দ্বিতীয় ধাপের ইউপি নির্বাচন : বিনা প্রতিদ্ব›িদ্বতায় নির্বাচিত ৮১ জন চেয়ারম্যান

আগের সংবাদ

সম্প্রীতির জমিনে শকুনের চোখ

পরের সংবাদ

সম্প্রীতির সৌন্দর্য

প্রকাশিত: অক্টোবর ২৯, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: অক্টোবর ২৯, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

একটি কবিতার উদ্ধৃতি দিয়ে শুরু করা যাক, যাকে বর্তমান আলোচনার চিন্তাসূত্র বলতে পারি-
মিহিন সুতোয় বোনা সম্প্রীতি তাঁতের শাড়ি
ঝড়-জলে অনুভবে থাকা মানবিক নর-নারী;
সম্প্রীতি বিশ্বাস পরস্পর পূর্ণ আস্থা
ভেদাভেদ ভুলে সবার অভিন্ন রাস্তা।
ধর্ম-বর্ণ-গোত্র ভুলে জমে ওঠে সম্প্রীতির মেলা
বদ্বীপ বঙ্গের জনপদ জুড়ে সম্প্রীতি মাটির ঢেলা।
সম্প্রীতি-সৌহার্দ্য সহিষ্ণুতা মানবের যাবতীয় শুভ কলা
মা’র হাতে খাওয়া শৈশবের অমৃত ভাতের নলা।

সিসামুক্ত বাতাসে সম্প্রীতি অনিন্দ্য পরোপকারী
প্রগতির পথে উর্ধ্বশ্বাস নির্মোহ হাওয়াই গাড়ি;
সম্প্রীতি উদার নীলাকাশ নীল সমুদ্রের জল
স্রোতস্বিনী নদীতে সম্প্রীতি ঘোলা জলের কল্লোল,
সম্প্রীতি কল্যাণ মুক্তপ্রাণ মানুষের অনুভূতি
শান্তিকামী জনতার কাক্সিক্ষত স্বপ্নের গীতি;
সম্প্রীতি নিঃশর্ত ভালোবাসার বিকল্প পরিচয়
সাম্প্রদায়িকতার বিপক্ষে সে জানে না অনুনয়!
(সম্প্রীতির সৌন্দর্য \ ফরিদ আহমদ দুলাল)

