তিতাস গ্যাস কর্মচারী ইউনিয়ন : পূর্ণ প্যানেলে জয়ী কাজিম-আয়েজ পরিষদ

আগের সংবাদ

যুদ্ধাপরাধ বিচারে স্থবিরতা ; বাকি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এগিয়ে নিতে সরকারের আগ্রহ নিয়ে সংশয়! ট্রাইব্যুনালেও জনবল সংকট

পরের সংবাদ

মাস্টারের দ্বিতীয় কাহিনী

প্রকাশিত: অক্টোবর ১৩, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: অক্টোবর ১৩, ২০২১ , ১২:৫৮ পূর্বাহ্ণ

মাস্টার ঘুমিয়ে পড়েছিল। ঘুম থেকে উঠে দেখল কাইতান ধরে নাই। আশ্বিনের বৃষ্টিকে বলে আইতান, কার্তিকের বৃষ্টিকে বলে কাইতান। তারা আষাঢ়ের বৃষ্টিকেও বলে কাইতান। -কাইতান লাগছে।
চোখ থেকে ঘুমের উম যায় নাই, অর্ধনিমিলিত চোখে মাস্টার ডাকল, ‘ও আইতান কাইতানের মা।’
শিখা বলল, ‘ঢং!’
শিখা ঘরেই আছে মাস্টার দেখে নাই। নজর করে নাই।
চোখ নিমিলিত করে দেখল টেবিলে সেলাই মেশিন এবং রং-বেরঙের কাপড়ের স্তূপ নিয়ে বসে আছে শিখা।
মাস্টার বলল, ‘অ। কী সেলাই করো?’
শিখা বলল, ‘ব্লাউজ।’
মাস্টার বলল, ‘অ। কী দরকার?’
‘কী দরকার মানে? কী দরকার মানে কী আবার? ব্লাউজ ছিঁড়ে গেছে সেলাই করব না? ছেঁড়া ব্লাউজ পরে থাকব?’
‘তা কেন? ব্লাউজ না পরে থাকলেই বা কী? এই কাইতানে একটু দেখতাম।’
‘অসভ্য লোক। ঢং রাখো। কল দিয়া দেখ তোমার বোন রে। পুত্র-কন্যারে নিয়া যে গেছে ফিরত দিয়া যাবে কোন বেলা? কত বললাম থাক, কাইতানের দিন। দুই দিন পরে ভাইপো-ভাইঝিরে নিয়া যা। আমার কথা কেউ শোনে আর কী!’
‘আমি শুনি।’
‘কী? একটুও মুখে আটকায় না বলতে? আমার কোন কথাটা তুমি শোনো? হ্যাঁ? কোনকালে শুনছো?’
‘সকালে শুনি নাই…?’
‘কী-ই-ই? অসভ্য।’
হেসে ফেলল শিখা।
মাস্টার বলল, ‘শোনো, পুত্র-কন্যা আজ থাকুক পিসির কাছে। এই কাইতান ধরতে ধরতে মাঝরাত পার হয়ে যাবে।’
‘মাঝরাতে! বলছে তোমারে। সন্ধ্যাবাতির আগেই কাইতান ধরব-।’
‘সন্ধ্যাবাতি! সন্ধ্যাবাতি দাও নাই এখনো?’
‘সন্ধ্যা হইছে? আমি কি এই দুপুরে সন্ধ্যাবাতি দিব?’
‘দুপুর মানে? সন্ধ্যা হয় নাই?’
‘না মাস্টার মশাই, বিকালও হয় নাই। সাড়ে তিনটা বাজে মাত্র।’
‘কী বলো?’
‘ঘড়ি দেখো। মোবাইল দেখো।’
মাস্টার মোবাইল ফোন দেখল। ০৩:৩৩ পিএম। কী আশ্চর্য! সে তবে কতক্ষণ ধরে ঘুমাল? চল্লিশ-বেয়াল্লিশ মিনিট। তাও খেয়ে উঠেছে দুইটায়। মোবাইল ফোনে দুই মিনিট ইরাব, দেড় মিনিট তার সমনামী মৎস্য অফিসার খোকনের সঙ্গে কথা বলেছে। ঘুম সঙ্গে সঙ্গে নিশ্চয় ধরে নাই।
