প্রকাশিত: ডিসেম্বর ৩, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: ডিসেম্বর ৩, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
মহাপ্রয়াণ ঘটল এক মহিরুহের। বাংলাদেশ হারাল একজন অকৃত্রিম জাতীয়তাবাদী সন্তানকে- এক প্রাজ্ঞ ব্যক্তিকে, একজন নিবেদিতপ্রাণ নজরুল গবেষককে- একজন ভাষাতাত্ত্বিককে, বাঙালির আবহমানকালের সংস্কৃতির এক ধারককে- আর আমি হারালাম এক শ্রদ্ধেয় শিক্ষাগুরুকে- তিনি অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম।
আমি দীর্ঘকাল ধরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগে অধ্যাপনা করেছি বলে অনেকেই আমাকে সংস্কৃতের ছাত্র বলেই জানেন, এটা সত্যি। কিন্তু আমি যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের ছাত্র ছিলাম, এটা অনেকেরই অজানা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের ছাত্র হিসেবে ১৯৬৭ সালে ভর্তি হই বিএ অনার্স শ্রেণির প্রথম বর্ষে। প্রথম বর্ষের পাঠ্যসূচিতে ছিল নজরুলের কাব্য। অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম স্যার আমাদের নজরুলের কাব্য পড়াতেন। রফিক স্যারের ছিল অসাধারণ ব্যক্তিত্ব। প্রমিত বাংলায় কথা বলতেন। ক্লাসে কেউ তাকে কোনো প্রশ্ন করার সাহস পেত না। কোনো প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতে হলে সবাই আমাকে ফিসফিস করে। এমনকি পিঠে গুতো দিয়ে প্রশ্ন করতে বলত। ক্লাসের মধ্যে নিজ নিজ আঞ্চলিক কথ্য বাংলায় কথা বললে রফিক স্যার তাকে ব্যঙ্গ করতেন। তার মত হলো : নিজ অঞ্চলে আঞ্চলিক ভাষারীতি ব্যবহার করতে পার, কিন্তু আনুষ্ঠানিকভাবে কথা বলতে হলে প্রমিত বাংলায় বলতে হবে। এর দুটি কারণ, একটি হলো সবাই তা বুঝতে পারবে, দ্বিতীয়টি হলো শিষ্টতা।
আমার ছোটবেলার একটা বড় সময় পশ্চিমবঙ্গে কেটেছে। তাই প্রমিত কথ্য বাংলায় কথা বলাটাই আমার প্রকাশরীতি হয়ে গিয়েছিল। তাই রফিক স্যার আমাকে পছন্দ করতেন এবং সহপাঠীরা আমাকেই প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতে বলতেন।
তা ছাড়া আরেকটা ভয় ছিল রফিক স্যারের ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের। কেউ অসার বা অপ্রাসঙ্গিক কিছু বললে রফিক স্যার বলতেন : ‘বৃক্ষে কভু নাহি ফলে মূর্খ, মূর্খ আশেপাশেই বিচরণ করে।’