বাঙালির চোখে যিনি স্বশাসিত হবার স্বপ্ন এঁকে দিয়েছিলেন এবং যিনি তার সংগ্রামী জীবনের সবটাই উৎসর্গ করেন সাধারণের মুক্তিচিন্তায়, তিনি বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। যিনি পেয়েছিলেন শান্তির সর্বোচ্চ পুরস্কার ‘জুলি ও কুড়ি’। শান্তির জন্যই সম্প্রীতি অত্যাবশ্যক; কিন্তু জুলি ও কুড়ির দেশে ‘মুজিববর্ষে’ যদি সাম্প্রদায়িক শক্তির হীন চক্রান্তে সম্প্রীতি বিপন্ন হয়, তা যেমন গভীর বেদনার তেমনি লজ্জারও। এই লজ্জা থেকে পরিত্রাণের পথ কী? না, সে পথ কোন দুর্লঙ্ঘ পথ নয়, সে পথ আমাদের অপরিচিতও নয়। অকুণ্ঠচিত্তে বলতে পারি, সে পথের দিশা-১৯৭১। মহান মুক্তিযুদ্ধের সুবর্ণজয়ন্তীতে আমাদের বিভ্রান্ত হবার সামান্য সুযোগ নেই। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং মুজিবাদর্শের প্রেক্ষাপট বিবেচনায় আজকের সংকটে ঐক্য ও সম্প্রীতি অনেক বেশি তাৎপর্যপূর্ণ; কার ঐক্য? অবশ্যই সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী প্রাগ্রসর মানুষের। একদিকে দুঃসহ করোনা মহামারি মোকাবিলা; অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শক্তি, ধর্মান্ধ মৌলবাদী গোষ্ঠীর আস্ফালন; ইতোমধ্যেই আমরা প্রত্যক্ষ করেছি, মৌলবাদী গোষ্ঠী বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভাঙার ধৃষ্টতা দেখিয়েছে। সম্প্রীতির বাংলাদেশে প্রাগ্রসর লেখক সমাজ ও সাধারণ মানুষ এ বঙ্গভূমিতে কোন ধরনের ধর্মান্ধতা-কূপমণ্ডূকতা দেখতে চায় না; ১৯৭১-এ ত্রিশ লাখ মানুষের আত্মত্যাগ এবং দুই লক্ষাধিক মা-বোনের সম্ভ্রমহানির বিনিময়ে যে বিজয় আমরা অর্জন করেছি, তাকে সমুন্নত রাখতে আমরা বদ্ধপরিকর। তাই সাম্প্রদায়িকতা নিয়ে কথা, কথা সম্প্রীতি নিয়ে।
সমাজের কল্যাণ-প্রয়োজনেই একজন সমাজ সংস্কারককে হয়ে উঠতে হয় একজন আদর্শ সংস্কৃতিকর্মী। সংস্কৃতিকর্মীর পরিচয় অনেক বিস্তৃত। এক অর্থে মাঠের রাখাল থেকে ধর্মপ্রচারক, সৃজনশীল শিল্পকর্মী থেকে নিমগ্ন দার্শনিক সবাই সংস্কৃতিকর্মী। সংস্কৃতি সব সময়ই প্রাগ্রসর চিন্তার বহিঃপ্রকাশ। পৃথিবীর প্রাণিকুলের মধ্যে একমাত্র মানুষেরই রয়েছে নিজস্ব সংস্কৃতিভুবন; যে কারণে মানুষকে সৃষ্টির সেরা জীব বলে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। মানুষের এই শ্রেষ্ঠত্ব কেবল কিতাবে থাকলেই তাকে শ্রেষ্ঠ হিসেবে মেনে নেয়া যায় না, শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণ তার নিজেকেই করতে হবে। কেন না মানুষের শ্রেষ্ঠত্বের প্রচার করেছে মানুষ নিজে; সুতরাং শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণ করতে হবে তাকে তার আচরণে, তার ব্যবহারে, তার সৃষ্টিশীলতায়-উদ্ভাবনে-প্রাগ্রসরতায়, তার শিষ্টাচারে-নম্রতায়, তার মননে-মনীষায়, তার ব্যক্তিত্বে ও বিনয়ে। শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের জন্য চাই সংস্কৃতিমান হয়ে ওঠার প্রয়াস ও সাফল্য। সংস্কৃতিমান না হলে কেউ শিষ্ট হতে পারে না, সংস্কৃতিমান না হলে কেউ নম্র-বিনয়ী-ব্যক্তিত্ববান হতে পারে না, সংস্কৃতিমান না হলে কেউ সৃষ্টিশীল হতে পারে না; সংস্কৃতিমান না হলে কেউ সহিষ্ণু হতে পারে না, সংস্কৃতিমান না হলে কেউ চলিষ্ণু হতে পারে না; কেন না সংস্কৃতি মানেই প্রগতি-সংস্কৃতি মানেই প্রাগ্রসরতা। সংস্কৃতিকে তুলনা করা যায় প্রবহমান নদীর সাথে। প্রবহমান নদী যেমন নিত্য বয়ে চলে, সংস্কৃতিও তেমনি নিত্য প্রবহমান। যা প্রবহমানতাকে ধারণ করতে জানে তার নামই তো সংস্কৃতি। আমরা যদি সংস্কৃতির স্বরূপ সন্ধান করতে পারি তাহলেই আমরা হয়ে উঠতে পারি সম্পন্ন মানুষ। কেননা মানুষের মানুষ হয়ে ওঠা, আর মানুষের সংস্কৃতির সাথেই আছে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের আবশ্যিক পূর্বশর্ত। এবং এভাবেই ‘সংস্কৃতি’ শব্দটি দুর্বোধ্যতা ও জটিলতার আবর্তে আবৃত হয়ে যায়, যে আবর্ত থেকে সংস্কৃতি শব্দটিকে সাধারণ্যে গ্রহণীয় এবং প্রাঞ্জল করে তুলবার দায়িত্বটি পালন করতে হয় সংস্কৃতিকর্মীকে; বোধগম্য কারণেই সংস্কৃতিকর্মীর পরিচয় অনেকটাই বিস্তৃত হয়ে পড়ে।
