তিতাস গ্যাস কর্মচারী ইউনিয়ন : পূর্ণ প্যানেলে জয়ী কাজিম-আয়েজ পরিষদ

আগের সংবাদ

যুদ্ধাপরাধ বিচারে স্থবিরতা ; বাকি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এগিয়ে নিতে সরকারের আগ্রহ নিয়ে সংশয়! ট্রাইব্যুনালেও জনবল সংকট

পরের সংবাদ

বাঙালির মাতৃপূজা দেশমাতৃকার পূজা থেকে আলাদা নয়

প্রকাশিত: অক্টোবর ১৩, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: অক্টোবর ১৩, ২০২১ , ১২:৫৯ পূর্বাহ্ণ

এসো হে আর্য, এসো অনার্য, হিন্দু মুসলমান-
এসো এসো আজ তুমি ইংরাজ, এসো এসো খ্রিস্টান।
এসো ব্রাহ্মণ, শুচি করি মন ধরো হাত সবাকার-
এসো হে পতিত, হোক অপনীত সব অপমানভার।
মার অভিষেকে এসো এসো ত্বরা, মঙ্গলঘট হয়নি যে ভরা
সবার পরশে-পবিত্র করা তীর্থনীরে-

এখানে যে ‘মার অভিষেক’র কথা কবি বলেছেন সেই ‘মা’ অবশ্যই দেশমাতৃকা। বাঙালির মাতৃপূজাও তো আসলে দেশমাতৃকার পূজা থেকে আলাদা নয়। বিদেশি শাসনবিরোধী স্বদেশি আন্দোলনের যুগে মাতৃপূজায় এই বিশেষ মাত্রাটি যুক্ত হয়। এতকাল মাতৃপূজার মণ্ডপে ব্রাহ্মণ-চণ্ডাল একত্রে মিলিত হতে পারত না, বারোয়ারি পূজাতেও ‘সবার পরশে পবিত্র-করা তীর্থনীরে’ মঙ্গলঘট ভরা হতো না। বিশ শতকের গোড়ার দিক থেকেই এ অবস্থার পরিবর্তন সূচিত হতে থাকে। সবাই যখন দেশ মায়ের ডাকে একত্রে মিলিত হয়, তখন দুর্গা মায়ের পূজারিদের মধ্যেও রূপান্তরের ছোঁয়া লাগে, দুর্গোৎসবও অধিক পরিমাণে সার্বজনীন হয়ে ওঠে।
এই সার্বজনীনতারই আরো সম্প্রসারণ ঘটে ‘মুসলমান’ নজরুলের কবিতায়। মুসলমানত্বের কোনো রূপ ব্যত্যয় না ঘটিয়েই নজরুল বাঙালিত্বকে সমগ্র সত্তায় ধারণ করতে পেরেছিলেন। তাই বাঙালির দুর্গোৎসবে দেশের সংকটকালে দুর্গা দেবীকে কবি অভিমানক্ষুব্ধ কণ্ঠে অনুযোগ জানান-
আর কতোকাল থাকবি, বেটি মাটির ঢেলার মূর্তি আড়াল।
স্বর্গ যে আজ জয় করেছে অত্যাচারী শক্তি চাঁড়াল।
‘আনন্দময়ীর আগমনে’ নামক কবিতার প্রথম দুই পঙ্ক্তিতে যে ‘স্বর্গে’র কথা কবি বলেছেন, সে স্বর্গ যে তার মাতৃভূমি আর ‘অত্যাচারী শক্তি চাঁড়াল’ যে সাম্রাজ্যবাদী শাসকগোষ্ঠী- এ কথা তো সহজেই বোঝা যায় এবং শাসকরাও তা ঠিকই বুঝেছিল। আর এরই জন্য রাজদ্রোহের অভিযোগে কবিকে দেয়া হয় কারাদণ্ড। নজরুলের এই কবিতা ও কবিতার জন্য দণ্ডলাভ- বাঙালির দুর্গোৎসবে আরো একটি নতুন মাত্রা যোগ করল। দুর্গোৎসব শুধু গতানুগতিক ধর্মীয় উৎসব যে নয়, এর মধ্যে যে আছে প্রতিবাদ-প্রতিরোধ ও বিদ্রোহেরও উপাদান- নজরুল সে সত্যেরও উন্মোচন ঘটালেন। সে সত্যের প্রতি সব বাঙালির সক্রিয় দৃষ্টি আকর্ষণের জন্যই তিনি লিখলেন আরেকটি অসাধারণ কবিতা- ‘পূজা-অভিনয়’। প্রতি বছরের নিষ্প্রাণ ও গতানুগতিক দুর্গাপূজাকে তিনি নিতান্ত অভিনয় ছাড়া আর কিছুই বলতে পারেননি। তিনি এর পৌরাণিক উৎসটির কথা স্মরণ করেই বললেন-
এমনি শরৎ সৌরাশ্বিনে অকাল বোধনে মহামায়ার
যে পূজা করিল বধিতে রাবণে ত্রেতায় স্বয়ং রামাবতার,
আজিও আমরা সে দেবী-পূজার অভিনয় ক’রে চলিয়াছি।
পৌরাণিক কাহিনীর রাম-রাবণের যুদ্ধের এক নতুন তাৎপর্যও তিনি নিষ্কাশন করেন। তার মতে, ‘সীতা’ হচ্ছে শস্য, ‘রাবণ’ হচ্ছে সেই লোভী ধনিক যে কৃষকের উৎপাদিত শস্য হরণ করে নিয়ে যায়, আর ‘রাম’ হচ্ছেন সেই কৃষক- নেতা যিনি অত্যাচারী ও শোষক রাবণকে উৎখাত করার শক্তিলাভের বাসনাতেই অকাল বোধনে মহাশক্তি দুর্গা দেবীর পূজা করেন। অথচ এ কালে আমরা শ্রীরামচন্দ্রের দুর্গাপূজার আসল উদ্দেশ্য ভুলে গিয়ে পূজার অভিনয় নিয়েই মেতে রয়েছি। তাই কবির ক্ষুব্ধ জিজ্ঞাসা-

