লজিক প্রকল্প : রৌমারীতে সোলার পাম্প স্থাপন শুরু

আগের সংবাদ

চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় কী প্রস্তুতি : বিভিন্ন দেশের সঙ্গে অগ্রাধিকার ও মুক্তবাণিজ্য চুক্তি হবে > ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হবে

পরের সংবাদ

শিল্পসাধক রবিউল হুসাইন

প্রকাশিত: নভেম্বর ২৬, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: নভেম্বর ২৬, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

রবিউল হুসাইনকে দূর থেকে দেখা মানুষের সংখ্যা অনেক বেশি। সেটাই স্বাভাবিক, আপন কর্ম ও অবদানের নিরিখে মানুষ যাদের জানে, তাদের পরিচিতি অনেক ব্যাপক, সেই তুলনায় কাছ থেকে মানুষটিকে দেখা বা জানার তো থাকে এক সীমারেখা কিংবা বলা যায় বৃত্তাবদ্ধতা। ফলে বলা যেতে পারে, এমন ধরনের কৃতবিদ্য কিংবা কর্মবীর মানুষের থাকে দুই পরিচয়, একটি বাইরের, আরেকটি ভেতরের। সুপরিচিত ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে বাইরের এবং ভেতরের সত্তার মধ্যে একটা ফারাক থেকেই যায়। কেননা মানুষ বাস্তবের সঙ্গে কল্পনার মিশেল দিয়ে এঁকে নেন আরাধ্য ব্যক্তির ভাবমূর্তি। সে কারণে কেউ কেউ বলেন, যারা পাবলিক ফিগার বা নন্দিত ব্যক্তি তাদের কাছে যেতে নেই, তাদের দেখা-জানা অর্থ মোহভঙ্গ হওয়া, ছবির মানুষ কখনো মনের মানুষ হতে পারে না।
এই অবতরণিকা রবিউল হুসাইনকে ঘিরে, যে মানুষটি অনেক পরিচয়ে পরিচিত, অনেক গুণে গুণান্বিত। তার ক্ষেত্রে ভেতরের বাইরের কোনো ফারাক ছিল না, দুইয়ে মিলে তার সত্তা, উভয়ের সম্মিলনের চাইতেও তিনি বুঝি বড়। পেশায় তিনি স্থপতি, বাংলাদেশে স্থাপত্যবিদ্যা বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে আলাদা বিষয় হিসেবে যখন স্বীকৃত হয়েছে সেই সময়ের প্রথম পর্বের স্নাতক তিনি। সবে গড়ে উঠছে এক নতুন বিদ্যাচর্চা, যা দক্ষ দেশজ পেশাজীবী গোষ্ঠীর জন্ম দেবে, তারা কোন স্বপ্ন ও সাফল্য দ্বারা তাড়িত হবেন, জীবনে প্রতিষ্ঠার জন্য কোন পথে এগোবেন, সেই অগ্রসরতার বাধা কোন সৃজনের গুণে অপসারণ করে নতুন পথরেখা তৈরি করবেন- এসব নির্ভর করছিল অনেক কার্যকারণের ওপর, যেখানে তিন উপাদানের ছিল বড় ভূমিকা, শিক্ষকমণ্ডলী, ছাত্র স¤প্রদায় এবং জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডল।
এখন পিছন ফিরে তাকালে চোখে পড়বে একগুচ্ছ নবীন প্রতিভা, যারা স্থাপত্যবিদ্যা শিল্প ও পেশা হিসেবে জাতির সামনে প্রতিষ্ঠা করলেন। তাদের এই অবদানের সঙ্গে তুলনীয় হতে পারে পঞ্চাশের দশকের গোড়ায় ঢাকায় ছোট আকারে আর্ট ইনস্টিটিউটের প্রতিষ্ঠা, জয়নুল-কামরুল ও তাদের সহযোগীরা হাতে-গোনা কতিপয় ছাত্র নিয়ে যে যাত্রা সূচনা করেন সেই শিক্ষার্থীরা কীভাবে বাংলাদেশের শিল্পভুবন পাল্টে দিল, সে ইতিহাস কমবেশি আমরা জানি এবং সেই জানা, বিচার-বিশ্লেষণ নানাভাবে অব্যাহত রয়েছে, তুলনায় স্থাপত্যবিদ্যার প্রথম দিককার ছাত্রদের সম্পর্কে আমরা তো খুবই কম জানি। তাদের জানা, তাদের জীবন ও কর্ম বিচার ছাড়া বাংলাদেশের এই স্থাপত্যচর্চার বিকাশ আমরা বুঝবো না, যেমন বুঝবো না চারুকলার শিল্পশিক্ষাযাত্রা ব্যতীত বাংলাদেশের জাগরণের বিবিধ অর্জনসমূহ।
