প্রণোদনা ঋণের জন্য ঘুষ লাগে ২৯ শতাংশ ব্যবসায়ীর

আগের সংবাদ

অসংক্রামক রোগের ঝুঁকি বাড়ছে : করোনার প্রকোপ কমার পর ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ ও বিষণ্নতার বড় আঘাত আসছে

পরের সংবাদ

কয়েকটি নিঃসঙ্গ প্রহর

প্রকাশিত: আগস্ট ৩০, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: আগস্ট ৩০, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

চৈত্রের সন্ধ্যা। আলতাফ হোসেন উঠোনে বসে আছেন। লোডশেডিং। ঘরের ভেতরটায় অসহনীয় গরম। তাই বাইরে বসে বাতাস খাচ্ছেন। গ্রামাঞ্চলে লোডশেডিং একটা স্বাভাবিক ব্যাপার। আলতাফ হোসেনের হাতে একটা হাতপাখাও রয়েছে। মাঝেমধ্যে হাতপাখা দিয়ে নিজের শরীরে বাতাস করছেন।
চতুর্দিকে সুনসান স্তব্ধতা। আলতাফ হোসেন একা উঠোনে বসে আছেন। তিনি প্রায়ই লোডশেডিং হলে এভাবে একা বসে থাকেন। অথচ আজ তার কেন জানি বসে থাকতে আর ইচ্ছে করছে না। চতুর্দিকের সুনসান নীরবতা তাকে ভড়কে দিচ্ছে। কেন জানি মনে হচ্ছে, তার পেছনে কেউ দাঁড়িয়ে আছে। অথচ ঘাড় ঘোরালে কাউকেই দেখতে পান না। কেউ নেই। আলতাফ হোসেনের ভেতর অদ্ভুত এক অনুভূতি হতে লাগল। মনে মনে ভাবতে লাগলেন- এই পৃথিবীতে তিনি আর বেশিদিন নেই। তার মৃত্যুক্ষণ ঘনিয়ে আসছে।
ইদানীং আলতাফ হোসেনের মধ্যে বেশ পরিবর্তন এসেছে। তিনি এখন কারোর সাথেই কথা বলেন না। সারাক্ষণ একা একা থাকেন। মোট কথা নিজেকে সবার আড়ালে রাখতে বেশি ভালোবাসেন। কারো সাথে মিশতেই চান না তিনি। আলতাফ হোসেন আগে এমন মানুষ ছিলেন না। তিনি ছিলেন বড় আড্ডাপ্রিয় একজন রসিক মানুষ। সব সময় মানুষের সঙ্গে আড্ডা দিতে ভালোবাসতেন।
রাত বড় অসহায় করে দেয় আলতাফ হোসেনকে। তার এখন রাতে কিছুতেই ঘুম আসতে চায় না। সারারাত জেগে থাকেন। মাঝেমধ্যে ঘরের বারান্দায় পাঁয়চারি করেন। নিজের জীবনে এমন পরিবর্তন দেখে তিনি বেশ চিন্তিত।
জয়নাল মিয়া সন্ধ্যায় হাট থেকে বাড়ি ফেরার পথে আলতাফ হোসেনের সাথে দেখা করতে এসেছেন। তিনি আলতাফ হোসেনকে উঠোনে বসে থাকতে দেখে বললেন- আলতাফ ভাই নাকি? আলতাফ হোসেন চমকে উঠলেন। তার শরীর ঝাঁকুনি দিয়ে উঠল। তিনি পেছন ফিরে দেখলেন- জয়নাল মিয়া দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি জয়নাল মিয়াকে দেখে বললেন- আরে জয়নাল ভাই! কতদিন পর আপনি এলেন।
– আপনাকে তো ইদানীং দেখি না। তাই ভাবলাম, বাড়ি ফেরার পথে একটু দেখা করে যাই।
– কোথাও গেছিলেন নাকি?
– হাটে গেছিলাম।
– আজকের হাট কেমন গেল?
– তেমন ভালো না। জিনিসপত্তরের দাম খুব বেশি।
জয়নাল মিয়ার হাতে একটি বাজারের ব্যাগ। সে ব্যাগের ভেতরেই রয়েছে হাটে থেকে কেনা সদাই। তরিতরকারি-চাল-ডাল আর সংসারের প্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী।
আলতাফ হোসেন চুপচাপ হয়ে বসে আছেন। তার মুখের দিকে জয়নাল মিয়া চেয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। তারপর বললেন- আলতাফ ভাই, আপনার মুখটা এত শুকনা মনে হচ্ছে কেন? কোনো এক বিষয় নিয়ে গভীর চিন্তা করছেন বোধহয়?
আলতাফ হোসেন বললেন- না। তেমন কিছু না। চা খাবেন? চা করি?
– কথা ঘুরিয়ে ফেললেন তাই না?
– সত্যি বলছি, আমি কোনো বিষয় নিয়ে চিন্তা করছি না।
– আপনি মিথ্যা বলছেন। কারণ আপনার চোখে-মুখেই চিন্তার প্রগাঢ় ছাপ।
আলতাফ হোসেন স্তব্ধ হয়ে বসে রইলেন। জয়নাল মিয়াও আর কিছু না বলে চলে গেলেন।
