ডিজিটাল মামলায় রিমান্ডে টিকটকার সানোয়ার

আগের সংবাদ

পুনরাবৃত্তি রোধে সর্বোচ্চ শাস্তি > আবরার হত্যা মামলায় ২০ জনের মৃত্যুদণ্ড, যাবজ্জীবন দণ্ডিত ৫

পরের সংবাদ

কুড়ানো মামা

প্রকাশিত: ডিসেম্বর ৮, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: ডিসেম্বর ৮, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

কুড়ানো মামার দিকে তাকিয়ে আমি অবাক হয়ে গেলাম। মামার চোখে মুখে অন্যরকম আনন্দের ঝিলিক! যা আগে কখনো দেখিনি। ছোট থেকেই দেখেছি, সারাক্ষণই মুখটা গম্ভীর থাকে তার। অথচ মোটা কালো ফ্রেমের চশমার আড়ালে থাকা চোখ দুটো কী সুন্দর! ওই চোখ দেখে যে কারোর মায়া লাগে। হয়তো এই কারণেই কুড়ানো মামাকে আমার এত ভালো লাগে।
মামার আরো কিছু আকর্ষণ আছে। তার আচার-আচরণ খুব অদ্ভুত! আড়ালে কেউ কেউ অবশ্য পাগলাও বলে। কিন্তু এই অদ্ভুত আর পাগলামি ভাবটা আমার ভালো লাগে। সারাক্ষণ মোটা মোটা বই পড়েন। ঘরের ভেতর দুটো মাথার খুলি আর অনেকগুলো হাড় সাজিয়ে রেখেছেন। কিন্তু ওই ঘরে সবার ঢুকতে মানা। সবসময়ই ঘরটা আবছা অন্ধকারে ঢেকে রাখেন। জানালাগুলোও খোলেন না কখনো।
কিন্তু এবার ব্যাপারটা কী? মামার ঘরের সব জানালা খোলা!
আমি খোলা জানালা দিয়ে মামার রুমের ভেতর উঁকি দিলাম দেখি, পতাকার ওপরে একটা মাথার খুলি ও কয়েক টুকরো হাড়। কিছু বুঝতে না পেরে মামার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলাম- হোয়াটস দ্যাট?
মামা কিছু না বলে মিষ্টি করে একটু হেসে দরজা বন্ধ করে দিলেন।
কুড়ানো মামার মতো এবার বাড়ির সবাইকে একটু অন্যরকম মনে হচ্ছে। অন্যবারের চেয়ে সবাই একটু বেশিই হাসিখুশি। সবাইকে হাসিখুশি দেখে অনেক ভালো লাগছে।
গতবার নানা ভাই কথা দিয়েছিলেন- সামনের বার তোদের কুড়ানোর গল্প শোনাবো।
আমি বুঝতে পারি না যে, কুড়ানো মামাকে নিয়ে আবার কী গল্প থাকতে পারে? আমি বারবার সবাইকে প্রশ্ন করি- এতো সুন্দর মানুষটির নামটা এত্ত পচা কেন? কুড়ানো কারো নাম হয় নাকি?
কয়েকবার মামাকেও প্রশ্ন করেছি- মামা, তোমার নাম কী পচা গো! কুড়ানো কোনো নাম হলো? নানু তোমার জন্য কোনো সুন্দর নাম খুঁজে পাননি?
কুড়ানো মামা কখনো আমার প্রশ্নের জবাব দেননি। শুধু দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতেন।
আমি গ্রামে গেলে, আমার বয়সি সব ছেলেমেয়ে আমার সাথে সাথে থাকে। এবার যেন সবাই একটু বেশিই খাতির করছে। কারণ আমার ল্যাপটপ! ওরা কেউ ল্যাপটপ এর আগে কখনো দেখেনি। এত সহজে দূরের কিছু সামনে আনা যায়! তা ওরা কল্পনাতেও আনতে পারেনি। স্কাইপের মাধ্যমে আমেরিকা থেকে ছোট মামার সাথে কথা বলেছি সরাসরি। টিভিতে একটা অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেছি। ব্যাস! আমার ল্যাপটপের নাম হয়ে গেছে ম্যাজিক বাক্স। ওদের সাথে নিয়ে নানাভাইকে আঁকড়ে ধরলাম- নানাভাই, এখনই তোমাকে কুড়ানো মামা সম্পর্কে বলতে হবে। ওনার নাম কুড়ানো রাখলে কেন?
