রাণীরঘাটের বৃত্তান্ত প্রভৃতি গল্পে জীবন এসেছে জীবনের উপলব্ধি থেকেই।
‘দিগলি টাঁড়ের বৃত্তান্ত’ গল্পটিতে যে জীবন প্রত্যক্ষ করি তা পাঠককে ভাবিত করে, বদরাগী এক মাতাল ড্রাইভার লোহার রড দিয়ে এক রাতে সাধুচরণকে অকারণে মেরেছিলো, তারপর হাসপাতাল পা কেটে বাদ দেয় ডাক্তার, সেই মাতাল ড্রাইভারের সঙ্গে পেটের মেয়ে আকাশমনিকে রেখে তার বউ সন্ধ্যামনি পালায় একদিন। সন্ধ্যামনির বয়স তখন ১৭-১৮ বছর। কিসের লোভে অথবা কেনো যে সন্ধ্যামনি ওভাবে পালিয়ে গেলো সাধুচরণ আজো বুঝে পায় না। হয়তো মেয়ের টাঁড়ে থাকতে রুচিতে বেঁধেছে, তাই বলে নাড়িছেঁড়া ধনকে রেখে কীভাবে পারলো ভেগে যেতে!
‘দিগলি টাঁড়ের বৃত্তান্ত’ গল্পটিতে ফুটে উঠেছে একজন পিতার কষ্ট, বাদলপুরের জটাকে আলতোভাবে না হয় সাধু একটা কথাই বলেছিল, তাই বলে সে আবার ঘুটঘুটিয়ার কাটু মুখুয্যেকে কেনো বলতে গেলো, তারপর আবার কথার মধ্যে রঙ মিশিয়ে বলেছে, টাঁড়ে কেউ মেয়ে দেবে না। সাধুচরণ নিশ্চুপ থাকে, নিজেকে সামলাতে পারে না, একজন জটা কি না তার জাতধম্ম নিয়ে কথা বলে, সে জানে না কালীদাসির মেয়েদের টাঁড়ে মেয়েরা আপনাআপনিই আসে। সেই কথা কানে কানে কতো দূর গেছে, আকাশমনির কানেও গেছে, তাই আকাশমনি বাবাকে সইতে পারেনি, সাধুচরণের মা ছিলো, বাবা ছিলো না, সাধুচরণ কোনোদিনই জানতে চায়নি কে তার বাবা, চটকা-কটকটিরাও জানতে চায় না, তারা যে একটা করে জীবন পেয়েছে এই ঢের যথেষ্ট, যদি জীবনটাই না পেতো তবে কিসের এতো জারিজুরি। আকাশমনির মা নেই তো কি হয়েছে, বাক্ষা তো ছিলো, তারপরও ওর মন ভরেনি, মনকে বিষিয়ে দিয়েছে জটার কথা। চোলাই মদের ভাটি তদারকি করে তুফানী, সাধুচরণই দিয়েছে, সেই তুফানীও বলেছিলো, আমি বলি কি দাদা, নিজেও বিয়ে করো, মেয়েরও বিয়ে দাও, দিয়ে জামাইকে ধাবার পেছনে পাকা ঘর করে দাও, সেখানে মেয়ে-জামাই থাকুক, তুমি থাকো মাসির টাঁটে বসে, জামাইকে একখানা কাপড়ের দোকান করে দাও, খুব চলবে দোকান, কতো জায়গা পড়ে আছে। সাধুচরণের ইচ্ছা ছিলো মেয়ের বিয়ে দিয়ে মেয়ে-জামাইকে কাছে রাখবে, সেই হবে কালিদাসীর দিগলি টাঁড়ের রাজা, কিন্তু সে স্বপ্ন শুধু স্বপ্নই রয়ে গেলো। কাজের কাজ কিছুই হলো না।
একজন সাধুচরণ, নিজেকে সে সর্বদাই ভাবে ভাগ্যবান, যদিও তার বউ ভেগেছে মাতাল এক ড্রাইভারের সঙ্গে, তাকে মানুষজন নেংড়া বলে বিদ্রুপ করে আড়ালে-আবডালে, কিন্তু সে সময়কে ধরে রাখতে চায়, নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছে দিগলি টাঁড়ে, তার মা কালিদাসী যেমন সেবাশুশ্রƒষা করতো, মানুষজনও ভালোবাসতো, সেই অপরিসীম ভালোবাসা নিয়েই সে চলে গেছে, তার সাম্রাজ্য আজ দেখভাল করছে তারই একমাত্র ছেলে সাধুচরণ। গল্পটির মধ্যে গত শতাব্দির কুড়ি/ত্রিশ দশকের আবহ লক্ষ্য করা যায়, মানুষের জীবনাচরণ সেভাবেই ফুটে উঠেছে, মানুষজন ভালো ছিলো, চোরছেচ্চর সেভাবে ছিলো না, সহজ-সরল সে জীবনের আখ্যান সিরাজ তুলে ধরেছেন অত্যন্ত শৈল্পিকভাবে, এখানেই হয়তো সিরাজের অসীম ক্ষমতার জাদু।
