শাহজালাল বিমানবন্দর : পাকস্থলীতে করে ইয়াবা পাচারের সময় গ্রেপ্তার ১

আগের সংবাদ

নেতৃত্বের দ্বন্দ্বে বাড়ছে সহিংসতা

পরের সংবাদ

জন্মদিন > শামসুর রাহমানের কবিতায় লোকজ অনুষঙ্গ ও ঐতিহ্য

প্রকাশিত: অক্টোবর ২২, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: অক্টোবর ২২, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

শামসুর রাহমান আধুনিক বাংলা কবিতার অন্যতম প্রধান কবি। নিঃসন্দেহে সতীর্থদের মধ্যে সেরা। কালের সীমানা পেরিয়ে মহাকালের বুকে কবিতার সার্বভৌম আধারের প্রতিভূ। তার কবিতার ব্যাপ্তিমূলে যে বোধ ও সংবেদ কাজ করেছে তা অন্তর্গত ও বহিঃরস্থ উভয় ক্ষেত্রে সমানভাবে পরিদৃষ্ট। তার কবিতা হয়ে ওঠেছে সর্বজনীন প্রজ্ঞা, প্রত্যয় ও পাঠকপ্রিয়তায় অনন্য। শামসুর রাহমানের কবিতার ব্যাপ্তি নানাভাবে নানামাত্রায়। তার কবিতা কালের কর্ষিত মহিমায় অন্তহীন আলোয় অভিষিক্ত। কবিতার মর্মার্থ বিশ্লেষণে নানাভাবে তাকে আখ্যায়িত করা হয়। অভিহিত করা হয় নাগরিক কবি, স্বাধীনতার কবি, জাতীয় চেতনার কবি হিসেবে। বিষয়টি সর্বত্রভাবে একমাত্রিক নয়। তবে তার কবিতার বহুমাত্রিকতা ও বৈচিত্র্য এরকম নানা প্রসঙ্গের প্রাসঙ্গিকতাকে অনিবার্য করে তুলেছে।
শানসুর রাহমানকে প্রধানত নাগরিক বোধ ও সংবেদনশীলতার কবি বলা হয়। কিন্তু তার কবিতা অনুষঙ্গ, আবেদন, শিল্পময়তায় বাংলা ও বৈশ্বিক কবিতার ভুবনজুড়েই পরিব্যপ্ত। তার কবিতায় অন্যান্য বিষয়াবলীর সঙ্গে লোকজ উপাদান, ঐতিহ্যের বৈভব লক্ষ করা যায়। জসীমউদ্দীনের কবিতার লোকজ উপাদান প্রচলিত ধারায় উপস্থাপনের মধ্য দিয়ে যে কবিকীর্তির জাগরণ ঘটে, শামসুর রাহমান সেখানে অনেকটাই আলাদা। এ ভিন্নতাই তার বৈশিষ্ট্য ও নিজস্ব কাব্যস্বর। বস্তুত শামসুর রাহমানের কবিতায় প্রকরণগত ভিন্নতা ও বাঁকবদল ঘটেছে বারবার। তার সচেতন দৃষ্টিভঙ্গি, দেশাত্মবোধ, স্বাধীনতা, চিরায়ত বাঙালিত্বের প্রতি আনুগত্য, প্রগতিশীলতা, নিরন্তর মগ্নতা তার কণ্ঠকে আলাদা স্বরে ও শব্দে বৈশিষ্ট্যময় করে তোলে। তাই নগরকেন্দ্রিক জীবনযাপন করেও গোটা দেশ ও বিশ্বকে কবিতায় বিস্ময়কর দ্যুতিতে তিনি তুলে আনতে সমর্থ হয়েছেন। শামসুর রাহমানের প্রথম থেকে শেষ কাব্য পর্যন্ত এ ধারা কমবেশি বহমান।