সবে দুপুর! চারটাও বাজে নাই।
ভাইপো-ভাইঝিকে নিশ্চয় এখনই ফেরত দিয়ে যেতে আসবে না বনানী। এখন রওনা দিলেও পারবে না।
টাউনেই বিয়ে হয়েছে বনানীর। জামাই নীলকণ্ঠ সাহা মনার কলিগ। বাংলার অধ্যাপক। তারা থাকে ধোপাখালিতে। ভাড়া বাসা বৃষ্টিতে ধোপাখালির রাস্তায় জল জমে যায়।
উল্লসিত মাস্টার কল দিল বোনকে। নেটওয়ার্ক এরর। আবার কল দিল। নেটওয়ার্ক এরর না, বনানী ধরল, ‘দাদা রে!’
‘কী রে!’
‘আমাদের উঠানে জল উঠে গেছে রে দাদা!’
‘উঠানে! কী সর্বনাশ!’
শিখা বলল, ‘কী হইছে গো?’
বনানী বলল, ‘আধ আঙুল উঠছে-।’
‘মাত্র আধ আঙুল। অ। তুই যেভাবে বললি বাবা রে, আমি তো মনে করছিলাম ঘরদোর ডুবে গেছে তোদের।’
‘এইসব কী ধরনের কথা? আমাদের ঘরদোর ডুবে যাবে কেন? নাকি ডুবে গেলে খুশি হবি তুই? হরির লুট দিবি?’
‘অষ্টপ্রহর কীর্তনের পরে হরির লুট দিব।’
‘সে আমি জানি। আমার ভালো কোনকালে সহ্য হয় না তোর!’
‘কোনটা ভালো? তোদের উঠানে জল উঠছে সেটা?’
‘চুপ কর। শোন, আমাদের সামনের রাস্তায় হাঁটুজল। নীলকণ্ঠ বাবু গম্ভীর মুখ করে টেলিভিশন দেখতে বসেছেন। নিউজ দেখবেন। নিউজ না নিউজ পাঠক মেয়েদের দেখবেন, সে কি আর আমি জানি না। কত ঢুফি কত গাঙঢুফি দেখলাম।’
ঢুফি তারা বলে ঘুঘুকে। গাঙঢুফি বলে জলঘুঘুকে।
মাস্টার হাসল, ‘নীলকণ্ঠ কি ঢুফি নাকি?’
‘ঢুফি মানে? গাঙঢুফি বুঝলি?… কী?… একটু ধর তো… এই! অন্তাই! তুই কেন আগে বোনকে খামচি দিলি?… আমি দেখি নাই? মিঠাই তুই ল²ী বাবা।… দাদা শোন, অন্তাই মিঠাই আজ এখানে থাকবে।’
‘তোদের ওখানে?’
‘আর কোথায়? তোর পুত্র-কন্যাকে আমি নিশ্চয় কুমড়ার মাচানে ঘুম পাড়িয়ে রাখব না। আমি তো আর তোর মতো হই নাই। তোর মতো মর্কট রাশিও না, আমার রাশি কর্কট।’
ভাইয়ের সঙ্গে চিরকাল এমন বনানী। নিজের বাচ্চা নিয়ে কী যে করবে? এখন তার পৃথিবীর সব মায়া অন্তহীন এবং ময়ুরাক্ষীর জন্য। অন্তাই। মিঠাই। চোখের মণি পিসির।
অধিক উচ্ছ¡াস প্রকাশ না করে মাস্টার আনন্দ সংবাদ দিল শিখাকে, ‘অন্তাই-মিঠাইরে কাল দিয়া যাবে বলল।’
‘অ। জল জমে গেছে?’
শিখা বলল।
মাস্টার বলল, ‘জমে গেছে!’
শিখা বলল, ‘অসভ্য লোক।’
এই সময় ফোন বাজল মাস্টারের।