শুধু নজরুলের কাব্যই নয়, রফিক স্যার আমাদের ‘ভাষাতত্ত্ব’ পড়াতেন। ভাষা বিজ্ঞানে তার উচ্চতর পঠন ও ডিগ্রি ছিল। তখন বাংলা ভাষায় বা বিজ্ঞানের কোনো বই আমাদের দেশে ছিল না। পশ্চিমবঙ্গে বাংলা ভাষায় প্রকাশিত ভাষাতত্ত্বের বই তখন সুলভ ছিল না। রফিক স্যার আমাদের নিজের ইংরেজি নোটস থেকে বাংলা করে করে বোঝাতেন। এভাবে ভাষাতত্ত্বের বাংলা বইয়ের একটা কাঠামো গড়ে ওঠে এবং পরে রফিক স্যার ভাষাতত্ত্ব বিষয়ে একটি বই লেখেন এবং সেটি ভাষাতত্ত্বের বইয়ের অভাব পূরণ করে। অন্যদিকে প্রফেসর মুহাম্মদ আবদুল হাই স্যার রচনা করেন ‘ধ্বনি বিজ্ঞান ও বাংলা ধ্বনিতত্ত্ব’- নামক অসাধারণ একটি বই। ধ্বনি বিজ্ঞান ও বাংলা ধ্বনিতত্ত্ব সম্পর্কে যে এত সহজ করে বলা যায়- প্রকাশ করা যায়, তা এ বইটি না পড়লে জানতে পারতাম না।
এত গেল একাডেমিক দিক। রফিক স্যার শিক্ষার্থীদের সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চার ক্ষেত্রে ছিলেন উৎসাহদাতা। এ ক্ষেত্রেও তিনি পালন করেছেন নেতৃত্বের ভূমিকা। রফিক স্যারের তত্ত্বাবধানে আমরা বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থীরা বাংলা সাহিত্যকে সাধারণ মানুষের কাছে পরিচিত করে তোলার জন্য একটি অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছিলাম- সেটি হলো : ‘হাজার বছরের বাংলা কবিতা ও গান’। সেখানে বাংলা সাহিত্যের প্রাচীনতম নিদর্শন ‘চর্চাপদ’ থেকে শুরু করে মধ্যযুগ ও আধুনিক যুগের প্রতিনিধিত্বশীল কবিদের নির্বাচিত কবিতা সংগ্রহ করে অনুষ্ঠানটি নির্মিত হয়েছিল। আমরা বাংলা বিভাগ ছাড়াও, বাংলাদেশ টেলিভিশনেও দুবার অনুষ্ঠানটি উপস্থাপন করে প্রশংসা অর্জন করি। রফিক স্যারকে সহযোগিতা করতেন আমার আরেকজন প্রিয় স্যার অধ্যাপক সৈয়দ আকরাম হোসেন। কামনা করি, আকরাম স্যার দীর্ঘজীবী হোন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে আমার সহপাঠী হিসেবে যাদের পেয়েছি তাদের মধ্যে যারা খুবই খ্যাতিমান হয়েছেন, তাদের মধ্যে কয়েকজনের নাম উল্লেখ করছি : জননেত্রী শেখ হাসিনা, কবি নির্মলেন্দু গুন, কবি কাজী রোজী, নাট্যকার সেলিম আলদীন, উর্দু থেকে অনুবাদক আকতার-উন-নবী, জননেতা ও সাহিত্যিক নূহ-উল-আলম লেনিন, নাট্যশিল্পী এফ এম মহসীন- এরকম বেশ কয়েকজন। আমরা সবাই রফিক স্যারের স্নেহভাজন ছিলাম।
শুধু সাহিত্য-সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানই নয়, আমরা পিকনিক করতাম- এতেও রফিক স্যারের প্রচণ্ড উৎসাহ ছিল। তিনি নিজেই একটা ক্যামেরা গলায় ঝুলিয়ে রাখতেন। প্রচুর ছবি তুলতেন। আমরা অবাক হয়ে যেতাম রফিক স্যারের তারুণ্যদীপ্ত আচরণে- বয়স যেন তাকে ছুঁতে পারেনি। রফিক স্যারের উৎসাহে আবদুল আহাদের মতো ব্যক্তিত্ব আসতেন, আমাদের মধ্যকার সঙ্গীত শিল্পী শিক্ষার্থীদের গানের তালিম দিতে। ভাবা যায়!
বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বাংলাদেশ বেতারে রফিক স্যারের ছিল নিয়মিত অংশগ্রহণ। মুগ্ধ হয়ে শুনতাম তার প্রমিত উচ্চারণে উপস্থাপিত কথিকা-আলোচনা। প্রকৃতই রফিক স্যারের প্রমিত উচ্চারণের প্রতি গুরুত্ব প্রদান আমাকে প্রমিত বাংলায় কথা বলার ক্ষেত্রে একটি উৎসাহের উপাদান হিসেবে কাজ করেছে। নজরুল প্রীতি, ভাষা বিজ্ঞানে আগ্রহ, বাংলা ও বাঙালির সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধা ও চর্চার ক্ষেত্রে রফিক স্যারের অবদান শুধু বাঙালি জাতিকে চিরকাল স্মরণ করতে হবে।
পাকিস্তান আমলে যখন রবীন্দ্র সঙ্গীত বর্জন এবং নজরুলের কবিতা ও গানের বিকৃতি সাধন করা হচ্ছিল ধর্মের নামে, তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ রুখে দাঁড়িয়েছিল। যখন বাংলা ভাষার বর্ণমালা থেকে কয়েকটি বর্ণ বাদ দেয়ার অপচেষ্টা চলছিল। তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ দৃঢ়কণ্ঠে প্রতিবাদ জানিয়েছিল। আর তার নেতৃত্বে ছিলেন অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম এবং অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী।
আজীবন তিনি ধারণ করেছেন বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনাকে। এ চেতনা ছিল তার সাংস্কৃতিক চেতনা ও মননের কেন্দ্রস্থলে। বাঙালিত্বের ধারক ও মননের চেতনাবাহী প্রতিষ্ঠান বাংলা একাডেমির চলার পথেও তিনি ছিলেন অগ্রগামী সেনানী। তিনি বৃত হয়েছিলেন বাংলা একাডেমির সভাপতির পদে। এ ছাড়া কাজী নজরুল ইসলামকে বাংলাদেশে আনয়নের ক্ষেত্রে তিনি বঙ্গবন্ধুকে সহযোগিতা করেছেন। নজরুলের একটি কবিতায় ছিল, তাকে যেন মসজিদের পাশে কবর দেয়া হয়। এ-কথা রফিক স্যারই মনে করিয়ে দেন এবং নজরুলকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মসজিদের পাশে কবর দেয়া হয়। তাই এ নজরুল সমাধি নজরুল-প্রেমীদের একটি পীঠস্থান। নজরুল ইনস্টিটিউটের প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনার ক্ষেত্রেও তিনি ছিলেন অন্যতম কর্ণধার। তিনি ছিলেন নজরুল ইনস্টিটিউটের বর্তমান সভাপতি।
যেসব অনুষ্ঠানে রফিক স্যার আমন্ত্রিত হতেন, সেসব অনুষ্ঠানে তিনি সেই উত্তরা থেকে যথাসময়ে উপস্থিত হতেন। তার এ সময় ও নিয়মানুবর্তিতা অনুকরণীয়। তিনি উপাচার্য হিসেবেও বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে দায়িত্ব পালন করেছেন। সেসব স্থানেও দক্ষ প্রশাসকের স্বাক্ষর রেখেছেন তিনি। একুশ পদক, স্বাধীনতা পদকসহ বহু পদক- পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন তিনি।
সবশেষে কয়েকটি রাখছি :
১. বাংলা বিভাগে ‘অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম চেয়ার’ প্রতিষ্ঠা করা হোক।
২. বাংলা একাডেমিতে প্রতি বছর অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম স্মারক বক্তৃতার আয়োজন করা হোক।
৩. নজরুল-কেন্দ্রিক গবেষণার জন্যও বাংলা একাডেমিতে রফিকুল ইসলাম পদক প্রদানের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হোক।
৪. রফিক স্যার ভাষা বিজ্ঞান বিভাগেও পড়াতেন, তাই ভাষা বিজ্ঞান বিভাগেও তার মৃত্যু দিবসে প্রতি বছর আলোচনা সভা অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত গৃহীত হোক।
৫. নজরুল ইনস্টিটিউটেও অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম স্মারক বক্তৃতার আয়োজন করা হোক।
৬. বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বাংলাদেশ বেতারে অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম স্মরণে তার মৃত্যুদিবসে আলোচনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হোক।
পরিশেষে আমার শিক্ষাগুরু জাতীয় অধ্যাপক প্রফেসর রফিকুল ইসলামের পবিত্র স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা ও তার পরিবার ও পরিজনদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানাচ্ছি।
শেয়ার করুন
মন্তব্য করুন
খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।
মন্তব্য করুন
খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।