নানাভাই বললেন- তোরা সবাই গোল হয়ে বসে পড়। আর কুড়ানোকেও ডেকে নিয়ে আয়।
কুড়ানো মামা আসতেই নানাভাই বলতে শুরু করেন- ১৯৭১ সাল। আষাঢ় মাসের শেষের দিকে হবে। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। কাঁদা পানির ভেতর দিয়ে হাঁটছি। আমাদের সবার শরীর খুব ক্লান্ত। একটানা ৩ দিন যুদ্ধ করেছি। পেটে কোনো ভারি খাবার পড়েনি। বৃষ্টির মতো গুলি! চারদিকে মৃত্যুর হাহাকার! নারী-শিশুর আত্মচিৎকার।
আমি নানাভাইয়ের দিকে তাকিয়ে আছি। তা দুচোখ চিকচিক করছে। নানাভাই যেন ফিরে গেলেন ১৯৭১ সালে। যুদ্ধের ময়দানে। আমি কুড়ানো মামার হাত ধরে বসেছি। ল্যাপটপে সব ভিডিও হচ্ছে।
নানাভাই বলে যাচ্ছেন- আমাদের দল ছত্রভঙ্গ হয়ে গেছে। প্রচণ্ড গোলাগুলি। দুদিন আগে আমরা ব্রিজ উড়িয়ে দিয়েছি। ওই এলাকায় ঢুকতে হলে নৌকা ছাড়া উপায় নেই। আমরা মুক্তিযোদ্ধারা ভাবলাম, এলাকায় হয়তো আর পাকবাহিনী ঢুকতে পারবে না। আমরা এ গ্রাম থেকে ভাগে ভাগে ছড়িয়ে যাব। রাজাকারদের চিন্তাটা মাথায় ছিল না।
রাজাকার, আলবদরের দল পাকিস্তানি সেনাদের নৌকায় করে নিয়ে আসে। আমরা ছিলাম অপ্রস্তুত। কেউ কেউ ঘুমে আচ্ছন্ন। গুলি, বৃষ্টির মতো গুলি! তিন দিন একটানা যুদ্ধ। এর মধ্যেই এলো বৃষ্টি। ঝুম বৃষ্টি। আমরা যারা বেঁচে আছি তারা ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে পিছু হটতে থাকলাম। আমি পাঁচজন সহযোদ্ধাকে নিয়ে দক্ষিণ-পূর্ব দিকে হাঁটতে থাকলাম। কাদা-পানির ভিতর দিয়ে হাঁটছি। ধান আর পাট ক্ষেতের মাঝখান দিয়ে হাঁটছি। পা আর চলে না। ক্লান্ত হয়ে বসে পড়ি।
একটু দূরে একটি বাচ্চার কান্নার শব্দ শুনতে পাই। এগিয়ে গিয়ে দেখি… নানাভাই থেমে যান। তার দুচোখ বেয়ে বৃষ্টির ধারার মতো জল গড়িয়ে পড়ছে। তিনি চশমা খুলে চাদরে মুছে নেন। আমিসহ ঘরে থাকা সব ছেলেমেয়ের চোখেও পানি। শুধু কুড়ানো মামা ভাবলেশহীন চোখে উপরের দিকে তাকিয়ে আছেন।
নীরবতা ভেঙে নানাভাই আবার বলা শুরু করেন- আমরা কেউ কান্না আটকাতে পারিনি। আমরা সহযোদ্ধারা একে অপরকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছি। জন্মভূমি। বাংলাদেশ। এ দৃশ্য চোখে দেখা যায় না। ১৩/১৪টার মতো মৃতদেহ। ছড়ানো ছিটানো। মৃতদেহগুলো শিয়ালে ছিঁড়ে খেয়েছে। মাঝখানে এক মহিলার লাশ। ছোট্ট শিশুটি তার বুকের দুধ টানছে! দুধ আসে না তাই কাঁদছে। ঠাণ্ডায়ও কাঁপছে। বৃষ্টিতে ভেজা। আমি শিশুটিকে কোলে তুলে নিলাম। কোমরে বাঁধা গামছাট খুলে তার শরীর মুছে দিলাম।