সমাজে ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান-সংস্কার-রীতি-নীতি যখন মানব সভ্যতার অগ্রযাত্রার পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায় তেমন পরিস্থিতি থেকে সমাজকে নতুন পথের দিশা দিতে যিনি বা যারা এগিয়ে আসেন তিনি বা তারা সমাজ সংস্কারক হিসেবে পরিচিতি পান; এবং সমাজ-সংস্কারক মনীষীরা যতক্ষণ সমাজকে এগিয়ে নেবার কাজে নিয়োজিত থাকেন, তার সে সময়ের কাজটিই সংস্কৃতিকর্মীর কাজ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ছিলেন বাঙালি জাতির দিশা; হাজার বছরের ইতিহাসে যে বাঙালি জাতি কখনো স্বশাসিত হবার কথা ভাবেনি; সেই জাতির চোখে তিনি স্বাধীনতার স্বপ্ন জুড়ে দিয়েছিলেন ১৯৭১-এ। ত্রিশ লক্ষ মানুষের বুকের রক্ত, দুই লক্ষাধিক মা-বোনের সম্ভ্রম আর কোটি মানুষের সীমাহীন দুর্ভোগের বিনিময়ে আমরা সেই স্বপ্নকেই বাস্তব করেছি। আত্মত্যাগের মাধ্যমে বাঙালি যে স্বপ্ন বাস্তব করেছে, সেই স্বপ্নের মর্যাদা সমুন্নত রাখতে প্রয়োজনে আমাদের কঠোর হতে হবে বৈকি! ধর্মের ভুল ব্যাখ্যা করে যারা বিশ্বাসী-সরল মানুষের সাথে প্রতারণা করে, বাঙালির স্বপ্নকে পদদলিত করে, ব্যক্তিস্বার্থ এবং গোষ্ঠীস্বার্থ বজায় রাখতে চায়। পরোক্ষে তারা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের অর্জনকে অস্বীকার করতে চায়। সুতরাং যৌক্তিক কারণেই আমরা তাদের সমস্ত ঔদ্ধত্যের তীব্র প্রতিবাদ জানাই; কেবল প্রতিবাদ নয় প্রয়োজনে কঠিন প্রতিরোধ গড়ে তুলে অন্ধতা-কূপমণ্ডূকতার সমুচিত জবাব দিতে হবে; যে সোনার বাংলার স্বপ্ন নিয়ে ১৯৭১-এ বাঙালি বঙ্গবন্ধুর তর্জনী হেলনে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। বঙ্গবন্ধুর কাক্সিক্ষত ‘স্বাধীনতা’ আমরা অর্জন করেছি, এবারে ‘মুক্তি’ অর্জনের যুদ্ধে সবাই ঐক্যবদ্ধ হতে চাই। সে জন্য বাঙালির ঘরে ঘরে চাই সম্প্রীতি। সম্প্রীতির আলো ছড়িয়ে দিয়েই আমরা পরাস্ত করতে চাই সাম্প্রদায়িকতাকে কূপমণ্ডূকতাকে-ধর্মান্ধতাকে।
মানবজীবনের গূঢ় সত্যের উন্মোচন সাহিত্যের অন্যতম লক্ষ্য; যে গূঢ় সত্য উন্মোচনের মাধ্যমে পাঠকের নানাবিধ প্রত্যাশা পূরণের পাশাপাশি মানবহিতের বিষয়টিকে নিশ্চিত করাও এর কাজ। আর সত্যের সাথে আছে জ্ঞানের যোগ, যে কারণে সাহিত্যকে জ্ঞানের কষ্টিপাথরে যাচাই করে নেবারও প্রয়োজন পড়ে। জ্ঞানকে আবার কর্মে-ভাবে-আধুনিকতায় ও বিজ্ঞানের তুল্যমূল্যে বিকশিত হওয়া আবশ্যক। সৃষ্টিশীল সাহিত্যিকগণ নিজেদের রচনার মাধ্যমে মানবহিতের বিষয়টি নিশ্চিকরণে সচেষ্ট থাকেন। লোকবাংলার সাধারণ মানুষকে তথ্য-উপাত্ত দিয়ে উদ্বুদ্ধ করার কারণ দেখি না, লোকবাংলার মানুষ জানে, ‘নানান বরণ গাভিরে ভাই একই বরণ দুধ/জগৎ ভরমিয়া দেখি একই মায়ের পুত।’ এবং ‘সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপর নাই।’ শাশ্বত এই বাণী আজকের সংকটে আমাদের সবাইকে উপলব্ধিতে আনতে হবে। মানুষ যখন চাঁদে যাচ্ছে-যখন মঙ্গল গ্রহে পাড়ি জমাচ্ছে, যখন গোটা পৃথিবীকে বলা হচ্ছে ‘গেøাবাল ভিলেজ’; প্রযুক্তি যখন পলকে পৃথিবীর এক প্রান্তের মানুষের সাথে অন্য প্রান্তের মানুষকে সংযুক্ত করছে, বিজ্ঞানের নতুন নতুন আবিষ্কার যখন অজস্র প্রচলিত মূল্যবোধকে প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে; ঠিক তখন কিছু ধর্মান্ধ কূপমণ্ডূক ধর্মের অপব্যাখ্যা দিয়ে সরলপ্রাণ মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে, উগ্র মৌলবাদ এক ধর্মের মানুষকে অন্য ধর্মের মানুষের ওপর আক্রমণ করতে প্রাণিত করছে। এক গোত্রের মানুষ অন্য গোত্রের মানুষের ওপর পৈশাচিকতা ছড়িয়ে দিচ্ছে। এমন পৈশাচিকতা যেমন বাংলাদেশ প্রত্যক্ষ করছে; পৃথিবীর অন্য দেশেও তা বর্তমান। অন্যেও চিন্তা না করে আমরা যদি নিজেদের পরিশুদ্ধ করে নিতে পারি, তবেই আসবে মুক্তি- আসবে সম্প্রীতি। মানুষের মুক্তিচিন্তায় বঙ্গবন্ধু যে বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন, সেই বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার মধ্যেই আছে সাধারণের মুক্তি। আসবে মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি, অন্ধতা-কূপমণ্ডূকতা-অনাচার-দুঃশাসন-দুর্নীতি-ধর্মান্ধতা-অনৈতিকতা থেকে মুক্তি এবং আসবে সাংস্কৃতিক মুক্তি। যে ‘মুক্তি’র ঘোষণা বঙ্গবন্ধু দিয়েছিলেন ১৯৭১-এর ৭ মার্চে।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়