কাকা কলিং…।
কাকা ওরফে খলিল। ফ্রম ঢাকা। এই হারামজাদার টাইম সেন্স নাই। এমন এমন সময়ে কল দেয়। দুপুর-সন্ধ্যা-রাতের ঠিক নাই। অন্তরঙ্গ মুহূর্তে কল দিয়েছে কয়েকদিন। একবার ধরেছিল মাস্টার। রাত ১টায়। টেনশনে ধরেছিল। একা থাকে ঢাকায়, বিপদ-আপদ কিছু হলো নাকি মেকুড়টার?
কিসের বিপদ, কিসের আপদ? সে কল দিয়েছে কারণ মাত্র সে ঘুম থেকে উঠেছে।
‘ঘুমাইছিলি কখন?’
‘মনে নাই। রবিবারে মনে হয়।’
‘রবিবারে মানে? আজ তো বুধবার। তুই চার দিন ধরে ঘুমাইছিস?’
‘মনে হয়।’
‘আরো ঘুমা। রাখ এখন-!’
‘না না শোন, একটা কথা শোন। তুই এখন কী করিস?’
‘ছয়ের ঘরের নামতা মুখস্থ করি।’
‘নয়ের ঘরেরও কর। সিক্সটি নাইন হোক। খিক খিক খিক!’
‘রাখ শালা খবিশ!’
নগদ বৃত্তান্ত কি শালা খবিশের?
‘ভাইয়ের আরেক শাশুড়ি মারা গেছে শুনলাম।’
ভাই মানে মনা।
মাস্টার বলল, ‘আরেক শাশুড়ি। কে? ও, সমুদার মা। তোরে কে বলল?’
‘ভাইই ফোন দিছিল রাতে। শাশুড়ির মুখে গঙ্গাজল দিয়া নমিতা তারে প্রথম ফোন করে সমুদারে ফোন দিতে বলছে। শোক সংবাদ শুনে সমুদা বলছে, আমি তো দেশে নাই। সব দায়িত্ব তোর রে মনা। তোর বৌদি তো এইবার সম্পূর্ণ একা হয়ে গেল। তুই ছাড়া আর কে তারে দেখবে?’
‘বিরাট দায়িত্ব। তবে আমাদের ভাই দায়িত্ববান-।’
‘শোন না, নমিতাও নাকি তারে বলছে, এখন সব দায়িত্ব আপনার মনাদা। আমি বলছি তুই দায়িত্ব নে ভাই। সমুদার সন্তানের দায়িত্বও নে।’
‘সমুদার সন্তান-?’
‘আরে ব্যাটা, ভাই দায়িত্ব নিলে একটা-দুইটা সন্তান হতে কয় মাস সমুদা- নমিতা বৌদির?’
‘তা অবশ্য ঠিক। ভাই চ্যাম্পিয়ান।’
‘হ্যাঁ। ভাইয়ের বউটাই শুধু বুঝল না। আফসোস। তোর বউ কই রে?’
‘আছে। কেন?’
‘ঠিক আছে? ভেঁপু, হেডলাইট?’
‘শুয়োরের বাচ্চা!’
খলিল হা হা করে হাসল।
এই হলো খলিল। ডিয়ার কাকা।
শিখার ফোন বাজল।
মাস্টার বলল, ‘ধরো।’
খলিল বলল, ‘কী ধরবে রে?’
বলা মাত্র লাইন কেটে গেল ফোনের। খুশি হলো মাস্টার। খবিশ আর কল দেবে না এখন। কখনো দেয় না। নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা হিসাবে তাও ফোন অফ করে দিল মাস্টার, বহুদিন পর মনে মনে একটা শুভ কাজের প্রস্তুতি নিচ্ছে সে, বিঘœ চায় না।
শিখার ফোন আবার বাজল।
‘ধরো না কেন?’ মাস্টার বলল।
শিখা বলল, ‘তোমার কী সমস্যা? মসতুরা আপার ফোন।’