সাধুচরণ সর্বদা আকাশমনিকে চোখে চোখে রাখতো, সে জানতো খারাপের মধ্যে ভালো থাকে না, আকাশমনির মধ্যেও কালিদাসী ঢুকে গিয়েছিলো, সাধুচরণ ফোঁস করে শ্বাস ছাড়তো, অবিকল কালিদাসীই, মা তার টাঁড় ছেড়ে চলে যায়নি, সবর্দাই বিরাজ করছে, মায়ের ছায়া এবং মায়ায় সে আজো তেমনভাবেই বেঁচেবর্তে আছে। আকাশমনির সাধ ছিলো ধাবার পাশের পোড়ো জমিটাতে তার বাবা একটা কালীমন্দির প্রতিষ্ঠা করুক, কিন্তু করবে বলে মনে হয় না, আকাশমনি ভাবে সে যদি কোনোদিন কালিদাসী হয়ে উঠতে পারে কালীমন্দির একটা করবেই করবে। ঠাকুমার প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা থেকেই এমন প্রতিজ্ঞা, দিগলি টাঁড়ের আর মানুষগুলো হয়তো কালিদাসীকে ভুলে গেছে কিন্তু চটকার মা টগরবালা বলে, কালিমাসি তেপান্তরে ফুলবাগান করেছিলো, গন্ধে ম-ম, ওই দেখো কেমন ভনভনাচ্ছে। শুধু তাই নয়, তুফানী-পদ্মপিসি সবাই এখনো কালিদাসীর নাম করে। কিছু বেইমান মানুষ এখনো দিগলি টাঁড়ের নামে দুর্নাম করে, তাদের প্রতি তাই সাধুচরণের ক্ষোভ। অথচ এই ঘুটঘুটিয়ার মতো জবরজং জায়গাটাকে কে সত্যি সত্যি একটা উপযুক্ত করে তুললো, মানুষজন আজ কতো বড় হয়েছে, নিজের মতো নিজেরা চলছে, কিন্তু কেউই হদিস রাখে না, এমন একটা গেঁয়ো জায়গাটাকে সোনার পালিশ মেরে কে চটকদার করে তুলেছে, যদিও কালিদাসীদের সময় মানুষজন এতোখানি খারাপ ছিলো না, নদীর ওপর ব্রিজ ছিলো না, খরার মাসে গোরুমোষের গাড়ি কি মোটরগাড়ি ঠেলেঠুলে নদী পাড় করানো হতো, বর্ষার ঢল নামলে তখন ঘাটোয়ারিজির নৌকা ভরসা। নৌকার জন্য দিনরাত্রি লাইন। গাড়োয়ানরা ড্রাইভাররা খাবে কোথায়? বা জিরোবে কোথায়? এই দিগলির টাঁড়ের কাছে একশ-দুশো বাড়ি, কতো পবলেম, কে আগে যাবে তাই নিয়ে ঝগড়াঝাটি-মারামারি, সব চোখের সামনে আজো ভাসে সাধুর, সেই সময় কালিদাসী এসে বসলো টাঁটের মাথায়, চটি করলো, হাইরোড যখন হলো, ট্রাক যায় হিল্লিদিল্লি-বোম্বাই, এদিকে শিলিগুড়ি-আসাম, কতো কতো দূরের মুল্লুক, ড্রাইভারদের ‘রেস’ দরকার, বডি ফিট থাকাও দরকার, খাওয়া-দাওয়া তো আছেই, কালিদাসী মাথা ফাটানো বুদ্ধি বের করেছিলো, ওদের জন্য একটা আশ্রয় খুলে বসলো, তাদের ইচ্ছা মতো ‘সারবিস’ দিতো, কালিদাসী মরলো তো সেই কালের চাকা ধরলো তারই ছেলে সাধুচরণ। অথচ আজ কতিপয় মানুষ যারা একটু বড় হয়েছে, নিজেকে অনেক কিছু ভাবতে শিখে গেছে, তারা আড়ালে-আবডালে বলে কি না মেয়েমানুষের টাঁড়, সাধুচরণ নিজেকে সামলাতে পারে না তখন।