প্রাত্যহিক নাগরিক জীবনের দৃশ্যমান অদৃশ্যমান ঘটনা, বিষয়, অনুষঙ্গ যেমন তিনি কবিতায় ধারণ করেন, তেমনি লোকজ বিষয়-আশয়ও কবিতায় লালন করেন সমান দক্ষতায়। এর সঙ্গে ঐতিহ্য ও মিথের ব্যবহার করে কবিতার আধুনিকতার ধারায় এনেছেন নতুন বেগ। গভীর মননশীলতায় জাতির শেকড় সম্পৃক্ততার দিকটি সমীহের সঙ্গে স্মরণ করেছেন। এভাবে তার কবিতা বিস্তৃত ও প্রসারিত অগাধ সাড়ম্বরে।
শামসুর রাহমান লোকজ শব্দ ও বিষয়াবলী কবিতায় সংযোজনের ক্ষেত্রে সাবলীল ও সংযমী। যা বললে হয়, যা বললে নয় এর মধ্যে তিনি থাকতে চেয়েছেন। মৃত্তিকামগ্ন মানুষের জীবন, জীবনধারা থেকে আহরণ করেছেন উপকরণ। লোকজ শব্দাবলীর প্রয়োগে একই সঙ্গে মিথ, ইতিহাস ও ঐতিহ্যে মিলে তার কবিতায় বিস্ময়কর সমন্বয় ঘটেছে। স্বাভাবিকভাবে তার সৃষ্টি কালের বিশালত্বকে স্পর্শ করেছে নিজস্ব ভার ও শক্তিতে :
ঝিঁঝির কোরাসে স্তব্ধ, বিগত রাত মনে করে/ উন্মন- মনে হরিণের মতো দাঁতে ছিঁড়ি ঘাস,/ হাজার যুগের তারার উৎস ঐ যে আকাশ/ তাকে ডেকে আনি হৃদয়ের কাছে, সোনালি অলস মৌমাছিদের/ পাখা-গুঞ্জনে জ্বলে ওঠে মন, হাজার-হাজার বছরের ঢের/ (রূপালী স্নান, প্রথম গান, দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে)। এ কবিতাটি তিনি এমনি অনেক লোকজ শব্দ দিয়ে পুরোটাই সাজিয়েছেন। যেখানে নাগরিক মননের সঙ্গে গ্রামীণ জীবনের আবহের প্রতিফলন লক্ষণীয়। শামসুর রাহমান তার অনেক কবিতাই মাকে ধারণ করেছেন। কখনো আবার মায়ের আদলে ধারণ করছেন দেশ ও বাঙালিত্বের অতলস্পর্শী হৃদয়িক চেতনা। মা ভালোবাসা, আশ্রয়, নির্ভরতার প্রতীক। জন্মভূমি অনুরূপভাবে গভীরে প্রসারণমান জাগ্রত চেতনায়, অভীক্ষা ও অঙ্গীকারে। এসব প্রকাশের ক্ষেত্রে তিনি বেছে নিয়েছেন গ্রামীণ জীবন ও লোকালয় থেকে আহরিত শব্দাবলী, উপমা, চিত্রকল্প:

– বলে শুনি, পাল্কি চড়ে, বেনারসী প’রে/
যেদিন এলেন তিনি আমাদের ঘরে/
চেরাগের মতো কল্যাণের হাত ধ’রে/
তারই স্মৃতি আছে লেগে অদৃশ্য চাঁপার উন্মীলনে,/ সোনার কলস আর সাঁঝ- নামা দিঘীর গহনে।/ মার চোখে শৈশবের ক্রৌঞ্চ দ্বীপ ভাসে? চোখে বেনেবউ পাখি, চোখে চন্দ্রমল্লিকার দাবি / (আমার মা’কে, রৌদ্র করোটিতে)
শামসুর রাহমানের অজস্র কবিতা লোকজ ও ঐতিহ্যের পালকি, বেনারসী শাড়ি, কলস, সাঁঝ, দিঘী, বেনেবউ পাখি, নকশীকাঁথা, চন্দ্রমল্লিকা এসব শব্দ, উপমায় শিল্পময় হয়ে উঠেছে। নগরে বসবাস ও বেড়ে ওঠা সত্ত্বেও তিনি লোকসংস্কৃতি ও ভাষা থেকে অনুষঙ্গ আহরণে দ্বিধাহীনভাবে অগ্রসরমান থেকেছেন আজীবন।
নগর চেতনা, সমসাময়িক বিষয়, ব্যক্তি, বিশেষ ঘটনা ও স্থানকেন্দ্রিক যেসব কবিতা তিনি লিখেছেন সে সব কবিতাজুড়েও অজস্র লোকজ শব্দ ও অনুষঙ্গের ব্যবহার করেছেন। এখানে লোকজ শব্দটি দিয়ে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর সঙ্গে সম্পৃক্ত বিষয়াদি বোঝানোর চেষ্টা করা হয়েছে। নগর জীবন ঘিরে নানা ঘটনা ও পরিস্থিতির অন্ত নেই। শামসুর রাহমান এ নগরে আজীবন থেকেছেন। এর আবহাওয়া, প্রতিদিনের আলোছায়া ঘিরে তার জীবন আবর্তিত হয়েছে। সুখ স্মৃতির পাশাপাশি অজস্র বিরূপ ঘটনা, অসহনীয় অস্থিরতায়ও তিনি আক্রান্ত হয়েছেন। এ অচলায়তন ভেঙে আবার তিনি তার সৃষ্টিশীলতায় মগ্ন হয়েছেন। নগর জীবন ঘিরে থাকা নানা পেশা, নানা শ্রেণির মানুষের কর্মকাণ্ড, বেঁচে থাকার অবিরাম অভিযাত্রা লক্ষ করেছেন। দেখা- অদেখা সব কিছুকে গভীর অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে উপলব্ধি করেছেন। আর নিজ মনের উৎসারিত বোধ ও আবেগে সেই অভিজ্ঞতার ফসলকে রূপ দিয়েছেন কবিতায়। এ প্রসঙ্গে তার কবিবন্ধু ও কথাসাহিত্যিক সৈয়দ শামসুল হক ‘আমাদের মহান সতীর্থ শামসুর রাহমান’ শীর্ষক স্মৃতিকথায় বলেন- ‘মনে পড়ে, কতবার কতদিন না দেখেছি তাকে — আড্ডায় কি তার কর্মস্থলে —- বাড়িতে কি’
পথ চলতে- ঠোঁট নাড়ছেন, জিজ্ঞেস করলে ‘ও কিছু না’ বলে, ত্রস্ত হয়ে, ঈষৎ হেসে, ঠোঁট নাড়ানো বন্ধ করছেন, আবার কিছুক্ষণ পরেই শুরু করেছেন নীরবে সেই শব্দ স্বাদ জিহ্বায় গ্রহণ করা, পরীক্ষা করা, বাতিল করা, আবার ফিরে থেকে শুরু করা। (শামসুর রাহমান স্মারকগ্রন্থ, বাংলা একাডেমি, পৃষ্ঠা-১০) এমনিভাবে কখনো তিনি কবিতায় ফিরে থেকে শুরু করেছেন।
তাই প্রতিটি কাব্যের কমবেশি কবিতায় লোকজ অনুষঙ্গের সন্ধান মেলে। তার প্রতিফলন লক্ষ করা যায়, যেমন:
-আজকাল কোনো কোনো বিকেলে হঠাৎ কী রকম/ হয়ে যাই, কী রকম এলোমেলো, যেন/ আমার ভেতরে/ কালবৈশাখীর মাতলামী, ভুলে যাই ইদানীং/ আমার মাথার তিন ভাগ চুলে শাদার পোচড়া/ পড়েছে, চোখের আলো বিকেল বেলার/ মতই স্তিমিত। বাসনার স্বপ্ন- ধোওয়া চরে নামে / আচাভূয়া পাখি, মাটি খুঁজে বের করে প্রতœ হরেক রকম।/ (বিউটি বোর্ডিং, ধুলায় গড়ায় শিরোস্রাণ) এ কবিতাটি পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী বিউটি বোর্ডিংকে কেন্দ্র করে লেখা। যেখানে কবির আড্ডাময় অনেক সময় কেটেছে। সেই বোর্ডিংয়ে অনেকদিন না যাওয়ার আকুলতা তাকে আজ আবেগে আপ্লুত করে তোলে। বহুদিন যেতে পারেন না সেখানে। কারণ, কবির ভাষায়- ক্যান্সারের মতো দ্রুত বর্ধমান বয়স আমার’। এ কবিতার বিউটি বোর্ডিং ঐতিহ্যে ও সময়ের স্বাক্ষর বহন করে। আবার ব্যবহৃত অনেক শব্দই উঠে আসে জনজীবনের অন্তহীন সাধারণ স্তর থেকে, যেমন; পোচড়া, চর, আচাভূয়া পাখি, দেবতা, বেশুমার, খাটো পা, বকের ছানা ইত্যাদি।