নানাভাই দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে কুড়ানো মামার দিকে আঙুল তুলে বললেন- ওই সেই ছেলে। ওর কোনো পরিচয় খুঁজে পাইনি। আমার নিজের সন্তানের মতো করে ওকে বড় করেছি। আমার মা ওকে কুড়ানো বলে ডাকত। সেই থেকে ওর নাম কুড়ানো।
আমি কুড়ানো মামাকে জড়িয়ে ধরে কান্না শুরু করে দিলাম। ঘোষণা করলাম- আজ থেকে কেউ উনাকে কুড়ানো বলতে পারবে না। উনার নাম স্বাধীনতা। উনি আমাদের স্বাধীনতা মামা।
মামা কিছু না বলেই নিজের ঘরের দিকে পা বাড়ালেন। আমিও মামাকে অনুসরণ করি। এবার আর ঘরে ঢুকতে বাঁধা দেন না তিনি।
মামার রুমে বসে আমি সবকিছু ভালো করে দেখছি। মুক্তিযুদ্ধের অনেক ছবি, বই, কংকাল, হাড়, মাথার খুলি।
মামা বললেন- গতবার তুই জানতে চেয়েছিলি, জানালা কেন খুলি না? পণ করেছিলাম, যতদিন রাজাকারদের বিচার না হবে, ততদিন আমি জানালা খুলবো না। ইতোমধ্যে সাকা চৌধুরী, মুজাহিদ, নিজামীসহ অনেক রাজাকার-আলবদর-যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসি হয়েছে। তাই ঘরের জানালা খুলে দিয়েছি। তোরা ইতিহাস জানিস না। আমাদের দেশের সত্যিকারের ইতিহাস তোদের জানতে হবে। তোদের জন্য আমি লিখছি। সবাইকে কীভাবে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস জানানো যায় সেটা ভাবছি।
– মামা, আমার মাথায় একটা আইডিয়া এসেছে। ল্যাপটপটি নিয়ে আসি। সবাইকে বাংলার সত্যিকারের ইতিহাস জানাতে হবে। জানো, আমার ক্লাসের অনেকেই মুক্তিযুদ্ধের কথা জানে না। এমন কী করলে ছোট থেকে বড় সবাই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস জানবে, সেই আইডিয়া এসেছে আমার মাথায়। এখনই সেই আইডিয়া শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়ে দিচ্ছি।
– আগে তোর আইডিয়াটা আমাকে বল।
আমি মামার দিকে তাকিয়ে বলতে শুরু করি- ১৯৪৭ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত। ১০ ভাগে ভাগ করতে হবে। প্রথম থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত ১০টা মুক্তিযুদ্ধের বই থাকবে। বাংলা, ইংরেজি, গণিতের মতো বাধ্যতামূলক। ১০০ নম্বরের হবে। তাহলে সবাই এটা…
মামা লাফিয়ে উঠে বললেন- এই দাঁড়া দাঁড়া… এটা তো আমার মাথায় আগে আসেনি। তোর ছোট মাথায় কী করে এলো?
– আমি ফেসবুকে আমার আইডিয়া দিয়েছিলাম। অনেক লাইক পড়েছে।
দেখি স্বাধীনতা মামার চোখ চকচক করছে। উনি মাথার খুলিটি হাতে নিয়ে উল্টেপাল্টে দেখেন। বুকের সাথে আঁকড়ে ধরেন। ফোঁটা ফোঁটা চোখের পানি তাতে গড়িয়ে পড়ে।
আমি মামার দিকে তাকাই। আমার চোখে ভেসে ওঠে অর্ধগলিত লাশের বুকের দুধ খাওয়া একটি শিশুর দৃশ্য…।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়