রবিউল হুসাইনের সঙ্গে আমি দেখি আরো একঝাঁক তরুণকে, আলমগীর কবির, শামসুল ওয়ারেস, তাজু চৌধুরী, মুজতাহিদ আহমদ, শাহীন চৌধুরী, প্রমুখ হাতেগোনা কতক ব্যক্তিসত্তা। প্রত্যেকের জীবনচরিতের মধ্যে পাওয়া যাবে তৎকালীন বঙ্গসমাজ ও বিশ্বকে। এরা জীবনের নানা দিকে ছড়িয়ে গেছেন, সাফল্যের বিবিধ উদাহরণ তৈরি করেছেন এবং সমষ্টিগতভাবে পরিচয় দিয়েছেন সামাজিক অঙ্গীকারের, পেশার দক্ষতার সঙ্গে দেশের মাটির মিশেল দিয়ে গড়ন নির্ধারণ করে দিয়েছেন বাংলাদেশের চারুশিল্পের স্থাপত্যচর্চার, আজ যার বহুমুখী পল্লবময়তা আমরা দেখি আমাদের চারপাশে।
ষাটের দশকে সম্পূর্ণ নতুন এক বিদ্যাচর্চায় যারা অবতীর্ণ হয়েছিলেন তাদের নেতৃত্বে ছিলেন বলিষ্ঠ তরুণেরা, পরে কীভাবে কোন অলক্ষে সবার অঘোষিত নেতায় পরিণত হলেন কুণ্ঠিত স্বভাবের একান্ত শিল্পসাধক রবিউল হুসাইন, সেটা বিশেষভাবে লক্ষণীয়। আইয়ুবি জমানায় স্থাপত্য বিভাগের শিক্ষার্থীরা যে সাহিত্যে মজেছিল বড়ভাবে, চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনে ছিল সোৎসাহী সদস্য, দেশের উত্তালতার আঁচ অনুভব করে সেই আগুনে ইন্ধন জোগাতে পিছপা ছিলেন না, সেটা বিশেষভাবে প্রকাশ পেয়েছে মুক্তিযুদ্ধে তাদের ভূমিকা দ্বারা।
স্থাপত্যবিদ্যাচর্চা এবং তার প্রয়োগ যাত্রাকাল থেকে যে স্বাতন্ত্র্য অর্জন করেছিল স্বভাবগতভাবে তা ধারণ করে চলেছিলেন রবিউল হুসাইন, সেই চেতনা ও আলোকদীপ্তি নিয়ে অব্যাহত রেখেছিলেন পথচলা। চলার পথে পাথরে ক্ষত-বিক্ষত তিনি হয়েছেন, কিন্তু সবার জন্য ভালোবাসার অর্ঘ্য নিবেদনে কখনো কার্পণ্য করেননি। ফলে কোন অজান্তে সবার অগোচরে তিনি হয়ে উঠলেন নেতা, সকলের রবিদা, কে জানে। স্থপতিদের সংঘের তিনি নির্বাচিত হলেন প্রথম সভাপতি, দক্ষিণ এশীয় স্থপতি সংসদের ক্ষেত্রেও তাই। বাংলাদেশে পাবলিক আর্টের শিল্পিত উদাহরণ আমরা বিশেষ তৈরি করতে পারিনি, কেননা সৃজনশীতার দ্বার খুলে দিতে যে ঔদার্য, শিল্পদৃষ্টি ও সংবেদনশীলতা প্রয়োজন, যৌথ তৎপরতা, বিশেষভাবে সরকার সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রীয় প্রকল্পে তার বিকৃতি ঘটে নানাভাবে। অন্যদিকে জাতীয়ভাবে যেসব স্থাপত্য বিশেষভাবে স্মৃতিস্তম্ভ, সৌধ ও প্রতীকী নির্মাণ ঘটেছে তার অধিকাংশের জুরি বোর্ড সদস্য হিসেবে রবিউল হুসাইন সৃজনশীলতার অগ্রাধিকার নিশ্চিত করেছেন। ফলে এক্ষেত্রে নবীনদের পদপাত ও নব্য-সৃজনশীলতার পথ মনে হবে একান্ত অনায়াসে তিনি করে দিয়েছিলেন। তিনি সাহিত্যিক সংঘে একইরকমভাবে সম্পৃক্ত ও সহজভাবে নেতৃত্বে বরিত। শামসুর রাহমানের অবর্তমানে কবিতা পরিষদের হাল তিনিই ধরেছেন। আরো কত উদ্যোগে তার কল্যাণ-স্পর্শ লেগে আছে সেসবের হদিশ করা মুশকিল, তবে করা একান্ত দরকার। আর এই দীর্ঘ জীবনসাধনায় তিনি পরম দরদ ও নিষ্ঠা নিয়ে মিলিয়েছিলেন কবিতা ও স্থাপত্য, এই দুইয়ের সম্মিলিত সাধনাই বুঝি জীবনভর করে গেছেন, জাগতিক সব সাফল্য প্রলোভন তুচ্ছ করে বাউলের মতো সহজিয়াভাবে। তাইতো তিনি আমাদের সবার রবিদা, যে অভিধা তাকেই মানায়, কেননা তিনি তো আমাদেরই লোক, অলোকসামান্য, একান্ত আপনার।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়