তিতাস গ্যাস কর্মচারী ইউনিয়ন : পূর্ণ প্যানেলে জয়ী কাজিম-আয়েজ পরিষদ

আগের সংবাদ

যুদ্ধাপরাধ বিচারে স্থবিরতা ; বাকি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এগিয়ে নিতে সরকারের আগ্রহ নিয়ে সংশয়! ট্রাইব্যুনালেও জনবল সংকট

পরের সংবাদ

দেবী দুর্গার মহাস্নান : তথ্য ও তাৎপর্যনিরঞ্জন অধিকারী

প্রকাশিত: অক্টোবর ১৩, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: অক্টোবর ১৩, ২০২১ , ১২:৫৭ পূর্বাহ্ণ

বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায় প্রতি বছর দুবার দেবী দুর্গার পূজা করে থাকে। একবার শরৎকালে এবং একবার বসন্তকালে। শরৎকালের দুর্গাপূজাকে বলা হয় শারদীয় দুর্গাপূজা। আর বসন্তকালের দুর্গাপূজাকে বলা হয় বাসন্তী পূজা।
শাস্ত্রমতে হিন্দু সম্প্রদায় যে বছর গণনা করে, তার দুই ভাগ : দক্ষিণায়ন ও উত্তরায়ন। আষাঢ় মাস থেকে সূর্য মকর রাশিতে অগ্রসর হতে থাকে, একে দক্ষিণায়ন বলে এবং পৌষ মাসে সূর্য পুনরায় উত্তর দিকে আসতে আরম্ভ করে। একে উত্তরায়ন বলে। উত্তরায়ন দেব-দেবীগণের নিদ্রার কাল। তাই এ সময়ে দেবী দুর্গার পূজা করতে হলে তাকে জাগাতে হবে। এই জাগানোকে বলা হয় ‘বোধন’। কিন্তু বসন্তকালের দুর্গাপূজা বা বাসন্তী পূজার সময় দেবী দুর্গাকে জাগানোর প্রয়োজন নেই। কারণ তখন তো দেব-দেবীদের জাগরণকাল।
দেবী দুর্গা যেন ঘরের মেয়ে। তিনি ঘরের মেয়ের মতোই বাবার বাড়ি আসেন। চার দিন তার সঙ্গে আসে পুত্রদ্বয় গণেশ ও কার্তিক এবং কন্যাদ্বয় ল²ী ও সরস্বতী। পেছন পেছন আসেন দেবী দুর্গার স্বামী শিব বা মহাদেব। তিনি লুকিয়ে আসেন, তাই খুব ছোট্ট করে তার প্রতিমা বানিয়ে দুর্গাপূজার কাঠামোর ওপরের দিকে স্থাপন করা হয়।
ভোর বেলা দেবী দুর্গাকে জাগাতে হয়। আসরে ছোট ঠাকুরদার কাছে শুনেছি, আমাদের বাড়িতে দুর্গাপূজা শুরু হয় আমার জ্যাঠামশাই ও বাবা যখন কিশোর বয়সের ছিলেন। তারা সবাইকে লুকিয়ে দুর্গা প্রতিমা বানিয়ে ফেলেন। জ্যাঠামশাই এ গুণেও গুণান্বিত ছিলেন। এ ছাড়া তিনি যত রকমের তালযন্ত্র আছে, সব বাজাতে পারতেন। বাবা গাইতেন গান, ছিলেন অনেক বড় অভিনেতা ও নাট্য-নির্দেশক। তাদের সেই দুর্গাপ্রতিমা নির্মাণ আর লুকানো থাকে না। কেউ দেখে তা তাদের ঠাকুরদাকে জানিয়ে দেন। তিনি প্রথমে রেগে গেলেও পরে বলেন, মা দুর্গা যখন এসেই পড়েছেন, তখন বিধিমতো তার পূজার আয়োজন কর। সেই থেকে আমাদের বাড়িতে দুর্গাপূজার শুরু।
সেই পূজার সময় ভোর বেলায় ঢাকী ঢাক বাজাতেন। একে বলা হতো জাগরণ বা ভোর বাজানো। মানে দেবী দুর্গাকে ঘুম থেকে জাগানো। সঙ্গে সঙ্গে আমাদেরও জাগানো। আমাদের মধ্য থেকে কেউ কেউ যেত ফুল তুলতে, কেউ কেউ বাজার করতে বা অন্যান্য প্রয়োজনীয় কাজ করতে।