ওরে সর্বনাশ! শিখার কলিগ। টাউনের স্বনামখ্যাত ইতিহাস-গবেষক মসতুরা আপা। কোনাকাঞ্চির নিউজ অবগত টাউনের। পাড়া, গলির। গাঁটের পয়সা খরচ করে নানাজনকে ফোন দিয়ে বিতং করে বলেন। পঁয়তাল্লিশ মিনিট থেকে এক ঘণ্টার সেমিনার। ভালো করেছে শিখা ধরে নাই। না হলে ধরে। মসতুরা আপার নিউজ আপডেট শুনে হাসতে হাসতে মরে যায়। এখন তাহলে ধরল না কেন?
সবুজ সংকেত ধরে নিল এবং খাট থেকে নামল মাস্টার।
কাইতান না ধরুক অনেকক্ষণ।
শিখা বলল, ‘কী মাস্টার মশাই?’
মাস্টার বলল, ‘তোমার দয়ামায়া নাই!’
‘নাহ। কী করব?’
‘দয়ামায়া করো।’
‘এই! এই! এইদিকে না! একদম না-!’
‘শোনো তোমার আইতান-কাইতানরে সব দিন কি বনানী নিয়া যায়? সব দিন কি তারা পিসির বাসায় থাকে? সব দিন কি এই রকম কাইতান নামে? সব দিন কি- সব দিন কি-?’
ঝাপটা দিল মাস্টার।
‘এই-ই-ই!’
সমর্পণ দিল শিখা।
কতদিন পর!
ঘনঘোর কাইতানে তারা ডুবল।
এ ভাটি অঞ্চলের কাইতান। কিচ্ছাদারের কিচ্ছার সমান লম্বা। ধরল না তারা যতক্ষণ ডুব দিয়ে থাকল।
শান্তি বর্ষিত হলো খটখটে ধরায়।
দারুণ অবসাদে মাস্টার আবার ঘুমাল। আবার ঘুম থেকে উঠেও দেখল কাইতান ধরে নাই। টাউন ডুবে যাবে। ধূপকাঠির ঘ্রাণ, জলো হাওয়ার সঙ্গে রোল করছে ঘরে। ঠাকুরঘরে শিখা। সন্ধ্যাবাতি দিচ্ছে।
কাঁথা মুড়ি দিল মাস্টার। আবার ঘুম ধরছে।
বনানী কল দিল, ‘দাদা রে!’
‘কী রে!’
‘দশবার তোরে কল দিছে বৌদি। কল ধরিস না।’
বৌদি। মানে? শিখা ছাড়া বনানীর বৌদি আবার কে?
মাস্টার বলল, ‘অ।’
‘অ কী? তুই কি ঘুমাই পড়ছিলি? শোন বৌদির ফোনে ব্যালেন্স নাই। কথা বল।’
কার সঙ্গে?
শিখা ঠাকুরঘরে।
বনানীর কথিত বৌদি বলল, ‘কী-ই-ই?’
শিখা! মানে কী?
মাস্টার বলল, ‘তুমি!’
‘হ্যাঁ আমি। শোনো এই কাইতান তো ধরবে না। বোনুর বাসার সামনে হাঁটুজল। বোনু বলতেছে থেকে যেতে। আমি কী করব বুঝতে পারতেছি না।’
আমিও বুঝতে পারতেছি না। মাস্টার ভাবল। বলল, ‘থেকে যাও।’
শিখা বলল, ‘ভাত গরম করে খেয়ে নিও। হিং-এর কচুরি আছে বাটিতে। বাটা মাছের চচ্চড়ি পিংক বক্সে।’
‘খেয়ে নেব।’
‘আচ্ছা, ফোন দিও।’
‘হুম।’
শিখা ফোনের লাইন কেটে দিল।
মাস্টার কিংকর্তব্যবিমূঢ়। টেনেটুনে আবার কাঁথা মুড়ি দিল।
শিখার ঘ্রাণ কাঁথার টানাপড়েনে।
কাইতান রে কাইতান!

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়