অথবা
-যারা গেল, তাদের এখনো/ আঁকড়ে রাখতে চায়, এ দেশের শেকড়-বাকড়,/
আঁকড়ে রাখতে চায় লতাগুল্ম আর/ গহিন নদীর, বাঁক, আঁকড়ে রাখতে চায়, শারদ রোদ্দুরে/ ডানা-মেলে-দেয়া কবুতরের ঝলক,/ আঁকড়ে রাখতে চায় নিঝুম তুলসীতলা, জোনাকির ঝাঁক। /(কেন মানুষের মুখ, অবিরাম জলভূমি)
শামসুর রাহমানের কবিতায় এভাবে লোকজ অনুসঙ্গ অত্যাবশ্যকীয় উপাদান হিসেবে সংযোজিত হয়েছে। নগর চেতনার কবিতাগুলোর পরিস্ফুটনে তিনি পরিব্রাজকের মতো দেশজুড়ে বিচরণ করেছেন। এদেশের শ্যামলিমাময় প্রকৃতি, তার কোলে লুকিয়ে থাকা অপার সৌন্দর্য, উজ্জ্বীবনের মহিমা, পাড় ভাঙনের শব্দ, লোকালয়ে জমে ওঠা অন্ধকার সবকিছুই তার দৃষ্টি ও মননে জাগ্রত ছিল। শারীরিকভাবে অবস্থান ও জীবনযাপন শহরে হলেও মানসিকভাবে তিনি বিরাজ করেছেন দেশময়।
কবিতায় শব্দ, চিত্রকল্প, উপমা, প্রতীকের জন্য তিনি সবসময় অনুসন্ধানে ব্যাপৃত ছিলেন। সব ধরনের কবিতায় তিনি নাগরিক অনুষঙ্গের সঙ্গে লোকজ শব্দ, অনুষঙ্গের প্রয়োগ ও সমন্বয় করেছেন দক্ষতার সঙ্গে। তার গভীর ও প্রসারিত অন্তর্মুখী শিল্পচেতনা ক্রমে গণমুখী শিল্পচেতনায় রূপান্তরিত হয়েছে। মানবিকতার শেকড় থেকে শিখরে গড়ে তুলেছেন সৃষ্টির শিল্পসৌধ।
মুক্তিযুদ্ধকালীন অবরুদ্ধ সময়ে তিনি বেশ কয়েকটি কালজয়ী কবিতা রচনা করেন। এর মধ্যে স্বাধীনতা তুমি, তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা উল্লেখযোগ্য।
-তোমার জন্য,
সগীর আলী, শাহবাজপুরের সেই জোয়ান কৃষক,/ কেষ্ট দাস, জেলেপাড়ার সবচেয়ে সাহসী লোকটা,/ মতলব মিয়া, মেঘনা নদীর
দক্ষ মাঝি,/
আর রাইফেল কাঁধে বনে জঙ্গলে ঘুরে বেড়ানো/ সেই তেজী তরুণ যার পদভারে/
একটি নতুন পৃথিবীর জন্ম হতে চলেছে/
সবাই অধীর প্রতীক্ষা করছে তোমার জন্য, হে স্বাধীনতা।/ (তোমাকে পাওয়ার জন্য, হে স্বাধীনতা, বন্দি শিবির থেকে)
এ কবিতায় বর্ণিত ব্যক্তিগণ আমাদের চেনাজানা গ্রামীণ জনপদের পরিচিত মুখ। স্বাধীনতার জন্য ব্যাকুল, মৃত্যুকে তুচ্ছ করে তারা অপেক্ষা করছেন। লোক জীবনের এ চাওয়াকে তিনি সামগ্রিক আবেগসহকারে কবিতায় অনবদ্য করে তুলেছেন।
শামসুর রাহমানের কবিতায় এভাবে জনজীবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত প্রকৃতি, পরিবেশ, অনুষঙ্গ ও শব্দাবলীকে তুলে এনেছেন। শুধু তাই নয়, বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর আশা-আকাক্সক্ষার প্রতিফলন ঘটেছে তার কবিতায় নিবিড় কলস্বরে। মনন ও মেধার দীপ্তিময় বিভায় তার কাব্যভুবন প্রসারিত হয়েছে ব্যক্তিগত আবেগ থেকে সমগ্রতায়।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়