এখন রাত। আলতাফ হোসেন ঘরের ভেতর বসে আছেন। তিনি জানালা দিয়ে বাইরের আকাশের দিকে চেয়ে আছেন। তার রাতের আকাশ দেখতে বেশ ভালোই লাগে। আজকে আকাশে মিটিমিটি করে তারা জ্বলছে। আলতাফ হোসেন আকাশের তারার দিকে চেয়ে আছেন। তিনি মনে মনে নিজেকেই প্রশ্ন করলেন- এই তারাগুলো কীভাবে আকাশের বুকে লেগে আছে? প্রত্যেকটি তারা একা। নিঃসঙ্গ।
আলতাফ হোসেনও একা। নিঃসঙ্গ। তিন কূলে তার কেউ নেই। বাবা জন্মের আগেই মারা যান ট্রাকের তলায় চাপা পড়ে! আর তার যখন দশ বছর বয়স তখন মারা যান মা। পরবর্তীতে খালার কাছে মানুষ হয়েছেন। তবে একটু বড় হওয়ার সাথে সাথেই খালার কাছ থেকে চলে আসেন তিনি। এরপর নিজের বাড়িতেই থাকতে শুরু করেন। একা একা। নিঃসঙ্গ এক জীবন তার। বড়ই বিচিত্রময়। খালা তাকে বলেছিলেন- নিজের বাড়িতে যখন থাকবি তা বেশ। তবে একটা বিয়ে করে নে। আলতাফ হোসেনের একই কথা, তিনি বিয়ে করবেন না। বিয়ে-টিয়ে করা তার পক্ষে সম্ভব নয়। তিনি তার যাপিত জীবনটাকে একাকিত্ব কাটাতে চান। এতে তিনি দ্বিতীয় পক্ষের হস্তক্ষেপ চান না।
আলতাফ হোসেনের বর্তমান বয়স সাঁইত্রিশ। আরও দশ বছর আগে বয়স যখন সাতাশ, তখন একটি মেয়ের সঙ্গে তার প্রণয় হয়েছিল। কিন্তু সেটা স্থায়ী হয়নি। তাসের ঘরের মতো ভেঙে গেছে হালকা টোকাতেই। সেই থেকে মেয়েদের প্রতি তার এক তীব্র অনীহা তৈরি হয়েছে। তার মতে, একলা একটা জীবন একাকী ভোগ করার মধ্যে রয়েছে ঢের আনন্দ। তবে আলতাফ হোসেন ইদনীং বেশ একাকিত্ব অনুভব করেন। তার আগের ধারণাটি এখন পাল্টে গেছে। এখন জীবনটা তার কাছে ক্রমে ক্রমে দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। বয়স বেড়েছে। এ সময় একাকিত্বে¡র প্রহরগুলো আর ভালো লাগে না। রাতে ঘুমানোর সময় ভয় করে। ভালো মতো ঘুম হয় না। প্রায় রাতেই বিছানায় এপাশ-ওপাশ করে কাটিয়ে দেন। আর নিদ্রাহীন একেকটি রাত তার কাছে বেশ দীর্ঘ মনে হয়। নিদ্রাহীন প্রতি রাতই তাকে ভীষণ কষ্ট দেয়। এই কষ্ট থেকে তিনি মুক্তি চান।
গত রাতে আলতাফ হোসেনের ঘুম হয়নি। শরীর খারাপ ছিল। এখনো গায়ে জ্বর। সকালবেলা দুই পিস টোস্ট দিয়ে এক কাপ চা খেয়েছেন। এখন একটু ভালো লাগছে। তবে জ্বরটা কমেনি। তার এমন সময় মনে হলো- খালাকে একটা ফোন করে বলি, আমি আসছি। এখন থেকে তোমাদের বাসাতেই থাকব। এ কথা শুনে খালা অনেক খুশি হবেন। তা ছাড়া খালাও তো একা একা থাকেন। আমি গেলে দু’জনে মিলে থাকব। আর একা একা সময় কাটাতে হবে না আমার।
আলতাফ হোসেন তার খালাকে ফোন করলেন। রিং হচ্ছে। ফোনটি ধরতে একটু সময় লাগল। ফোন ধরে খালা বললেন- হ্যালো!
আলতাফ বললেন- হ্যালো! খালা, আমি।
– আলতাফ!
– হ্যাঁ, কেমন আছো?
– ভালোই আছি। তুই কেমন আছিস? তোকে আমি আজই ফোন করতাম।
– কেন? কিছু কী হয়েছে?
– আমি তো সামনের মাসে কানাডা চলে যাচ্ছি।
আলতাফ হোসেন ফোনের এপাশে হতাশ হয়ে গেলেন। তারপর বললেন, কার কাছে যাচ্ছ?
– সবুজের কাছে। এখানে আমি অনেক একা থাকি তো, তাই ও নিয়ে যাবে আমাকে। আমিও আপত্তি করিনি। কারণ, আমার আবার একা একা থাকতে ভালো লাগে না।
– আচ্ছা সাবধানে যেও তুমি।
বলেই ফোনটি রেখে দিলেন আলতাফ হোসেন। তিনি বুঝতে পারলেন, আরো অনেক প্রহর তাকে নিঃসঙ্গ হয়ে কাটাতে হবে। যতক্ষণ পর্যন্ত ধ্রæব সত্য মৃত্যু এসে দরজায় কড়া না নাড়ে।
আহরাফ রবিন
নবাবগঞ্জ, ঢাকা

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়