ওভাবে দেবী দুর্গাকে জাগানোর পর, তার পূজার আয়োজন করা হতো। একদিকে সাজানো থাকত পুষ্পপত্র (ফুল-বেলপাতা রাখা তামার পাত্র) এবং জ¦ালানো ধূপতি ও টনবেদ্য- বিভিন্ন ফল, ভেজানো আতপ চাল ও কলা ইত্যাদি।
পুরোহিত মহাশয়রা পবিত্র হয়ে পূজায় বসতেন। একজন পূজায় মন্ত্র বলে দিতেন, আরেক জন সেই মন্ত্র আবৃত্তি করে পূজা করতেন। আরেকজন দেবীমাহাত্ম্যবিষয়ক গ্রন্থ শ্রী শ্রী চণ্ডী পাঠ করতেন।
এরপর দেবী দুর্গার স্নান- যাকে বলা হয় মহাস্নান। এ মহাস্নানের মধ্য দিয়ে পূজাকালে ঐশ্বর্যশালীদের নানা উপকরণ ব্যবহার করে স্নানের পরিচয় পাওয়া যায়।
আমি পূজার মন্টিদরে থাকতাম। পুরোহিত মহাশয়দের পর্যায়ক্রমে পূজা বেশ মনোযোগ দিয়ে দেখলাম। মহাস্নানের সময় দেখতাম নানা উপকরণ দিয়ে দেবী দুর্গার মহাস্নান, কিন্তু দেবীর প্রতিমা তো মৃণ¥য়ী- মাটির তৈরি।
তাকে স্নান করাতে গেলে তো ভিজে গলে যাবে। তাই একটি ধাতুনির্মিত দর্পণ ব্যবহার করা হতো। দর্পণ মানে আয়না। ধাতুনির্মিত একটি গোল চাকতির সঙ্গে একটি হাতল লাগিয়ে বানানো হতো দর্পণ। একটি তামা বা মাটির পাত্রে সেই ‘দর্পণ’ রেখে তাকে স্নান করানো হতো। দেবী দুর্গার প্রতিবিম্ব পড়ছে দর্পণে। সেই দর্পণকে স্নান করানো মানে দেবী দুর্গাকে স্নান করানো।
আমরা জানি দেবী দুর্গার প্রতিমার কাঠামোতে সংযুক্ত করা হয়। নয়টি বৃহস্পতিবার সমাহারে গঠিত নবপত্রিকা- যাকে বলা হয়, ‘কলা বউ’। দেবতা গণেশের পাশে লোকে তাকে মনে করে গণেশের বউ বুঝি! আসলে তা নয়, এই নবপত্রিকা দেবী দুর্গা বা বনদুর্গারই একটি রূপ। হিন্দু সম্প্রদায়ের কাছে ‘পৃথিবী’ দেবীরূপে বিবেচিত। তেমনি পরিবেশ সংরক্ষণের জন্য বৃক্ষ লতারা সংরক্ষণের প্রয়োজন। সেই চেতনা নবপত্রিকা প্রতিষ্ঠা ও পূজার মধ্য দিয়ে প্রকাশিত হয়।
মহাস্নানের সময় নব পত্রিকাকেও সøান করানো হয়। এ স্নান কিন্তু সরাসরি নয়। কুশিতে বিভিন্ন উপকরণের সঙ্গে জল মিশিয়ে যথাক্রমে নবপত্রিকা ও দেবী দুর্গাকে স্নান করানো হয়। সে কালে তো রাসায়সনিকভাবে উৎপাদিত সাবান ছিল না। তাই পরিষ্কারক জল নদীর পবিত্র জলের মধ্যে নানা উপকরণ মিশিয়ে সøান করার ব্যবস্থা। ‘মাটি’ একটি পরিষ্কারক বস্তু। ছোট বেলায় দেখেছি অনেক নারী পুকুরঘাটে এসে এঁটেল মাটি দিয়ে মাথার চুল পরিষ্কার করছেন। এ থেকে বুঝতে পেরেছিলাম কেন নবপত্রিকা ও দেবী দুর্গাকে নানা স্থানের জল ও মাটি দিয়ে স্নান করানো হয়।
চন্দন, পিটুনি (আতপ চাল গুঁড়া করে পেস্টের মতো করে বানানো)। পঞ্চ শস্য প্রভৃতির চূর্ণ ও তেল হলুদ দর্পণে মাখিয়ে নিম্নলিখিত মন্ত্রটি পড়তে হয় ও নানারূপ ধরে দেবি দিব্য বস্ত্রাবগুষ্টিতে। তবানু লেপ মাত্রেন চিত্রদোষ বিনশ্যতি। ও উদ্বর্তয়ামি দেবি ত্বাং যথেষ্টং চন্দ্রনাদিভিঃ। ঊর্ধ্বতন প্রসাদের প্রাপ্লুয়াম শ্রিয়মুত্ত মাং। তারপর হাড়ি বা তামার পাত্রে একটি বেল ফল রেখে তার ওপর ‘দর্পণ’ স্থাপনপূর্বক স্নান করাতে হয়।