গল্পের শেষে দেখা যায়, সাধুচরণ অসহায় একজন বাপের মতো হা-হাপিত্যেশ করছে তার একমাত্র মেয়ের জন্য, ঘরপালানির মেয়ে তো পালিয়েই যাবে, এতে আর নতুন কি, পোষা পাখি খাঁচা ছেড়ে একবার চলে গেলে আর ফিরে আসে না, আকাশমনিও আর ফিরবে না বাপের কাছে, মানুষ যেন মুক্তি চায়, মুক্তির জন্য সবাই ছটফট করে, একবার যদি মুক্তি পেয়েই যায় সে কি আর ফিরে আসে বদ্ধ পুরানো খাঁচায়। কেউই আসে না। কিন্তু সাধুচরণ পালাতে পারে না, তার পালানো সাজে না, কেনোই বা পালাবে, কেমন করে পালাবে, কার সঙ্গেই বা পালাবে… না পালানো একজন মানুষ শুধুই নিজেকে প্রশ্ন করে, হাজারো প্রশ্নের মধ্যে নিজেই বিলীন হয়ে যায়। একটা বাধা একটা সীমান্ত সাধু কখনো অতিক্রম করতে পারবে না, কারণ সে মহামায়ার ভেতরে আটকে গেছে, তার সামনে কোনো পথ খোলা নেই, নিজেকে তাই ভাঙতে ভাঙতে জাতীয় সড়কের ধারে একটি মাইলস্টোন হয়ে সে পুঁতে থাকে মাটির ভেতর, তার আর নড়ার কোনো উপায় নেই।
মানিক-তারা-বিভূতি চলে যাওয়ার পর বাংলাসাহিত্য নিয়ে কে কী করছেন সবই জানা, সমরেশ বসুর রচনা, জ্যোতিরিন্দ্র নন্দীর রচনা বা দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের রচনা কিছু সময় বাংলাসাহিত্যকে নাড়া দিয়েছিলো বটে, কিন্তু দীর্ঘস্থায়ীভাবে কেউই রাজত্ব বিস্তার করতে পারেননি। দেশ বিভাগের পর এপার-ওপার করার ফলেও কিছু সাহিত্যিক যখন পশ্চিমবঙ্গে স্থায়ীভাবে ঢেরা বাঁধে, তাদের মধ্যে অতীন-সুনীল-রতন-গৌরকিশোরের মতো সাহিত্যিকের পদচারণ ঘটলেও সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের প্রয়োজন এতোটুকু ফুরোবার নয়। সময়ের প্রয়োজনে সুনীল-শীর্ষেন্দেু-সমরেশ মজুমদাররা হালকা চালের রচনা লিখে সাময়িক সুখ্যাতি অর্জন করলেও সিরাজ বরাবরই তার শক্ত মাটির ওপর দাঁড়িয়ে নিজেকে প্রত্যক্ষ করেছেন, এবং এই কারণেই তিনি সবার থেকে ব্যতিক্রম। এবং বর্তমান বাংলা সাহিত্যে যখন ছোটগল্পের হাহাকার বা গল্পকাররা গল্প রচনায় উৎসাহ হারিয়ে দিগি¦দিক ঘুরে বেড়িয়ে বলছেন, ছোটগল্প মরে গেছে, ঠিক তখনই সিরাজকে তাদের নাস্তার টেবিলে অর্থাৎ পড়ার লাইব্রেরিতে উপস্থিত করা প্রয়োজন, কারণ বিভূতি-তারাশঙ্করের পরে একমাত্র সিরাজই বাংলা সাহিত্যাকাশে এতোখানি আসন নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। তার সাহিত্য পাঠে আমাদের আরো আরো সমৃদ্ধি এবং বোধের জানালা উন্মুক্ত হবে অনস্বীকার্য।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়