ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে মামলা

আগের সংবাদ

বিদেশি বিনিয়োগে যত উদ্যোগ : আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, দুর্নীতিসহ ৫ বাধা, কর ব্যবস্থা আরো সহজ করার দাবি

পরের সংবাদ

অশ্রুসিক্ত আনন্দ ভ্রমণ

প্রকাশিত: ডিসেম্বর ১, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: ডিসেম্বর ১, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

আসলাম আনন্দ ভ্রমণে এসেছে মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ চা-বাগান এলাকায়। বাবা মহসিন সাহেবও রয়েছেন তার সঙ্গে। তিনি তাকে ধলই চা-বাগানের আঁকাবাঁকা পথ মাড়িয়ে নিয়ে গেলেন একেবারে ভারত সীমান্তের কাছাকাছি। তারপর দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই শুরু করলেন গল্প বলা। গল্প ছিল মুক্তিযুদ্ধের। বাবা বলে চলছেন- ‘আমরা যেখানে দাঁড়িয়ে আছি, ওখান থেকে একটু দূরে ভারত ভূখণ্ডের দিকে তাকাও। ওই যে দ্যাখো, কয়েকটি কাক মাটির মধ্যে লাফালাফি করছে! ঠিক ওই জায়গাতেই মুক্তিযুদ্ধের সময় শহীদ হন আমাদের সাতজন বীরশ্রেষ্ঠের সর্বকনিষ্ঠ বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমান। মাত্র আঠারো বছর বয়সেই অসীম সাহসিকতার পরিচয় দেন এই হামিদুর রহমান। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আক্রমণ শুরু হলে চাকরিস্থল থেকে নিজ গ্রামে চলে আসেন হামিদুর রহমান। বাড়িতে একদিন থেকে পরদিনই মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেয়ার জন্য চলে যান মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ থানার ধলই চা বাগানের পূর্ব প্রান্তে অবস্থিত ধলই বর্ডার আউটপোস্টে। তিনি ৪নং সেক্টরে যুদ্ধ করেন। ১৯৭১ সালের অক্টোবর মাসে হামিদুর রহমান ১ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সি কোম্পানির হয়ে ধলই সীমান্তের ফাঁড়ি দখল করার অভিযানে অংশ নেন। ভোর ৪টায় মুক্তিবাহিনী লক্ষ্যস্থলের কাছে পৌঁছে অবস্থান নেয়। সামনে দুই প্লাটুন ও পেছনে এক প্লাটুন সৈন্য অবস্থান নিয়ে অগ্রসর হতে থাকে শত্রæ অভিমুখে। শত্রæ অবস্থানের কাছাকাছি এলে একটি মাইন বিস্ফোরিত হয়। মুক্তিবাহিনী সীমান্ত ফাঁড়ির খুব কাছে পৌঁছে গেলেও ফাঁড়ির দক্ষিণ-পশ্চিম প্রান্ত থেকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর মেশিনগানের গুলিবর্ষণের কারণে আর অগ্রসর হতে পারছিল না। অক্টোবরের ২৮ তারিখে ১ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও পাকিস্তান বাহিনীর ৩০-এ ফ্রন্টিয়ার রেজিমেন্টের মধ্যে তুমুল সংঘর্ষ হয়। ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ১২৫ জন মুক্তিযোদ্ধা যুদ্ধে অংশ নেন। মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি বাহিনীর মেশিনগান পোস্টে গ্রেনেড হামলার সিদ্ধান্ত নেন। গ্রেনেড ছোড়ার দায়িত্ব দেয়া হয় হামিদুর রহমানকে। তিনি পাহাড়ি খালের মধ্য দিয়ে বুকে হেঁটে গ্রেনেড নিয়ে আক্রমণ শুরু করেন। দুটি গ্রেনেড সফলভাবে মেশিনগান পোস্টে আঘাত হানে। কিন্তু তার পরপরই হামিদুর রহমান গুলিবিদ্ধ হন। সে অবস্থাতেই তিনি মেশিনগান পোস্টে গিয়ে সেখানকার দুই জন পাকিস্তানি সৈন্যের সঙ্গে হাতাহাতি যুদ্ধ শুরু