প্রথমে শীতল উদবে অর্থাৎ ঠাণ্ডা জলে, তারপর তামা বা মাটির হাঁড়িতে জল ভরে ভারতবর্ষের সাগর তড়াগ, পর্বত, ওষুধ, রতœ, অস্ত্র, শস্ত্র বাহন, সর্বতীর্থ, মাতৃবগ, দেব, দাব, নন্ধর্ব, যক্ষ, ব্যক্ষস, পন্নগ প্রভৃতির আবাহন করে মন্ত্রপাঠ করে দেবী দুর্গাকে দর্পণের মাধ্যমে স্নান করাতে হয়। তারপর মধু আখের রস, রৌপ্য জল, পুষ্কারিণার জল, শিশিরের জল, বৃষ্টির জল প্রভৃতি দিয়ে স্নান করাতে হয়।
এরপর গজদন্ত মৃত্তিকা (হাতির দাঁতে লেগে থাকা মাটি, বরাহদণ্ড মৃত্তিকা, শূকরের দাঁতে লেগে থাকা মাটি, রেশ্যাদ্বার মৃত্তিকা, বৃক্ষশঙ্খ মৃত্তিকা, ষাঁড়ের দাঁতে লেগে থাকা মাটি, নদীর উভয় কূলের মাটি, গঙ্গা মাটি, চতুষ্পথ মৃত্তিকা (চারাপথের সংযোগস্থলের মাটি) প্রভৃতি স্থানীয় বস্তু সহস্রধারা হলে মিশ্রিত করে দর্পণে প্রতিফলিত দেবী দুর্গার প্রতিবিম্বকে স্নান করাতে হয়।
দেবীর স্নানের সময় বিভিন্ন রাগ বাদ্যযন্ত্র সহযোগে পরিবেশিত হয়। যেমন, মালব রাগের বিজয় বাদ্যসহ গঙ্গা জলে, ললিত রাগের বিজয় বাদ্যসহ বৃষ্টি হলে ভৈরব বাগের ভীমবাদ্যসহ সাগর জলে ইত্যাদি।
তাৎপর্য :
এই মহাস্নানের বর্ণনা থেকে আমরা অতি প্রাচীন বাংলার ঐশ্বর্যশালী পরিবারের মেয়েদের স্নানের দৃষ্টান্ত পাই।
স্নানের সময় ব্যবহারের জন্য বিভিন্ন স্থানের মাটি এবং সাগর, নদী প্রভৃতির জল সংগ্রহ করতে গিয়ে যে পর্যটন করতে হয়, তাতে পর্যটনকারী বহুদর্শী ও অভিজ্ঞ হয়ে ওঠেন। শুধু নিজ গ্রাম থেকে একজন মানুষের মধ্যে যে কূপমণ্ডুকতা ও সংকীর্ণতার সৃষ্টি হয়, তা থেকে তিনি মুক্ত হয়ে একজন সংস্কারমুক্ত ও সংস্কৃতিমান মানুষে পরিণত হন।
গজদন্ত, বরাহদন্ত, বৃষশৃঙ্গ প্রভৃতি থেকে মৃত্তিকা সংগ্রহ করতে হলে শক্তি ও সাহসের প্রয়োজন; এ মৃত্তিকা সংগ্রহের জন্য তাই শক্তিমান ও সাহসী হয়ে উঠতে হয়।
বিভিন্ন সাগর-নদী-পবিত্র স্থান ভ্রমণে তীর্থ করার পুণ্যও একই সঙ্গে অর্জিত হয়।
এ মহাস্নান থেকে আমরা প্রাচীনকালের বাংলার লোকেরা বিশেষ করে বিত্তবানরা পরিষ্কারক হিসেবে যে সব দ্রব্য ব্যবহার করতেন, তারও একটা বিবরণ পাই।
প্রাচীনকালে কেন এখনো তো অনেক জায়গায় কেবল পুকুরে স্নান করতে হয়। বহুলোকের প্রাত্যহিক স্নানে পুকুরের জল দূষিত হয়ে যেত। তাই ধারাজলে স্নান করতে হতো। দেবী দুর্গার মহাস্নানের বর্ণনা থেকে ধারা জলে স্নান করার প্রয়োজনীয়তার কথা সম্পর্কে জানা যায়।
যে সব উপকরণে জল বিশোধিত হয়, সে সব উপকরণের পরিচয়ও আমরা দেবী দুর্গার মহাস্নানের বর্ণনা থেকে পাই।
দেবী দুর্গার স্নানের বিভিন্ন রাগে বাদ্যযন্ত্র বাজানো হয়। এতে বিভিন্ন রাগের চর্চা হয়। এর একটা শিল্পগত তাৎপর্যও রয়েছে।
মোট কথা, দেবী দুর্গার মহাস্নানের বর্ণনা থেকে আমরা ঐতিহাসিক তথ্য ও তৎকালীন সামাজিক নানা বিষয় সম্পর্কে অবহিত হতে পারি।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়