কে ঘুচাবে এই পূজা-অভিনয়, কোথায় দুর্বাদল-শ্যাম
ধরণী-কন্যা শস্য-সীতারে উদ্ধারিবে যে নবীন রাম!
কবি অবশ্যি প্রচণ্ড আশাবাদী। এই বাংলার বুকেই সেই নবীন রামের অভ্যুদয় সম্ভাবনা ব্যক্ত করেন তিনি-
দশমুখো ঐ ধনিক রাবণ, দশদিকে আছে মেলিয়া মুখ,
বিশ হাতে করে লুণ্ঠন তবু ভরে না ক ওর ক্ষুধিত বুক।
হয়তো গোকুলে বাড়িছে সে আজ, উহারে কল্য বধিবে যে, গোয়ালার ঘরে খেঁটে-লাঠি করে হলধর-রূপী রাম সেজে!

বাঙালি হিন্দুর ধর্মীয় অনুষ্ঠান দুর্গোৎসবের বিচিত্র মাত্রাগুলোর প্রতিই যদি শুধু দৃষ্টি দিই তাহলেও দেখব যে- বাঙালির ধর্মকেন্দ্রিক সংস্কৃতিরও মর্মমূলে নিহিত আছে ধর্মনিরপেক্ষ অন্তঃসার, তার ধর্মীয় উৎসবও সার্বজনীনতার সম্পদে সমৃদ্ধ এবং সদা গতিশীল ও অন্যায়-অবিচারের প্রতিবাদী। তাই কোনো উৎসব যদি বাহ্যত হিন্দুর ধর্মীয় উৎসবও হয় তবু তার সঙ্গে একাত্মবোধ করতে খ্রিস্টান, ব্রাহ্ম বা মুসলমান কবির বাধে না। সাম্প্রদায়িক মানস প্রতিবন্ধে আক্রান্ত সমালোচকরা যাই বলুন, সুস্থ বাঙালি সংস্কৃতির সাধকদের কেউই সাম্প্রদায়িক হিন্দু, খ্রিস্টান, ব্রাহ্ম বা মুসলমান নন- তারা কেবলই মানুষ।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়