তিতাস গ্যাস কর্মচারী ইউনিয়ন : পূর্ণ প্যানেলে জয়ী কাজিম-আয়েজ পরিষদ

আগের সংবাদ

যুদ্ধাপরাধ বিচারে স্থবিরতা ; বাকি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এগিয়ে নিতে সরকারের আগ্রহ নিয়ে সংশয়! ট্রাইব্যুনালেও জনবল সংকট

পরের সংবাদ

ধর্ম ও সমাজ ভাবনা

প্রকাশিত: অক্টোবর ১৩, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: অক্টোবর ১৩, ২০২১ , ১:০০ পূর্বাহ্ণ

ধর্মের মূলভিত্তি জীবজগতের কল্যাণ-কামনা। বলা হয়ে থাকে- স্বধর্মে নিধনং শ্রেয়, পরধর্ম ভয়াবহ। এর তাৎপর্য এই যে, পৃথিবীতে যুগে যুগে অনেক ধর্মের আবির্ভাব হয়েছে। সবই মানব কল্যাণের উদ্দেশ্যে। পৃথিবীর এক-এক অঞ্চলের আবহাওয়া এক-এক রকম। তার উপর ভিত্তি করে ধর্মচিন্তা স্থায়ী হয়েছে। তাই প্রকৃতি ও পরিবেশ ধর্মাচরণের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। যেমন ধর্মে পোশাক-পরিচ্ছদ, খাবার-দাবার ইত্যাদির বেলায়ও অনেক ভিন্নতা লক্ষণীয়। তাই যে যে ধর্মের আদর্শকে জীবনে গ্রহণ করেছে, তার সে জায়গায় থাকার তাগিদই দেয় এই বাণী। এর মধ্যেও মানুষের কল্যাণের কথা বর্ণিত আছে। যারা ধর্মের ধারক ও বাহক, তারা মহাপুরুষ- এই অর্থে যে তারা সুন্দর সমাজ বিনির্মাণের জন্য তাদের জীবন উৎসর্গ করেছেন- মানুষের মুক্তির অর্থাৎ কল্যাণের বাণী শুনিয়ে গেছেন। এখন আমরা যে কল্যাণ-সমাজের কথা বলি, সমতার কথা বলি, সামাজিক মূল্যবোধ ও সুন্দর সমাজগঠন এবং সহাবস্থানের কথা বলি- ধর্মের মূল বাণীও তাই। ধর্ম হচ্ছে উপলব্ধির বিষয়, আত্মচৈতন্য জাগ্রত করার বিষয়। ধর্মাচরণ শুধু আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে সীমিত থাকবে না, আচার-আচরণের মধ্যেও সীমিত থাকবে না। ধর্মের বাণী হৃদয়ঙ্গম করতে হবে এবং সেভাবে আত্মশুদ্ধির চেষ্টা থাকতে হবে। এই আত্মশুদ্ধি মানে পুকুরে ডুব দিয়ে ওঠা নয়, মনকে কলুষমুক্ত রাখা! সর্বোপরি ধর্মের দর্শন বোঝার চেষ্টা করা।
মানব সভ্যতার আদিতে প্রস্তর যুগের শুরু। বন্যপশু শিকার ও বনজঙ্গলের ফলমূল খেয়ে জীবনধারণ করত মানুষ। ধীরে ধীরে তারা পশুপালন ও কৃষিকাজ করতে শেখে। তখন থেকে ধর্মীয় চেতনায়ও পরিবর্তন আসে। কৃষিব্যবস্থা চালু হওয়ার পর সূর্য ও চন্দ্র দেবতারূপে গণ্য হতো। কারণ প্রাচীন মানুষ লক্ষ করে যে- বীজবোনা থেকে ফসলতোলা পর্যন্ত সূর্যের এবং পৃথিবীকে ঠাণ্ডা রাখা শস্যকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য চন্দ্রের প্রভাব অনস্বীকার্য। এভাবে ভারত, মিসর, গ্রিস প্রভৃতি দেশে সূর্যমন্দির, চন্দ্রমন্দির ইত্যাদির প্রতিষ্ঠা হয়। কালক্রমে প্রকৃতির অজেয় শক্তিকে তুষ্ট করার জন্য দেবদেবীর কল্পনা ও শক্তিপূজার উদ্ভব ও বিকাশ সাধিত হয় মানব-সমাজে। প্রকৃতির অজেয়শক্তির ভীতি ছাড়াও সৃষ্টির অপরূপ রূপেও বিস্ময় জাগে মানুষের মনে। এই সৃষ্টিরহস্য এখনো প্রায় অজানা। মানুষ সৃষ্টির এই অপার শক্তির কাছে নত হয়। এভাবে বিকশিত হয় ধর্মের শাখা-প্রশাখা, আর্বিভাব হয় নানা দেবদেবীর।