করেন। এভাবে আক্রমণের মাধ্যমে হামিদুর রহমান এক সময় মেশিনগান পোস্টকে অকার্যকর করে দিতে সক্ষম হন। এই সুযোগে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের মুক্তিযোদ্ধারা বিপুল উদ্যমে এগিয়ে যান। পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে পরাস্ত করে সীমানা ফাঁড়িটি দখল করতে সমর্থ হন। কিন্তু হামিদুর রহমান বিজয়ের স্বাদ উপভোগ করতে পারেননি। ১৯৭১ সালের ২৮ অক্টোবর প্রাণ হারান এই অকুতোভয় বীর। মুক্তিবাহিনী পাকিস্তান বাহিনীর মেশিনগান পোস্টে গ্রেনেড হামলা করে ফাঁড়ি দখলের পর শহীদ হামিদুর রহমানের লাশ উদ্ধার করে। হামিদুর রহমানের মৃতদেহ সীমান্তের অল্প দূরে ভারতীয় ভূখণ্ডে ত্রিপুরা রাজ্যের হাতিমেরছড়া গ্রামের স্থানীয় এক পরিবারের পারিবারিক গোরস্তানে দাফন করা হয়। নিচু স্থানে অবস্থিত কবরটি এক সময় পানির তলায় তলিয়ে যায়। পরে ২০০৭ সালের ২৭ অক্টোবর তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার হামিদুর রহমানের দেহ বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নেয়। সে অনুযায়ী ওই বছরের ১০ ডিসেম্বর বাংলাদেশ রাইফেলসের একটি দল ত্রিপুরা সীমান্তে হামিদুর রহমানের দেহাবশেষ গ্রহণ করে এবং যথাযোগ্য মর্যাদায় কুমিল্লার বিবিরহাট সীমান্ত দিয়ে শহীদের দেহাবশেষ বাংলাদেশে নিয়ে আসা হয়। ১১ ডিসেম্বর রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমানকে ঢাকার বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে সমাহিত করা হয়।’
আসলাম একমনে বাবার কথাগুলো শুনে যাচ্ছে। মাঝেমধ্যে দু’হাত মুষ্টিবদ্ধ করে এদিক সেদিক তাকাচ্ছেও সে। হঠাৎ দেখা গেল ঝর্ণার প্রবাহমান পানির মতো দরদর করে গড়িয়ে পড়ছে তার চোখের পানি। কান্নার ঝাঁকুনিতে দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না আসলাম। বসে পড়ে সে। হঠাৎ বাবাকে লক্ষ্য করে বলে উঠে, ‘বাবা! আমার কলিজাটা ফেটে যাচ্ছে বাবা! আমার চোখের পানি কোনো বাঁধ মানছে না যে! হাহাকার করছে ভেতরটা। বাবা কেন এমনটা হচ্ছে?’
বাবা মহসিন সাহেব তাকে অভয় দিলেন। শান্ত হতে বললেন। কিন্তু সে একটানা কেঁদেই চলছে। বাবাকে চমকে দিয়ে সহসা বলে উঠে আসলাম, ‘বাবা, পেনশনের টাকায় এখানেই একটা ঘর করবে তুমি। আমি জানালা দিয়ে চেয়ে থাকব বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমানের শহীদ হওয়ার স্থানটির দিকে। চেয়ে চেয়ে প্রাণ জুড়াবো বাবা! বাবা… বা…বা…আ…আ…।’
ছেলের আকস্মিক এমন অস্বাভাবিক আচরণে মহসিন সাহেব থতমত খেয়ে যান। কিছুটা ভীতসন্ত্রস্তও হয়ে পড়েন তিনি। একটু অদূরে দাঁড়িয়ে থাকা পর্যটকরা কী আনন্দ-উল্লাস করছে! অথচ আনন্দ ভ্রমণে এসে তার ছেলেটা কি-না কেঁদে বুক ভাসাচ্ছে! হঠাৎ মাথা ঝাঁকিয়ে আপন মনে বলে উঠলেন, ‘আরে! আমার ছেলেকে ভূতে ভয় দেখাচ্ছে নাতো? এগুলো নিশ্চয়ই পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর প্রেতাত্মা! নাহ্ এখানে আর দাঁড়িয়ে থাকা যায় না।’
ছেলের হাত ধরে বাড়ির দিকে রওয়ানা হলেন তিনি। ফেরার সময় ছেলেকে শুধু এই বলে সান্ত¡না দিলেন, ‘হ্যাঁ, পেনশনের পর এখানেই একখানা ঘর করব বাবা। এখন তবে বাড়িতে যাওয়া যাক।’

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়