পৃথিবীতে যখন থেকে মানব জাতির উদ্ভব হয়েছে, তখন থেকেই সভ্যতার বীজ, সামাজিক বোধের বীজ রোপিত হয়েছে মানুষের মনে। কারণ প্রাণিজগতে মানুষই হচ্ছে সবচেয়ে বুদ্ধিমান ও মেধাসম্পন্ন সৃষ্টি। সেই গুহা মানবের কথাও যদি চিন্তা করি, দেখা যায় মানুষ নিজেরাই বুদ্ধি খাটিয়ে ধীরে ধীরে বেঁচে থাকার উপায় খুঁজে বের করেছে এবং প্রাকৃতিক বিপর্যয় থেকে নিজেকে রক্ষা করার কৌশল তৈরির ভাবনা করেছে। এভাবে প্রস্তর যুগ, কৃষিসভ্যতা এবং সেই সঙ্গে মানুষে-মানুষে সামাজিকতা গড়ে উঠেছে। মানুষ নিজেদের রক্ষার জন্য, পারিবারিক কল্যাণের জন্য, ফসল রক্ষার জন্য, খাদ্য জোগাড় করার জন্য পশুশিকারের জন্য প্রার্থনা করত। কালক্রমে প্রাকৃতিক ও জাগতিক বিপর্যয় থেকে মুক্ত থাকতে এভাবেই মানুষের মনে ধর্মীয় চেতনার উন্মেষ ঘটেছে।
ধর্মের স্পষ্টত দুটি দিক রয়েছে- একটি আধ্যাত্মিক চেতনাজ্ঞাপক; অন্যটি সামাজিক চেতনাজ্ঞাপক। ব্যক্তিতে-ব্যক্তিতে এই বোধেও তফাৎ রয়েছে। যেহেতু মানুষের স্বতন্ত্রভাবে চিন্তা করার ক্ষমতা রয়েছে- সেহেতু যার যার ভাবনাও আলাদা হয়েছে। সে যাই হোক না কেন, ধর্ম আমাদের সমাজ ও সভ্যতার সঙ্গে সম্পৃক্ত বিষয় হিসেবে প্রাচীনকাল থেকে মান্য হয়ে এসেছে। ধর্মের সামাজিক যে দিক তা প্রকৃতির সঙ্গে সম্পৃক্ত বিধায় একই প্রাকৃতিক পরিবেশের মানুষ একই আচার-আচরণ পালন করে এসেছে। যে কারণে প্রধান প্রধান ধর্মীয় অনুষ্ঠানগুলো কালক্রমে সর্বজনীন অনুষ্ঠানে রূপলাভ করেছে। এই অঞ্চলের প্রধান ধর্মীয় উৎসব দুর্গাপূজা, ঈদ, বৈশাখী পূর্ণিমা কিংবা বড়দিনের উৎসব। এসব অনুষ্ঠানে বাঙালি মাত্রই সমবেত হয়, পারস্পরিক কুশল বিনিময় করে। অনুষ্ঠানগুলো পরিণত হয় বাঙালির মিলনমেলায়। এতে মানুষে মানুষে ভাবের ও প্রীতির বিনিময় হয়, গড়ে ওঠে সামাজিক সম্প্রীতি। বাঙালির মহামিলনের উপলক্ষ হিসেবে আরো দুটি অনুষ্ঠান অন্তর্ভুক্ত হয়েছে আমাদের জীবনযাত্রায়। তা হলো- ‘পহেলা বৈশাখ’, আমাদের নববর্ষ পালনের উৎসব; অন্যটি ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’- জাতীয় শহীদ দিবস, বর্তমানে যা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে সারা বিশ্বে পালিত হচ্ছে। এই দিনগুলোতে জাতি-ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে সৌহার্দ-সম্প্রীতিবোধে উজ্জীবিত হয়ে ওঠে বাঙালিরা। দুর্গাপূজা প্রসঙ্গে বলা যেতে পারে যে, নিজের ও সমাজের দুর্গতি নাশের জন্যই দেবী দুর্গাকে অন্তরে ধারণ করেন ভক্তেরা। অসুর কিংবা অশুভকে বধ করে সুরের কিংবা শুভশক্তির জয়বার্তা ঘোষণা করে সমবেতভাবে।
ষড়ঋতুর আর্বতনে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের দেশ বাংলাদেশ। শারদীয় দুর্গোৎসব উদযাপিত হয় শরৎকালে- আশ্বিন মাসে। গ্রামাঞ্চলে তখন ধানের মৌসুম শেষ। বর্ষার পানিতে ডুবে থাকে গ্রামের পথঘাট। সে সময় নৌকায় গ্রামের পথে যাতায়াতের সুবিধা হয়। আবার চাষাবাদের পর বর্ষায় নিকাজ বিশ্রামের সময়ে সামাজিক অনুষ্ঠানাদিতে সমবেত হওয়ার তাগিদও বোধ করে তারা। এভাবে শারদীয় দুর্গোৎসবও ধীরে ধীরে বাঙালির মহোৎসবে পরিণত হয়েছে। পারিবারিক ও সামাজিক মঙ্গল কামনার পাশাপাশি মানুষের সমবেত আনন্দোৎসবেরও উপলক্ষ হয়েছে।
বৈদিক যুগের পর দেবদেবীর রূপ ও গুণের ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে, স্বাভাবিকভাবেই। কারণ আমরা জানি, এটাও মাঙ্গলিক উৎসব! কালের পরিক্রমায় দেবতা ও দেবীর সুস্পষ্ট রূপ লোকসমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। দেবতারাও ইহজাগতিক মানুষের সুখ-দুঃখের অংশী হয়েছেন। মানুষের এই বিশ্বাস জন্মেছে যে, দেবীর আরাধনায় তুষ্ট হয়ে কেউ দেবদেবীর কৃপালাভে ধন্য হয়েছেন। আবার কৃপালাভে ব্যর্থ হয়ে কাউকে দুর্ভোগও পোহাতে হয়েছে। এভাবে মানুষের প্রতিদিনের জীবনযাপনে, মানুষের বিশ্বাসে দেবদেবীর অবস্থান দিনে দিনে দৃঢ় হয়েছে। এই অঞ্চলে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের কাছে দুর্গাপূজা ধীরে ধীরে সামাজিক আচার-উৎসবের রূপ পরিগ্রহ করেছে।
আবার অঞ্চল বিশেষে দুর্গা ভিন্ন ভিন্ন নামেও পূজিত হতে দেখা যায়। যে নামেই হোক, উদ্দেশ্য হচ্ছে পারিবারিক ও সামাজিক মঙ্গলাকাক্সক্ষা। তাই যদি হবে, তবে ধর্মে-ধর্মে হানাহানির সুযোগ কোথায়? দেবীর আরাধনা তো প্রাণিজগতের কল্যাণের জন্যই! এসব তো ধর্মের প্রকৃত মাহাত্ম্য বুঝে উঠতে পারার ঘাটতির জন্যই হয়ে থাকে। আমি কবিতায় লিখেছিলাম- ‘ধর্মের বাহানায় হিংসার লোলুপ জিহ্বা মেলে ধরে যারা/ তাদের চিন্তাগুলো কদাকার- ভুল,/ তারা নরাদম, তারা পশু সমতুল।’ এই বার্তাই দিতে চেয়েছিলাম যে, যদি অন্য ধর্মের প্রতি পরস্পর শ্রদ্ধাশীল না হতে পারা যায়- তবে ধর্মের তো আর কিছুই থাকলো না। বিজ্ঞানীদের মতে- মাত্র কয়েক লাখ বছর আগে পৃথিবীতে মানব প্রজাতির আর্বিভাব হয়েছে। সৃষ্টির আদিতে মানুষের তো আর আলাদা আলাদা ধর্ম ছিল না, সব মানুষের আচার-আচরণ বোধভাবনা ছিল একই রকম। মানবসভ্যতার বিবর্তনের মধ্য দিয়েই কালক্রমে মানুষের ভিন্ন ভিন্ন ধর্মবিশ্বাস গড়ে উঠেছে। এ ধর্মবিশ্বাসের মূলে রয়েছে প্রাকৃতিক পরিবেশ ও লোকচিন্তার প্রভাব। হিন্দুদের বহু দেবদেবী রয়েছে, তা সত্ত্বেও তারা এক সৃষ্টিকর্তায় বিশ্বাসী। দেবদেবীগণ সৃষ্টিকর্তার শক্তি ও মহিমা প্রকাশের ভিন্ন ভিন্ন প্রতীক মাত্র। উপলক্ষ-ভেদে দেবতারও ভিন্নতা রয়েছে। রোগশোকের দেবতা, বনের দেবতা, শান্তির দেবতা ইত্যাদি। গ্রহ-উপগ্রহের প্রভাবও মানুষের জীবনচর্চার সঙ্গে জড়িত। এভাবেই শক্তির প্রকাশ ও দেবতাকে বশে রাখার জন্য পূজার আয়োজন হয়েছে কালে কালে। সবকিছুর মূলেই তো জগতের মঙ্গল কামনা।
শরৎকাল এলেই হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের মনে বেজে ওঠে দেবীদুর্গার আগমনী সুর, বেজে ওঠে বোধনের ঘণ্টাধ্বনি। এর মধ্যেই কাশবনের শুভ্রঢেউ ভক্তদের হৃদয়ে আনন্দের বার্তা বয়ে আনে। দুর্গার বর্তমান রূপটি পাওয়া যায় রামায়ণে। বলা হয়েছে- শ্রীরামচন্দ্র ত্রেতাযুগে রাবণ বধের জন্য দেবীর আরাধনা করেছিলেন। রামচন্দ্র যখন দেবীকে আহ্বান করেন তখন ছিল শরৎকাল। দক্ষিণায়নের সময় দেবতাদের নিদ্রার সময়। সেই সময় দেবতাদের নিদ্রাভঙ্গ করার জন্য শ্রীরামচন্দ্র দেবীর অকালবোধন করেছিলেন। রামচন্দ্রের অকালবোধনের আগে দেবীদুর্গার পূজা হতো বসন্তকালে। তা এখানে বাসন্তীপূজা নামে অভিহিত। তবে শরৎকালের শারদীয় দুর্গোৎসবই এখন বড় উৎসবে পরিণত হয়েছে। তা হলে এ কথা স্পষ্ট যে, সমাজের বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে দুর্গাদেবীকে অন্তরে ধারণ করে মনের সব অশুভ ও অকল্যাণকে বিসর্জন দিয়ে চিত্তশুদ্ধি করাই ভক্তদের লক্ষ্য। সামাজিকভাবে চিন্তা করলে- সমাজবিরোধী অপশক্তিকে নির্মূল করে সমাজদেহের সবপর্যায়ে শুভশক্তির উদ্বোধন করাই ধর্মের মূলমন্ত্র। আমরা তো কথায় কথায় বলি- ধর্ম যার যার, উৎসব সবার। একবিংশ শতাব্দীর এই লগ্নে এসে আমরা যদি মনের কালিমা বিসর্জন দিয়ে নিঙ্কলুষ মনের অধিকারী হতে পারি, ব্যক্তিস্বার্থের ওপর সমাজস্বার্থকে স্থান দিতে পারি, ধর্মীয় অন্ধ-আবেগ পরিত্যাগ করে মানবজাতির সামগ্রিক কল্যাণ কামনা করতে পারি- তবেই পূজা-আয়োজন সার্থক হবে। প্রকৃত অর্থে তখনই আমরা জাতিবর্ণ নির্বিশেষে সহমর্মী হয়ে, সামাজিক কল্যাণে উদ্বুদ্ধ হয়ে ধর্মোৎসব পালন করতে পারব। আর সেই উৎসব হবে- আনন্দের, কল্যাণের, ভ্রাতৃত্ববোধের এবং সর্বোপরি দেশাত্মবোধের।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়